হেঁয়ালি

শীতকাল। এখন তো পাখি ডাকেই না। মাঝে মাঝে যা–ও দু–একটা পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায়, সে পাখি দেখা যায় না। লুকিয়ে থাকে গাছের কোনো ডালে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে একটা কোকিল ডেকে উঠল। আর তখনই মাঠের পাশের গাছটার কাছে গল্পে মশগুল ক্লাস টেনের শৌনক, অজয়, ইরাম আর শুভ্র ক্লাসের পথে চলল। কোকিলটা আরও একবার ডেকে উঠল।

ক্লাসে এসে ওরা দেখে, নতুন এক স্যার এসেছেন। তিনি বললেন, তাঁর নাম রাহুল। ক্লাস টিচার জামাল স্যার নাকি ২ বছরের ছুটি নিয়ে জাপান যাচ্ছেন। তাই এখন থেকে টেস্টের আগপর্যন্ত রাহুল স্যারই ক্লাস নেবেন।

রাহুল স্যার আজ প্রথম দিন ক্লাস নিতে এসেই তাঁর ছাত্রদের বললেন, ‘তোমাদের মন যা চায়, তা–ই কোরো।’

এই কথা বলে তিনি শৌনক, শুভ্র, ইরাম আর অজয়কে একটু সমস্যায় ফেলে দিলেন। কারণ, ওরা পড়াশোনোর কথা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনায় ভালো না করলে কী কী দুর্ভোগ আছে কপালে, সে কথাই চারদিকের সবাই বলে ওদের। আজ তাঁর প্রথম ক্লাসেই রাহুল স্যার বললেন একেবারে উল্টো কথা। ‘মন যা চায় তা–ই কোরো।’

ওরা চারজন যখন ক্যানটিনে বসে শিঙাড়া খাচ্ছিল, তখন শৌনক বলল, ‘আচ্ছা, স্যার তো বলেই খালাস। মন যা চায়, তা–ই করো। মন তো কত কিছুই চাইতে পারে!’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। মন তো সারাক্ষণ মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসে থাকতে চাইতে পারে!’, বলল শুভ্র।

‘মন তো ইউটিউবে সিনেমা দেখতে চাইতে পারে’, বলল অজয়।

ইরাম বলল, ‘আচ্ছা, এখন এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। কয়েক দিন দেখি তাঁকে।’

আর মাত্র কটা দিন! দু মাস পরেই টেস্ট পরীক্ষা। এরই মধ্যে ক্লাসটিচার পরিবর্তন হলো। রাহুল স্যার কোথায় মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলবেন, তা না, তিনি বলছেন, ‘মন যা চায়, তা–ই কোরো।’ এ কী আজব ব্যাপার।

এরপর আবার পড়াশোনার কথা ভুলে গিয়ে তিনি বললেন, ‘কে কে টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিনের গল্প পড়েছ?’

মাত্র চারটা হাত ওপরে উঠল।

‘সুকুমার রায়?’

এবার দুটো হাত বাড়ল।

‘ফেলুদার কাহিনি?’

এবার অর্ধেক ক্লাস হাত ওঠাল।

‘দীপু নাম্বার টু?’

কয়েকটা হাত কমে গেল।

‘তোমাদের অবস্থা তো মারাত্মক! সব সময় পড়ার বই পড়লে তো কুয়োর ব্যাঙ হয়ে যাবে। বাইরের বই পড়ো না কেন?’

এ দেখি একেবারে উল্টো কথা! এত দিন ওরা শুনে এসেছে, বাইরের বই পড়লে মহাবিপদ। দশ নম্বর সতর্কসংকেতের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা। বাইরের পড়ার বই যাদের বাড়ির লাইব্রেরিতে ছিল, তারা তা সরিয়ে ফেলেছে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই আবার বইগুলো ফিরে আসবে যথাস্থানে। তার আগে নয়।

কিন্তু রাহুল স্যার সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘পড়ালেখার যে চাপ, তা থেকে বের হতে হবে। একটু বিশ্রাম দিতে হবে মগজকে। গল্পের বই পড়বে, খেলতে যাবে। গান শুনবে।’

