আমার কাজটাই হলো যেটা তুঙ্গে ওঠে, সেটা ছেড়ে দেওয়া — রকিব হাসান

বাংলাদেশের বইপড়ুয়াদের একটি বড় অংশের কৈশোরের নিত্যসঙ্গী তিন গোয়েন্দা। জননন্দিত এ সিরিজের স্রষ্টা রকিব হাসান। তাঁর জন্ম ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর; কুমিল্লায়। তবে বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ছেলেবেলা কেটেছে ফেনীতে। ফেনী থেকেই স্কুলজীবন শেষ করে তিনি ভর্তি হন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিয়মমতো যোগ দিয়েছিলেন চাকরিতেই। কিন্তু কোথাও মন টেকেনি বেশি দিন। তাই একে একে বদলেছেন বেশ কটা চাকরি। অনেক চেষ্টার পরও অফিসের বাঁধাধরা নয়টা-ছয়টার ঘড়ির কাঁটায় আটকে থাকতে পারেননি। অবশেষে সব ছেড়েছুড়ে লেখালেখি শুরু করলেন একদিন। লেখক সত্তার সঙ্গেই নিজের অচ্ছেদ্য বন্ধন টের পেলেন। তারপর তো লেখালেখিকে বেছে নিলেন পেশা হিসেবে। হলেন পুরোদস্তুর লেখক। আজ কয়েক প্রজন্মের পাঠকের কাছে জনপ্রিয় তিনি। লেখালেখির শুরুটা সেবা প্রকাশনীতে। নামে-বেনামে লিখেছেন চার শতাধিক বই। বিশ্বসেরা ক্লাসিক বইয়ের অনুবাদ দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। একে একে লিখেছেন টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ অসংখ্য জনপ্রিয় বই। তারপরও শুধু তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা হিসেবেই অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছেন এই ভীষণ প্রচারবিমুখ মানুষটি। তিন গোয়েন্দার ৩০ বছর পূর্তিতে অবশেষে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছেন কিআ দলের কাছে। প্রথমবারের মতো দিয়েছেন সুদীর্ঘ সাক্ষৎকার। এতে উঠে এসেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর, লেখালেখির আদ্যোপান্ত, সেবা প্রকাশনীর দিনগুলো আর বর্তমান জীবনযাপনসহ নানা বিষয়। সাক্ষাৎকার দলে ছিল শেরেবাংলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাশরাবা আহমেদ চৌধুরী, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাহাতাব রশীদ, ঢাকা সিটি কলেজের মারজুকা আহমেদ চৌধুরী, মতিঝিল মডেল হাইস্কুল ও কলেজের সাবেরা আক্তার এবং নটর ডেম কলেজের অংকন ঘোষ দস্তিদার। সঙ্গে ছিলেন আনিসুল হক, সিমু নাসের, আদনান মুকিতমহিতুল আলম। কিআ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সাক্ষাৎকারের ছবি তুলেছেন কবির হোসেন

প্রশ্ন :

জাফর চৌধুরী, আবু সাঈদ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করে আপনি লিখেছেন, ‘রকিব হাসান’ নামটাও ছদ্মনাম নয়তো?

না। তবে জোড়া দেওয়া বানানো নাম।

প্রশ্ন :

বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করার কারণ কী?

তিন গোয়েন্দা যখন জনপ্রিয় হয়ে গেল, তখন আমার মনে হলো এটা কি রকিব হাসানের নামে জনপ্রিয় হয়েছে, নাকি লেখার কারণে? সে জন্য আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলাম যে অন্য নামে লিখলে সেই বই জনপ্রিয় হয় কিনা।

প্রশ্ন :

এর ফলাফলটা কী হয়েছিল?

সফল।

প্রশ্ন :

আবু সাঈদ ছদ্মনামে আপনার লেখা গোয়েন্দা রাজুও তো কিশোরদের বই ছিল? আর জাফর চৌধুরী নামে রোমহর্ষক...

হ্যাঁ। ১৬টা বই বের হয়েছিল গোয়েন্দা রাজু সিরিজের। ওই যে মামার মন খারাপ, চকলেট রহস্য, দামি কুকুর...ইত্যাদি। রোমহর্ষকের ছিল যাও এখান থেকে, নরবলি, পাগলা ঘন্টি, অভিশপ্ত ছুরি...ওই বইগুলো ছিল জাফর চৌধুরী নামে, মোট বই বেরিয়েছিল ১১টা। এটার আরও একটা কারণ ছিল। তিনটা ভাগ করা—একটা হচ্ছে বেশি ছোটদের। এই ধরো থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত। তিন গোয়েন্দা সিরিজটা হচ্ছে ফাইভ থেকে নাইন-টেন পর্যন্ত। আর রোমহর্ষকটা নাইন থেকে ইন্টার পর্যন্ত।

প্রশ্ন :

রকিব হাসান—লেখালেখির শুরুটাও কি এই নামেই ছিল?

না। রকিব হাসান নামটা আমার ছদ্মনাম না, আগেই বলেছি, কিন্তু নামটা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে একটা মজার ঘটনা আছে। আমার সার্টিফিকেট নামটা বিশাল। আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব—পাঁচটা নামের সমাহার। আমার আর ভাই নেই, সে জন্য বাবার মনে হলো পাঁচটা নাম, পাঁচটা ছেলে বানাই! (হাসি) ওই পাঁচটার পরেও হয়তো আরেকটা রাখার দরকার ছিল, সে জন্য আমাকে মাঝে মাঝে ‘হাসান’ নামে ডাকত। আমি শামসুদ্দীন নওয়াব নামে বই লিখেছি, কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেও বই লিখেছি। কিন্তু আমার নামে প্রথম যে বইটা বের হয়, সেটা ছিল অনুবাদ, জঙ্গল, ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের একটা শিকার কাহিনি। সে বইটা আমি লিখলাম আবদুর রকিব নামে। সে সময় বিখ্যাত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী প্রচ্ছদ করতে নিলেন; নামটা তাঁর পছন্দ হলো না। উনি বললেন, ‘তা তোমার এতগুলা নাম, আরেকটা নাম নেই? জোগাড় করতে পারো না?’ বললাম যে, আমার বাবা মাঝেমধ্যে হাসান নামেও ডাকত। উনি ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। যাওয়ার তিন দিন পর সেবায় গেলাম, কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ডেকে পাঠালেন। বললেন আপনার প্রচ্ছদ তৈরি হয়েছে। তখন আমরা প্রায়ই কাজী সাহেবের অফিসে আড্ডা দিতাম। তো শাহাদত চৌধুরী প্রচ্ছদটা বের করলেন। সুন্দর একটা ছবি। তার ওপর লিখলেন ‘রকিব হাসান’। অর্থাৎ রকিবের সঙ্গে ডাকনাম হাসান যুক্ত করে বললেন, ‘এখন কেমন হয়েছে দেখো তো?’ আমি বললাম, আচ্ছা রেখে দেন। যদিও মনে হয়েছে আবদুর রকিব রাখলে কী হতো? হয়তো তিন-চারটা বইয়ের পরে আবদুর রকিব নামটাই জনপ্রিয় হয়ে যেত। কারণ শুরুতে যখন হুমায়ূন আহমেদ নামটা দেখলাম, তখন সাদামাটা মনে হয়েছিল। এখন মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ সত্যিই একটা ছান্দিক নাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক—সবই কিন্তু সাধারণ নাম। কিন্তু এখন? যা হোক, আমি আর আপত্তি করিনি। রকিব হাসান নামেই বইটা হিট হয়ে গেল। আর কিছু করার থাকল না আমার। দ্বিতীয় বইও বের হয়ে গেল, ড্রাকুলা—সুপারহিট!

প্রশ্ন :

সেবা প্রকাশনীতে কীভাবে এলেন?

