স্মৃতির বজরা

দরজার ঘণ্টি শুনে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর বেরটোল্ড।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার চুল ঘন কালো, উজ্জ্বল চোখজোড়াও কালো। ‘ক্লিনটন হলে এই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলাম আমি, আপনার বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এত মানুষের সামনে কথা না বলে তাই একাকী এসেছি...কিছুটা নির্জনতা পাব বলে। আপনি নিশ্চয়ই সারা বিশ্বে পুনর্জন্মের ব্যাপারে সেরা বিশেষজ্ঞ?’

একটু লাল হলেন বেরটোল্ড। ‘আসলে, পুনর্জন্ম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটাকে আমার নেশা বলতে পারেন। লেখাপড়া মনস্তত্ত্ব নিয়ে।’

চোখের পাপড়ি দিয়ে কিছু একটা যেন ইঙ্গিত করল মেয়েটি। “আমার নাম ডায়ানা ও’ ফ্ল্যাহার্টি। আপনি কি আসলেই কাউকে তার আগের জন্মে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন?”

‘আমি কিন্তু কখনো বলিনি যে কাজটা পারি, তবে বলেছি যে আমার বিশ্বাস, কাজটা সম্ভব। তবে সে জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ, সঠিক মানুষ এবং আরও অনেক ব্যাপার। তত্ত্বীয়ভাবে সেটা সম্ভব...’

আলতো করে অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করল মেয়েটি। ‘আপনি সম্মোহিত করেন মানুষকে?’

‘শুরু ওভাবেই করতে হয়।’

‘এর আগে কখনো কোনো মানুষকে অতীতে পাঠানোর চেষ্টা করে দেখেননি?’

‘নাহ, একেবারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চাই না। গত সপ্তাহে অবশ্য এক শিম্পাঞ্জিকে কয়েক প্রজন্ম পেছনে পাঠিয়েছি। যদিও জানি না ঠিক কয় প্রজন্ম...যোগাযোগের সমস্যা আরকি।’

‘তাহলে তো হলোই! এবার মানুষের ওপর চেষ্টা করে দেখুন।’ ডায়ানা আগ্রহ নিয়ে বলল। ‘আমি আপনার ভলান্টিয়ার হব!’ প্রফেসরের চেহারার ওপর স্থির হলো মেয়েটার নজর। ‘আমি ক্লিওপেট্রা...মানে আগের জীবনে ছিলাম। কোনো সন্দেহ নেই তাতে!’

‘এই ধারণা কেন হলো?’

‘নিজেকে আমার মিসরীয় বলে মনে হয়। আমার দাদি কায়রো থেকে আসা, নাচতেন। তার ওপর আমি আবার সাপ একদম সহ্য করতে পারি না। প্রফেসর, আমাকে আপনার অতীতে পাঠাতে হবে। চিরকালের জন্য না অবশ্যই, অল্প সময় হলেই হবে!’

মেয়েটির চোখে চোখ রাখামাত্র প্রফেসর বেরটোল্ডের মনে হলো, ভেতরে কিছু একটা যেন গলে যাচ্ছে!

‘ঠিক আছে।’ বললেন তিনি। ‘অসুবিধে কী? অপেক্ষা করার আর কোনো মানে হয় না। ক্লিওপেট্রার জীবনের কোন সময়টায় ফিরতে চাও তুমি? ওর ছেলেবেলা, সিরিয়ায় নির্বাসন...নাকি সিজারের ঘটনা?’

‘আমি ভাবছিলাম মার্ক অ্যান্টনি আর বজরার সময় গেলে মন্দ হতো না। মানে ক্লিওপেট্রা যখন প্রথম দেখলেন অ্যান্টনির সঙ্গে। তখন তিনি পরে ছিলেন ভেনাসের সাজ, উদয় হয়েছিলেন বজরায়। চলচ্চিত্রে ছিল দৃশ্যটা।’

এনসাইক্লোপিডিয়া বের করে খুললেন বেরটোল্ড। পড়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওহ, পেয়েছি। ঘটনাটা ঘটেছিল সিলিয়ার টারসাসে। সিজারের গুপ্তহত্যার পর তার ওপর যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেটার জবাব দিতে। টারসাস হচ্ছে বর্তমানের তুরস্ক।’ ডেস্কে থাকা মানচিত্র দেখালেন তিনি।

ভ্রু কুঁচকে গেল মেয়েটির। ‘টারসাস তো সমুদ্র থেকে দূরে, তাহলে ওখানে পানি ছিল কীভাবে? বজরাই–বা যাবে কোন পথে?’

