ওয়ারফেজ নামের অর্থ কী?
ওয়ারফেজ: আসলে ‘ওয়ারফেজ’ (Warfaze) বলে ডিকশনারিতে কোনো শব্দ নেই। ওয়ারফেজ মানে একটি বাংলাদেশি হার্ড রক ব্যান্ড—এটা তোমরা বলতে পারো। আমাদের এই নাম দিয়েছিল আমাদের বন্ধু মীর মেহেদী। তখনকার সময় বিদেশি ব্যান্ডগুলোর নামের মতো আমাদের ব্যান্ডের একটা নাম দরকার ছিল। তখন মেহেদী বলল, ওয়ারফেজ নামটা রাখলে কেমন হয়? বিদেশি রক ব্যান্ডগুলোর সঙ্গে মেলে। এভাবেই জিনিসটা এসেছে। আর আমরা যেটা প্রথমে বলতাম, ‘ওয়ার’ মানে যুদ্ধ। ‘ফেজ’ দিয়ে আমরা যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতাম। কিন্তু এখন আমরা বলি, ওয়ারফেজ মানে বাংলাদেশ হার্ড রক ব্যান্ড।
যখন আপনারা গান শুরু করেছিলেন, তখনকার পরিস্থিতির চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন পপ মিউজিকের যেমন অনেক বড় একটা জোয়ার আছে। সবাই এখন ওটাই শোনে। আপনাদের কি মনে হয় ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এখন আগের চেয়ে ইতিবাচকভাবে এগিয়েছে, নাকি জোয়ারটা আগের চেয়ে একটু কম?
ওয়ারফেজ: এখন আমাদের এন্টারটেইনমেন্ট বা বিনোদনের জায়গাটা খুব ছোট হয়ে ৯০ সেকেন্ডের ভিডিও বা রিলের মধ্যে ঢুকে গেছে। আমাদের গান শোনা বা কোনো কিছু দেখার সময়ও অনেক কমে এসেছে এখন। কিন্তু যারা ব্যান্ড মিউজিক পছন্দ করে, তাদের কাছে এটা একটা দর্শন। তারা ব্যান্ড মিউজিককে ওইভাবেই চায়, যেভাবে আমরা গেয়েছি। কদিন আগে আমরা কোক স্টুডিওতে ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটা করলাম। গানটা আমরা যখন প্রথম কম্পোজ করেছিলাম, ওটা ছিল সাড়ে আট মিনিটের। সেখান থেকে কমিয়ে ছয় মিনিট করা হয়েছে। এর নিচে আর নামানো যায়নি। কর্তৃপক্ষের চিন্তা ছিল, এত বড় গান মানুষ শুনবে কি না। টিপু ভাই বলেছিলেন, গানটা এভাবেই রাখতে হবে। সেটা কিন্তু সুপারহিটও হয়েছে। আমরা যতই ট্রেন্ডি বিটস, ফিউশনের কথা বলি, এগুলো সব সময় ছিল। হয়তো অন্য কোনো নামে। কিন্তু যারা ব্যান্ড মিউজিক বা ওয়ারফেজের কোর ফ্যান, যারা ওয়ারফেজকে পছন্দ করে, তারা তাদের চেনা শিল্পীদের লিগ্যাসি ধরে রেখেছে। সেটাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছে। এভাবেই কিন্তু একটি জেনারেশনের পর আরেকটি জেনারেশন আমাদের গান শুনেছে, শুনছে। আমাদের মনে হয়, তারা ব্যান্ড মিউজিক ওভাবেই চায়, কোনো পরিবর্তন চায় না।
কোন গানটা শুনে আপনাদের মনে হয়েছে, আমাদের একটা ব্যান্ড খোলা উচিত? এ রকম কি কোনো গান আছে?