আমার ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালো লাগে। মানে বই পড়তে ভালো লাগে না শুধু, ছাপার অক্ষর এতই পছন্দ, রাস্তায় যদি ঠোঙা পড়ে থাকত, সেটাও তুলে নিয়ে পড়তাম। ওর মধ্যে কী লেখা আছে সেটা মূল কথা না, ছাপার অক্ষরটাই আসল। পড়তে পড়তেই বড় হলাম, তো দেখলাম বাংলা বইয়ের সংগ্রহ আর তেমন নেই, বাংলা বই তেমন পাওয়া যেত না আমার সময়ে। আমার তখনকার সম্বল ছিল ভারত থেকে আসা বই, সেগুলোও খুব একটা পাওয়া যেত না। যেগুলো যেত সেগুলো পড়ে পড়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম—শরৎচন্দ্র মুখস্থ, নীহাররঞ্জন মুখস্থ, যেটা পাই সেটা-ই মুখস্থ। দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন। আরও ছিল স্বপনকুমার সিরিজ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেনী শহরে থাকতাম তখন, ওখানে বই পাওয়াটা খুব কঠিন। তারপরেও একটা বড় সুবিধা ছিল যে আমাদের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বইয়ের ভক্ত। যার ফলে পাঠাগারটা ছিল অস্বাভাবিক সমৃদ্ধ। ইংরেজি এবং বাংলা বই সবই ছিল। আমি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র না, কাজেই উপন্যাস বোঝার মতো অবস্থা নেই। পড়ালেখার ইংরেজি আর উপন্যাসের ইংরেজি এক না। শিকারের গল্প আমার খুব প্রিয়। জিম করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতার অনুবাদ পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। ক্লাস সিক্স বা সেভেনে। ও ভারত থেকে বই আনাত। বইটা অর্ধেক পড়ার পরেই ঘণ্টা পড়ে গেল—ছুটির ঘণ্টা। আমার বন্ধু, যেহেতু ওটা নতুন বই, সেটা আমাকে দিল না। পরে দিবে বলে নিয়ে গেল এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে বইটা সে হারিয়ে ফেলল। ফলে রুদ্রপ্রয়াগের চিতা আমার কল্পনার যে জায়গাটাতে ছিল, ওই জায়গাতেই আটকা পড়ে রইল। পরে মূল ইংরেজি বইটা আমি পেলাম আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের পাঠাগারে। ওখান থেকে এনে পড়া শুরু করলাম। বারবার ডিকশনারি দেখতে হয়েছে, কিন্তু দেখলাম যে পারি। তখন থেকে ইংরেজি কাহিনি পড়তে লাগলাম। ইংরেজি বইয়ের দোকানে ঘুরতাম অনেক, পুরোনো বইয়ের দোকানে। ঢাকায় তখন অনেক পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল, এখনই বরং কমে গেছে। একদিন এক পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক বসে আছেন—খুব শুকনো একজন ভদ্রলোক। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, ঝাঁকড়া চুল মাথায়, সেগুলো ব্যাকব্রাশ করা, একটা কালো চশমা, একটা ইজিচেয়ারের মতো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বসে পা দোলাচ্ছেন আর গভীর মনোযোগের সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছেন একটার পর একটা। দোকানদার বলল, ‘অনেক নতুন বই আসছে।’ আমি দেখেটেখে বললাম, ‘ধুর! এগুলো সবই তো পুরোনো, আমার পড়া। নতুন বই তো তুমি কিছু আনো নাই।’ তখন ওই লোক সিগারেটটা সরিয়ে বললেন, ‘আপনি কী করেন?’ আমি বললাম, ‘আমি কিছু করি না।’ বললেন, ‘আপনি তো অনেক বইয়ের নাম জানেন।’ বললাম, ‘আমি পড়ি।’ তিনি বললেন, ‘আপনি কি মাসুদ রানা পড়েছেন?’ বললাম, ‘পড়েছি।’ তিনি বললেন, ‘কেমন লাগে আপনার?’ বললাম ‘কাজী আনোয়ার হোসেন আমার খুব প্রিয় মানুষ হয়ে গেছেন মাসুদ রানার কারণে।’ বললেন, ‘এগুলো তো বিদেশি বই থেকে লেখা হয়, সেটা জানেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, জানি।’ বললেন, ‘বইয়ের প্লট কী করে জোগাড় করতে হয় সেটা জানেন?’ বললাম, ‘জানি না।’ উনি বললেন, ‘আমরা ইংরেজি বই পড়ে বিদেশি বইয়ের ছায়া অবলম্বনে বই লিখি। আপনার তো অনেক বই পড়া আছে, আপনি এমন এমন সব লেখকের নাম বললেন যেগুলো আমি জানিও না!’ আমি বললাম, ‘আপনাকে তো চিনলাম না।’ দোকানদার তখন পরিচয় করিয়ে দিল, ‘উনি শেখ আবদুল হাকিম।’ তখন আমি বললাম, ‘ও, আপনিই শেখ আবদুল হাকিম! আপনিই কাজী সাহেবের ছদ্মনামে মাসুদ রানা লেখেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘সে জন্যই তো ইংরেজি বইয়ের খোঁজ চাচ্ছি। আপনি যেগুলোর নাম বললেন, সেগুলো তো আমার চেনা না। অজানা, অনেক নাম। এগুলোর মধ্যে কি মাসুদ রানার প্লট আছে?’ আমি বললাম, ‘প্লট তো আছেই।’ বললেন, ‘আপনি প্লট দিতে পারবেন?’ আমি বললাম, ‘পারব। অনেক প্লটই দিতে পারব।’ তিনি বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হলো না।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” তিনি বললেন, ‘আমরা প্লট খুঁজে খুঁজে হদ্দ, বই-ই পাই না।’ আমি বললাম, ‘আপনি তো অনেক বইয়ের লেখকের নামই জানেন না। আপনি প্লট পাবেন কোথায়?’ তখন আমি একটু রুক্ষ স্বভাবের ছিলাম। বয়স অনেক কম। হাকিম সাহেব পা দুলিয়ে সিগারেট খাচ্ছেন, ওই জিনিসটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কারণ, আমি সিগারেট খাই না। ধোঁয়া ছাড়ছেন, সেটা আমার নাকে লাগছে, হাত দিয়ে থাবা মেরে সেই ধোঁয়া সরাতে হচ্ছে, তাতে আমি রেগে গিয়েছিলাম তাঁর ওপরে। তারপরে উনি সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘বলেন তো কয়েকটা ইংরেজি বইয়ের নাম?’ বললাম। হাকিম সাহেব দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কি ওসব বই আছে?’ দোকানদার বলল, ‘না, এখানে নেই।’ হাকিম আমাকে বললেন, ‘আপনি কি তাহলে আগামী শুক্রবার সেবা প্রকাশনীতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন? আমি কাজী সাহেবকে বলে রাখব। দুইটা মাসুদ রানার প্লট নিয়ে দেখা করতে পারবেন?’ বললাম, ‘পারব। দুইটা না, দশটা নিয়ে দেখা করব।’

আমি দশটাও না, বারোটা নিয়ে দেখা করেছিলাম। কাজী সাহেবকে দেখেই আমার পছন্দ হলো। শেখ আবদুল হাকিমও খুব ভালো মানুষ, পরে যখন রহস্য পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গেছি, তখন বুঝলাম আমিই হচ্ছি এই পুরো দলটার মধ্যে বাজে লোক (হাসি)। এঁরা সবাই অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, আমি দুর্বিনীত। সবার মধ্যে বয়সও কম আমার। ২৭ বছর।

হাকিমের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, অথচ শুক্রবার দিন যেতেও ইচ্ছে করছে। কারণ সেবা প্রকাশনী—কাজী আনোয়ার হোসেন থাকেন—এমন একটা জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব! শেষ পর্যন্ত যা থাকে কপালে ভেবে বারোটা বই ব্যাগের মধ্যে নিয়ে গেলাম। কাজী সাহেবের অফিসটা তখন একটা টিনের বাড়ি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমি উঁকি দিলাম। উঁকি দিয়ে দেখি একজন ভীষণ কট্টর মেজাজের লোক বসে বসে লিখছে। কাজী সাহেবের হিসাবরক্ষক। সালাম দিলাম, তাকালেন না। খুব ভয়ে ভয়েই ‘এই যে ভাই’ বললাম, একটু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বললাম, ‘শেখ আবদুল হাকিম সাহেব কি এসেছেন?’ খুব রুক্ষভাবে মুখ ভেংচে তিনি বললেন, ‘কত লোক যে আজ হাকিম সাহেবকে খুঁজল!’ আমি বুঝলাম, আমার এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত, আর হবে না। এমন সময় ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে? নাম জিজ্ঞেস করুন।’ দেখলাম হিসাবরক্ষক সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতেই পারেননি কাজী সাহেব অন্য দরজা দিয়ে নিজের অফিস ঘরে ঢুকে বসে আছেন। হিসাবরক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কী নাম?’ বললাম, ‘রকিব।’ ভেতরের অফিস থেকে জবাব এল, ‘আসতে বলেন।’ ঢুকলাম। কাজী সাহেব বসে আছেন, বললেন, ‘হাকিম সাহেব চলে আসবেন এখনই।’ হাকিম সাহেব এলেন খানিক পরে। তাঁকে আমি ইংরেজি বইগুলো দিলাম। এ-ই হচ্ছে সেবা প্রকাশনীতে আমার ঢোকার গল্প। সম্ভবত সেটা ’৭৭-এর শেষ দিকে।

প্রশ্ন :

ওই দিন কি কোনো লেখার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?

পাঁচ-সাত দিন পরে কাজী সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেদিন বিকেলে দেখা করতে বললেন। ভাবলাম, কিছু অপমান-টপমান আছে কপালে। কারণ, বড় বড় কথা বলেছি তো! বয়স কম, আত্মবিশ্বাসের কিছুটা অভাব আছে। তারপরও হঠাৎ করে শক্ত হয়ে গেলাম। কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম, শাহাদত চৌধুরী, সাজ্জাদ কাদির, জ্ঞানে-গুণে বড় বড় সব মানুষ—আমার তাতে কী? আমার মতো ইংরেজি বই তো তাঁরা পড়েননি (হাসি)। সবাই আমার চেয়ে কম পড়ছেন। তখনো জানি না, ওঁরা কোনো অংশেই আমার চেয়ে কম পড়া মানুষ নন। আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত, বয়সে বড়, অভিজ্ঞ। আমি ভাবলাম, হতে পারেন কেউ বড় কবি, কেউ পত্রিকার সম্পাদক, কেউ লেখক; কিন্তু আমার মতো এত ইংরেজি থ্রিলার কেউ পড়েননি। এসব ভেবে নিজেকে বোঝালাম আরকি, সাহস সঞ্চয় করলাম। গেলে আর কী হবে? বড়জোর বলবেন, আপনার বই দিয়ে মাসুদ রানা হবে না। তখন চলে আসব।