থামুন,’ বলল ডায়ানা। ‘বজরা দেখতে পাচ্ছি, বাঁক ঘুরছে। আমি ১০ হাজার মিটার ওপরে আছি, ডেকে নিয়ে যান। একটা মুহূর্তও মিস করতে চাই না।

‘সিনডাস নদী আগে টারসাসের ভেতর দিয়ে যেত, এখন আর তার অস্তিত্ব নেই।’ একটা আরামকেদারা দেখালেন প্রফেসর। ‘শুয়ে পড়ো ওখানে, নিজেকে ছেড়ে দাও। তাকাও আমার চোখের দিকে, চেষ্টা করো মনকে একেবারে শূন্য করে ফেলতে।’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘোলা হয়ে গেল ডায়ানার চোখের দৃষ্টি।

বেরটোল্ড নম্র, একঘেয়ে কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি ফিরে যাচ্ছ অতীতে...অতীতে...’ আধা মিনিট অপেক্ষা করে। ‘কী দেখতে পাচ্ছ?’

সমাহিত স্বরে জবাব দিল মেয়েটি। ‘দেখতে পাচ্ছি...পুরো দুনিয়াটাকে। গোলাকার দুনিয়া একদম।’

‘বেশ,’ বেরটোল্ড বললেন। ‘তোমাকে দৃশ্যটা বলি। দুনিয়া দেখতে পাচ্ছ তুমি, নামছ ধীরে ধীরে। তুরস্কের ওপরে নেমে এসেছ এখন।’

অপেক্ষা করলেন বেরটোল্ড।

‘বেশ,’ বলল ডায়ানা। ‘তুরস্ককে দেখতে পাচ্ছ তো? মানচিত্রের মতো হলদে দেখায় না কিন্তু!’

‘রং বাদ দাও, আকারের কথা বলো।’

‘টারসাস,’ মেয়েটি জানাল। ‘দেখতে পাচ্ছি। একটা নদী আর অনেক ছোট নৌকা আছে, তবে বজরা নেই কোনো।’

‘যেই বছরে যেতে চেয়েছিলে, সেই বছরেই নিয়ে গিয়েছি তোমাকে। তবে ইতিহাসবিদেরা একদম সঠিক করে সময়টা বলতে পারেন না। যা–ই হোক, এখন সময় ঠিক করছি। আস্তে আস্তে যাচ্ছি সামনের দিকে। এক হপ্তা, দুই হপ্তা...তিন হপ্তা।’

আট সপ্তাহ এগিয়ে যাওয়ার পর ডায়ানা বলল, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। বজরা দেখতে পাচ্ছি, পোতাশ্রয়ে নোঙর ফেলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক দিন পেছনে নিয়ে যান, নদীতে নৌযানের আসা দেখতে চাই।’

তা–ই করলেন বেরটোল্ড।

‘থামুন,’ বলল ডায়ানা। ‘বজরা দেখতে পাচ্ছি, বাঁক ঘুরছে। আমি ১০ হাজার মিটার ওপরে আছি, ডেকে নিয়ে যান। একটা মুহূর্তও মিস করতে চাই না।’

তা–ই করলেন বেরটোল্ড...মিনিট পাঁচেক পেরিয়ে গেল।

সাদা হয়ে গেল মেয়েটির চেহারা। ‘ফিরিয়ে আনুন, আমাকে ফিরিয়ে আনুন এখুনি!’

সামনের দিকে ঝুঁকলেন প্রফেসর। ‘কেন? কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘পরে বলছি,’ খেপে গেল মেয়েটি। ‘ফিরিয়ে আনুন দয়া করে।’

আধা মিনিট পর চোখ খুলল ডায়ানা। ‘বয়স ছিল আমার ৬০, হতচ্ছাড়া বুড়ি ছিলাম সেই সময়ে!’

চোখ পিট পিট করলেন বেরটোল্ড। ‘কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? ক্লিওপেট্রা তো যৌবনে মারা গিয়েছেন!’

বিস্ফারিত হলো ডায়ানার চোখ। ‘আমি ক্লিওপেট্রার ভৃত্য ছিলাম! গিয়ে দেখি, তখন রাতের খাবারের সময় চলছে। ভৃত্য-ভৃত্যাদের যে মহিলা কী খাওয়াত, তা বললে বিশ্বাস করবেন না।

বিদায় নিয়ে দরজার কাছে চলে এল সে, নাক টেনে বলল। ‘শুধু শুধু যে মানুষ কেন ক্লিওপেট্রাকে সুন্দর বলে! তেমন আলাদা কিছু তো দেখলাম না।’

প্রফেসরের ঘণ্টি বেজে উঠল আবার, ডায়ানা বিদায় নেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে।

লম্বা, প্রশস্ত কাঁধের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

‘আমার নাম জেরাল্ড বোনেভিচি। ক্লিনটন হলে আপনার বক্তব্য শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছি। কাউকে কখনো বলিনি, তবে আমার ধারণা, আগের জীবনে মার্ক অ্যান্টনি ছিলাম!’

