হাতির সঙ্গে হাতাহাতি

সংগ্রহ করার বাতিক কোনোকালেই ছিল না কাকার! কেবল টাকা ছাড়া। কিন্তু টাকা এমন জিনিস যে যথেষ্ট পরিমাণে সংগৃহীত হলে আপনিই অনেক গ্রহ এসে জোটে এবং তখন থেকেই সংগ্রহ শুরু।

একদিন ওদেরই একজন কাকাকে বললে, ‘দেখুন সব বড়লোকেরই একটা না একটা কিছু সংগ্রহ করার ঝোঁক থাকে। তা না হলে বড়লোক আর বড়লোকে তফাত কোথায়? টাকায় তো নেই। ওইখানেই তফাত, ওখানেই বিশেষ বড়লোকের বৈশিষ্ট্য। আর ধরুন, বৈশিষ্ট্যই যদি না থাকল তবে আর বড়লোক কিসের? আমাদের সম্রাট পঞ্চম জর্জেরও কালেকশনের “হবি” ছিল।’

কাকা বিস্মিত হয়ে গ্রহের দিকে তাকান, ‘পঞ্চম জর্জও?’

‘নিশ্চয়!’ কেন, তিনি কি বড়লোক ছিলেন না? কেবল সম্রাটই নন, দারুণ বড়লোকও যে! অনেকগুলো জমিদারকেই একসঙ্গে কিনতে পারতেন।’

‘ও! তাই বুঝি জমিদার সংগ্রহ করার বাতিক ছিল তাঁর?’ কাকা আরও বিস্ময়ান্বিত।

‘উহুহু। জমিদার নিয়ে তিনি করবেন কী? রাখবেন কোথায়? ও চিজ তো চিড়িয়াখানায় রাখা যায় না। তিনি কেবল স্ট্যাম্পো কালেক্ট করতেন—’

‘ইস্ট্যাম্পো? ওই যা পোস্টাপিসে পাওয়া যায়? না, দলিলের?’

‘দলিলের নয়। নানা দেশের নানা রাজ্যের ডাকটিকিট, এক শ বছর আগের, তারও আগের—তারও পরের—এমনি নানান কালের, নানান আকারের, রংবেরঙের যত ডাকটিকিট।’

‘বাঃ বেশ তো!’ কাকা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন, ‘আমারও তা করতে ক্ষতি কী?’

কিছু না। তবে একটা পুরোনো টিকিটের দাম আছে বেশ। দু-পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ দশ বিশ হাজার দু লাখ চার লাখ পর্যন্ত!’

‘অ্যাঁ, এমন?’ কাকা কিছু ভড়কে যান; তা হোক, তবুও করতেই হবে আমার। টাকার ক্ষতি কি আবার একটা ক্ষতি নাকি?’

‘নিশ্চয় নয়! আর তা না হলে বড়লোক কিসের?’ এই বলে গ্রহটি উপসংহার করে। এবং, আমার কাকাকেও প্রায় সংহার করে আনে।

কাকা স্ট্যাম্প সংগ্রহ করছেন—এ খবর রটতে বাকি থাকে না। পঞ্চাশখানা অ্যালবাম যখন প্রায় ভরিয়ে এনেছেন, তখন একদিন সকালে উঠে দেখেন বাড়ির সামনে পাঁচ শ ছেলে দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় ওরা সবাই এসেছে কাকার কাছে কেউ স্ট্যাম্প বিক্রি করতে, কেউবা কিনতে। সবারই হাতে স্ট্যাম্পের অ্যালবাম।

কাকা তখন গ্রহকে ডাকিয়ে পাঠান, ‘এ কী কাণ্ড? এরাও সব ইস্টাম্পো সংগ্রহ করছে যে? করছে বলে করছে, অনেক দিন ধরে করছে—আমার ঢের আগে থেকেই—এ কী কাণ্ড?’

‘কী হয়েছে তাতে?’ গ্রহটি ভয়ে ভয়ে বলে কাকার ভাবভঙ্গি তাকে ভীত করে তুলেছে তখন, ‘কেন ওদের কি ও কাজ করতে নেই?’

‘সবাই যা করছে পাড়ার পুঁচকে ছোঁড়াটা পর্যন্ত’—কাকা এবার একেবারে ফেটে পড়েন, ‘তুমি আমাকে লাগিয়েছ সেই কাজে? ছ্যা! কেন, এরাও কি সব বড়লোক নাকি?’

‘বড় বালকও তো নয়।’ আমি কাকাকে উসকে দিই তার ওপর, ‘নেহাৎ কাচ্ছাবাচ্ছা যত।’

কাকা আবার আফসোস করতে থাকেন, ইস্ট্যাম্পে আমার দশ-দশ হাজার টাকা তুমি জলে দিলে হ্যাঁ! ছ্যা!’