তারপর গেলাম সেবায়। আমাকে বসতে বলা হলো। হাকিম শুরুতেই বললেন, ‘ভাই, এত পড়লেন কী করে? এত অল্প বয়সে?’ বললাম, ‘একটা বই পড়তে দু-তিন দিন লাগে, কত বই-ই তো পড়া যায়!’ তিনি বললেন, ‘আপনার বইগুলো প্রায় সবগুলোই হবে।’ কাজী সাহেব একটু নাটক করে বলতে চেয়েছিলেন, হাকিম তাঁকে সেটা করার সুযোগ দিলেন না, প্রথমেই আসল কথাটা ফাঁস করে দিলেন। আমি বললাম, ‘ওই দিন আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি দোকানে...’ বাধা দিয়ে হাকিম বললেন, ‘ধুর সাহেব, কবে ভুলে গেছি সে কথা! আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, এতগুলো মাসুদ রানা দিয়েছেন। আমি তো প্লট পাচ্ছিলাম না, লিখতে পারছিলাম না।’ তখন আমি চিন্তা করলাম পড়তে পারি, লিখতে অসুবিধে কী? আমি একটা মাসুদ রানা লিখব। একটা বই পড়লাম, খুব ভালো একটা বই ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো, এটা মাসুদ রানা হয়েই আছে। কাজী সাহেবকে গিয়ে বললেই হয়। তারপরে গিয়ে কাজী সাহেবকে বললাম যে এই বইটা মাসুদ রানা হয়। তিনি বললেন, ‘যেগুলো দিয়েছেন, ওগুলোর চেয়ে ভালো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, ওগুলোর চেয়ে ভালো।’ তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘এটা আগে না দিয়ে নিজে রেখে দিলেন কেন?’ বললাম, ‘হাতের কাছে যা পেয়েছি তা-ই নিয়ে ছুট দিয়েছিলাম।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘তো, লিখতে পারবেন?’ বললাম, ‘আমি পারব কি না আপনি বলেন।’ তিনি বললেন, ‘পারবেন।’ আমি বললাম, ‘কী করে বুঝলেন পারব?’ তিনি বললেন, ‘কারণ, আপনি পড়তে পারেন। লিখতে পারার মূলে হলো পড়া। আপনার বাংলাও পড়া আছে, ইংরেজিও পড়া আছে।’ সেই প্রথম একটা মাসুদ রানা লিখলাম। ভুল-ভাল হয়েছিল অনেক। কাজী সাহেব বইটা পড়লেন। পড়ে আবার ডেকে পাঠালেন। গেলাম এবার ভয়ে ভয়ে। পাণ্ডুলিপিটা আমার সামনে ছেড়ে দিলেন। দেখলাম যে অনেক লাল কালির দাগ, বানান ভুল, কাটাকুটি। ভাবলাম, আমাকে দিয়ে হবে না। উনি বললেন, ‘না, হবে। হয়েই আছে। খুব ভালো লিখেছেন।’ আমি একটু সাহস পেলাম। তিনি বললেন, ‘এই এই জিনিসগুলো একটু মেরামত করে নিয়ে আসেন। তারপর হাকিমকে দিয়ে সম্পাদনা করাব। সবশেষে আমি দেখব।’ সেসব করার পর বেরিয়ে গেল মাসুদ রানার বই। খুব সহজেই বলতে হবে। তখন সাহস পেয়ে গেলাম। বললাম এরপর কী লিখব? উনি বললেন, ‘মাসুদ রানা আর লিখতে যেয়েন না। কারণ এটা লিখতে অভিজ্ঞতা দরকার, অনেক কঠিন কাজ। আপনি সহজ কোনো কাজ দিয়ে শুরু করেন।’ পরে চিন্তা করলাম যে কী দিয়ে শুরু করতে পারি? জুল ভার্ন আমার খুব ভালো লাগত। বললাম যে জুল ভার্ন অনুবাদ করলে কি চলবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চলতে পারে। আপনি চেষ্টা করেন।’ বললাম, ‘মাসুদ রানা তো লিখলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে, জুল ভার্ন-এর অনুবাদটায় কী হবে?’ হাকিম আমাকে সাবধান করল, ‘রকিব! খবরদার! নিজের নামে লিখতে যেয়েন না! কাজী সাহেবকে রাজি করান। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে অনুবাদ করেন।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল, ‘ওই নামে লিখলে ভুল হলেও বই চলবে।’ (হাসি) তো কাজী সাহেব বললেন, ‘না, জুল ভার্ন-এর অনুবাদ ওর নিজের নামেই বের হবে। আপনার সাহস নাই। যদি ওর সাহস থাকে লিখুক।’ আমি কিন্তু আমার নামে লিখতে রাজি আছি। কিন্তু হাকিম আমাকে কিছুতেই ছাড় দিল না। তারপর কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, একটা ছদ্মনামে লিখেন, শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লিখেন।’ শামসুদ্দীন নওয়াব হচ্ছে কাজী সাহেবেরই আরেক নাম। তখন থেকেই শুরু হলো অনুবাদ। প্রথম অনুবাদ করলাম শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে পাতাল অভিযান, তারপর সাগরতলে, তারও পর রহস্যের খোঁজে। তিনটা লিখলাম, এর মধ্যে একদিন সাজ্জাদ কাদির এনে হাজির করলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে একটা বই। সাজ্জাদ কাদির খুব প্রশংসা করতে লাগলেন বইটার। বললেন, অসাধারণ সব গল্প আছে। আমি বইটা পড়িনি। উল্টেপাল্টে দেখলাম। বললাম, ‘এ তো পড়ি নাই।’ সাজ্জাদ হো হো করে হাসলেন। বললেন, ‘রকিব পড়ে নাই, এমন বই আমরা পড়েছি! তো রকিব, কী করবা?’ আমি বললাম,‘এটা আমাকে দিয়ে দেন। আমি এটার অনুবাদ করব।’ তিনি বললেন, ‘এটা তো আমি অনুবাদ করব ভেবে কিনেছি। এই জন্যই কাজী সাহেবকে দেখাতে এনেছি।’ তিনি যে খেপাচ্ছেন আমাকে, উত্তেজনায় সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘না, এটা আমাকে দিয়ে দেন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কী করে বুঝলা এটা ভালো হবে?’ আমি বললাম, ‘ব্যাককাভার পড়েই বুঝেছি।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা এটা নিয়ে যান। দেখি, কী করে আনেন।’ করে আনলাম এবং ওইটাও শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে ছাপা হলো। এবং এটা হলো এখন পর্যন্ত আমার ছদ্মনামে লেখা সুপারহিট বইগুলোর একটা। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লেখা। তারপরই এল জঙ্গল! তখন আমার সাহস হয়ে গেছে। তখন আমি বলেছি, আমি আমার নামেই লিখব। হাকিমের বাধা আর মানলাম না। রকিব হাসানের জন্ম হলো। জঙ্গল হচ্ছে ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকারকাহিনি।

প্রশ্ন :

এটাই নিজের নামে প্রথম লেখা ছিল?

হ্যাঁ। দ্বিতীয় হলো ব্রাম স্ট্রোকারের বিখ্যাত বই ড্রাকুলা। ’আশির শেষ দিকে বেরিয়েছিল।

প্রশ্ন :

আপনার ছেলেবেলা কেটেছে ফেনী শহরে। তখনকার দিনগুলো কেমন ছিল?

স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না। পাঠ্যবই পড়তে ইচ্ছে করত না। পাঠ্যবইয়ের মধ্যে দ্রুতপঠন, আর বাংলা বইতে যেসব গল্প থাকত, সেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পড়ে শেষ করে ফেলতাম। স্কুলে যেতে ইচ্ছে না করলেও কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে স্কুলে যেতেই হতো। আব্বা চলে যেত অফিসে, আর মা ছিল ভীষণ কঠোর! কোনোভাবেই মাকে ফাঁকি দেওয়া যেত না, স্কুলে যেতেই হতো। আমার ভাই নেই। বোন তিনজন। একজন বড়, আর দুজন ছোট। পাঠ্যবইয়ের ভেতর গল্পের বই লুকিয়ে নিয়ে পড়তাম, এখনকার বাচ্চারা যা করে, এই যে (দেখিয়ে) এভাবে। (হাসি)। মায়েরা যখন বাধা দেন, তখন সব কিশোর পাঠকেরাই বোধ হয় এই কাজটা করে।

প্রশ্ন :

তখন লেখালেখি করতেন?

লেখালেখি তখনো শুরু করিনি। সে সময় নীহাররঞ্জনের কালো ভ্রমর খুব জনপ্রিয় বই ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো, দারুণ তো! দস্যু বাহরাম পড়ি, টারজান পড়ি আর নানা রকম কল্পনা তৈরি হয় মগজে, লিখতে ইচ্ছে করে। বাহরামের অনুকরণে একটা দস্যু সিরিজ লেখার খুব ইচ্ছে হলো। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একটা বই লিখে ফেলে নাম দিলাম ডাকু মনসুর। দ্বিতীয় বইটা আর লেখা হয়নি। পাণ্ডুলিপিটা আমার এক বন্ধু পড়ে বলল, ‘দারুণ লেখছস।’ বলল ঠিকই, কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে সে হারিয়েও ফেলল। বইটা আর প্রকাশিত হয়নি। যাহোক, ক্লাস এইটে উঠেও পাঠ্যবই পড়তে চাইতাম না। স্কুলে যেতাম, টিচারের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তবে হোমওয়ার্ক করতাম, না হলে পিটুনি খাওয়া লাগত। কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। মা অনেক কঠোর হলো। পরীক্ষার আগে ৭ দিন পড়ে নিলাম, ভালোমতো। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। একবার ক্লাস ফাইভে বোধ হয় না পড়েও ফার্স্ট হয়ে গিয়েছিলাম। যাহোক, না পড়েও মোটামুটি পাস করলাম এইটেও। এখনকার মায়েরা স্কুলে নিয়ে যান, সারাক্ষণ কড়া নজর রাখেন, তখন তো ওসব ছিল না, মায়েরা খালি দেখতেন ছেলে ঠিকমতো পড়তে বসছে কি না। আর ঠিকমতো স্কুলে গেল কি না। আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমি কী পড়লাম, কী লিখলাম, অত তদন্তের মধ্যে যেত না মা। আর আব্বা খেয়ালই দিত না। আব্বার মত হচ্ছে স্বাধীনভাবে বড় হবে—পড়লে পড়ল, না পড়লে নাই। ছেলে হয়ে জন্মেছে যখন, কিছু তো একটা হবেই, চোর-ডাকাত কিংবা খারাপ মানুষ না হলেই হলো।

প্রশ্ন :

আব্বা কী করতেন?

