হ্যাপি বাদ দে টু ইউ

অলংকরণ: তুলি

টুকু একটা খবরের কাগজের টুকরা কুড়িয়ে পেয়েছে। সেই টুকরায় আবার সিনেমার নায়ক-নায়িকার খবর।

আজ শাকিবের জন্মদিন। সে বানান করে করে পড়ল। পথশিশুদের একটা স্কুল আছে কারওয়ান বাজারের ভেতরে। মুরগির মার্কেটের পেছনের দোতলার অন্ধকার সিঁড়ি পার হলে তাদের স্কুল। তিনটা ঘর। আলোর পাখি সেই স্কুলের নাম। তিনজন আপা সেখানে বাচ্চাদের পড়ান। টুকু পড়ে সেখানে। দিনে দুই ঘণ্টা। দিনের বাকিটা টুকুর অবাধ স্বাধীনতার সময়। টুকু তেজগাঁও রেলস্টেশনে পড়ে থাকা ট্রেনের বগিতে ঘুমায়। কারওয়ান বাজারে ডালা হাতে সে মিন্তিগিরি করে। মানে সাহেবেরা বাজার করতে আসেন গাড়ি করে। টুকু, বয়স ৭, গায়ের রং শ্যামলা, মুখমণ্ডল গোলাকার, চোখ দুটো বড় বড় আর ভাসা ভাসা, সামনের দাঁত দুটো বড়, সেই গাড়ির পেছনে পেছনে ডালা হাতে ছোটে আর বলে, স্যার, মিন্তি লাগব, মিন্তি? কেউ কেউ বলেন লাগবে, আয়। কেউ বলেন, আরে সর সর, গাড়ির চাকার নিচে পড়বি তো। কেউ বাজারসদাই করে ২০ টাকা দেন, কেউবা ১০০ টাকাও দিতে কিপ্টেমি করেন না। একজন স্যার একবার ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। এই রকম হঠাৎ করে বেশি টাকা পাওয়া গেলে সিনেমা দেখতে যায় পূর্ণিমা সিনেমা হলে। টাকা কম পেলে মন খারাপ করে ফুটপাতে ডালা বিছিয়েই তার মধ্যে আরাম করে ঘুমায়।

আজকে টুকু তার ডালাটাতে বসে। বিকেল চারটার মতো বাজে। এই সময় লোকে বাজার করতে আসেন না, আরাম করে কুড়িয়ে পাওয়া পত্রিকা পড়ছে।

আরে বাহ্, জবর খবর। আজকে শাকিব খানের জন্মদিন।

সিনেমার নায়ক শাকিব খানকে তার পছন্দ। সে পূর্ণিমা সিনেমা হলে শাকিব খানের সিনেমা দেখে।

শাকিব খান খুব ভালো ফাইটিং পারে। আর নাচতে পারে খুব ভালো। মনে করেন, নায়িকা যদি বিপদে পড়ে, অপু বিশ্বাস যদি বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচায়, তখন টুকুর খুব কান্না পায়, যেই শাকিব খান এসে হাজির হয়, টুকু হাততালি দিয়ে ওঠে।

এখনো টুকু হাততালি দিচ্ছে।

সিনেমা হল ছাড়াও বাজারের দোকানের টেলিভিশনে সে শাকিব খানের সিনেমা দেখে।

একটা সিনেমায় সে দেখেছে, বড়লোকেরা জন্মদিন কেমন করে পালন করে।

যে বাচ্চার জন্মদিন তার মাথায় একটা মুকুট পরাতে হয়। তারপর আরও আরও বাচ্চারা আসে। সঙ্গে তাদের মা-বাবারা থাকেন। তাঁরা একটা টেবিলের পাশে দাঁড়ান। আরেক পাশে থাকে একজন ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাম্যান কী, টুকু জানে। একবার একজন ক্যামেরাম্যান টুকুর ছবি তুলেছিল। টুকু ডালার ওপরে শুয়ে আছে, সেই ছবিটা। সেটা পরে খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। টুকু সেই ছবি দেখেছিল। কাগজটা অবশ্য সে জোগাড় করতে পারে নাই। ওষুধের দোকানের খবির চাচা খবিশ আছেন। তিনি সেটা তাকে দেননি।

তো যার জন্মদিন তার সামনে থাকে একটা তিনতলা কেক। কেকের ওপরে আবার থাকে মোমবাতি। যার জন্মদিন সে মোমবাতিতে ফুঁ দেয়, কেক কাটে, আর বাকিরা হাততালি দিয়ে গান গায়—হ্যাপি বাদ দে টু ইউ।

আজকে শাকিব খানের জন্মদিন। টুকুর একটা বন্ধু আছে, তার নাম শাকিব। তার জন্মদিনটা পালন করলে কী হয়?