ওয়ারফেজ: শুরুতে আমরা এসি/ডিসি, ব্ল্যাক সাবাথ, রেইনবো, ডিপ পার্পল, লেড জেপেলিন এগুলোই শুনতাম। এগুলো শুনেই আমরা উৎসাহিত হয়েছি। তখন ঠিক ভাবিনি বাংলায় গান গাইব। ভেবেছিলাম আমরা এই ইংলিশ গানগুলো কাভার করব, এই গানগুলোই গাইব। বাংলায় নিজেদের গান হবে, এটা তখনো আমাদের মাথায় আসেনি। মাথায় এসেছে নব্বইয়ের দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর। বামবা ১৯৯০–এর ২৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে বৈশাখী কনসার্ট আয়োজন করল। আমরা ওই কনসার্টে ডাক পেলাম। বামবার সভাপতি ছিলেন মাকসুদুল হক। মাকসুদ ভাই আমাদের সব সময় উৎসাহ দিতেন। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড ছিলাম। মাকসুদ ভাই বললেন, ‘বৈশাখী কনসার্টে গান করতে হলে তোমাদের বাংলা গান করতে হবে, কোনো ইংলিশ গান করা যাবে না।’ আমরা বললাম, ‘ঠিক আছে।’ বাংলা গান করার জন্য উদ্বুদ্ধ হলাম। তখন বাবনা, কমল, মারসুখ—সবার কাছে যে গানগুলো ছিল, ওগুলো নিয়েই আমরা এগোলাম।
আপনাদের লম্বা সময়ের যাত্রা, এর মধ্যে আপনারা অসংখ্য কনসার্ট করেছেন। আপনাদের প্রথম লাইভ কনসার্টের অনুভূতি কেমন ছিল? এত দিনের পথচলায় কোন কনসার্ট করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
ওয়ারফেজ: লাইভ কনসার্ট নিয়ে আমাদের দুই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। একটা হলো প্রথম অ্যালবাম বের করার আগে। আরেকটা হলো প্রথম অ্যালবাম বের করার পরে। প্রথমে যখন আমরা ‘কাভার’ গান করতাম, মানে তখন আমরা আয়রন মেইডেনের মতো ব্যান্ডগুলোর ইংরেজি গান গাইতাম। তখন বাংলাদেশে পাশ্চাত্য মিউজিকের জোয়ার শুরু হয়েছে। সবাই শুনত, উপভোগ করত। তখন আমরা ভাবলাম বাংলা ভাষায় অরিজিনাল কিছু গান লাগবে আমাদের। মানে কিছু মৌলিক গান। তারপর ১৯৯৩ সালে ৭ জানুয়ারি রাওয়া ক্লাবে আমাদের প্রথম অ্যালবাম ওয়ারফেজ প্রকাশিত হলো। অ্যালবাম প্রকাশের পর কনসার্টে দর্শকের সাড়া ছিল অন্য রকম। এটা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। প্রতিটি কনসার্টে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে আমাদের মধ্যে। আমাদের কাছে প্রতিটা কনসার্ট সমান। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ডেগুলো আমরা সব সময় উপভোগ করি। মানুষ এত এনকারেজিং আর এত রেসপন্স করে, আমরা খুব উৎসাহিত হই। আরও ভালো পারফরম্যান্স করতে উদ্বুদ্ধ হই। আবার যখন আমরা রিইউনিয়ন কনসার্ট করি, সেটাও দারুণ উপভোগ্য হয়। সেখানে আমরা আমাদের সাবেক মেম্বারদের পাই। তারা আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। তাদের নিয়ে যখন আমরা কনসার্ট করি, একটা বিশেষ ভালো লাগা আমাদের মধ্যে কাজ করে। তবে এটা ঠিক, প্রতিটা কনসার্টই আমাদের কাছে সমান।
আপনাদের ৩০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি একটা বড় কনসার্ট হয়েছিল। আপনাদের ব্যান্ডের এখন ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে, এটাও তো একটা অনেক বড় মাইলফলক। ৪০ বছর পূর্তিতে কোনো কনসার্ট হলো না কেন?