সরকারি চাকরি করতেন। উনি নিজেও পাঠক। আমি স্কুল থেকে কোনো বই আনলে সেটা কেড়ে নিয়ে পড়তেন। যখন তাঁর আঙুলে ধরে বাজারে যাওয়া শিখলাম, তখন একদিন বলেছিলাম, ‘আপনি লেখাপড়া কতখানি করেছেন?’ আব্বা বললেন, ‘যা করেছি, তোর মতোই।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি স্কুল ফাঁকি দিতেন?’ আব্বা হেসে জবাব দিলেন, ‘আমারও স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না, কিন্তু বাবা সব সময় একটা কঞ্চি রাখত। তোর বাপের মতো অত সহজ বাপ ছিল না সে! মা কিছু বলত না, কিন্তু বাবা কঞ্চির বাড়ি দিত, কাজেই আমাকে স্কুলে গিয়ে পড়তে হতো।’ আমার আব্বার এসব স্বাধীনতা দেওয়া আমাকে খারাপ বানায়নি, বরং বড় হয়ে আমার কাজে লেগেছে। মায়ের কঠোরতাটাও কাজে লেগেছে। না হলে আমি যা ছিলাম, এসএসসিও পাস করতাম না। তবে এখন বাচ্চাদের ওপর অভিভাবকেরা পড়ালেখার যে চাপ দেন, সেটা ভয়ংকর। বাচ্চাগুলোর জন্য কষ্ট হয়। প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিয়ে...এই পাও-ওই পাও-জিপিএ পাও-এটাতে ভর্তি হও-ওটাতে... এত্ত বেশি চাপ, রীতিমতো নির্যাতন। এ ধরনের কথা সম্ভবত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাক্ষাৎকারেও পড়েছি, বোধ হয় তোমাদের কিশোর আলোতেই।

প্রশ্ন :

আপনার স্কুলের কোনো মজার ঘটনা মনে পড়ে?

স্কুলে আমার উর্দু ক্লাস করতে ইচ্ছে করত না। মনে হতো, কী হবে উর্দু শিখে। ফাঁকি দেওয়ার চিন্তা করতে লাগলাম। উর্দু ক্লাসে টুপি পরতে হতো। উর্দু শিক্ষককে আমরা বলতাম ছোট হুজুর। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হতো, উর্দু একটা মহাপবিত্র ভাষা, শেখার সময় টুপি না পরলে অপবিত্র হয়ে যাবে। একদিন দেখলাম, ছোট হুজুর সামনের বেঞ্চে বসা একটা ছেলেকে ধরলেন, তার মাথায় টুপি নেই। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাই তোর টুপি কই?’ ছেলেটা বলল, ‘হুজুর, আনতে ভুলে গেছি।’ ছেলেটার কান ধরে হুজুর বললেন, ‘বাইর হ।’ সোজা বের করে দিলেন। মানে টুপি মাথায় না থাকলে উর্দু ক্লাসে থাকা যাবে না। বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। আমার টুপিটা বের করে মাথায় দিতে গিয়েও দিলাম না, পকেটে রেখে দিয়ে খুব নিরীহ ভঙ্গিতে বসে রইলাম। ‘অ্যাই, তোর মাথায় টুপি নাই কেন?’ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন হুজুর। বললাম, ‘হুজুর, আনতে ভুলে গেছি।’ আমারও কান ধরে বললেন, ‘বাইর হ!’ পেয়ে গেলাম সুযোগ। তখন থেকে যেদিনই হুজুরের ক্লাস থাকত, টুপি পরতাম না। তারপরে একদিন হুজুর ধরে ফেললেন ফাঁকিটা। বললেন, ‘অ্যাই, জাতীয় সংগীতের সময় আমি তোর মাথায় টুপি দেখছি! ক্লাস ফাঁকি দিস, না?’ (হাসি)।

প্রশ্ন :

আপনি বাবার চাকরির জন্য ফেনীতে থাকতেন, নাকি বাড়ি ছিল ওখানে?

বাবার চাকরির জন্য। বাড়ি, মানে জন্ম কুমিল্লায়।

প্রশ্ন :

কত সালে?

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বরে জন্ম। এখানে সার্টিফিকেটের একটা সমস্যা আছে। আমাকে আব্বা বাসায় পড়াতেন। একদম ছোটবেলা থেকে। একদিন ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, ‘একে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেন।’ সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ‘না, আগে ওয়ানে ভর্তি করানো নিয়ম।’ আব্বা বললেন, ‘না, আপনি দেখেন, ও পারবে। ক্লাস ফোরেরগুলোও পারবে।’ সুপারিনটেনডেন্ট দেখলেন আমি সত্যিই ক্লাস ফোরের পড়াও পারি। আমাকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করা হলো। সে জন্য আমার বয়সের তুলনায় ক্লাস এগিয়ে গেল। বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী এসএসসি দিতে সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়স হতে হতো তখন। সে জন্য এসএসসির আগে বয়সটা ইচ্ছে করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন :

চারদিকে তো অনেক পেশা। বৈমানিক কিংবা ০০৭! ছোটবেলায় আপনি কী হতে চাইতেন?

আমি মনে হয় লেখকই হতে চেয়েছি। এর বাইরে কোনো কিছুতে আমার কোনো আকর্ষণ নেই। অনেক কাজেরই সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু যাইনি। যে চাকরিগুলোর কথা বলছি, ওগুলোর কোনোটাই কিন্তু ফেলনা ছিল না। তবু ঘরে বসে বেকুবের মতো লিখে যাওয়াতেই মন সায় দিচ্ছিল আমার।

প্রশ্ন :

আপনি কখনো অন্য কোনো পেশায় ছিলেন?

১২-১৩টা চাকরিতে ঢুকেছি, কোনোটার মেয়াদ ৮ ঘণ্টা, কোনোটা ২০ ঘণ্টা, কোনটা ১২ ঘণ্টা, কোনোটা ১০ দিন! (হাসি) ওইসব করে-টরে আমি বুঝলাম বসের ঝাড়ি আমার সহ্য হবে না, নিয়মিত অফিসে যাওয়া আমাকে দিয়ে হবে না, স্যার বলতে আমি পারব না, সালাম দিতে পারব না। আমি স্বাধীন টাইপের মানুষ, স্বাধীনভাবে থাকাই ভালো। তাতে টাকা কামাই হলে হোক, না হলে নাই।

প্রশ্ন :

সেবা প্রকাশনীর রহস্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। ওটা তো একধরনের চাকরি...

না, চাকরি ছিল না। আমিই কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম যে রহস্য পত্রিকা বের করেন আবার, একটা আড্ডাবাজি করা যাক। কারণ, খালি বই লিখতে লিখতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম; যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সবাই অফিস যায়, ছাতা মাথায় দেয়, বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে যায়। আমরা কোথাও যেতে পারি না। খালি ঘরে বসে বসে বই লেখা, টাইপরাইটারে। এমন কিছুর একটা ব্যবস্থা করেন যাতে একটু আড্ডাবাজির ব্যবস্থা করা যায়। আমি বললাম, রহস্য পত্রিকাটা আবার চালু করলে একটা সুবিধা হবে; রহস্য পত্রিকায় অনেক মানুষ আসবে, অনেক মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা হবে, আড্ডাবাজি হবে, চা খাওয়া হবে, লেখালেখি হবে, ওরা লেখাগুলো আনবে, সেগুলো কাটাকাটি হবে, একটা বৈচিত্র্য হবে। সেই সঙ্গে যদি রহস্য পত্রিকার কাজটা করে দিই, তাহলে আপনার ব্যবসা হবে। ব্যবসা হলে আমাদের চা খাওয়া, আসা-যাওয়ার খরচাপাতিটা দিয়ে দেবেন। তাহলেই তো আমাদের হয়ে গেল।’ বললেন, ‘আচ্ছা, আমি ভেবে দেখব।’ পাঁচ-সাত দিন পর বললেন, ‘আমি ঠিক করেছি, রহস্য পত্রিকা আবার বের করব।’ প্রথমে আমাদের যাওয়ার কোনো বিধিনিষেধ ছিল না, সবাই মোটামুটি সন্ধ্যাটাকে বেছে নিলাম এবং যার যার মতো যেতাম-আসতাম। কারণ বাঁধাধরা নিয়ম কাজী সাহেব নিজেও পছন্দ করেন না। উনি নিজেও তো চাকরি করেননি। পুরো স্বাধীনতা আর আড্ডাবাজির মধ্যে পত্রিকাটা বের হতো। তবে যেই মুহূর্তে এটা পেশাদার হয়ে উঠতে লাগল; মানে বিক্রি বাড়তে লাগল, পয়সা আসতে লাগল অনেক বেশি, আমাদেরও বেতন বাড়তে লাগল, আমি ছেড়ে দিলাম। মানে আমার কাজটাই হলো যেটা তুঙ্গে ওঠে, সেটা ছেড়ে দেওয়া (হাসি)। কারণ, সেটা তখন আমার জন্য ফাঁদ হয়ে যায়। স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ মানেই আমি ছেড়ে দেব।

প্রশ্ন :

সব সময় তো এত রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখেন। কখনো কি মনে হয়েছে নিজেও এসব অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়বেন?