শৌনক বিড়বিড় করে বলল, ‘কিন্তু আমাদের টেস্ট পরীক্ষা তো চলে এসেছে। এখন দিনে ১২ ঘণ্টা করে না পড়লে তো ভালো রেজাল্ট হবে না।’

‘ভালো রেজাল্ট না হলে মা–বাবা বকবে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করবে।’ শৌনকের কথায় সায় দিল শুভ্র।

‘অন্যদের সঙ্গে তুলনা করবে মানে?’ একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন রাহুল স্যার।

‘বাহ্‌! এটাও জানেন না? ধরেন, শৌনক সব কটি পরীক্ষায় পেল পাঁচ, আমি শুধু জীববিদ্যায় পেলাম চার, আর সব কটিতে পাঁচ। ব্যস, বাড়ির সবাই বলবে, শৌনক এত ভালো ছাত্র। ও একটা বিষয়েও চার পায়নি। আর তুই চার পেলি!’ শুভ্র ব্যাখ্যা করে বোঝাল।

‘বলো কী!’ আবার অবাক হন রাহুল স্যার। ‘কেউ বেশি পাবে, কেউ কম পাবে, সেটাই তো নিয়ম। সবাই পাঁচ পেলে চার কে পাবে? সবাই চার পেলে তিন কে পাবে?’

এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারে না ছাত্ররা।

স্যার আবার বললেন, ‘পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলেও পড়তে হবে—এ কেমন নিয়ম?’

শৌনক স্যারকে জিজ্ঞেস না করে পারল না, ‘স্যার, আপনি কি বিদেশ থেকে এসেছেন? আপনি কি এই দেশের নিয়মকানুন কিছু জানেন না?’

স্যার এবার একটু চিন্তিত হলেন। প্রথমে মাথার চুল টানলেন কিছুক্ষণ। তারপর কপাল টিপলেন। বললেন, ‘কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে দেখছি!’

‘কী হলো স্যার?’ সবাই উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আমাকে তো আমার বাবা বললেন তোমাদের দেখে আসতে। তিনি বললেন, তোমাদের এখানে তো এখন পড়াশোনাটা আনন্দময় হওয়ার কথা!’

‘আপনার বাবা কোথায় আছেন?’ অজয় জিজ্ঞেস করল।

‘সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। তিনি আমাকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। বলেছেন, স্কুলে যা মন চায়, তা করার মতো করে তোমাদের গড়ে তুলতে হবে। তোমরা ভালো কিছু করবে। নিজের ভাবনাকে বড় করে দেখবে।’

শৌনক জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বাবা কী করেন?’

‘সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।’ একই বাক্য আবার উচ্চারণ করলেন রাহুল স্যার। ‘শোনো, আমার বাবা ছিলেন এক বাড়ির চাকর।’

হঠাৎ রাহুল স্যার কেন তাঁর বাবা চাকর ছিলেন, সে কথা বললেন, তা ওরা বুঝতে পারল না।

স্যার বললেন, ‘চলো, সবাই মিলে ওই মাঠে গাছের ছায়ায় গিয়ে বসি।’

‘সর্বনাশ! স্যার, এখন তো ক্লাস। গাছের ছায়ায় আমাদের দেখলে প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের টিসি দিয়ে দেবেন!’ আর্তনাদ করে উঠল ইরাম।

‘আরে কিছু হবে না। আমি তো তোমাদের সঙ্গে থাকব।’

স্কুলে এই প্রথম এমন একটা ঘটনা ঘটল, যা আগে কোনো দিন ঘটেনি। অন্য ক্লাসের ছেলেরা দেখল, নতুন স্যারের পেছন পেছন ক্লাস টেনের সব শিক্ষার্থী বেরিয়ে গেল এবং সবাই গিয়ে বসে পড়ল মাঠে গাছের নিচে।

তারা তিনজন মিলে ডাকতে থাকল বাবাকে। কিন্তু বাবা কোনো উত্তর দিল না। প্রজাপতির মতোই বাবার পিঠে বুঝি পাখা গজিয়েছে।

‘আমি আমার বাবার কথা বলব তোমাদের।’ বললেন রাহুল স্যার।

শুভ্র ধরিয়ে দিল, ‘আপনি বলছিলেন তিনি ছিলেন চাকর।’