ওয়ারফেজ: আমরা ২০২৪ সালের ৬ জুন ৪০ বছরে পা রেখেছি, এখন আমাদের ৪০ বছর চলছে। ৪০ বছর উপলক্ষে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি, এরপরে গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এরপর যাব কানাডায়, আমাদের ৪০ বছর উদ্যাপন করতে। বাংলাদেশেও আমরা কনসার্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে করতে পারিনি। আমরা যদি কোনো কনসার্টের আয়োজন করি, তাহলে বিদেশ থেকে আমাদের সাবেক শিল্পী, ব্যান্ড মেম্বারসহ আরও অনেকে আসবে। আর এমন একটি অনুষ্ঠান যদি এক দিন কিংবা দুই দিন আগে বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সমস্যা। এখন তো যেকোনো সময় কনসার্ট বাতিল হয়ে যাচ্ছে, যেহেতু পরিস্থিতি একটু অন্য রকম। এ জন্যই আমরা সাহসটা নিতে পারিনি। তবু আমাদের ইচ্ছা আছে। যদি দেশের অবস্থা ভালো থাকে, কনসার্ট করার মতো পরিবেশ থাকে, তাহলে এ বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা করব।
এত বছরের পথচলায় আপনাদের অনেক ব্যান্ড মেম্বার পরিবর্তন হয়েছে। এত বছর ধরে আপনারা কীভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন?
ওয়ারফেজ: এখানে আমরা সবাই মিলে যে দর্শন বজায় রাখার চেষ্টা করেছি, সেটা হলো আমাদের গানটা ভালো হতে হবে। যেটা আজ থেকে ২০-২৫ কিংবা ৫০ বছর পরেও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। এই জিনিসগুলো মাথায় নিয়ে আমরা সব সময় গান নির্বাচন করতাম এবং ব্যান্ডের সবার মতামত থাকত অবশ্যই। এভাবেই আমরা গানগুলো বাঁচিয়ে রেখেছি। বিদেশে যেটা হয়, একটা অ্যালবামে ৮টা, ১০টা কিংবা ১২টা গান থাকে। ওদের প্রডিউসাররা বলে, ‘আমাদের একটা হিট গান হলেই হবে, সর্বোচ্চ গেলে দুইটা হিট গান, আমাদের আর অন্য কোনো মাথাব্যথা নেই।’ কিন্তু আমাদের সব সময় ছিল, ১০টাই হিট হতে হবে, ১০টাই আমাদের সন্তান। এভাবে আমরা জিনিসগুলো করেছি। এ কারণে আমাদের ১১০টা গানের মধ্যে ৭০-৮০টা গান সুপারহিট, এ রকম পৃথিবীর খুব কম ব্যান্ডেরই আছে। আমরা ব্যাপারটা মেনে চলেছি; গানগুলো যেন এত বছর পরেও বেঁচে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, গান করলেই হবে না, আমরা যখন লাইভ কনসার্টে এগুলো শ্রোতাদের সামনে ডেলিভারি করব, তখন আমাদের রেকর্ডিং যেভাবে করেছি, তেমনই হতে হবে। রেকর্ডিং করেছি এক আর লাইভে যা করছি তা আরেক, এ রকম হলে লাভ নেই। বেসুরো গাইছে, ভুলভাল বাজাচ্ছে, লাভ নেই, হবে না। এই ব্যাপারগুলো ধরে রেখেছি আমরা। কোয়ালিটির সঙ্গে ওয়ারফেজের অতীত-বর্তমানের সব সদস্যই ওই মানটা ধরে রেখেছি।
ওয়ারফেজ ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপ
পলাশ নূর: ভোকাল
শেখ মনিরুল আলম টিপু: ড্রামার
ইব্রাহিম আহমেদ কমল: গিটারিস্ট
শামস মনসুর গণি: কি–বোর্ড
নাঈমুল হক রজার: বেজিস্ট
সামির হাফিজ: গিটারিস্ট
সৌমেন দাস: গিটারিস্ট
আপনারাও তো সব সময় কোয়ালিটিটা ধরে রেখেছেন। ১০টা গানের ১০টাই ভালো হতে হবে। এমন কি কোনো ঘটনা ঘটেছে, আপনারা গান লিখেছেন, রেকর্ডিংও শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু মনে হয়েছে, না, মনের মতো হয়নি। বাদ দিয়ে দিয়েছেন?
