হা হা গুড্ডুবুড়া বাহবা গুড্ডুবুড়া

অলংকরণ: তুলি

গুড্ডুবুড়া দাদার বাড়ি গেছে। তার দাদার বাড়ি রংপুর শহরে। একতলা টিনে ছাওয়া বাড়ি। ঢেউ খেলানো টিনের চালা। বাড়িতে উঠান। পেছনে সবজির বাগান। উঠানে শজনেগাছ। একটা জবাগাছে জবা ধরেছে। ঘরের পেছনে আর উঠানের পাঁচিলজুড়ে অনেক আমগাছ, কাঁঠালগাছ।

উঠানে মুরগি চরছে।

গুড্ডুবুড়া তার ছোট ফুফুকে বলল, ফুফু, এটা কী?

মুরগি।

আচ্ছা। মুরগি কেন?

আমরা মুরগি পুষি।

কেন পোষো?

মুরগি ডিম পাড়ে। আবার মুরগির মাংস আমরা খাই।

আমি কোনো দিনও মুরগির মাংস খাইনি।

ফুফু বললেন, কী বলিস। তুই কোনো দিনও মুরগির মাংস খাসনি। তবে যে শুনলাম তুই নাকি কেএফসিতে গিয়েছিলি। চিকেন ফ্রাই খেয়েছিলি।

গুড্ডুবুড়া বলল, ও তো চিকেন ফ্রাই। চিকেন তো আমি একটু একটু খাই। তবে আমি তো কিছুই খেতে পছন্দ করি না। তাই চিকেন ফ্রাইও পছন্দ করি না।

ছোট ফুফু রংপুর রোকেয়া কলেজে আইএ পড়েন। তিনি তাঁর বেণি দুলিয়ে বললেন, ওই চিকেনই তো মুরগি। মুরগির ইংরেজি চিকেন।

গুড্ডুবুড়া বলল, মুরগির ইংরেজি না হেন?

তা অবশ্য ঠিক। মুরগির বাচ্চাকে বলা হয় চিকেন। যখন মানুষ মুরগির মাংস খায়, তখন চিকেনই বলে।

আমি আর কোনো দিনও চিকেন খাব না—গুড্ডুবুড়া বলল।

কেন খাবি না?

কী সুন্দর মুরগিগুলো ঘুরছে। ওদের মাংস খাওয়ার দরকার কী?

ফুফু বললেন, ওই দেখ, মুরগিগুলো কীভাবে পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। মুরগি পোকা খায়। আমরা মুরগি খাই। মাংস খেলে শরীরে শক্তি হয়। শরীরে শক্তি হলে তুই ভালো খেলতে পারবি। চোর গুন্ডা খারাপ মানুষদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবি।

লড়াই করতে পারব? গুড্ডুবুড়া হাতের পেশি ফোলানোর চেষ্টা করল। ও তো এতটুকুন একটা ছেলে। হাত-পা সরু কাঠির মতো। খায় না বলে ভীষণ রোগা। লম্বাও হয়নি।

বিকেলবেলা বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওর খিদে পেয়েছে। ওর মনে হলো একটা কিছু খাওয়া দরকার। এখন চলছে ডিসেম্বর মাস। স্কুল ছুটি। তাদের বাসার সামনে কলাবাগান মাঠে স্কুলের ছেলেরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট করবে। তাকে তারা দলে নেয় না। কারণ তার কবজিতে জোর নেই। সে একটা ক্রিকেট বল যদি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুড়ে মারে, তবু সেটা তার পায়ের কাছেই পড়ে। একবার সে বল সামনের দিকে ছুড়ে মারবে বলে মাথার ওপরে হাত তুলেছিল, আর বলটা পেছনে চলে গিয়েছিল।

শক্তি দরকার। শক্তি। চিকেন খেতে হবে। চিকেন মানে মুরগির বাচ্চা। উঠানে একটা বাঁশের খাঁচার নিচে একটা মুরগি, তার কতগুলো হলুদ বাচ্চা। মা মুরগিটা ঘুমাচ্ছে। তার পাখা মেলে ধরা। পাখার নিচে কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা। এই সব বাচ্চার একটাকে ধরে সে নিয়ে যাবে ফুফুর কাছে। ফুফু, আমাকে এই চিকেনটা ফ্রাই করে দাও।