রাহুল স্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নির্ভাষ বসে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমার বাবা নিজেকে চাকর বলত না। যে বাড়িতে সে কাজ করত, সে বাড়িতে তাঁকে চাকরই মনে করা হতো।’

শৌনক আর অজয় পরস্পর মুখ চাওয়া–চাওয়ি করল।

‘বাবার নাম ছিল রাজীব। সে সময় তাঁর বয়স ছিল বারো। দাদার সাধ্য ছিল না ছেলেকে মানুষ করেন। তাই তিনি গ্রামেরই পরিচিত এক বড়লোকের বাড়িতে রাজীবকে নিয়ে আসেন। বড়েলাকটি তখন থাকতেন ঢাকা শহরে। তখন ঢাকার মানুষ ছিল কম। এ দেশেই মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটি।’

‘আপনি কখনকার কথা বলছেন?’

‘১৯৭১ সালের’, বললেন রাহুল স্যার।

মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতারা নড়ছে। সূর্যের আলো এসে পড়ছে গাছের পাতার ফাঁক গলে। মাটিতে নেমে এসে তা কাঁপছে।

রাহুল স্যারের গল্প

‘ঢাকার শান্তিনগরে ছিল এক বাড়ি। সেখানেই কাজ করত বাবা। বাবার দেশের বাড়ি ছিল মাগুরা। মাগুরা থেকে বেনাপোল সীমান্ত খুব কাছে। কেন তোমাদের বেনাপোল সীমান্তের কথা বলছি, সেটা একটু পরই জানতে পারবে।

‘যে বাড়িতে বাবা কাজ করত, সেই বাড়ির গৃহিণীর নাম ছিল রওশন আরা। দারুণ ডাকসাইটে আর খিটমিটে মহিলা ছিলেন তিনি। বাবা কাজ করতে যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, “আমার কথার বাইরে একটা কাজ করলে হাত ভেঙে দেব। এর আগে যে ছেলেটা আমাদের এখানে কাজ করত, ও মিথ্যে কথা বলেছিল, তাই ওর হাত পুড়িয়ে দিয়েছিলাম খুনতি দিয়ে।”

তখন চারদিকে আন্দোলন চলছে। একটার পর একটা মিছিল আসছে। কিন্তু এই বাড়ির মালিক জাফর সাহেব সেই মিছিলে যেতেন না। মালকিন রওশন আরাও যেতেন না। মিছিলকে ভয় পেতেন। তবে নির্বাচনে বাঙালিদের জয় হয়েছে, এতে তারা খুশি ছিলেন। বুঝতেই তো পারছ, সব মানুষ একরকম হয় না।

বাবাকে করতে হতো মালির কাজ। বাজারও করতে হতো বাবাকে। বাড়ির যাবতীয় ফাই–ফরমাশ খাটতে হতো তাকে। বাড়ির রান্নার কাজে সহযোগিতা করত ফুলবানু নামের একটি মিষ্টি মেয়ে। কত বয়স হবে? দশ কি এগারো। বাবা মাঝে মাঝে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। ফুলবানু যখন রুটি বানাতে বানাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন মাঝে মাঝে বাবা গিয়ে দাঁড়াত ওর পাশে। তাতেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত ফুলবানুর। বাবা খুব সরল মানুষ ছিল। ফুলবানুকে তার এতই পছন্দ হয়ে গেল যে সে ভাবল, বড় হয়ে এই ফুলবানুকেই সে বিয়ে করবে।

রওশন আরা সব সময় রাগী রাগী চেহারা করে ওদের সামনে ঘুরে বেড়াতেন। কথায় কথায় বলতেন, ‘চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব।’ কেন বলতেন, তা ওরা বুঝত না। শুধু বুঝত, মালিকেরা বুঝি এ রকমই হয়। কিন্তু পাশের বাড়ির মনসুর খালু আর লীনা খালাম্মা তাঁদের বাড়ির কাজের লোকেদের খুব আদর করতেন। তাই বাবা আর ফুলবানু হিসেবটা মেলাতে পারত না।