গ্রহ আর কী জবাব দেবে? সে তখন বিগ্রহে পরিণত হয়েছে। পাথরের প্রতিমূর্তির মতোই তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই আর। তিক্ত-বিরক্ত হয়ে কাকা নিজের যত অ্যালবাম খুলে ছিঁড়ে চ্যাঙড়াদের ভেতর স্ট্যাম্পের লুট লাগিয়ে দ্যান সেই দণ্ডেই।

কিন্তু স্ট্যাম্প ছাড়লেও বাতিক তাঁকে ছাড়ল না! বাতিক জিনিসটা প্রায় বাতের মতোই, একবার ধরলে ছাড়ানো দায়! তিনি বললেন, ‘ইস্ট্যাম্পো নয়, এমন জিনিস সংগ্রহ করতে হবে যা কেউ করে না, করতে পারেও না। সেই রকম কিছু থাকে তো তোমরা আমায় বাতলাও!’

তখন নবগ্রহ মিলে মাথা ঘামাতে শুরু করল। তাদের প্রেরণায়, তাদেরই আরও নব্বইজন উপগ্রহের মাথা ঘামতে লাগল। নতুন ‘হবি’ বের করতে হবে এবার রীতিমতো বুদ্ধি খাটিয়ে।

নানা রকমের প্রস্তাব হয়! খেচরের ভেতর থেকে প্রজাপতি, পাখির পালক, জলচরের ভেতর থেকে রঙিন মাছ, কচ্ছপের খোলা ইত্যাদি; ভূচরের ভেতর থেকে পুরোনো আসবাবপত্র, সেকেলে ঢাল-তলোয়ার, চীনে বাসন, গরুর গলার ঘণ্টা, রংবেরঙের নুড়ি, যত রাজ্যের খেলনা—

কাকা সমস্তই বাতিল করে দ্যান। সবাই পারে সংগ্রহ করতে এসব। কেউ না কেউ করেছেই।

তখন পকেটচরদের উল্লেখ হয়। নানা দেশের এ কালের-সে কালের মোহর, টাকা, পয়সা, সিকি, দুয়ানি ইত্যাদি। ফাউন্টেন পেন, দেশলায়ের বাক্সকেও পকেটচরদের মধ্যে ধরা হয়েছিল।

কিন্তু কাকাকে রাজি করানো যায় না। কেউ না কেউ করেছেই এসব; এত দিন ধরে ফেলে রাখেনি নিশ্চয়।

কেউ কেউ মরিয়া হয়ে বলে, ‘কেরোসিনের ক্যানেস্তারা?’ ‘নস্যির ডিবে?’ ‘জগঝম্প?’ ‘কিংবা গাঁজার কলকে?’ অর্থাৎ চরাচরের কিছুই তখন বাকি থাকে না। কাকা তথাপি ঘাড় নাড়েন।

নানা রকমের খাবারদাবার? চপ, কাটলেট, সন্দেশ, শনপাপড়ি, বিস্কুট, টফি, চকলেট, লেবেনচুস? মানে খাদ্য-অখাদ্য যত রকমের আর যত রঙের হতে পারে—আমিই বাতলাই তখন। তবুও কাকার উৎসাহ হয় না।

অবশেষে চটেমটে একজনের মুখ থেকে বেফাঁস বেরিয়ে যায়, ‘তবে আর কী করবেন? শ্বেতহস্তীই সংগ্রহ করুন।’

কিন্তু পরিহাস বলে একে গ্রহণ করতে পারেন না কাকা। তিনি বারবার ঘাড় নাড়তে থাকেন, ‘শ্বেতহস্তী! শ্বেতহস্তী! সোনার পাথর বাটির মতো ও-কথাটাও আমার কানে এসেছে বটে। ব্রহ্মদেশে না শ্যামরাজ্যে কোথায় যেন ওর পুজোও হয়ে থাকে শুনেছি। হ্যাঁ, যদি সংগ্রহ করতে হয় তবে ওই জিনিস! বড়লোকের আস্তাবল দূরে থাক, বিলেতের চিড়িয়াখানাতেও এক-আধটা আছে কি না সন্দেহ। হ্যাঁ, ওই শ্বেতহস্তীই চাই আমার!’

কাকা সর্বশেষ ঘোষণা করেন, তাঁকে শ্বেতহস্তীই দিতে হবে এনে, শ্যামরাজ্য কি রামরাজ্য থেকেই হোক, হাতিপোতা কি হস্তিনা থেকেই হোক, করাচি কিংবা রাঁচি থেকেই হোক, উনি সেসব কিছু জানেন না কিন্তু শ্বেতহস্তী ওঁর চাই। চাই-ই। যেখান থেকে হোক, যে করেই হোক জোগাড় করে দিতেই হবে, তা যত টাকা লাগে লাগুক। এক-আধখানা হলে হবে না, অন্তত ডজন খানেক চাই তাঁর, না হলে কালেকশন আবার কাকে বলে?

এই ঘোষণাপূর্বক তৎক্ষণাৎ তিনি ইঞ্জিনিয়ার কন্ট্রাক্টর ডাকিয়ে আসন্ন শ্বেতহস্তীদের জন্য বড় করে আস্তাবল বানাবার হুকুম দিয়ে দিলেন।

আশ্চর্য! দুসপ্তাহের ভেতর জনৈক শ্বেতহস্তীও এসে হাজির! নবগ্রহের একজন উপগ্রহ কোথা থেকে সংগ্রহ করে আনে যেন।

কাকা তো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, ‘বটে বটে? এই শ্বেতহস্তী! এই সেই, বাঃ! দিব্যি ফরসা রং তো! বাঃ বাঃ!’