ওয়ারফেজ: হ্যাঁ, এমন তো হয়ই। কত তর্ক হয়েছে ব্যান্ডের মেম্বারদের সঙ্গে। ধরো, এক অ্যালবামের জন্য একজন পাঁচটা গান শুনিয়েছে। পাঁচটার মধ্যে দুইটা নিয়েছি, তিনটা নিইনি, ওর মাথা গরম হয়ে গেছে। আরেকজন দিয়েছে চারটা, ওর কাছ থেকে নিলাম একটা-দুইটা। কেননা, আমাদের এই ব্যালান্সটা থাকতে হবে। এভাবে আমরা ব্যালান্স করে এগিয়েছি। অনেক গান আছে, আমরা রেকর্ড করেছি, পছন্দমতো হয়নি বা আমাদের স্ট্যান্ডার্ডটা মিট করেনি বা পরবর্তী সময়ে আরও ভালো গান চলে এসেছে, পরবর্তীকালে আমরা ওগুলো আর কাজে লাগাইনি। এ রকম অনেক গান আছে আমাদের।
কিআ: ভোকাল পলাশ নূর ওয়ারফেজে যুক্ত হয়েছেন ২০১৬ সালে। তিনি ওয়ারফেজের সঙ্গে দুটি নতুন গান করেছেন। সামনে তাঁকে নিয়ে আমরা কোনো অ্যালবাম পাব?
ওয়ারফেজ: পলাশ আমাদের সঙ্গে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে যুক্ত হয়। ২০১৭ সালে ওকে নিয়ে আমরা একটা নতুন গান করি, ‘অপরূপ বিস্ময়’। তারপর ‘মায়া’ করেছি দুই বছর আগে। ওটা পলাশেরই কথা ও সুর, এটাও খুব সুন্দর একটা গান। ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই গানটা করা হয়েছিল। আমরা আবার পথচলা ২-এর কাজ শুরু করেছি। আমরা তিনটা গান রিলিজ করেছি ইতিমধ্যে। কিন্তু কনসার্ট, ট্যুর ও নানা ব্যস্ততার কারণে এর ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পারছি না। তবে আমরা কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছি। খুব দ্রুতই পথচলা ২ অ্যালবামের বাকি গানগুলো রিলিজ হবে।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎটা আপনারা কেমন দেখেন? বিশেষ করে জেন-জি বা তাদের পরের প্রজন্ম জেন আলফা—তাদের রুচি আপনারা ধরতে পারছেন কি না?
ওয়ারফেজ: আমরা আপডেটেড থাকার চেষ্টা করছি। বর্তমানে বাংলাদেশে র৵াপ, হিপহপ, আরএনবি খুব পরিচিতি পাচ্ছে, যেহেতু বিশ্বব্যাপী এটি পরিচিতি পেয়েছে। নতুন জেনারেশন এসব গান শুনছে। কিন্তু আমরা আমাদের মূলধারা থেকে সরব না, কেননা আমরা এটা নিয়েই এগিয়েছি। অবশ্যই ট্রেন্ডি হতে হবে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জিনিসগুলো হতে হবে। সাউন্ড নিয়ে আমরা সেভাবেই কাজ করছি, সামনেও কাজ করার ইচ্ছা আছে। জেন-জি আমাদের গান শুনছে। ওরা আমাদের মিউজিক্যাল ফিলোসফি ধারণ করে। আমাদের ‘মহারাজ’, ‘আগামী’, ‘অমানুষ’, ‘সত্য’, ‘অসামাজিক’, ‘জীবনধারা’—এই গানগুলো আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে বের হয়েছিল, কিন্তু এখনো এগুলো প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ‘মহারাজ’। এ গানগুলো টগবগে তারুণ্যের। আমাদের এই জেনারেশন নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, কেননা আমরা তারুণ্যের টগবগে স্পৃহা ও দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ৪০ বছর ধরেই আছি। এটা নিয়ে আমরা খুব একটা চিন্তিত নই। কিন্তু গান শোনার রুচিতে তো পরিবর্তন হবেই।
আপনারা যে সময় গানের জগতে এসেছেন, সে সময় আপনারা হয়তো ছাত্র ছিলেন। ওই রকম একটা সময়ে কীভাবে সব দিক সামলে এত দূর এগিয়েছেন?