হুমায়ূন আহমেদের একটা বই-ই আমি পড়েছিলাম সে সময়, নাম দারুচিনি দ্বীপ। এক ঝড়ের দিন সকালে বইটা পাওয়ায় পড়তে শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ যে কী জিনিস, এটা তখনো বুঝিনি। আমাকে শেষ করিয়ে ছাড়লেন। আমার অনেক কাজ তখন। দারুচিনি দ্বীপ পড়ে মনে হলো, তিনিও লেখক, আমিও লিখি। বয়স সমানই দুজনের। হুমায়ুন আহমেদ যদি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে পারেন, গিয়ে বাড়ি বানাতে পারেন, আমার সেখানে যেতে অসুবিধাটা কোথায়? আমি ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম টেকনাফ। ওই সময়টাতে শান্তিবাহিনীর সমস্যা, টেকনাফে রোহিঙ্গা। সম্রাট হোটেল নামে একটা হোটেল ছিল। হোটেল ম্যানেজার আমাকে দেখে বললেন, ‘আপনি এই ঝড়ের মধ্যে সেন্ট মার্টিন যাবেন?’ আমি বললাম, ‘আমাকে নিয়ে যেতে পারলে যাব।’ তিনি আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। জানালাম। সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা হোটেলের ম্যানেজার তিনি, লাফ দিয়ে উঠলেন, ‘আপনি তিন গোয়েন্দার লেখক না তো?’ বললাম,‘হ্যাঁ, আমি তিন গোয়েন্দারই লেখক।’ উনি বললেন, ‘আমার দুই মেয়ে তিন গোয়েন্দার অন্ধ ভক্ত।’ এরপরে আর আমাকে কিছু করতে হলো না। বেয়ারাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘ব্যাগ-ট্যাগ যা আছে সব নিয়ে যাও। খাবার দাও, হাত-মুখ ধোয়ার জায়গা দাও।’ তারপরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি সত্যিই যেতে চান?’ আমি বললাম, ‘হুমায়ূন আহমেদ যাননি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, গিয়েছেন।’ বললাম, ‘আমিও যাব।’ তারপর তিনি ট্রলারের মাঝিকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘এই ভদ্রলোক আমার লোক। তাঁকে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছানোর দায়িত্ব তোমার।’ পরদিন সকালে ঝড় থেমে গেল, হঠাৎ করে রোদ উঠল। ট্রলারের লোক আমাকে শুরুতে নিয়ে গেল টেকনাফের চায়নিজ মার্কেটে। দুই জোড়া রাবারের স্যান্ডেল, জালের দড়ির ব্যাগ, তার মধ্যে গামছা, কিছু কাপড়চোপড় আর একটা বিশেষ টুপি কেনাল আমাকে দিয়ে। বলল, আপনার ব্যাগ-ট্যাগ সঙ্গে করে ঢাকা থেকে যেগুলো নিয়ে আসছেন, ওগুলা লাগবে না, আপনি এগুলা রাখেন। তারপরে হাঁটা দিল ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। তখন ভাটার সময়। হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তারা আমাকে হাঁটাচ্ছে তো হাঁটাচ্ছে। বললাম, ‘আমি যাব সেন্ট মার্টিন, তোমরা আমাকে সুন্দরবনে ঢোকাচ্ছ কেন?’ মাঝি বলল, ‘চলেন!’ এ রকম করতে করতে বহুদূর নিয়ে যাওয়ার পর নাফ নদী দেখা গেল। নাফ নদীর ঠিক মাঝখানে একটা ট্রলার। সেই ট্রলারটা এত পুরোনো, মনে হচ্ছে প্রাচীনকালের স্প্যানিশ জলদস্যুরা যেগুলো নিয়ে বের হতো, সে রকম কিছু। একটা ডিঙি নৌকা করে সেখানে পৌঁছার পর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় মনে হলো স্প্যানিশ জলদস্যুদের জাহাজেই উঠেছি। ছোটবেলায় আমার টারজান হওয়ার, স্প্যানিশ জলদস্যু হওয়ার শখ ছিল।

যাচ্ছি আর ভাবছি, সমুদ্র নেই কেন? ভটভট করে ট্রলার চলছে। যখন মোহনাতে পড়ল, তখন গিয়ে মনে হলো, যাক, এতক্ষণে সমুদ্র দেখা গেল। মোহনায় গিয়ে পড়ার পর ট্রলার একটা ঝাঁকি খেল। ঝাঁকি খেয়ে মোহনাটা পার হলো, পার হয়ে সমুদ্রে পড়ল। ঝকঝকে রোদ। কিছুদূর যাওয়ার পর বড়ই হতাশ লাগতে লাগল। মনে হলো, ধুর! আমাদের বাড়ির কাছে যে লেকটা আছে, যেটার মধ্যে বর্ষাকালে নৌকা নিয়ে যেতাম, এ তো সেই জিনিস। সমুদ্র তো এমন কিছু না। তারপরে গেলাম সেন্ট মার্টিন। দ্বীপটা অসম্ভব ভালো লাগল।

প্রশ্ন :

আপনি সমুদ্র পাড়ি দিলেন, আপনার ভয় লাগল না?

না। বললামই তো, দিঘির পানির মতো শান্ত। বাতাস নেই, তখন ঝড়টর সব থেমে গেছে। এবং আমি হতাশও হয়েছি যে কেন একটু দোলাল না, সমুদ্রে তো একটু দোলানি-টোলানি খাবই! তারপরে গেলাম, গিয়ে নামলাম, হুমায়ূন আহমেদের বাড়িটাড়ি দেখলাম। এখন যেখানে বন্দরটা হয়েছে, ওইটার সামনে একজন জেলের বাড়ি ছিল। ২৬টা নারকেলগাছ, ২ বিঘা জমি, একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর, তা-ও খুঁটির ওপর বসানো। হুমায়ূন আহমেদ তো আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বাড়ি দেখার পর, আমার মনে হলো আমি এই দ্বীপেই থাকি, আর যাব না। সঙ্গে যে ছিল, তাকে বললাম, ‘আচ্ছা, এই জেলের বাড়িটা কেনা যায় না?’ বলল, ‘হ্যাঁ, যায়।’ সে ডাকতেই জেলে পরিবার নেমে এল। যে ঘরটা থেকে নামল, ওইটাও আমার পছন্দ। একটা কুঁড়েঘর, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। কেনার প্রস্তাব দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। নিবন্ধনসহ ৮০ হাজার টাকা। আমি হিসাব করে দেখলাম যে টেকনাফ গিয়ে আমি হাজার বিশেক টাকা এদের অগ্রীম দিতে পারব। বললাম, ‘আমার সঙ্গে চলো।’ এল। দিয়ে দিলাম ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ওটা আমি কিনলাম। এরপরে নেশা হয়ে গেল। সেন্ট মার্টিনে জায়গার মালিক হয়ে গেছি, এখন তো নেশা হবেই! ঘনঘন যাই। মাসে দুবার। এ রকম করতে করতে চার-পাঁচবার, ছয়বার, সাতবার গেলাম। সপ্তম কিংবা অষ্টমবারে একটু ঝিরঝিরে বাতাস। এই বাতাসটা এত দিন ছিল না। হোটেল থেকেই দেখলাম, নারকেলগাছের মাথাটা একটু একটু কাত হয়ে যাচ্ছে। সম্রাট হোটেলের ম্যানেজার বললেন, ‘আপনি কিন্তু একটা ধাক্কা খাবেন।’ বললাম, ‘কিসের ধাক্কা?’ তিনি বললেন, ‘এই যে, বাতাস।’ কিসের বাতাস! মুখে বরং ফুরফুরে বাতাস লাগে, আরাম-শান্তি। নাফ নদীতে উঠলাম, নদীটা কেমন কালো হয়ে আছে। একটা গা ছমছমে ভাব, কিন্তু রোদ। দূর থেকে চেনা মোহনাটাকে দেখে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। ট্রলারটা যাচ্ছে, যাচ্ছে, হঠাৎ একটা টান দিল। টান দেওয়ার পর কামানের কয়েকটা গোলা একসঙ্গে ফাটলে যে শব্দ হয়, ওরকম একটা শব্দ হলো। খুঁজে বেড়াচ্ছি, শব্দটা কোথায়? আসলে ট্রলারের নিচে পানি দিচ্ছে বাড়ি। সাগরের ঢেউ। পড়ল মোহনায়। মোহনা যখন পেরোচ্ছে, ক্রমাগত বাড়ি মারছে। আর এমন এমন ঢেউ! সাগরের কাছে আমি তখন ক্ষমা চাইলাম যে আমি তোমায় ছোট করে দেখছিলাম, দিঘি বলেছিলাম। একবার কাত হতে হতে কয়েক ইঞ্চি বাকি থাকে, আবার সোজা হয়। প্রত্যেকটা দুলুনিতে আমার মনে হয় আয়ু শেষ। কোনোরকমে সেন্ট মার্টিন পৌঁছালাম। জমিটা তখনো রেজিস্ট্রি হয়নি। রেজিস্ট্রির জন্যই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম, গাছের মাথাগুলোকে বাতাস একপাশে কাত করে ফেলেছে। নারকেলগাছ কিন্তু খুব শক্ত। সেগুলো একদম বাঁকা, অ্যাঙ্গেলের মতো করে ফেলেছে। দেখলাম, দ্বীপ সব সময় স্বর্গ নয়! কেয়া বনগুলো থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন ভয়ে। দূরে সমুদ্রে রোল হচ্ছে, নীলচে-সবুজ পানিটা আর নাই। সাদা সাদা ধোঁয়ামতো উঠছে। ভালোও লাগল, যে এত দিনে তাহলে জলদস্যুর সমুদ্র দেখলাম। যা-ই হোক, তারপরে ফেরার পথে আরও ভালোমতো দেখলাম।

প্রশ্ন :

ওই দিনই ফিরেছিলেন?