অনেকক্ষণ তাঁর মুখ থেকে বাহবা ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। হাতিটাও সাদা শুঁড় নেড়ে তাঁর কথায় সমর্থন জানায়!

আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘জানিস, বার্মায়—না না, শ্যামরাজ্যে এ রকম একটা হাতি পেলে রাজারা মাথায় করে রাখে। রাজার চেয়ে বেশি খাতির এই হাতির; রীতিমতো পুজো হয়—হুঁহুঁ! শাঁখ-ঘণ্টা বাজিয়ে রাজা নিজে পুজো করেন। যার নাম রাজপূজা। তা জানিস?’

এমন সময় হাতিটা একটা ডাক ছাড়ে। যেন কাকার গবেষণায় তার সায় দিতে চায়।

হাতির ডাক? কী রকম সে ডাক? ঘোড়ার চিঁ-হি-হ, কি গরুর হাম্বার মতো নয়, ঘোড়ার ডাকের বিশ ডবল, গরুর অন্তত পঞ্চাশ গুণ একটা হাতির আওয়াজ। বিড়ালের কি শিয়ালের ধ্বনি নয় যে একমুখে তা ব্যক্ত করা যাবে। সহজে প্রকাশ করা যায় না সে ডাক।

হাতির ডাক ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর।

ডাক শুনেই আমরা দু-চার-দশ হাত ছিটকে পড়ি। কাকাও পাঁচ গজ পিছিয়ে আসেন।

‘বাবা! যেন মেঘ ডাকল কড়াক্ক্ড়।’ কাকা বলেন, সিংহের ডাক কখনো শুনিনি, তবে বাঘ কোথায় লাগে। হ্যাঁ, এমন না হলে একখানা ডাক।’

‘এটাকে হাতির সিংহনাদ হয়তো বলা যায়? না কাকা?’ আমি বলি।

উপগ্রহটি, যিনি হাতির সমভিব্যাহারে এসেছিলেন, এতক্ষণে একটি কথা বলার সুযোগ পান, ‘প্রায়ই ডাকবে এ রকম। শুনতে পাবেন যখন তখন।’

‘প্রায়ই ডাকবে? রাত্রেও? তাহলে তো ঘুমানোর দফা—’ কাকা যেন একটু দুর্ভাবিতই হন।

‘উঁহু, রাতে ডাকে না। হাতিও ঘুমোয় কি না। রাত্রে কেবল ওর শুঁড় ডাকে।’

‘তা ডাকে ডাকুক। কিন্তু এর কী রকম রং বল তো।’ আবার আমার প্রতি কাকার দৃকপাত—ফরসা ধবধব করছে। আর সব হাতি কি আর হাতি? এর কাছে তারা সব জানোয়ার। আসল বিলিতি সাহেবের কাছে যেমন সাঁওতাল। এই ফরসা রংটি বজায় রাখতে হলে সাবান মাখিয়ে একে চান করাতে হবে দুবেলা—ভালো বিলিতি সাবান, হুঁহুঁ পয়সার জন্য পরোয়া করলে চলবে না। নইলে আমার এমন সোনার হাতি কালো হয়ে যেতে কতক্ষণ।’

‘অমন কাজটিও করবেন না।’ উপগ্রহটি সবিনয়ে প্রতিবাদ করে।—ওইটিই বারণ। স্নানটান একেবারে বন্ধ এর। শ্বেতহস্তীর গায়ে জল ছোঁয়ানই নিষেধ, তাহলেই গলগণ্ড হয়ে মারা পড়বে!’

‘ওই গলায় আবার গলগণ্ড?’ আমি শুধাই। ‘তাহলে তো ভারী গন্ডগোল।’

‘অ্যাঁ, বলো কী?’ কাকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, ‘তাহলে, তাহলে?’

‘সাধারণ হাতির মতো নয়তো যে রাত-দিন পুকুরের জলে পড়ে থাকবে। শ্যামরাজ্যে রীতিমতো মন্দিরে সোনার সিংহাসনের ওপরে বসানো থাকে। সেখানে হরদম ধূপধুনো পুজো-আরতি চলে। কেবল চন্নামৃত তৈরির সময়েই যা এক-আধ ফোঁটা জল ওর পায়ে ঠেকানো হয়। এখানে তো সে রকমটি হবে না।’

কাকা তার কথা শেষ করতে দ্যান না, ‘এখানে হবে কী করে? রাতারাতি মন্দিরই বা বানাচ্ছে কে, সোনার সিংহাসনই-বা পাচ্ছি কোথায়? তবে পূজারি জোগাড় করা হয়তো কঠিন হবে না, পুরুৎ-বামুনের তো আর অভাব নেই পাড়ায়, কিন্তু হাতি পুজোর মন্তর কি তারা জানে?’