ওয়ারফেজ: এটা সহজ ছিল না। আসলে সত্তর-আশির দশকে আমরা যে মিউজিক করব, মিউজিক করে ক্যারিয়ার করব, এটা চিন্তাই করা যেত না। ওই সময় আমাদের কয়েকজন ভাগ্যবান ছিলাম, আমাদের পরিবার থেকে প্রচণ্ড সাপোর্ট দিয়েছিল। তখন অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল—সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে। সব দিক থেকেই আসলে সহজ ছিল না বিষয়গুলো। ইনস্ট্রুমেন্টও ছিল খুব কম। পাওয়াই যেত না। এগুলো নিয়ে খুব স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এই তো, এইভাবে এগিয়েছে। আমরা এখনো হার্ড রক নিয়ে স্ট্রাগল করছি। আমাদের কাছে মনে হয়, ব্যান্ড মিউজিক একটা লাইফস্টাইলের মতো। আমরা একটা ফিলোসফিতে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি, যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে, অধিকারের পক্ষে কথা বলতে গেলে ব্যান্ড মিউজিকের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের ব্যান্ড মেম্বার কমবেশি সবাই সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রাম আমাদের সবাইকেই করতে হয়েছে জীবনে।
ওয়ারফেজের জনপ্রিয় কিছু গান
বসে আছি, অবাক ভালোবাসা, ধূপছায়া, অসামাজিক, হতাশা, মহারাজ, যত দূরে, তোমাকে, পূর্ণতা
মা–বাবাকে কীভাবে ম্যানেজ করেছেন?
ওয়ারফেজ: ধরো, তোমার একটা শখ আছে, যেটা আসলে তোমার মা–বাবার যে স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে, সেটার সঙ্গে যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তোমাকে অবশ্যই ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কারোর নাচতে ভালো লাগে, কারোর গান গাইতে ভালো লাগে, কারোর হয়তো কবিতা লিখতে ভালো লাগে। কেউ যদি ভাগ্যবান থাকে, তবে তার পরিবার থেকে মেনে নেয়, খুব সাপোর্ট করে। কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেটা হয় না। তোমরা তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে এই ফর্মুলাটা করে দেখতে পারো—সেটা হলো তোমার বাসায় কিছু রিকোয়ারমেন্ট আছে তোমাকে নিয়ে। যেমন তোমার রেজাল্ট ভালো করতে হবে, তোমাকে পড়তে হবে, সকালে উঠতে হবে, স্কুলে যেতে হবে—এ রকম অনেক কাজই রয়েছে। এই কাজগুলো যদি তুমি ঠিকঠাকমতো করতে পারো, তাহলে আর এর বাইরে তুমি কী করলে, এটা নিয়ে বাসা থেকে আর কোনো ঝামেলা করবে না। তোমার যদি রেজাল্ট ভালো হয়, তারপর তুমি যদি গান করো, তোমাকে কেউ কিছুই বলবে না। কিন্তু গানের কারণে যদি তোমার পড়ার ক্ষতি হয়, তখন তুমি সমস্যায় পড়বে।