যেই না সে মুরগির ঢাকনা তুলে একটা বাচ্চা ধরবে বলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, অমনি মা মুরগিটা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মুখের ওপরে। দুই পাখা দিয়ে বাড়ি মারে, পা দুটো দিয়ে আঁচড় দেয়, আর ঠোঁট দিয়ে ঠোকরায়। গুড্ডুবুড়া তো মারাই যাবে আরকি। কোনোরকমে মুরগিটার মাথা ধরে সে মারল ছুড়ে।

তার চোখেমুখে আঁচড়ের দাগ। হাতে রক্ত। সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগল।

কিন্তু ঘরে সবাই ঘুমাচ্ছে। উঠানে কেউ নেই। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না।

কী করা যায়। দাদির আলমারির মধ্যে ডেটল আছে। তুলোয় মেখে ডেটল দিতে হবে। সে আস্তে আস্তে গেল ঘরের মধ্যে। তুলোও পাওয়া গেল। ডেটলও। সে ডেটলে তুলো মেখে নিয়ে যেই না তার কাটা জায়গায় ধরেছে, অমনি ভীষণ জ্বালা করে উঠল। সে আবার উফ্ করে উঠল।

কিন্তু সবাই এমন ঘুম দিয়েছে যে কেউ তার সাহায্যে এগিয়েই আসছে না।

কিন্তু খিদেটা যে খুব জ্বালাতন করছে। পেটের ভেতরে মোচড় দিচ্ছে। সে দেখল, একটা বয়ামে সাদা দই দেখা যাচ্ছে। পাশেই দাদির পানের ডিব্বা।

সে খানিকটা দই খেলেই পারে।

আসলে তো ওই পাত্রে ছিল চুন। চুনকে দই ভেবে গুড্ডুবুড়া যেইনা মুখে দিয়েছে, অমনি মুখ গেল পুড়ে। সে থু থু করে চুন ফেলে দিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিল।

দাদির ঘুম ভেঙে গেল। তিনি উঠলেন, এই গুড্ডু কী হয়েছে?

ফুফু উঠলেন। এই গুড্ডু, কী হয়েছে সোনা, কাঁদছিস কেন?

সবাই দেখল, গুড্ডু দই ভেবে চুন খেয়েছে।

তাকে কুলি করানো হলো। আর তার সারা গায়ে মুরগির আঁচড়। এই ছেলেকে নিয়ে এঁরা কী করবেন। এত বোকা একটা ছেলে। এত বোকা একটা ছেলে।

তাঁরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। হাত-পায়ে মুরগির আঁচড়, মুখ পুড়ে গেছে চুন খেয়ে।

ডাক্তার কিছু ওষুধ দিলেন। কিছু মলম দিলেন।

তারপর বললেন, ছেলেটার সব ভালো। কিন্তু ওর একটাই সমস্যা। ও খায় না। ও খায় না বলেই ওর বুদ্ধি হয় না। শরীর তো বাড়েই না, ব্রেনও দুর্বল। গুড্ডুবুড়া, তোমাকে খেতে হবে ঠিকমতো।

তুমি ভাত খাবে, মাছ খাবে, দুধ খাবে, ডিম খাবে, মুরগি খাবে, শাকসবজি খাবে, ডাল খাবে আর বেশি করে খাবে ফল।

গুড্ডুবুড়া বলল, ফল খাব না। ফল খাওয়ার নিয়মকানুন আমি কিছু বুঝি না।

সেটা কেমন? ডাক্তার বললেন।

গুড্ডুবুড়া বলল, মা আমাকে টমেটো খেতে দিলেন। আমি সেটা ছিলে ভেতরের বিচিগুলো খেলাম। মা আমাকে বকা দিলেন। বললেন, টমেটো কি ছিলে খেতে হয়?