কাকার প্রশ্নটা আমার প্রতিই হয়। আমি জবাব দিই, ‘হাতির চন্নামেত্য আমি কিন্তু খেতে পারব না কাকা!’

গোড়াতেই বলে-কয়ে রাখা ভালো। সেফটি ফার্স্ট। বলেই দিয়েছে কথায়।

‘পারবি না? কেন খেতে পারবি না? এ কি তোর গুজরাটি হাতি? কালো আর ভূত? এ হলো গিয়ে ঐরাবতের বংশধর, স্বর্গের দেবতাদের একজন। খেতেই হবে তোকে—তা না হলে পরীক্ষায় তুই পাস করতেই পারবিনে।

পরীক্ষার পাসের ব্যাপারে মেড-ইজির কাজ করবে ভেবে আমি একটু নরম হই। কম্প্রোমাইজের প্রস্তাব পাড়তে যাচ্ছি, এমন সময়ে উপগ্রহটি বলে ওঠে, ‘না না, পুজো করবার আবশ্যক নেই। হস্তীপুজোর ব্যবস্থা তো নেই এ দেশে। নিত্যকর্ম পদ্ধতিতেও তার বিধি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুজো করার দরকার নেই এমনি আস্তাবলে ওকে বেঁধে রাখলেই হবে। গায়ে জলের ছোঁয়াচটিও না লাগে, সহিস কেবল এই দিকে কড়া নজর রাখে যেন।’

‘সহিস? হাতির আবার সহিস কি? মাহুতের কথা বলছ বুঝি?’ কাকা জিজ্ঞেস করেন।

‘সহিস মানে, যে ওর সেবা করবে, সইবে ওকে। সহিস কাঁধে বসলেই মাহুত হয়ে যায়। কিন্তু ওর কাঁধে বসা যাবে না তো। ভয়ানক অপরাধ তাতে।’ উপগ্রহটি ব্যাখ্যা করে দ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাতির উদ্দেশেই হাত তুলে নমস্কার জানায় কিংবা মাথা চুলকায় কে জানে!

‘ওর স্নানের ব্যবস্থা তো হলো, স্নানটান নাস্তি। আচ্ছা, এবার ওর আহারের ব্যবস্থাটা শুনি’—কাকা উদ্গ্রীব হন, ‘সাধারণ হাতি তো নয় যে সাধারণ খাবার খাবে?’—তারপর কী যেন একটু ভাবেন, ‘ধারটার তো? না তাও বন্ধ?’

তাঁর অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা সবাই অবাক হই। বলে ফেলি, ‘খাবে না কী বলছেন? না খেলে অত বড় দেহ টেকে কখনো তাহলে? হাতির খোরাক বলে থাকে কথায়।’

‘আমি ভাবছিলাম, চানটানের পাট যখন নেই তখন খাওয়াটাওয়ার হাঙ্গামা আছে কি না কে জানে।’ কাকা ব্যক্ত করেন, ‘তা কী খায় ও বল তো?’

উপগ্রহটি বলে, ‘সবকিছুই খায়, সে বিষয়ে ওর রুচি খুব উদার। মানুষ পেলে মানুষ খাবে, মহাভারত পেলে মহাভারত। মানে, মানুষ আর মহাভারতের মাঝামাঝি ভূভারতে যা কিছু আছে সবই খেতে পারে।’

আমি টিপ্পনী কাটি, ‘তাহলে হজমশক্তিও বেশ ওর।’

‘ভালো, খুবই ভালো।’ কাকা সন্তোষ প্রকাশ করেন, ‘যদি মানুষ পায়, কতগুলো খাবে? টাটকা মানুষ অবশ্যি।’

‘যতগুলো ওর কাছাকাছি আসবে। টাটকা-বাসি নিয়ে বড় বিশেষ মাথা ঘামাবে না। বলেছি তো খুব উদার রুচি।’

‘তুই ওর কাছে যাসনে যেন, খবরদার!’ কাকা আমাকে সাবধান করেন, ‘তবে তোকে ও মানুষের মধ্যেই ধরবে কি না কে জানে!’

হ্যাঁ, তা ধরবে কেন? আমি মনে মনে রাগী, তা যদি ও না ধরতে পারে, তাহলে ওকেই-বা কে মানুষের মধ্যে ধরতে যাচ্ছে? ওর রুচি যেমনই হোক, ওর বুদ্ধিসুদ্ধির প্রশংসা তো আমি করতে পারব না। কাকার মধ্যেই বরং ওকে গণ্য করব আজ থেকে।

তবে একেবারেই নিশ্চিন্ত হতে চান কাকা, ‘খাদ্য হিসেবে কী ধরনের মানুষের ওপর ওর বেশি ঝোঁক।’

একবার কটাক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে নেন, আমার জন্যই ওর যত ভাবনা যেন।

‘চেনা লোকেরই পক্ষপাতী, চেনাদেরই পছন্দ করবে বেশি। তবে অচেনার ওপরেও বিশেষ আক্রোশ নেই। পেলে তাদেরও ধরে খাবে।’

‘ভালো ভালো। আর কতগুলো মহাভারত? প্রত্যেক ক্ষেপে?’