ওই দিনই। আর কি থাকি! ফিরে আসার সময় খানিক পরপরেই দেখি, গাল চটচট করে। তখন আমি পড়তাম মেটালের চশমা। ঢেউ বাড়ি দিলেই জ্বালা করে নাক। তারপরে দেখি নাকের কাছে ঘা হয়ে গেছে। ওই রোদটা তো খাড়া লাগে, গরম করে পুড়িয়ে ফেলেছে নাকের দুপাশ। হাত দিলে দেখি চটচট করে পুরু লবণ। বোধ হয় রাজশাহীর কোনো একটা স্কুলের একদল ছাত্র গিয়েছিল সেদিন। সবাই পানিতে ভেসে থাকার জ্যাকেট-ট্যাকেট পরে কান্নাকাটি। আমিও তো ভয় পাচ্ছি। ওদের বললাম, তোমরা যে চেঁচামেচি করছ, লাফালাফি করছ, এই ট্রলার কিন্তু একেবারেই হালকা। একপাশে যদি কাত করে দাও, মাত্র কয়েক ইঞ্চি। ডুবে যাবে। মোহনা পেরোবার পর, আমি ভাবতে ভাবতে আসছি। সাগরের কাছে জীবন বাজি। একজন পাগলামি করেছেন বলে আমিও পাগল হব নাকি (হাসি)! মোহনাটা পেরোলাম। পেরোনোর পরে সে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা চর আছে, সে চরটাকে দূর থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে বিঘার পর বিঘা লাল টকটকে হয়ে আছে। সাদা চর। শাহপরীর দ্বীপটা তখন তো চরই ছিল। বাড়িঘর ছিল না। কাছে আসার পর বুঝলাম, এগুলো কিছুই না, স্রেফ সাগরের কাঁকড়া। ঝড়ের সংকেত পেয়ে কোটি কোটি লাল কাঁকড়া পানি থেকে উঠে পড়েছে, বালুতে বিছিয়ে আছে। লাল চাদরের মতো। আরেকটু এগোলাম, দেখি ম্যানগ্রোভের জঙ্গলগুলো সব ধবধবে সাদা। সাদা বকের দল এত এসেছে, এসে গাছগুলো সাদা করে ফেলেছে। মানে সবাই সংকেত পেয়েছে, আশ্রয়ের সন্ধানে চলে এসেছে। তখন কিন্তু ঝকঝকে রোদ, ঝড়ের কোনো চিহ্নই নেই। আসার সময় কতগুলো দর্শন তৈরি হয়েছে মগজে। জায়গাজমি সব মাথা থেকে উধাও হয়েছে তখন। গাংচিলদের দেখলাম কত সাবলীলভাবে পানিতে ভেসে আছে। ওগুলোর তুলনায় আমার মনে হচ্ছিল মানুষ কত অসহায়। পানির বোতল হাতে নিয়ে বসতে বলেছিল মাঝি। আমি জানি এই পানির বোতল নিয়ে বসে কোনো লাভ হবে না। যদি ডুবে যাই, তাহলে ওই পানি খাওয়ার সুযোগও আমার হবে না। কিন্তু ওই গাংচিলটা? পানি খেতে পারছে, পা নাড়াচ্ছে, ইচ্ছে করলেই উড়ে যাচ্ছে। অথচ আমি কত অসহায়! নিজেকে এত বিরাট ভাবার কী হলো মানুষের? যাহোক, নাফ নদী পাড়ি দিলাম। ওটাই আমার শেষ যাত্রা। পরে জমির মালিক আর দালালেরা ফোন করতে করতে অস্থির। আমি বললাম ২০ হাজার টাকা গেছে, যাক। আমার বায়না ফেরত দেওয়া লাগবে না। আমি জমির জন্য সাগরের কাছে জীবন বাজি রাখতে পারব না। আমার স্প্যানিশ জলদস্যু হওয়ার শখ শেষ। (হাসি)।

প্রশ্ন :

তিন গোয়েন্দার ৩০ বছর পূরণ হতে চলেছে। একটা সিরিজ হিসেবে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিল কিশোর-মুসা-রবিনরা। এর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

বড়দের বই পড়তে পড়তে একসময় আমি কিশোরদের বই পড়তে শুরু করলাম। একদিন দুপুরে খাওয়ার পর একটা হালকা ধরনের বই পড়তে বসলাম—থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজের একটা বই নিলাম। দারুণ লাগল। পড়ে আমার মনে হলো এটা যদি আমাদের দেশের কিশোরদের জন্য রূপান্তর করা যায়, তাহলে ওদের অনেক ভালো লাগবে। আইডিয়াটা এভাবেই এল। একসময় ঠিক করলাম, বড়দের জন্য লেখা বন্ধ করে আমি ছোটদের জন্যই লিখব। তিন গোয়েন্দার শুরুটা এভাবেই। পরে সেই বইটা থেকেই কাকাতুয়া রহস্য বইটা লিখেছি। রবার্ট আর্থারের এই বইটাই আমার লেখক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আর্থারের মতোই, কিশোর-মুসা-রবিন—এদের সৃষ্টি করার সময় আমি তিনটা চরিত্রকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। চিরকালই দেখে এসেছি, গোয়েন্দা কাহিনিতে একজন থাকে গোয়েন্দা আর আরেকজন তার সহকারী। সহকারীটা একটু বোকা আর মারামারিতে ওস্তাদ; অন্যদিকে গোয়েন্দার থাকে তীক্ষ বুদ্ধি। আমিচিন্তা করলাম তিনজন গোয়েন্দা থাকবে—একজন বুদ্ধি খাটাবে, আরেকজন শক্তিতে পারদর্শী আর আরেকজনের মাথায় সব ধরনের তথ্য জমা থাকবে। এভাবে তারা তিনজন মিলে একজন হয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

শুরুর সময় কি ভেবেছিলেন, এই সিরিজ একদিন এতটা জনপ্রিয়তা পাবে, কিশোরদের বই পড়া শেখাবে?

কিশোরদের বই পড়া শেখাবে কি না জানতাম না, তবে জানতাম যে এই সিরিজ দাঁড়াবে। তার কারণ হচ্ছে যে বইটা পড়ে আমি এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, একজন বয়স্ক লোক, তাতে আমার মনে হয়েছিল এটা কিশোরদের ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এতটা জনপ্রিয় হবে, এটা ভাবিনি। এতদিন টিকবে, এটাও ভাবিনি। কিন্তু জনপ্রিয় হবে, আমি নিশ্চিত ছিলাম।

প্রশ্ন :

নামগুলো কীভাবে পেলেন? কিশোর-মুসা-রবিন—এই নামগুলোর পেছনে কি কোনো গল্প আছে?

না। কোনো গল্প নেই। আমি ঠিক করেছিলাম একটু সহজ নাম নেব, কিন্তু যেগুলো খুব বেশি প্রচলিত নয়। ও রকম তিনটে নাম বাছাই করা দরকার, বিশেষ করে বাঙালি নামটা।

প্রশ্ন :

কিশোর মুসা রবিন তো রকি বিচের একটা স্কুলে পড়ত। কিন্তু কখনো তাদের ক্লাসের কথা বলা হয় না কেন?

বলা হয় না এ জন্য যে, বয়স দিলেই একটা সমস্যা তৈরি হয়। যেমন ১৩ বছর বয়স দিলে প্রতি বছর বয়স বাড়তে থাকবে, সেটা লিখতে হবে। কল্পনা করো, আস্তে আস্তে ওদের গোঁফ গজাচ্ছে, চুল আরও বড় হচ্ছে, ওরা টিনএজ হচ্ছে। ভালো লাগবে তোমাদের? আমি লক্ষ করেছি, খ্যাতিমান কিশোর সাহিত্যিকেরা সবাই এই জিনিসটা এড়িয়ে যান। কিংবা বয়স একটা জায়গায় আটকে রাখেন। কারণ পাঠক চায় না বয়স বাড়ুক।

প্রশ্ন :

তিন গোয়েন্দা মূলত বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা। কিন্তু এর প্রায় সব গল্পই সেই সুদূর আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রেক্ষাপটে কেন?

আমি যখন তিন গোয়েন্দা লেখা শুরু করি, তখন এটি লেখার মতো এমন আধুনিক, সমৃদ্ধ আর তথ্যবহুল পটভূমি বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এতে পুলিশকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, মানুষকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা আমাদের দেশে দেখানো সম্ভব ছিল না। এ দেশের প্রেক্ষাপট এমন স্বাধীনতা, সামাজিকতা, উদারতা গ্রহণ করত না। তাই মনে হলো আমেরিকার প্রেক্ষাপটেই লিখি। তাতে অনেক ধরনের গল্প বলতে পারব। তবে এখন যদি শুরু করতাম তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই লিখতাম।

প্রশ্ন :

তিন গোয়েন্দার প্রথম দিককার অনেক বইয়ে আমরা দেখতাম কাহিনি শুরু হচ্ছে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড দিয়ে। রাশেদ পাশা বসে আছেন, তিন গোয়েন্দা ভীষণ ব্যস্ত, মেরি চাচি ওদের কাজ করতে চাপ দিচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে তিন গোয়েন্দাকে কেন ও রকমভাবে পাইনি?