আপনাদের এই দীর্ঘ পথচলায় অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেখান থেকে একটি ঘটনা যদি আমাদের বলতেন…
ওয়ারফেজ: আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। একটা কথা সব সময় মনে পড়ে, সেটা হলো আমরা তখন কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট পেতাম না। এখনকার মতো এতো সহজলভ্য ছিল না গানবাজনা করার বাদ্যযন্ত্রগুলো। তখন আমাদের দেশে ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুরু হয়েছে কেবল। সেই ধরনের বাদ্যযন্ত্র আমাদের দেশে পাওয়া যেত না। আমাদের টিপু ভাই ১৯৭৮ সালে প্রথম ড্রাম কেনেন। তাঁর বাবা ছিলেন বেশ সংস্কৃতিমনা। তিনি যখন ড্রামস বাজিয়ে প্র্যাকটিস করতেন বাসায়, সামাজিকভাবে আশপাশের লোকজন শব্দটা নিতে পারেনি এবং অনেক কমপ্লেইন করত। বারবার বাসা পরিবর্তন করতে হতো, অনেক সময় বাসা দিতেও চাইত না অনেকে, কারণ উনি ড্রাম বাজান। এ ধরনের স্ট্রাগল আমাদের অনেককেই ফেস করতে হয়েছে।
আরেকজনের কথা মনে পড়ে, রকস্টার ব্যান্ডের মাহবুব ভাই। ওয়ারফেজের সঙ্গে রকস্টারের খুব ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক ছিল। টিপু ভাইয়ের তো তাও ড্রাম ছিল, বাসায় ড্রাম বাজাতেন, কমপ্লেইন আসত। মাহবুব ভাইয়ের বাসায় কোনো ড্রাম ছিল না, ড্রাম বাজানোর পারমিশনও ছিল না। ওনার বাসায় কেউ জানতও না, উনি গানবাজনা করেন। উনি ওনার বাসায় বালিশ দিয়ে ড্রাম প্র্যাকটিস করতেন। বালিশ দিয়ে প্র্যাকটিস করে উনি স্টেজে বাজাতেন—এটা ছিল অসাধারণ। আরেকটা জিনিস, আমাদের সময় ইন্সট্রুমেন্ট শেখার কোনো জায়গা ছিল না, মানে ফরমাল কোনো জায়গা ছিল না। এখন প্রচুর জায়গা আছে, তোমরা চাইলেই ফরমালি কোনো জায়গায় শিখতে পারো। আমাদের সময় যেটা হতো, আমাদের খুঁজে বের করতে হতো এই জিনিসটা কে বাজায়। ধরো, আমি কি–বোর্ড শিখতে চাই, কি–বোর্ড যারা বাজায়, তখনকার সময়ে দুই-তিনজন মানুষ ছিল ঢাকায়, তাদের কাছে যেতে হবে, তাদের বাসা চিনতে হবে। এখনকার মতো তখন তো আর ইন্টারনেট ছিল না যে সার্চ দিলেই পেয়ে যাব। এটা খুবই কঠিন ছিল। এর কাছে ওর কাছে জিজ্ঞাসা করে তাদের কাছে যেতাম, গিয়ে দেখি তাদের এত ব্যস্ততা যে তাদের সময় নেই শেখানোর, তারা শেখাবে না। এই চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের ছিল। যে জিনিসটা শিখতে এক বছর লাগে, সেগুলো আমাদের শিখতে লেগেছে ৮-১০ বছর, কেননা আমরা অনেকে এখানে–ওখানে ঘুরে ঘুরে শিখেছি। সেদিক থেকে তোমাদের সুযোগ অনেক বেশি।
অনেক ব্যান্ডই তো ভেঙে গেছে। ওয়ারফেজ কীভাবে এত দিন ধরে টিকে থাকল?