‘পুরো একটা সংস্করণই সাবড়ে দেবে।’

‘বলছ কি? অষ্টাদশ পর্ব ইয়া ইয়া মোটা এক হাজার কপি—?’

‘অনায়াসে!’ উপগ্রহটি জোরের সঙ্গে বলে, ‘অনায়াসে!’

‘...সচিত্র মহাভারত?’ কাকা বাক্যটাকে শেষ করে আনেন।

‘ছবিটবির মর্ম বোঝে না!’ আমি যোগ করি।

‘সেই রকম বলেই বোধ হচ্ছে।’ কাকা মন্তব্য করেন আরে, সবাই কি আর চিত্রকলার সমঝদার হতে পারে?’

উপগ্রহের প্রতি প্রশ্ন হয়, ‘সে কথা থাক! মানুষ আর মহাভারত ছাড়া আর কী খাবে? খুঁটিনাটি সব জেনে রাখা ভালো।’

ইট-পাটকেল পেলে মহাভারত ছোঁবেও না; শালদোশালা পেলে ইট-পাটকেলের দিকে তাকাবে না, শালদোশালা ছেড়ে বেতালকেই বেশি পছন্দ করবে, কিন্তু রসগোল্লা যদি পায় তো বেতালকেও ছেড়ে দেবে, রসগোল্লা ফেলে কলাগাছ খেতে চাইবে, মানে, এক আলিগড়ের মাখন ছাড়া সবকিছুই খাবে।’

‘কেন, মাখন নয় কেন? মাখন তো সুখাদ্য।’

‘মাখনকে জুতমতো ঠিক পাকড়াতে পারবে না কিনা। শুঁড়েই লেপ্টে থাকবে, ওকে কায়দায় আনা কঠিন হবে ওর পক্ষে।’

‘ও!’ কাকা এইবার বুঝতে পারেন।

‘হ্যাঁ, যা বলেছেন। মাখন বাগানো সহজ নয় বটে।’ আমি বলি, ‘এক পাউরুটি ছাড়া আর কেউ তা বাগাতে পারে না।’

‘যাক খাদ্য তো হলো, এখন পানীয়?’ কাকা জিজ্ঞাসু হন।

‘তরল পদার্থ যা কিছু আছে। দুধ, জল, ঘোলের শরবত, ক্যাস্টর অয়েল, মেথিলেটেড স্পিরিট—কত আর বলব? কার্বোলিক অ্যাসিডেও কিচ্ছু হবে না ওর, তারাও দু দশ বোতল দু এক চুমুকে নিঃশেষ করতে পারে। কেবল এক চা খায় না।’

‘ওটা গুড হ্যাবিট। ভালো ছেলের লক্ষণ।’ কাকা ঈষৎ খুশি হন, সিগারেট টানতেও শেখেনি নিশ্চয়। সবই তো জানা হলো, কিন্তু কী পরিমাণ খায় তা তো কই বললে না হে।’

‘যত জুগিয়ে উঠতে পারবেন। এক আধ মণ, এক আধনিশ্বাসে উড়িয়ে দেবে।’

‘তাতে আর কী হয়েছে। কেবল এক মানুষটাই পেয়ে উঠব না বাপু, ইংরেজ রাজত্ব কি না। হাতিকে কিংবা আমাকেই—কাকে ধরে ফাঁসিতে লটকে দ্যায় কে জানে। তবে আজই বাজারে যত মহাভারত আছে সব বইয়ের দোকানে অর্ডার দিচ্ছি। ময়রাদের বলে দিচ্ছি রসগোল্লার ভিয়েন বসিয়ে দিতে। আমার কলাবাগানটাও ওরই নামে উইল করে দিলাম। পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ভোগ-দখল করুক। আর ইট-পাটকেল? ইট-পাটকেলের অভাব কী? আস্তাবল বানিয়ে যা বেচেছে আস্তাবলের পাশেই পাহাড় হয়ে আছে। যত ওর পেটে ধরে ইচ্ছামতো বেছে খাক, কোনো আপত্তি নেই আমার।’

অতঃপর মহাসমারোহে হস্তীপ্রভুকে আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সবাই শোভাযাত্রা করে পেছনে যাই। শিকল দিয়ে ওর চার পা বেঁধে আটকানো হয় শক্ত খুঁটির সঙ্গে। শুঁড়টাকেও বাঁধা হবে কি না আমি জিজ্ঞাসা করি। ‘শুঁড় ছাড়া থাকবে জানতে পারা যায়। শুঁড় দিয়েই ওরা খায় কিনা, কেবল তরল ও স্থূল খাদ্যই নয়, হাওয়া খেতে হলেও ওই শুঁড়ের দরকার।

হাতির দাম শুনে তো আমার চক্ষু স্থির। পঞ্চাশ হাজারের এক পয়সা কম নয়; যে লোকটা বেচেছে সে থাকে দু শ ক্রোশ দূরে তার এক আত্মীয় শ্যামরাজ্যের জঙ্গল বিভাগে কাজ করে। সেখান থেকে ধরে ধরে চালান পাঠায়। উপগ্রহটি অনেক কষ্টে বহুত জপিয়ে আরও কেনার লোভ দেখিয়ে এটি তার কাছ থেকে এত কমে আদায় করতে পেরেছেন। নইলে পুরো লাখ টাকাই এর দাম লাগত! এই হস্তীরত্নের আসলে যথার্থ দামই হয় না, অমূল্য পদার্থ বলতে গেলে।