ও রকমভাবে না পাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে থ্রি ইনভেস্টিগেটরের বই ফুরিয়ে গেছে। তারপরেও আমি নিজে বানিয়ে লিখে অনেক দিন চালিয়েছি। তারপরে একটা সময় দেখলাম আমি নিজেই বিরক্ত হয়ে গেছি। ওই একই তো কাজ। কুকুরের চোখ টিপে ওখান দিয়ে কিংবা সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢোকা—একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। এরা এত বুদ্ধিমান তিনটা ছেলে, এত স্মার্ট, বর্তমানের চেয়ে এগিয়ে থাকা, সব সময় কি একই কাজ করবে নাকি? যুগ পাল্টেছে। ওরা এখন নতুন ধরনের গাড়ি চালাবে, মোটরসাইকেল চালাবে, প্লেন, জাহাজ, মহাকাশযান সবই চালাবে। নইলে এখনকার ইন্টারনেট যুগের পাঠকেরা পড়বে কেন? সব সময় আমি তিন গোয়েন্দায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি। নেটে আমি নতুন পাঁচটা থ্রি ইনভেস্টিগেটরের বই পেয়েছি। জার্মান এক লেখক পাঁচ-ছয়টা থ্রি ইনভেস্টিগেটর লিখেছেন। সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখি তিন-চার চ্যাপ্টার পড়ার পরেই ঝিমুনি আসে। বুঝলাম, এসব আর চলবে না। কারণ, আমার যেটা ভালো লাগবে না, সেটা দিয়ে পাঠককে ভালো লাগাতে পারব না। তিন গোয়েন্দা যখন শুরু করেছিলাম, তখন বাঙালি পাঠকদের কাছে জাঙ্ক ইয়ার্ড বিষয়টা নতুন ছিল। এখন বরং জিনা আর রাফিয়ান বেশি জনপ্রিয়। মুরল্যান্ড, ঘাসের জমি, আউটিংয়ে বেরিয়ে যাওয়া, চাষির বাড়িতে ধোঁয়া ওঠা, কেক-বিস্কুট-রুটি কিনে এনে তাঁবুর ভেতরে বসে খাওয়া, রাতে চোর দেখে কুকুরটার ঘেউ ঘেউ করা, বুনো ফুলের সুবাস, প্যাঁচার ডাক, এগুলো পৃথিবী যত দিন টিকে থাকবে তত দিন থাকবে। কিন্তু স্যালভিজ ইয়ার্ড পুরোনো হয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

তিন গোয়েন্দা, রকিব হাসান আর সেই নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা সেবা প্রকাশনীর বই—বাংলাদেশের অগণিত মানুষের কৈশোরের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই তিনটি বিষয়। কিন্তু এখন সেবা প্রকাশনী ছাড়া অন্য অনেক স্থান থেকেই আপনার লেখা কিশোর-মুসা-রবিনের গল্প প্রকাশিত হয়। এই পরিবর্তনটা কেন?

আসলে আমি আর নিউজপ্রিন্টে থাকতে চাইনি। যখন লেখক হিসেবে আমার খ্যাতি এসে গেল, তখন আমি চারপাশে আরও প্রচুর লেখককে দেখলাম। হুমায়ূন আহমেদকে দেখলাম, জাফর ইকবালকে দেখলাম, আরও অনেক ভালো লেখককে দেখলাম—কেউই পেপারব্যাকের মধ্যে বসে থাকেন নাই। পেপারব্যাকের সৃষ্টি হয়েছে সস্তায় সবস্তরের পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এটা কাজী আনোয়ার হোসেনের নিজস্ব আইডিয়া এবং এটা সফল হয়েছে। কিন্তু আমি তো প্রকাশক না, আমি একজন লেখক। আমার পেপারব্যাকে মন ভরছিল না। জানতাম, আমাকে হোয়াইট প্রিন্টে যেতে হলে পেপারব্যাকের তিন গোয়েন্দা ছেড়ে দিতে হবে। সেই সময়টায় তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা-বিক্রি-সবকিছু একেবারে তুঙ্গে, একদম সর্বোচ্চ শিখরে। পাত্তা দিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এটা ছেড়ে দেব, আর এটাই উপযুক্ত সময়। এখন যদি আমি এটা ছেড়ে না দিই, আর ছাড়তে পারব না। হোয়াইটপ্রিন্টে কিশোর-মুসা-রবিনের গল্প লিখলে প্রথম দিকে আমার কতগুলো অসুবিধা হবে, কিন্তু আমার যদি যোগ্যতা থাকে, তিন গোয়েন্দার জন্য যদি পাঠকের ভালোবাসা থাকে, দামটা আসলে বিষয় হবে না। পাঠকেরা সেটা মেনে নেবে। আর এখন তো দেখতে পাচ্ছি পেপারব্যাকের চেয়ে হোয়াইটপ্রিন্টই পাঠকেরা বেশি পছন্দ করছে।

প্রশ্ন :

আগের সেই তিন গোয়েন্দা কি কোথাও হারিয়ে গেছে? অনেকের মতে সেই স্বাদ, উন্মাদনা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এগুলো তো শুধুই সাধারণ অনুবাদের কাজ না। একটা গল্প বলতে হবে, পাঠককে ধরে রাখতে হবে, ভালো লাগাতে হবে—অনেক ধরনের ব্যাপার আছে। একটা মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে। চার শর বেশি বই লিখে ফেলার পর একটা মগজে আর কত কুলায়? তবে আমি আমার সাধ্যমতো সৎ, বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করছি পাঠকের কাছে। আমি যতটা ভালো কিছু সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার বইগুলো তো কম বিক্রি হচ্ছে না। এখনকার কিছু কিছু বই আগের লেখা বইয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। আসলে সেই প্রথম বইটা থেকে শেষ বইটা পর্যন্ত কোনোটাই কম বিক্রি হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

চরিত্রগুলো সবই কাল্পনিক। তবু বাস্তব জীবনে কাউকে দেখে কি মনে হয়েছে যে এ ঠিক কিশোরের মতো বুদ্ধিমান, মুসার মতো সাহসী কিংবা রবিনের মতো প্রতিভাবান?

নাহ্! মনে হয়নি।

প্রশ্ন :

বাস্তব জীবনে কোনো রহস্যের সমাধান করতে না পেরে কি কখনো মনে হয়েছে, ইশ্, এখন কিশোর পাশা থাকলে কী ভালোই না হতো!

না। আমি রহস্য নিয়েই মাথা ঘামাই না!

প্রশ্ন :

ব্যক্তিজীবনে আপনার সঙ্গে কার মিল আছে—কিশোর, মুসা নাকি রবিন?

কারও সঙ্গেই না।

প্রশ্ন :

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনি শুয়ে আছেন টেরর ক্যাসেলের কোনো কক্ষে। গা ছমছমে ভৌতিক একটা সুর বেজে আসছে অনেক দূর থেকে। কী করবেন?

হাসব, হাহা করে। বিষয়টা হবে পুরোই হাস্যকর, যেহেতু আমি ভূতে বিশ্বাস করি না।

প্রশ্ন :

একদিন সকালে টেবিলে বসে তিন গোয়েন্দার গল্প লিখছেন, এ সময় কেউ কলবেল বাজাল। দরজা খুলে দেখলেন কিশোর, মুসা আর রবিন দাঁড়িয়ে, কী করবেন?

আমি ভূত, অবাস্তব বা অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করি না। কাজেই ওরা কখনো দাঁড়াবে না। এরা আমার মগজের মধ্যে বসে আছে। আমি যদি বের করে দেই, তখন ঘুরে এসে বড়জোর একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে বলতে পারে, বের করলেন কেন? আবার লিখুন! (হাসি)

প্রশ্ন :

নানা রকম সিরিজ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। সেগুলো এখনো তুমুল জনপ্রিয়। নিজের লেখা কোন সিরিজটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

যেটা সবচেয়ে প্রিয় সেটা চলে না। মানে তিন গোয়েন্দার চাইতে কম চলে। এডগার রাইজ বারোজের টারজান সিরিজের বারোটা বই অনুবাদ করেছিলাম। এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় সিরিজ। জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ টারজান সিরিজের সবগুলো বই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশ করেছেন।

শেখ আবদুল হাকিম। তাঁর সঙ্গে রকিব হাসানের প্রথম দেখা হয়েছিল নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে

প্রশ্ন :

আপনি যখন লেখেন, তখন কি একটানা লেখেন? গল্পটা কি আগে পুরোটা ভেবে নেন?

একটানা লিখি না। আর গল্প আগে মাথায় নেওয়া যায় না। লিখতে থাকি, লিখতে লিখতে একটা গল্প দাঁড়িয়ে যায়। তা ছাড়া বিদেশি কাহিনি থেকে রূপান্তর করলে, সামনে একটা নমুনা থাকলে, কাজটা অনেক সহজ হয়।

প্রশ্ন :

আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখেন?

বিভিন্ন সময়ে লেখার সময়টা বদলেছে। দীর্ঘকাল আমি লিখেছি রাত ১১টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত। লেখা, পত্রিকার সম্পাদনা, বই পড়া—সব। তারপরে ঘুমিয়ে বেলা একটার সময় উঠেছি। এখন নিয়মিত সকালবেলা উঠি, উঠে কম্পিউটারের সামনে বসি। যা লেখা দুপুরের খাবারের আগেই, এ সময়ের মধ্যে না লিখতে পারলে নেই।

প্রশ্ন :

আপনি কি সবসময়ই কম্পিউটারে লেখেন?