একবার বাগানের গাছে পানি দিতে গিয়ে হঠাৎ একটা প্রজাপতি দেখতে পেল বাবা। প্রজাপতিটার ডানায় সাতটা রং। একবার এ ফুলে বসে তো আরেকবার অন্য ফুলে। বাবা তন্ময় হয়ে সেই প্রজাপতিটা দেখছিল। এদিকে রওশন আরা চিৎকার করে বাবাকে ডাকছেন। বাবার কানে সে ডাক পৌঁছাচ্ছে না। রওশন আরা খুব খেপে গেলেন। ফুলবানু হাত পুড়িয়ে ফেলেছে, রুটি বানাতে পারছে না। বাড়ির সামনের হক ব্রেড অ্যান্ড কনফেকশনারি থেকে একটা পাউরুটি কিনে আনা দরকার। পাউরুটি না খেয়ে জাফর সাহেব অফিসে যেতে পারবেন না। বাবার উত্তর না পেয়ে রওশন আরা বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। সেখান থেকে বাবাকে ডাকলেন, কিন্তু বাবার কী যে হলো, বিভোর হয়ে তাকিয়েই থাকল প্রজাপতির দিকে। রওশন আরার চিৎকারে জাফর সাহেব, ফুলবানুও বেরিয়ে এল বারান্দায়। তারা তিনজন মিলে ডাকতে থাকল বাবাকে। কিন্তু বাবা কোনো উত্তর দিল না। প্রজাপতির মতোই বাবার পিঠে বুঝি পাখা গজিয়েছে।

বাবার পাখা কেটে দেওয়ার সময় হলো। রওশন আরা বের করলেন একটা বেত। ছুটে গিয়ে বাবার পিঠে একের পর এক সপাং সপাং চালিয়ে দিলেন বেতটা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবার পিঠে লাল লাল ছোপ পড়ে গেল। বিস্মিত বাবা এতক্ষণে নিজের মধ্যে ফিরে এল, কিন্তু কেন তাকে মারা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারল না। এরই মধ্যে কয়েকটা টাকা তার দিকে ছুড়ে দিয়ে রওশন আরা বললেন, ‘এক্ষুনি গিয়ে পাউরুটি নিয়ে আয়। সাহেব কি নাশতা না করে অফিসে যাবে?’

চোখের পানি খুব কষ্টে চেপে ধরে বাবা চলে গেল পাউরুটি আনতে।

বাবা ফিরে আসার পর ফুলবানু এসে বলল, ‘আমার আর এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে না।’

‘কেন?’

‘এইখানে শুধু মারে।’

কথাটা সত্যি। পান থেকে চুন খসলেই মারপিট শুরু হয়ে যায়।

বাবা বলে, ‘মন যা চায়, তা–ই কোরো।’ তারপর বলে, ‘বাড়ি যাবা?’

ফুলবানু বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাতেই বাবা বুঝে যায় বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে সে। ফুলবানুর মনে যেন মুক্তির বাতাস এসে ঢোকে। মন যা চায়, তা–ই যদি করতে হয়, তাহলে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে বসতে চায় সে। নিজের যা ইচ্ছে তা–ই করবে। গ্রামে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবে, নদীর জলে দাপাদাপি করবে। যা ইচ্ছে তা–ই!

কাউকে কিছু না বলে বিকেলের দিকে তারা দুজন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু বেশি দূর যাওয়া হয় না। পাড়ার গলি থেকে বের হওয়ার আগেই ওরা দেখতে পায়, জাফর সাহেব রিকশায় করে ফিরছেন। সে সময় ওদের সামনে থেকে একটা মিছিল আসে। ‘মানি না, মানব না’ স্লোগান শুনতে পাওয়া যায়। ওরা দুজন মিছিলে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু জাফর সাহেব ঠিকই ওদের দেখতে পান এবং ধরে নিয়ে আসেন বাড়িতে।

এরপর স্বামী–স্ত্রী মিলে বাবা আর ফুলবানুকে বেদম পেটান। বলেন, যদি আর কখনো পালানোর চেষ্টা করে, তাহলে হাড়গোড় ভেঙে দেবেন।

এরই মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। শাঁই শাঁই করে গুলি চলল। রাতে থাকে কারফিউ। ডাকসাইটে রওশন আরা সব সময় কুঁকড়ে থাকেন। জাফর সাহেবও চিন্তিত। একদিন জাফর সাহেব ওদের হাতে কয়েকটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোরা গ্রামের বাড়িতে ফিরে যা। এখানে আর কাজের লোক লাগবে না।’

‘আমরা কীভাবে এই গুলির মধ্যে বাড়ি যাব?’