হাতিকে এত দূর হাঁটিয়ে আনতে, তার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে আসতেও ভদ্রলোকের কম কষ্ট হয়নি। কিন্তু কাকার হুকুম, কেবল সেই জন্যই—নইলে কে আর প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এহেন বিশ্বগ্রাসী মারাত্মক শ্বেতহস্তীর সঙ্গে—

‘তা তো বটেই’ কাকা অম্লান বদনে তখুনি তাকে একটা পঞ্চাশ হাজারের চেক কেটে দ্যান।

‘আরও আছে এমন, আরও আনা যায়’—উপগ্রহটি জানান, ‘এ রকম শ্বেতহস্তী যত চান, দশ বিশ পঞ্চাশ—ওই এক দর কিন্তু।’

‘আরও আছে এমন?’ কাকা এক মুহূর্ত একটু ভাবেন, ‘বেশ, তুমি আনাবার ব্যবস্থা কর। তাতে আর কী হয়েছে, পঁচিশ লাখ টাকার শ্বেতহস্তীই কিনব না হয়, হয়েছে কী।’

বড় মানুষের বড় খেয়াল! সেই পুরাতন গ্রহটি এতক্ষণে বাঙনিষ্পত্তি করে, ‘তা না হলে আর বড়লোক কিসের!’

দুদিন যায়, পাঁচ দিন যায়। হাতিটাও বেশ সুখেই আছে। আমরা দুবেলা দর্শন করি। কাকা ও আমি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কাকিমা বিশেষ ভক্তিভরে। কাকিমা অনেক কিছু মানতও করেছেন, হাতির কাছে ঘটা করে পুজো এবং জোড়া বিড়াল দেবেন বলেছেন। কাকিমার এখনো ছেলেপুলে হয়নি কিনা।

কলাগাছ খেতেই ওর উৎসাহ বেশি যেন। ইট-পাটকেল পড়েই রয়েছে, স্পর্শও করেনি। দু-একটা বিড়ালও এদিক-ওদিক দিয়ে গেছে, হাতিকে তারা ভালো করেই লক্ষ করেছে, ও কিন্তু তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি! গাদা গাদা মহাভারত কোণে পুঁজি করা—তার থেকে একখানা নিয়ে ওকে আমি দিতে গেছলাম একদিন। পাওয়ামাত্র উদরস্থ করবে আশা করেছি আমি। কিন্তু মুখে পোরা দূরে থাক, বইখানা শুঁড়তলগত করেই না এমন সজোরে আমার দিকে ছুড়েছিল যে আর একটু হলেই আমার দফারফা হতো।

কাকা বললেন, ‘বুঝতে পারলি না বোকা? তোকে পড়তে বলছে! ধর্মপুস্তক কিনা! মুখ্য হয়ে রইলি, ধর্মশিক্ষা তো হলো না তোর!’

ধর্মশিক্ষা মাথায় থাক। কাকার পুণ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছি সেই রক্ষে! না, এরপর থেকে এই ধর্মাত্মা হাতির কাছ থেকে সন্তর্পণে সুদূরে থাকতে হবে; সাত হাত দূর থেকে বািচত।

এইভাবে হপ্তা তিনেক কাটার পর হঠাৎ একদিন বৃষ্টি নামল। মুড়ি-পাঁপড়ভাজা দিয়ে অকাল বর্ষণটা উপভোগ করছি আমরা। এমন সময়ে মাহুত ওরফে সহিস এসে খবর দিল, বাদলার সঙ্গে সঙ্গে হাতিটার ভয়ানক ছটফটানি আর হাঁকডাক শুরু হয়েছে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটলাম আমরা সবাই।

কী ব্যাপার? সত্যিই ভারী ছটফট করছে তো হাতিটা। মনে হয় যেন লাফাতে চাইছে চার পায়ে।

কাকা মাথা ঘামালেন খানিকক্ষণ। ‘বুঝতে পারা গেছে। মেঘ ডাকছে কিনা। মেঘ ডাকলে ময়ূর নাচে। হাতিও নাচতে চাইবে আর আশ্চর্য কী? ময়ূর আর হাতি—বোধ হয় এক জাতীয়? কার্তিক ঠাকুরের পাছার তলার ময়ূর আর গণেশ ঠাকুরের মাথায় ওই হাতি, আত্মীয়তা থাকাই স্বাভাবিক। যা-ই হোক, ওর তিন পায়ের শিকল খুলে দাও, কেবল এক পায়ের থাক, নাচুক একটুখানি!’