মা বললেন, ডাক্তার সাহেব, এরপর আমি ছেলেকে কমলা খেতে দিলাম। সে ছালটা খেয়ে ভেতরের কোয়া ফেলে দিতে লাগল। আমি বললাম, আরে বুদ্ধু, কমলা তো ছিলে খেতে হয়। এরপর ওর বাবা নরম পাকা বরই কিনে এনেছে। গুড্ডু করল কী, বরইয়ের বাইরেরটা ফেলে দিয়ে ভেতরের বিচি খেয়ে ফেলল। তারপর তার সে কী কান্না। বলে, বিচি খেয়েছি। এখন পেটের মধ্যে গাছ হবে। গাছ মাথা ফুঁড়ে বের হবে। আমি মারা যাব।

ডাক্তার বললেন, তুমি ঠিকমতো খেতে শুরু করো। দেখবে, বুদ্ধি হয়ে গেছে। আর তোমার ব্রেন ভালো হলে এইসব কোনো ব্যাপারই না।

গুড্ডুবুড়া বেশি করে খেতে লাগল। দাদি তাকে যত্ন করে দুধ খাওয়ান, ডিম খাওয়ান। পিঠা খাওয়ান। ভাত আর মাছ খাওয়ান। এক মাসের মধ্যেই গুড্ডুবুড়ার শরীরটাও বেশ সেরে উঠল। তাকে এখন একটু লম্বা দেখায়। একটু শক্তপোক্তও লাগে।

গরমের ছুটিতে আবার গুড্ডুবুড়া এল রংপুরে, তার দাদার বাড়িতে।

তাদের দাদাবাড়িতে এত গাছ যে উঠানটাও অন্ধকার থাকে। আর ঘরের ভেতরটা দিনের বেলাতে অন্ধকার থাকে। পেছনের জানালা খুলে দিলেও লাভ হয় না। কারণ, পেছনে অনেক গাছের ঝাড়।

এই জন্য দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে থাকে। আর দাদি ফুফু সব সময় ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে রাখেন।

কিন্তু ইদানীং খুব লোডশেডিং হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটিই থাকে না। ঘরের ভেতরে অন্ধকারে তাই কিছুই দেখা যায় না। আর বাইরের রোদ থেকে ঘুরে এসে কেউ যদি ঘরে ঢোকে, তখন তার চোখ প্রথম প্রথম কিছুই দেখতে পায় না।

গুড্ডুবুড়া বলল, দাদি, তোমার সমস্যার সমাধান আমি জানি।

কী সমস্যা?

দিনের বেলা কী করে তোমার ঘরে বাতি জ্বালানো যায়! গুড্ডুবুড়া বলল।

কী করে?

বলল, এই দেখো। তোমাকে দেখাই। ইন্টারনেটে আছে। এই দেখো, বিবিসির ওয়েবসাইটেই আছে।

সাদা প্লাস্টিকের বোতলে পানি ভরতে হবে। তারপর তোমার ঘরের টিনের চাল ফুটো করে বোতলের মুখটা খানিকটা বাইরে আর বাকিটা ভেতরে রাখতে হবে। পানির সাদা বোতলগুলোই ব্যবহার করা যাবে। এই দেখো, ছবি। ইন্টারনেট থেকে ছবি বের করে সে দেখাল দাদিকে। ফুফুর স্মার্টফোনে।

দাদি বললেন, বেশ তো। তাহলে এটা আমরা করি না কেন। হাশেম আলী, ও হাশেম আলী। এদিকে এসো।

হাশেম আলী দাদির বাড়ির কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান কাম কর্মবীর। তিনি এলেন।

গুড্ডুবুড়া বলল, হাশেম চাচা। এই জিনিসটা বানিয়ে দিন।

হাশেম আলী বলল, বুদ্ধি ভালো। খালি ফুটা দিয়া যানি পানি না পড়ে ঘরের ভিতরত।

গুড্ডু বলল, আপনি টিনের উঁচু ঢেউটাতে ফুটো করবেন। নিচুটাতে করলে তো পানি পড়বেই। আর বোতলের পেটের এই নিচু খাঁজটা টিনের ফুটো বরাবর ফিট করবেন। তারপর পুডিং লাগিয়ে দেবেন।

হ। বুঝসি। পারমো।

হাশেম আলী হাতের কাজের জন্য বিখ্যাত। সে কয়েকটা মামের বড় বড় বোতল এনে একটা ঘরের চালে লাগিয়ে ফেলল। বাইরে রোদ ছিল ঝকঝকে। সেই রোদ পানি ভরা বোতলের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল ঘরে। মনে হচ্ছে ঘরে অনেকগুলো টিউবলাইট জ্বালানো হয়েছে। দেখে তো দাদি অবাক।

বাহবা, আমার নাতির এত বুদ্ধি।

দাদি বললেন, গুড্ডু তোকে একটা পুরস্কার দিতে হবে। বল তুই কী চাস?