জাফর সাহেব খেঁকিয়ে ওঠেন, ‘সেটা আমি কী করে জানব? সেদিন তো পালিয়ে যাচ্ছিলি!’

মনসুর খালু আর লীনা খালাম্মা এসে বলেন, ‘এই যুদ্ধের মধ্যে ওরা দুই বাচ্চা কীভাবে যাবে?’

জাফর সাহেব বলেন, ‘ওরা তো পালিয়েই যাচ্ছিল সেদিন। যেভাবে যেতে চাইছিল এখন সেভাবেই যাবে।’

কোনো কথা আর বলার থাকে না। বাবা আর ফুলবানু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর কতভাবে কত বাস পরিবর্তন করে, কতটা হেঁটে মাগুরার শরুশুনা গ্রামে পৌঁছায়, সে অন্য এক গল্প।

তবে আরেক গল্প শুরু হয় এর পাঁচ মাস পরে। যুদ্ধ খুব ভয়ানক হয়ে উঠেছে। শরুশুনা গ্রামে তখন শান্তি কমিটি গড়ে উঠেছে। রাজাকারেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে। তারা ইয়াহিয়া খানের পক্ষে কাজ করছে। ফুলবানু মাঝে মাঝে এসে বাবাকে বলে, ‘আমি তো যা ইচ্ছা, তা–ই করতে পারি না।’

বাবা বলে, ‘দেশ স্বাধীন হলে যা ইচ্ছে তা–ই করতে পারবা।’

‘যা ইচ্ছা তা–ই মানে কী?’

বাবাও খুব বোঝে, তা নয়। তারপরও বলে, ‘ভালো কিছু ভাববে, সেটা করার চেষ্টা করবে। এটাই যা ইচ্ছা তা–ই। তুমি বাড়ির মালিক হলে অন্যদের গায়ে হাত তুলবে না।’

ফুলবানু হাসে।

বাবা তো ওই একটি কথাই ফুলবানুর মনে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, “মন যা চায়, তা–ই করো।” আমিও সে কথা সবাইকে বলে বেড়াই।

একদিন সন্ধ্যায় এক অবাক করা ঘটনা ঘটে। বাবা দেখে, জাফর সাহেব আর রওশন আরা একটা স্যুটকেস টানতে টানতে ওদের বাড়িতে এসে হাজির। জাফর সাহেব দাদাকে বলেন, ‘বশির চাচা, আপনার বাড়িতে আমাদের একটু থাকতে দেবেন?’

দাদা ওদের দেখে খুশি হন। বলেন, ‘আপনারা আমার বাড়ি এসেছেন আর আমি আপনাদের থাকতে দেব না! আপনারা তো আমাদের ছেলেকে থাকার জায়গা দিয়েছিলেন। খাইয়েছেন!’

নিজেদের ঘর ছেড়ে দিলেন তিনি। জাফর সাহেব বাবাকে দেখে বললেন, ‘কেমন আছ তুমি?’

বাবার মনে অভিমান জমেছিল অনেক। কিন্তু ওদের বাড়িতেই আশ্রয় নিতে এসেছে তারা। বাবার মনে সেই বেতের বাড়ি মারার দৃশ্য ভেসে ওঠে। নিজেকে কোনোভাবে সামলায়। বলে, ‘ভালো আছি।’

রওশন আরা ফুলবানুদের বাড়ি যান। ফুলবানুকে আদর করেন। ওর গাল টিপে দেন। তারপর এমন কিছু কথা বলেন, যাতে মনে হয়, ফুলবানুকে ছাড়া তিনি নিজের জীবন ভাবতেই পারেন না।

সে রাতেই রাজাকারের লোকেরা ওদের বাড়ির সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। জালাল মোল্লা মুসলিম লীগের সদস্য। তারই নেতৃত্বে এসেছে ওরা।

দাদাকে জালাল মোল্লা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের বাড়িতে কারা এসেছে?’

দাদা বলেন, ‘কেউ না।’

‘রুহুল মোল্লা বলল, কাউকে ঢুকতে দেখেছে!’

