সুস্মিতাকে আমরা প্রায় চেপে ধরলাম। আজই সেই সুবর্ণ সুযোগ। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে এমন একটা ভাব করে সুস্মিতাকে বললাম, ‘তোমাকে আজ হিপনোটাইজ করে চালাক বানিয়ে দেব।’
তারপর জুমি আর রুমির উদ্দেশে বললাম, ‘তাই নারে জুরু?’ আমি জুমি ও রুমিকে এক করে জুরু বলে ডাকি।
জুরু বলল, ‘হ্যাঁ।’
আমরা খুব উৎফুল্ল এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তাকে হিপনোটাইজে আমি যে পাকা সেটা বোঝাতে লাগলাম। এটাই হিপনোটাইজের নিয়ম। আমার কথামতো চোখ বন্ধ করল সুস্মিতা। ওস্তাদের মতো ভাব করে তার কানের কাছে তালি বাজাতে লাগলাম আমি। গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘সুস্মিতা, এবার তুমি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে যাবে।’
সুস্মিতার কপাল বেয়ে ঘাম নামতে শুরু করল। আমি ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বললাম; যার অর্থ আমি নিজেও জানি না। আসলে আমি তো কোনো জাদুও জানি না। আমি কোনো জাদু করিনি। ওকে শুধু বিশ্বাস করিয়েছি যে এরপর ওর বুদ্ধি চাঙ্গে উঠবে। দু-এক মিনিট পর আমি তাকে তার চোখ খুলতে বললাম। আস্তে আস্তে চোখ খুলল সে। তার চোখে আগের মতো ভয়ার্ত দৃষ্টি আর নেই, কিন্তু কী যেন আছে। ঠান্ডা, নির্লিপ্ত একটা ভাব। আমি শিউরে উঠলাম। ছুটি হওয়া পর্যন্ত আমি কারও সঙ্গে কথা বললাম না। একটা মানুষ বুদ্ধিমান হলে আমার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটা প্রকৃতিগতভাবে না হয়ে অন্যভাবে হলে তা চিন্তার বিষয়। হোমওয়ার্কে মন বসল না আমার। ছটফট করলাম সারাক্ষণ। হিপনোটাইজ করার সময় ভয় ছিল সুস্মিতার চোখে। সে হয়তো ভেবেছিল সত্যি সত্যি তাকে বুদ্ধিমান বানিয়ে ফেলব আমরা। কিন্তু পরে আর ভয় ছিল না ওর চোখে। ও যেন এক অন্য মানুষ। আসলেই কি তাই? সত্যিই কি কাজ করে হিপনোটিজম? আচ্ছা, ও যদি বুদ্ধিদীপ্ত না হয়ে একটা খারাপ মানুষ হয়ে ওঠে? আমি ওর অদ্ভুত দৃষ্টির কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলাম।
সকালে নাশতা করে স্কুলে গেলাম। ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। তাই চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। সুস্মিতার কথা ভেবে একধরনের অদ্ভুত শঙ্কা কাজ করছিল মনের মধ্যে। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম পেছন থেকে। আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ! পেছনে তাকিয়ে সব শঙ্কা দূর হয়ে গেল। সুস্মিতা অটোরিকশার জ্যামের মধ্যে আটকে গেছে, বের হতে পারছে না। তার চোখে সেই বোকা বোকা দৃষ্টি। তাকে রীতিমতো ‘উদ্ধার’ করে আনলাম আমি। স্কুল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে ক্যানটিনের সামনে দাঁড়ালাম। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। একটু অস্বস্তি বোধ করলাম আমি।
‘তোমার হিপনোটাইজের জন্য আমি কাল রাতে গণিতের সিলেবাস শেষ করে ফেলেছি।’ সুস্মিতা বলল, ‘কাল রাতে আমি নাকি কিছুতেই ঘুমাচ্ছিলাম না। অঙ্ক খাতা বানানোর জন্য একটার পর একটা স্টেপলার মারছিলাম। সেই আওয়াজ এতই বেশি ছিল যে আব্বু-আম্মুর ঘুমও হারাম হয়ে গিয়েছিল। আমি নাকি কোনো কথাও বলছিলাম না। আম্মু বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিল কেন ঘুমাচ্ছি না। আর আমি বলছিলাম, অর্চিকে জিজ্ঞেস করো। বুদ্ধিমানরা সময় নষ্ট করে না। কথা বলা মারাত্মক সময় নষ্ট।’
শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম।
সুস্মিতা বলল, ‘আমার অবশ্য কিছুই মনে নাই। সব আম্মু বলেছে। কিন্তু আমার অঙ্কগুলো মনে আছে। আর আম্মু আমাকে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়া সময় যে দুটো ডিগবাজি খেয়েছি সেটা মনে আছে।’ তার একটু থেমে বলল, ‘তুমি হাঁ করে আছো কেন?’
আমার ‘হুশ’ এল। মেয়েটার অঙ্কের কথা মনে আছে। কী করে হলো এটা? ওর ওই সাংঘাতিক দৃষ্টি যদি আবার ফিরে আসে, কী হবে তাহলে? আমি পাথর হয়ে রইলাম।