গুড্ডু বলল, আমি কিছু চাই না দাদি। শুধু তোমাদের দোয়া চাই।

দাদা বললেন, গুড্ডুবুড়া। তুই তো ইলেকট্রিসিটি না থাকলে আলোর ব্যবস্থা করেছিস দিনের বেলায়। এতে আমাদের বিদ্যুৎ বিলও বাঁচবে। এবার আরেকটা কাজ করে দাও না ভাইয়া। বিদ্যুৎ না থাকলে ফ্যান ঘোরে না। গরমে বড় কষ্ট পাই।

গুড্ডু বলল, আচ্ছা দাদা, ফ্যান চলুক আর না চলুক, গরম যাতে ঘরে কমে যায়, সে ব্যবস্থা আমি করছি।

কী করে করবি?

ওই তো ইন্টারনেট থেকে।

তুমি হাঁ করো।

দাদা হাঁ করলেন।

হাতে ফুঁ দাও। মুখ হাঁ করে ফুঁ দাও।

দাদা দিলেন।

গরম বাতাস না ঠান্ডা বাতাস?

গরম।

এবার মুখটা ছোট করো। এবার ফুঁ দাও।

দাদা ফুঁ দিলেন।

এবার হাতের তালুতে গরম বাতাস লাগল, না ঠান্ডা বাতাস?

ঠান্ডা বাতাস।

তাহলে যদি ঘরের মধ্যে ছোট ফুটো দিয়ে বাতাস ঢোকাই, ঘর ঠান্ডা হবে?

তাই নাকি? দাদা বিস্মিত।

গুড্ডু বলল, এই দেখো, ইন্টারনেটে এই সমস্যার সমাধান দেওয়া আছে। এটা বাংলাদেশের লোকেরাই আবিষ্কার করেছে। তোমার ঘরে আমরা এইটা করব।

তুমি তো আর তোমার দেয়াল ফুটো করতে দেবে না। জানালার কবাটও কাটতে দেবে না। তবে আমরা সবগুলো জানালা খুলে রেখে মোটা কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখব। তারপর সেই কাগজ ফুটো করে আবার সেই বোতল লাগাব। এবার বোতলের তলা কাটতে হবে। আর মুখ রাখতে হবে খোলা। হাশেম চাচা, এই ছবিটা দেখেন। আমরা এই রকম বানাব।

হাশেম চাচা বিখ্যাত এই ধরনের হাতের কাজ করার জন্য। তিনি পিচবোর্ড কেটে জানালায় লাগালেন। তাতে গোল গোল ফুটো করে তলা-কাটা বোতল লাগিয়ে দিলেন। বোতলের খোলা মুখ রইল ঘরের ভেতরের দিকে। দক্ষিণের জানালায় এগুলো লাগানো হলো। গ্রীষ্মকাল। বাতাস আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। আশ্চর্য! ঘরটা ঠান্ডা হয়ে গেল।

দাদা বললেন, আমার নাতি তো বড় বিজ্ঞানী। ওকে আমি একটা পুরস্কার দেব। ওকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেব।

ফুফু বললেন, ভাবি, গুড্ডুকে যদি ওর দাদা ল্যাপটপ কিনে দেয়, তুমি অবশ্যই সেটাতে বাচ্চাদের ফিল্টার লাগিয়ে দেবে। ইন্টারনেটে ভালো জিনিস আছে, খারাপ জিনিসও আছে। বাচ্চারা যেন ইন্টারনেট থেকে ভালো জিনিস শেখে। খারাপ কিছু না শেখে। আর ও যেন ইন্টারনেট ইউজ করে সবার সামনে। ওর মনিটর যেন সবার সামনে খোলা থাকে।

গুড্ডুবুড়ার মা বললেন, অবশ্যই। অবশ্যই।