ওয়ারফেজ: এত দিন ধরে টিকে থাকার একটা কারণ হতে পারে আমাদের শুরুটা ছিল খুবই ধীরে, আর আমাদের ঊর্ধ্বগতির রেখাটা ছিল স্থির। ওয়ারফেজ জানে, খারাপ সময় কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়। আমরা জানি, আমাদের একজন ভোকালিস্ট চলে গেলে কী হয়, আমরা জানি আমাদের একজন গিটারিস্ট চলে গেলে পরের দিন কী অবস্থা হয়। এটা বহুবারই হয়েছে, আমরা এগুলো পার হয়ে এসেছি। অনেক ব্যান্ড আছে, তারা অনেক ভাগ্যবান, এই সমস্যার সম্মুখীন তাদের হতে হয়নি, কিন্তু দেখা গেছে তাদের কোনো একটা পরিবর্তন হয়েছে, তারা সেটা গ্রহণ করতে পারেনি, টিকতেও পারেনি। হয়তো ভেবেছে, এই ঝামেলা আমরা আর নেব না, থাক, আমরা অন্য কাজ করি।
নতুন প্রজন্মের গানের রুচি পরিবর্তন নিয়ে আপনারা কী অনুভব করেন?
ওয়ারফেজ: এখনকার জেনারেশনের টেস্ট চেঞ্জ হচ্ছে, এটা সব জেনারেশনেরই হয়। সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশ যে জায়গায়, বাংলা যে জায়গায়, কিছু কোর ভ্যালুজ থাকে, সেটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, এটা পরবর্তী জেনারেশনে পৌঁছাবে। আমরা শিল্পী হিসেবে, আমরা একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করতে পারি, ওয়ারফেজ এটা করে দেখিয়েছে। এখন যদি অন্য একটি ব্যান্ড বলে, আমরা একটি বেঞ্চমার্ক রেখে যেতে চাই, তাদের সেটা করে যেতে হবে, তখন আমরা আরেকটা বেঞ্চমার্ক করা ব্যান্ড পাব। আমরা যে বেঞ্চমার্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছি, এখনো করছি, আমরা নিজেদের বেঞ্চমার্ক ভাঙার চেষ্টা করছি, অন্যদের দেখেও চেষ্টা করি। জেনারেশনের টেস্ট পরিবর্তনের দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই, কেননা জেনারেশন তার হাতের কাছে যা পাবে, সে ওটাই শুনবে, ওটা ওদের হবে টেস্ট। আমরা যদি গান না রিলিজ করি, আমরা সব বড় ব্যান্ড মিলে যদি সিদ্ধান্ত নিই আমরা আর কোনো গান করব না, তখন তাদের টেস্ট তো বিদেশি গান দিয়েই পূরণ হবে। এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমাদের গান দিয়েও জেনারেশনের টেস্টের ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে। আমরা ওই বেঞ্চমার্কটা তৈরি করার চেষ্টা করি। আমরা আশা করি, আমাদের আশপাশের আরও ১০টা ব্যান্ডও যেন সেটা করতে পারে, কেননা একা কোনো কিছুই হয় না। একজন দিয়ে কিন্তু একটা ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয় না। ওয়ারফেজ কিন্তু এভাবেই তৈরি হয়েছে। আমাদের আগে সিনিয়র ব্যান্ডগুলো তৈরি হয়েছিল বলেই ওয়ারফেজ আসতে পেরেছে। আমাদের দায়িত্ব অন্যদের জন্য ভালো একটি উদাহরণ রেখে যাওয়া, তারা যদি ভালো কিছু না করতে পারে, সেটাও আমাদের ওপরে বর্তায়। আমরা সব সময় চেষ্টা করছি, যেন আমাদের কোনো রিগ্রেট না থাকে যে আমরা ওই সময় চেষ্টা করিনি। ওয়ারফেজের কোনো অ্যালবামে আমরা চেষ্টা করিনি, এই দ্বিধা আমাদের মনে হয়নি যে আমরা ওই অ্যালবামটা আরও বেশি চেষ্টা করতে পারতাম। আমাদের যতটুক লিমিটেশন, যে অবস্থা ছিল, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এরপর কোনোটা ভালো হয়েছে, কোনোটা হয়নি, কোনোটা একটু কম ভালো হয়েছে, কোনোটা বেশি। এটাই। আমাদের কোনো দুঃখ নেই, তবে হ্যাঁ, ওখানে আমাদের আরও কিছু করার ছিল।