‘আমার নাম জেরাল্ড বোনেভিচি। ক্লিনটন হলে আপনার বক্তব্য শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছি। কাউকে কখনো বলিনি, তবে আমার ধারণা, আগের জীবনে মার্ক অ্যান্টনি ছিলাম!’

চোখ বন্ধ করে ফেললেন প্রফেসর। ‘ওহ...মাথাব্যথা শুরু হয়েছে আমার!’

তারপরও বলে চলল জেরাল্ড। ‘হাইস্কুলে পড়ার সময় যখন মার্কের বক্তব্য শুনছিলাম, তখন মনে হলো ওগুলো আমারই কথা। মার্ক অ্যান্টনিকে আমার খুব আপন লাগে।’

মাথা নাড়লেন বেরটোল্ড। ‘তুমি যে মার্ক অ্যান্টনি ছিলে, সেই সম্ভাবনা কিন্তু একদম কম। হাজার হলেও সেই একই সময়ে দুনিয়ায় লোকসংখ্যা কম ছিল না! হয়তো তুমি ছিলে কোনো যোদ্ধা, অথবা কৃষক...অথবা ক্রীতদাস!’

জেরাল্ড হতাশ হলো না। ‘আপনি তো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে মানুষকে আপনি অতীতে নিয়ে যেতে পারেন। আমাকে আপনার সাবজেক্ট হওয়ার অনুমতি দিন। অ্যান্টনি যখন ক্লিওপেট্রাকে প্রথম দেখে, সেই মুহূর্তে নিয়ে চলুন।’

চোখ বন্ধ করে চোয়াল ঘষলেন বেরটোল্ড। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি আমার প্রথম মানুষ, সাবজেক্ট নও। তবে কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছ। সাবধান করে দিই একটা ব্যাপারে, অতীতে তুমি কোথায় নামবে, সেটা আমি জানি না। যেকোনোখানে হতে পারে কিন্তু। হয়তো দেখা যাবে ইংল্যান্ডে গিয়ে শুয়োর পালছ।’ আরামকেদারার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি, ‘ওখানে বসে আমার চোখে চোখ রাখো।’

জেরাল্ডকে সম্মোহিত করতেও বেগ পেতে হলো না।

‘পুরো বিশ্বকে দেখতে পাচ্ছি,’ বলল সে। ‘পুরো বিশ্বকে!’

‘বেশ,’ বললেন বেরটোল্ড। ‘এখন আমি তোমাকে নিচে নামাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, সেই সময়ে তুমি যেখানে ছিলে, যা ছিলে...স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেখানে পৌঁছে যাবে।’

ধীরে ধীরে বলল জেরাল্ড, ‘তুরস্কের ওপরে আছি আমি, নিচে নামছি...আস্তে–ধীরে। নদীটাকে দেখতে পাচ্ছি...ওই যে শহরটা।’

অবাক হলো বেরটোল্ড। ‘তুমি টারসাসে আছ?’

‘হ্যাঁ,’ বলল জেরাল্ড। ‘চিনতে পারছি এত ওপর থেকেও। বজরাটা আসছে।’

‘তারপর? বজরায় নেমেছ?’

জেরাল্ড জবাব দিল না।

‘কী হলো?’ বেরটোল্ড আবার জানতে চাইলেন।

জেরাল্ড কিচ্ছু বলছে না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

পুরো তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেল ওভাবেই। প্রফেসর বেরটোল্ড অনেক চেষ্টা করে অবশেষে জেরাল্ডকে ফেরাতে পারলেন বিংশ শতাব্দীতে।

ঘামে ভেজা ভ্রু মুছে ফেললেন প্রফেসর। ‘আমি তো ভেবেছিলাম আর ফিরবেই না। আমার কথা শুনতে পাওনি?’

ক্লান্ত দেখাল জেরাল্ডকে। ‘শুনেছি...’

‘তাহলে কিছু বললে না কেন? সবকিছু ঠিক ছিল তো?’

‘ছিল,’ বলল জেরাল্ড। ‘সব ঠিক ছিল।’

‘তুমিই অ্যান্টনি?’

‘নাহ,’ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে যোগ করল যুবক। ‘আমি ক্লিওপেট্রা!’