তিন পায়ের শিকল খুলে দিতেই ও যা শুরু করল, হাতির ভাষায় তাকে নাচই বলা যায় হয়তো। কিন্তু সেই নাচের উপক্রমেই, আরেক পায়ের শিকল ভাঙতে দেরি হয় না। মুক্তি পাওয়া মাত্র হাতিটা ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়ে, সহিস বাধা দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক শুঁড়ের ঝাপটায় তাকে ভূমিসাৎ করে দিয়ে চলে যায়।

তারপর দারুণ আর্তনাদ করতে করতে মুক্তকচ্ছ শুঁড় তুলে ছুটতে থাকে সদর রাস্তায়। আমরাও দস্তুরমতো ব্যবধান রেখে পেছনে পেছনে ছুটি। কিন্তু হাতির সঙ্গে ঘোড়দৌড়ে পারব কেন? আমাদের মানুষদের দুটি করে পা মাত্র সম্বল। হাতির তুলনায় তাও খুব সরু সরু। দেখতে দেখতে হাতিকে আর দেখা যায় না। কেবল তার ডাক শোনা যায়। অতি দূর-দূরান্ত থেকে।

তিন ঘণ্টা পরে খবর আসে, মাইল পাঁচেক দূরে এক পুকুরে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আত্মহত্যা করবে না তো হাতিটা? শ্বেতহস্তীর কাণ্ড, কিছুই বোঝা যায় না। কাকিমা কাঁদতে শুরু করেন, পুজো আচ্চা করা হয়নি ঠিকমতো, হস্তীদেব তাই হয়তো এমন খেপে গেছেন, এখন কী সর্বনাশ হয় কে জানে! বংশলোপই হবে গিয়ে হয়তো।

বংশ বলতে তো সর্বসাকুল্যে আমি, যদিও পরস্মৈপদী। কাকিমার কান্নায় আমারই ভয় করতে থাকে।

কাকা এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে ছোটেন শ্বেতহস্তীকে প্রসন্ন করতে। আমরা সকলেই চলি কাকার সঙ্গে। কিন্তু হাতির যে রকম নাচ আমি দেখেছি তাতে সহজে ওকে হাতানো যাবে বলে আমার ভরসা হয় না।

পথের ধারে মাঝে মাঝে ভাঙা আটচালা চোখে পড়ে, সেগুলো ঝড়ে উড়েছে কি হাতিতে উড়িয়েছে বোঝা যায় না সঠিক। আশপাশে জনপ্রাণীও নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। যত দূর সম্ভব হস্তীবরেরই কীর্তি সব! শ্বেত শুণ্ডের আবির্ভাব দেখেই বাসিন্দারা মুল্লুক ছেড়ে সটকেছে এই রকমই সন্দেহ হয় আমাদের।

কিছু দূর গিয়ে হস্তীলীলার আরও ইতিহাস জানা যায়। একদল গঙ্গাযাত্রী একটি আধমড়াকে নিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গাযাত্রায়, এমন সময়ে মহাপ্রভু এসে পড়েন। অমন ঘটা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে রাস্তা জুড়ে যাওয়াটা ওর মনঃপূত হয় না, উনি ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। শোনা গেল, এক-একজনকে অনেক দূর অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। কেবল বাদ দিয়েছেন, কেন জানা যায়নি, সেই গঙ্গাযাত্রীকে। সেই বেচারা অনেকক্ষণ অবহেলায় পড়ে থেকে, অগত্যা উঠে বসে দেহরক্ষার কাজটা এ যাত্রা স্থগিত রেখে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।

অবশেষে সেই পুকুরের ধারে এসে পড়া গেল। কাকা বহু সাধ্য সাধনা, অনেক স্তব স্তুতি করেন। হাতিটা শুঁড় খাড়া করে শোনে সব, কিন্তু নড়েচড়ে না। রসগোল্লার হাঁড়ি ওকে দেখানো হয়, ঘাড় বাঁকিয়ে দ্যাখে, কিন্তু বিশেষ উৎসাহ দ্যাখায় না।

পুকুরটা তেমন বড় নয়। কাকা একেবারে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ান—কাছাকাছি গিয়ে কথা কইলে ফল হয় যদি। কিছু ফল হয়, কেননা হাতিটা কাকা বরাবর তার শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়।

আমি বলি ‘পালিয়ে এসো কাকা। ধরে ফেলবে।’

‘দূর। আমি কি ভয় পাবার ছেলে? তোর মতন অত ভিতু নই আমি।’ কাকার সাহস দেখা যায়, কেন, ভয় কিসের? আমাকে কিছু বলবে না ও আমি ওর মনিব—মনিব—উঁহুঁহুঁ, শ্রীবিষ্ণু! সেবক—’

বলতে বলতে কাকা জিব কাটলেন। কান মললেন নিজের! ‘উঁহু, মনিব হব কেন, অপরাধ নিয়ো না প্রভু শ্বেতহস্তী। আমি তোমার ভক্ত—শ্রীচরণের দাসানুদাস। কী বলতে চাও বলো, আমি কান বাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমার ভক্তকে তুমি কিছু বলবে না, আমি জানি। হাতির মতো কৃতজ্ঞ জীব দুনিয়ায় দুটি নেই, আর তুমি তো সামান্য হাতি নও, তুমি হচ্ছ একজন হস্তী-সম্রাট।

কাকা কান বাড়িয়ে দ্যান, হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়—আমরা রুদ্ধশ্বাসে উভয়ের উৎকর্ণ আলাপের অপেক্ষা করি।

হাতিটা কাকার সর্বাঙ্গে তার শুঁড় বোলায়, কিন্তু সত্যিই কিছু বলে না। কাকার সাহস আরও বেড়ে যায়, কাকা আরও এগিয়ে যান। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ করেন, ‘দেখছিস, কেমন আদর করছে আমায়, দেখছিস?’