শাকিবটা যে এখন কোথায়? মনে হয় সাইকেলের গ্যারেজে আছে। টুকু ডালাটা হাতে নিয়ে তার কাল্পনিক মোটরসাইকেলটা স্টার্ট দেয়। মুখে শব্দ করতে থাকে—ভোঁ।

শাকিবকে পাওয়া যায়। সে একটা রিকশার চাকায় পাম্প মেশিনের মুখটা চেপে ধরে আছে।

রিকশাওয়ালা, একজন বুড়োমতো মানুষ, পাম্প দিচ্ছেন।

টুকু বলে, শাকিব, শাকিব, হ্যাপি বাদ দে টু ইউ।

শাকিব বলে, এইটা আবার কী গান?

‘ক্যান, শোধের বদলা প্রতিশোধ সিনেমায় দেখিস নাই? শাকিব খান যখন ছোট ছিল, তখন তার জন্মদিন হইল। তখন পোলাপান গান করল, হ্যাপি বার্থ দে টু ইউ।’

পাম্প মেশিনের নজল ছেড়ে দিয়ে শাকিব হাসে।

শাকিবটা একেবারে রোগা-পাতলা। আট বছরের মতো বয়স হবে। তার মুখখানা সরু। চোখ দুটো গর্তে ঢোকানো। কিন্তু তার দাঁতগুলো ভারি সুন্দর। হাসলে কী যে ভালো লাগে!

টুকু বলে, চল, পার্কে যাই। ওখানে শাবানা, ফরিদ, নগেন আর কলি আছে। অরা পাতা কুড়াইতাছে।

শেরাটনের মোড়ে কলিম আর ফুলিরে পামু। অরা ফুল বেচতাছে। সবাই মিইলা আজকা তোর জন্মদিন জন্মদিন খেলুম।

গ্যারাজ বন্ধ হইতে যে আরও ঘণ্টা খানেক লাগব?

আরে, পিশাব করার কথা কইয়া বাইরায়া পড়। আমি ওই মাথায় আছি। তুই আইলে একলগে দৌড় দিমু।

শাকিবের আইডিয়াটা মন্দ লাগে না। মজার খেলা হবে। জন্মদিন জন্মদিন খেলা।

টুকু গিয়ে সোনারগাঁওয়ের মোড়ে অপেক্ষা করে। ফাজিল শাকিবটা আসে না কেন? সে একটা সিগারেটের খালি প্যাকেট তুলে ফোন করে, হ্যালো শাকিব খান, তাড়াতাড়ি কর ব্যাটা। ওই দিকে তো অপু বিশ্বাসরে মিশা সওদাগর ধইরা নিয়া যায়।

এরপর তার আরও কতগুলো জরুরি ফোন কল আছে। সে সিগারেটের প্যাকেটটা কানে ধরে শাবানা, ফরিদ, কলিকে ফোন করে। রমনা পার্কের পুব গেটে থাকিস। আইজা শাকিবের জন্মদিন হইব।

নগেনের ফোনটা এনগেজড। কী যে কথা কয় নগেন সারা দিন—সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে ধরে তাকিয়ে টুকু বিড়বিড় করে।

একটু পরে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসে শাকিব।

শাকিব বলে, কিরে, এতটা পথ হাইটা যাবি।

না না, গাড়িতে যামু।

টুকু তার চাকাটা নিয়ে আসে। তার একটা চাকা আছে। ছোটদের সাইকেলের রিং। সেটা সে কাঠি দিয়ে দারুণ চালাতে পারে।

সেই গাড়ি চালাতে চালাতে পনেরো মিনিটে তারা পৌঁছে যায় পরীবাগ মোড়। কলিম আর ফুলিকে পাওয়া যায়। তাদের হাতে দোলনচাঁপার গুচ্ছ।

টুকু বলে, পার্কে চল কলিম, চল ফুলি, শাকিবের জন্মদিন করুম। খাড়া, ফুলগুলা ওই চাচিরে দিয়া আহি। আইজ আর ফুল বেচুম না, ফুলি এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়। একটু পরে ফিরে আসে, আমারে ছাড়তে চায় না, আমি কইছি আইজ শাকিব খানের জন্মদিন, আইজ আর ফুল বেচুম না।

পার্কে গিয়ে শাবানা, ফরিদকে পাওয়া যায়। নগেনকে পাওয়াই যায় না। কলি একটা জগ আর গেলাস হাতে একটু পরে আসে। পার্কে বেড়াতে আসা লোকজনের কাছে সে পানি বিক্রি করে।

আইডিয়াটা দারুণ। টুকুর হাতে শাকিব খানের জন্মদিনের কাগজটা দেখে সবাই একমত হয়।

আমাদের শাকিবের জন্মদিনের পার্টিটা এখানে ওই বটগাছের বাঁধানো চত্বরের কাছেই করতে হবে।

শাবানা হবে শাকিবের মা।

কলিম হবে শাকিবের বাবা।

কলি হবে ছোটবেলার অপু বিশ্বাস।

বাকিরা সবাই বন্ধু।

শাকিবের মাথায় একটা মুকুট দিতে হবে।

বটগাছে উঠে পড়ে টুকু। ফরিদও ওঠে। তারা পাতা ছেঁড়ে অনেকগুলো।

ফুলি একটা পাতা ঝাড়ু দেওয়ার ঝাঁটা নিয়ে আসে। তার কাঠি কয়েকটা ভেঙে পাতা গেঁথে গেঁথে মুকুট তৈরি হয়।