‘কেউ আসেনি। জালাল, তুমি তোমার কাজ করো। আমাকে জ্বালিও না।’

বাবা এরই মধ্যে বাড়ির ভেতরে গিয়ে জাফর সাহেব আর রওশন আরাকে পেছনের দরজা দেখিয়ে দেয়। তাঁরা তখনই বেরিয়ে যান। কিন্তু যাওয়ার আগে স্যুটকেস নিতে ভুলে যান।

শান্তি কমিটির লোকেরা ভেতর বাড়িতে ঢুকে দুই আগন্তুককে খুঁজে পায় না। কিন্তু স্যুটকেসটা দেখে। কারা এসেছিল, কেন এসেছিল, এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে না। হাতের বন্দুক দিয়ে তখনই দাদার মাথায় সপাটে বাড়ি মারে। দাদা উল্টে পড়ে। বাবা এসে জালাল মোল্লার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন তার বন্দুক থেকে সরাসরি বাবাকে গুলি করে। বাবার বুকে গুলি লাগে। তখনই বাবা মরে যায়।

গল্প প্রায় শেষ

রাহুল স্যার চুপ করে বসে থাকে। শৌনক, অজয়, শুভ্র আর ইরাম এ ওর মুখের দিকে চাওয়া–চাওয়ি করে। ওরা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

মৌনতা ভেঙে শৌনক রাহুল স্যারকে বলে, ‘স্যার, আপনার বাবা বারো বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছেন!’

‘হ্যাঁ!’

‘তাহলে আপনার জন্ম হলো কী করে?’

রাহুল স্যার হেসে বলেন, ‘আমার তো জন্ম হয়নি। আমি তো বাবার কথা বলার জন্য এসেছি। ফুলবানুর সঙ্গে বাবার বিয়ে হতে পারত, আমার জন্ম হতে পারত। সেটা হয়নি। বাবা তো ওই একটি কথাই ফুলবানুর মনে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, “মন যা চায়, তা–ই করো।” আমিও সে কথা সবাইকে বলে বেড়াই। স্বাধীন দেশে মন যা চায়, তা–ই করার স্বাধীনতা তো থাকতে হবে। স্কুলে শুধু নম্বরের জন্য পড়তে হবে কেন? আর কিছু করার নেই?’’

ঠিক এ সময় আরেকবার কোকিল ডেকে ওঠে। একটা নয়, দুটো কোকিল। একটি কোকিলের ডাকের উত্তরে ডেকে ওঠে আরেকটি কোকিল। ওরা চারজনই গাছের দিকে তাকায়। তারপর যখন ওদের চোখ আবার ফিরে আসে নিচে, ওরা দেখে সেখানে রাহুল স্যার নেই। তার মানে এতক্ষণ ওরা যা দেখল, তা একটা স্বপ্ন! জেগে জেগে চারজন মানুষ এ রকম অদ্ভুত স্বপ্নও দেখল! রাহুল স্যার বলে কেউই আসলে নেই!

ওরা এবার ক্লাস টিচার জামিল স্যারের ডাক শুনতে পায়, ‘কী ব্যাপার, তোমরা গাছতলায় বসে আছো কেন?’

ওরা কেউ সদুত্তর দিতে পারল না।

গল্প এখানেই শেষ

এ রকম একটা ঘটনার কোনো মানে বের করতে পারল না চার বন্ধু। কৌতূহলের বসে টেস্ট পরীক্ষার পর দুই দিনের জন্য ওরা মাগুরার শরুশুনা গ্রামে গেল। ফুলবানু নামে কেউ আছে কি না, জিজ্ঞেস করল। এবং ওরা খুবই বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করল, ফুলবানু নামে এক নারী বসে আছেন তাঁর দাওয়ায়। পাড়ার লোকদের কাছে ওরা শুনল, তিনি বিয়ে করেননি। যুদ্ধের পর থেকে এই বাড়িতেই রয়েছেন। যুদ্ধের আগে নাকি একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন, আর কোনো দিন গ্রাম থেকে বের হননি।

শৌনক, অজয়, শুভ্র আর ইরাম সেই নারীর দাওয়ায় বসতেই তিনি বললেন, ‘আমি জানি, কেন তোমরা আমার কাছে এসেছ? আমিও বলি, “মন যা চায়, তা–ই কোরো, ঠিক আছে?”’

ওদের চারজনের মনে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়!