কিন্তু হাতিটা অকস্মাৎ শুঁড় দিয়ে কাকার কান পাকড়ে ধরে, কানে হস্তক্ষেপ করায় কাকা বিচলিত হন। কেন বাবা হাতি! কী অপরাধ করেছি বাবা তোমার শ্রীচরণে যে এমন করে তুমি আমার কান মলছ?’

কিন্তু হস্তীরাজ কর্ণপাত করেন না। কাকার অবস্থা ক্রমশই করুণ হয়ে আসে; তিনি আমার উদ্দেশ্যে (চেষ্টা করেও আমার দিকে তখন তিনি তাকাতে পারেন না।) বলেন—বাবা শিবু কান গেল, বোধ হয় প্রাণও গেল। তোর কাকিমাকে বলিস—বলিস যে সজ্ঞানে আমার হস্তীপ্রাপ্তি ঘটে গেছে!’

আমরা ক্ষিপ্র হয়ে উঠি, কাকাকে গিয়ে ধরি। জলের মধ্যে একা হাতি, স্থলের মধ্যে আমরা সবাই। হাতির চেষ্টা থাকে কাকার কান পাকড়ে জলে নামাতে, আর হাতির চেষ্টা যাতে ব্যর্থ হয় সেই দিকেই আমাদের প্রচেষ্টা। মিলনান্ত কানাকানি শেষে বিয়োগান্ত টানাটানিতে পরিণত হয়, কান নিয়ে এবং প্রাণ নিয়ে টানাটানিতে!

কিছুক্ষণ এই টাগ অপ-ওয়্যার চলে। অবশেষে হাতি পরাজয় স্বীকার করে তবে কাকার কান শিকার করে তারপরে। আর হাতির হাতে কান সমর্পণ করে কাকা এ যাত্রা প্রাণ রক্ষা করেন।

কাকার কানটি হাতি মুখের মধ্যে পুরে দেয়। কিন্তু খেতে বোধ হয় তার তত ভালো লাগে না। সেই জন্যই সে এবার রসগোল্লার হাঁড়ির দিকে শুঁড় বাড়ায়।

যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে কাকা বলতে থাকেন—দিসনে খবরদার, দিসনে ওকে রসগোল্লা। হাতি না আমার চৌদ্দপুরুষ! পাঁজি ড্যাম শুয়ার রাসকেল, গাধা, ইস্টুপিট! উঃ, কিছু রাখেনি কানটার গো, সমস্তটাই উপড়ে নিয়েছে। উল্লুক, বেয়াদব, আহাম্মক!’

কাকার কথা হাতিটা যেন বুঝতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে জল থেকে উঠে আসে। ও হরি, এ কী দৃশ্য! গলার নিচের থেকে যে অবধি জলে ডোবানো ছিল, হাতির সেই সর্বাঙ্গ একেবারে কুচকুচে কালো—যেমন হাতিদের হয়ে থাকে। কেবল গলার ওপর থেকে সাদা—অ্যাঁ, এ আবার কী বাবা?

তাকিয়ে দেখি, পুকুরের কালো জল হাতির রঙে সাদা হয়ে গেছে। শ্বেতহস্তীর আবার এ কী লীলা?

কর্ণহারা হয়ে সে শোকও কাকা কোনোমতে এ পর্যন্ত সামলে ছিলেন, কিন্তু হাতির এই চেহারা আর তার সহ্য হয় না। অত সাধের তাঁর সাদা হাতি—!

মূর্ছিত কাকাকে ধরাধরি করে আমরা বাড়ি নিয়ে যাই। হাতির দিকে কেউ ফিরেও তাকাই না। একটা বিশ্রী কালো ভূতের মতো চেহারা কদাকার কুিসত বুড়ো হাতি। উনি যে কোনো কালে সোনার সিংহাসনে বসে রাজপূজা লাভ করেছেন এ কথা ঘুণাক্ষরেও কখনো মনে করা কঠিন।

পরদিন একজন লোক জরুরি খবর নিয়ে আসে—অনুসন্ধানী উপগ্রহের প্রেরিত অগ্রদূত। উপগ্রহটি আরও পঞ্চাশটি শ্বেতহস্তী সংগ্রহ করে কাল সকালেই এসে পৌঁছাচ্ছেন এই খবর। কাকার আদেশে প্রাণ তুচ্ছ করে, বহু কষ্ট স্বীকার করে দু শ ক্রোশ দূর থেকে চারপেয়ে হাতিদের সঙ্গে দুপায়ে হেঁটে তিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু কে তুলবে এই খবর কাকার কানে?

মানে, কাকার অপর কানে?