হ্যাঁ, আমি কখনোই হাতে লিখিনি। জীবনের প্রথম বইটাও না। হাতে লিখলে আমার লেখা পড়া যায় না। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা বই হাতে লিখেছিলাম। ওই যে, ‘ডাকু মনসুর’! এরপরে যখন লিখতে গেলাম, তখন দেখলাম মুনীর কিবোর্ডে টাইপ করে বাংলা লেখা যায়। কাজী সাহেব আমাকে বুদ্ধি দিলেন, আপনি একটা পুরোনো টাইপরাইটার কিনে ফেলেন। তারপর টাইপরাইটার দিয়ে চলল, কম্পিউটার আসার পর কম্পিউটার কিনে ফেললাম। যখন অ্যাপল ম্যাকিনটশ ঢাকার বাজারে এল, ১৯৯০-৯২ সালের দিকে, তখন থেকেই।

প্রশ্ন :

এখন কোন ধরনের বই বেশি পড়েন?

আগে যা পড়তাম, তা-ই। গোয়েন্দা-অ্যাডভেঞ্চার-ভূতের বই; শিশু-কিশোরদের বই-ই বেশি। রূপকথাও পড়ি।

প্রশ্ন :

প্রজাপতি প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ সালে বেরিয়েছিল আপনার লেখা আত্মজীবনী আমার কৈশোর। ভবিষ্যতে কি আরও আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে আছে?

না। কৈশোরে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছি, সেগুলো ছোটবেলার ঘটনা। এখন লিখলে হবে বড়দের ঘটনা। ছোটরা পড়বে কেন? তিন গোয়েন্দার পাঠকেরাই বা পড়বে কেন? আসলে আমি বড়দের জন্য আত্মজীবনী লিখতে চাই না।

প্রশ্ন :

আপনি তো প্রচারবিমুখ। সত্যি বলতে অনেক পাঠকই আপনাকে সামনাসামনি দেখতে পেলে হয়তো চিনতে পারবে না, কিন্তু নাম শোনামাত্রই চিনতে পারবে। এই প্রচারবিমুখতার কারণ কী?

জেমস হ্যাডলি চেজ নামে একজন থ্রিলার লেখক ছিলেন। তিনি প্রচারবিমুখ মানুষ। তাঁর নামটাও ছদ্মনাম। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তুমি ছদ্মনামে লেখো কেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমার নাম যা-ই হোক, পাঠক তো আমাকে চিনবে আমার লেখা দেখে।’ আমি হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার পর মাঝেমাঝে বাংলা একাডেমির বইমেলায় যেতাম। বাচ্চারা ঘিরে ধরত, অটোগ্রাফ নিত, নানা প্রশ্ন করত। ভালোই লাগত। হঠাৎ একসময় দেখলাম এই জিনিসটা আমার জন্য সমস্যা হয়ে যাবে। খ্যাতির বিড়ম্বনা। আমি খুবই সাধারণভাবে চলাফেরা করি; এক জোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে একটা ছাতা নিয়ে বৃষ্টির দিন হয়তো বেরিয়ে পড়লাম, বাসায় ফিরতে হয়তো রিকশায় বা পুরোনো একটা ভাঙা বাসে উঠে পড়লাম, কেউ আমাকে চিনল না। বাজারে গেলাম, কেউ আমাকে চিনল না। ‘হাই রকিব আংকেল’ বা ‘রকিব ভাইয়া’ বলল না। রাস্তায় কেউ বলুক, সেটা চাইও না। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকতে চাই। তাই আমি ছবি দিতে চাই না। টেলিভিশন বা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার বা টক শোতে ডাকা হয়, আমি যাই না। এখন এই প্রচারবিমুখতা আমার ভালোই লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে যখন দেখি উইকিপিডিয়ায় তিন গোয়েন্দা বা রকিব হাসান সম্পর্কে প্রচুর তথ্য আছে, কিন্তু পাশের ছবির বাক্সটার মধ্যে লেখা আছে ‘কামিং সুন’! (হাসি) এখন অবশ্য একটা পুরোনো ছবি দেওয়া হয়েছে। দু-তিনটা পুরোনো ছবি প্রকাশিত হয়েছে, সব জায়গায় ওগুলোই ঘুরেফিরে ছাপা হয়। পুরোপুরি জেমস হ্যাডলি চেজ আর হতে পারলাম না! পারতাম, যদি বাচ্চাদের লেখক না হতাম।

প্রশ্ন :

তিন গোয়েন্দার ওপরে একটি টিভি সিরিজ করা হয়েছে। ওগুলো কি আপনি দেখেন?

না, দেখি না। তিন গোয়েন্দার নাটক বানাতে দিতে আমি মোটেও আগ্রহী ছিলাম না, এখনো আগ্রহী না। আমি জানতাম, তাতে কিশোর-মুসা-রবিনের আসল চেহারাগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা তিন গোয়েন্দার ভক্ত, তাদের ভালো লাগবে না। কিন্তু পরিচালক খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন যে ‘আমি এমন একটা জিনিস বানাব রকিব ভাই, আপনার ভীষণ পছন্দ হবে।’ আমি বলেছি, ‘আমার যদি চল্লিশ ভাগও পছন্দ হয়, তাহলে আমি আপনাকে থ্যাংকস জানাব।’ টিভিতে তিনটা পর্ব দেখার পরে তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এটা কী হলো?’ তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘এটা তো অত্যন্ত জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রশংসা জানিয়ে অনেক চিঠি আসে।’ অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। আমার তিন গোয়েন্দার নাটক দেখে আমি পাথর না, জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপরে আমি আর যোগাযোগ করিনি তাঁর সঙ্গে। কোনো পর্বও দেখিনি।

প্রশ্ন :

বিদেশি টেলিভিশনগুলোতে ছোটদের নিয়ে বেশ সুন্দর সুন্দর প্রোগ্রাম হয়। এখানে বাজেট হয়তো বা...

বাজেট নেই, তা আমি বলব না। আসলে ভালো প্রোগ্রামের জন্য প্রথমেই দরকার মেধা। শুধু টাকা ঢাললেই হয় না। আর ছোটদের জিনিস বানানো অনেক কঠিন কাজ। আমাদের দেশে অনেকেই ‘আমি এই করব, ওই করব’ বলতে পারে, পরে দেখা যায় অশ্বডিম্ব প্রসব করল। এদের দিয়ে আর যা-ই হোক, বাচ্চাদের জিনিস হবে না। বাজেট দিলেও না।

প্রশ্ন :

আপনি কি কখনো লস অ্যাঞ্জেলেস গিয়েছেন? বা যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে কখনো?

না। তাতে আমার স্বপ্নভঙ্গ হবে। আমি কল্পনার জগতেই থাকতে ভালোবাসি। যেটা আমার কল্পনায় ভালো লাগে, সেই জায়গায় আমি কক্ষনো যাই না। কেউ যদি আমাকে নিয়েও যেতে চায়, তাহলেও যাব না।

কঠিন একটা প্রশ্ন করে রকিব হাসানকে চিন্তায় ফেলতে পেরে দারুণ খুশি কিআ সাক্ষাৎকার দল

প্রশ্ন :

মুসার যেমন মুদ্রাদোষ আছে ‘খাইছে’ বলার, তেমনি আপনারও কি কোনো মুদ্রাদোষ আছে?

আসলে ‘খাইছে’ শব্দটা আমি একসময় নিজের অজান্তেই বলে ফেলতাম। মনে হলো শব্দটা ঢুকিয়ে দিই। আমার কাছ থেকে মুদ্রাদোষটা সংক্রমিত হয়েছে মুসার মাঝে। যদিও আমি নিজে এখন আর ‘খাইছে’ বলি না।

প্রশ্ন :

ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। কারণ, আব্বু-আম্মু দেখলেই রাগ করত, বকা দিত। অথচ বিপদে পড়লে কীভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার পাওয়া যায়, কীভাবে বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হয়—এমন অসংখ্য জিনিস তিন গোয়েন্দা পড়ে শিখেছি। যে অভিভাবকেরা আমাদের তিন গোয়েন্দা পড়তে দেন না, তাঁদের উদ্দেশে আপনার কী বলার আছে?

আমাদের সময় ‘আউটবই’ বলে একটা শব্দ ছিল। বাবা-মা মনে করতেন পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই আউটবই। আমার মনে হয়, বই না পড়াটাই মূর্খতা। আর বই পড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়, কথাটা মোটেও ঠিক নয়। বরং বই মগজকে শাণিত করে। বুদ্ধি বাড়ায়। মানুষের উদারতা বাড়ায়। ভালোমন্দ বুঝতে শেখায়। খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। বইয়ের চেয়ে ভালো আর উপকারী বন্ধু আমি তো অন্তত দেখি না।

প্রশ্ন :

যারা লেখালেখি করতে চায়, তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?

প্রথমত প্রচুর বই পড়তে হবে। দ্বিতীয়ত লেখাটাকে কোনো অবস্থাতেই সহজ-সরল একটা বিষয় মনে করা চলবে না। এখানে বিন্দুমাত্র অবিশ্বস্ততা ও ফাঁকি দেওয়া চলবে না। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা বাক্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে, যদি সফলতা পেতে চাও। সোজা কথা ধৈর্য, অধ্যবসায়, বিশ্বস্ততা এগুলো থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পড়তে হবে অনবরত।

প্রশ্ন :

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার দলের পাঁচজন ছাড়াও আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে—আফসানা চৌধুরী, ফারিহা রাইসা, হাসানুল ফেরদৌস, মীর মাইনুল ইসলাম, মুহ্সী রহমান, নাফিসা মালিয়াত, এস কে শাহরিয়ার, শাফায়াতুল ইসলাম ও উম্মে হানি।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)