কিন্তু কেক কই পামু? শাবানা জিগ্যেস করে।

টুকু বলে, তুই শাকিব খানের মা। তুই ক। কেক কই পামু।

খাড়া। ওই যে, ওইখানে মাটির ঢিবি আছে। গাছের চারা লাগানোর লাইগা গর্ত করছে। ভালা মাটি।

ওইটা দিয়া আমি কেক বানাইতে পারুম।

শাবানা দৌড়ায়। পেছনে পেছনে দৌড়ায় কলি।

মাটি নিয়ে আসে তারা একটা কুড়িয়ে পাওয়া বিরিয়ানির প্যাকেট ভরে।

সেই প্যাকেটে মাটি ভরে ঠেসে প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেললেই একটা কেকের আকার দাঁড়িয়ে যায়।

তার ওপর পত্রিকার পাতার ওই লেখাটা—আজ শাকিব খানের জন্মদিন—ভাঁজ করে তারা রেখে দেয়।

কেক প্রস্তুত। এবার কাটা হবে। ছুরির জন্য একটা কাঠের টুকরাও জোগাড় হয়ে যায়।

এমন সময় ছুটে আসে পার্কের গার্ড। তার পরনে খাকি পোশাক। হেই পোলাপান, বটগাছের বাঁধানো জায়গাটা নোংরা করতাছস কেন? ভাগ তোরা।

আপনের কী? আমরা নোংরা করি না, ঝাড়ু দিয়া পরিষ্কার করি। আপনে ভাগেন। ফুলি জবাব দেয়।

কী কস? মাইরা ৩২টা দাঁত ফালায় দিব।

আমার দাঁত মাত্র ২২টা। বাকি ১০টা কি নিজের দাঁত তুলবেন?

গার্ড খেপে যায়। ফুলির চুলের মুঠি ধরে ফেলে হাতে।

সে চিৎকার করে ওঠে। বাকিরাও একযোগে চিৎকার করে—ছাইড়া দেন, ছাইড়া দেন, নাইলে আধলা ইট দিয়া মাথা ফাটায় ফালামু।

চেঁচামেচি দেখে একজন তরুণী ছুটে আসেন।

তিনি বলেন, কী হয়েছে, কী হয়েছে?

ওরা বলে, দেখেন না, আমরা জন্মদিন করুম, এই গার্ড ব্যাটা আমগো জন্মদিন করতে দেয় না।

তরুণীটা তাদের আয়োজনের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসেন। বলেন, গার্ড ভাইয়া, আপনি ওকে ছেড়ে দিন। শুনুন, বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলবেন না। আপনি যদি হাত না সরান, আমি মোবাইল ফোনে আপনার এই অপকর্ম ভিডিও করব। তারপর ইউটিউবে দিয়ে দেব। তারপর আপনার জেল হয়ে যাবে।

গার্ড ছেড়ে দেন ফুলিকে। অরা দেখেন না মাটি দিয়া বাঁধানো বেদিটা নোংরা করতাছে।

আমরা করি না, আমরাই তো ঝাড়ু দিই। আরে ক পার্ক ঝাড়ু দিয়া পাতা আর কাগজ টুকায়া লইয়া যায়, কন?

আচ্ছা তোমরা জন্মদিন করো। আমি তোমাদের খেলাটা ভিডিও করি।

শাকিবের মাথায় পাতার মুকুট। তার মা শাবানা তার পাশে। অপু বিশ্বাস সেজেছে কলি। সে লিপস্টিক দিচ্ছে ঠোঁটে। সত্যিকারের লিপস্টিক।

শাকিব কেক কাটে। তারা সবাই গান ধরে, হ্যাপি বাদ দে টু ইউ।

মোবাইল আপা ভিডিও করেন।

***

এক সপ্তাহ পরের কথা। ভিডিওটা ইউটিউবে দেওয়া হয়েছে। এক লাখ বার শেয়ার হয়েছে।

গভীর রাত। শাকিব ঘুমিয়ে আছে তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। পাশে ঘুমিয়ে আছে টুকু।

টর্চের আলোয় তাদের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তারা দেখে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাকিব খান। টুকু বলে, দুরো শালা, স্বপ্ন দেখার টাইম আছে? ঘুমামু না শান্তিমতো?

শাকিব বলে, আরে আমিই তো শাকিব খান, আপনে আবার কেডা?

তারা আবার চোখ বন্ধ করে।

তখন একজন কিশোর তাদের ধাক্কা দেয়—আমরা কিশোর আলো থেকে এসেছি। সঙ্গে করে এনেছি তোমাদের প্রিয় শাকিব খানকে। সবাই চিনে ফেলবে বলে শাকিব খানকে এত রাতে আনতে হয়েছে। তোমরা ওঠো। শাকিব খান তোমাদের নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটবেন। আমরা এখন এফডিসি যাব।