স্বস্তি

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

জারার মুখে রাজ্যের হাসি। জাফর ইকবাল স্যার তার সামনে বসে আছেন। কিন্তু একি। স্যার গেল কই? সবকিছু এমন কাঁপছে কেন? ধড়মড় করে উঠে বসল জারা। ওহ্! একটা তার স্বপ্ন ছিল। বিছানা থেকে নেমে জারা মাকে দেখতে পেল না। মা মনে হয় কাজের জন্য বেরিয়ে গেছেন। জারাও ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনে চলে এল। নিরিবিলি আর বড় বড় গাছে ঢাকা জায়গাটি জারার খুব প্রিয়। জারা মাঝামাঝি একটি ডালে বসতেই নিশাতকে দেখতে পেল। নিশাত জারার এক বছরের বড় হলেও তা তাদের বন্ধুত্বকে টলাতে পারেনি।

নিশাত জারাকে দেখে বলল, ‘কিরে, সাতসকালে গাছে উঠে বসে আছিস কেন?’

‘ভালো লাগছে না।’

‘নিশ্চয়ই তুই আবার সেই স্বপ্ন দেখেছিস।’

কিছু বলল না জারা। নিশাতের সঙ্গে মিথ্যা বলে না সে। নিশাত জারার পাশে বসে বলল, ‘আচ্ছা, বল তো তুই কেন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাস? তোকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কখনো বলিসনি, আজ তোকে বলতেই হবে।’

জারা তার এই দুঃখের ঘটনা কাউকে না বললেও নিশাতকে বলল।

দুই বছর আগেও জারা তার পরিবারের সঙ্গে ছিল। সেবার গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয় সে। তখন স্যারের বক্তব্য জারাকে অনুপ্রাণিত করে। স্যারের লেখা বই পড়তে শুরু করে সে। ধীরে ধীরে জারা বুঝতে পারে, স্যার আসলে অসাধারণ এবং অতুলনীয় একজন মানুষ। জারা তখন থেকে অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সে জানে, জাতীয় পর্যায়ে গেলে আবারও স্যারের সঙ্গে দেখা করা যাবে। কিন্তু সেবার বন্যায় মা আর ভাই ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এই কুঁড়েঘরে স্থান পায় জারা। স্কুলে যেতে পারবে না—ভাবতেই জারার মনে হয় সে আর বাঁচবে না। তবুও স্যারের বক্তব্য আর তাঁর বইয়ের অনুপ্রেরণায় আজও বেঁচে আছে জারা। তার স্বপ্ন স্যারের সঙ্গে আর একবার দেখা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানানো। হয়তো সে সুযোগ আর হবে না। স্কুলে না যাওয়ার কারণে অলিম্পিয়াড দেওয়ারও সুযোগ নেই।

নিশাত ভেজা চোখে জারাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোর এত কষ্ট। কিন্তু কখনো বলিস না কেন? তবে এত কষ্টের মাঝেও তোর কিছুটা কষ্ট লাঘব করতে পারি।’ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জারা। ‘মানে কী?’

‘চল আমার সাথে’, বলে গাছ থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল নিশাত। জারাও হাঁটতে লাগল নিশাতের সঙ্গে।

হঠাৎ জারা নিজেকে শাহজালাল তথ্য ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আবিষ্কার করে। এখানে স্যার পড়ান। জারা সেটা জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছিই থাকে ওরা। তবে স্যারের সঙ্গে দেখা করার সাহস হয়নি কখনো।

জারা প্রথম ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার আগেই নিশাত তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মঞ্চের সামনে ভিড় দেখে এগোল সেদিকে। স্যারের হাসিমাখা মুখটি দেখতে পেল জারা।

স্যার মঞ্চে বসতেই সবাই শান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ জারা স্যারের পেছনে একজন লোককে দেখতে পেল, হাতে কী যেন ছুরির মতো...

ক্ষিপ্রগতিতে মঞ্চের দিকে ছুটল জারা। সে বুঝে গেছে লোকটি কী করতে চায়। নিশাত জারাকে চিত্কার করে ডাকছে, জারার কোনো কিছু শোনার সময় নেই। তাকে যে সময় থাকতে মঞ্চে পৌঁছাতে হবে। না হলে...

কোনোমতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে লোকটাকে ধাক্কা দিল একদম ঠিক সময়ে। কিন্তু...রক্ত বয়ে গেল, পড়ে গেল জারা।

দুই দিন পর জারা চোখ খুলল হাসপাতালের বেডে। দরজা খুলে ভেতরে এলেন স্যার। জারার পাশে কিছুক্ষণ বসে বললেন, ‘মা, তুমি এমনটা কেন করলে? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে...।’

জারার খুব ক্লান্ত লাগছিল। তবুও সে কোনোমতো বলল, ‘স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই একটি কথা আপনাকে বলতে আর আপনার অনুপ্রেরণা আমাকে এত দিন বাঁচিয়ে রেখেছে।’ কিছুক্ষণ থেমে জারা আবার বলল, ‘আমি না থাকলে এ দেশ কিছুই হারাবে না। কিন্তু আপনি না থাকলে...’

থেমে যায় জারা, আর পারছে না সে। তবে তার আর কোনো দুঃখ নেই। সব কষ্ট মুছে গেছে। তার স্বপ্ন

নির্মম ভাবে হলেও বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এটুকুতেই তার আনন্দ। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল সে।