আমার ভেতরে কবিতাটাই বেশি আছে — ড. আবেদ চৌধুরী

আমাদের দেশের একজন মাঠপর্যায়ের গবেষকের গল্প জানব আজ। তিনি সুদূর অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা দেশের গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগকে নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়ে ছুটে আসেন এ দেশের মাটির মানুষের কাছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে থেকে নিজের গবেষণার মাধ্যমে আরও একটু ভালো জীবন উপহার দিতে চেয়েছেন সবাইকে। দীর্ঘ ১২ বছর সিলেটের কানিহাটি গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রোদ-বৃষ্টিতে নিরলস পরিশ্রম করে আমাদের দেশের ধানকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন তিনি। একাধারে গবেষক, লেখক, কবি ও সমাজকর্মী হিসেবে পরিপূর্ণ এই মানুষটি হচ্ছেন ড. আবেদ চৌধুরী। ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি হাজির হয়েছিলেন কিশোর আলোর কার্যালয়ে। কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকন ঘোষ দস্তিদার, সরকারি বিজ্ঞান কলেজের হাসনাইন তোহা, নটর ডেম কলেজের আমজাদ হোসেন মজুমদার ও সরকারি বাঙলা কলেজের আলিমুজ্জামান-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন তাঁর জীবনের অসাধারণ মুহূর্তগুলো।

প্রশ্ন :

ছোটবেলা থেকেই কি গবেষক হতে চেয়েছিলেন?

সেভাবে ছোটবেলায় কিছু ভাবিনি। আমি যখন আমেরিকায় লেখাপড়া করতে গেলাম, তখন থেকেই বিভিন্ন অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহটা এভাবেই বেশি তৈরি হলো। এসব বড় বড় বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাছাকাছি আসার পর আমার মনে হয়, আমি নিজেও এ ধরনের কাজে সফলতা পাব।

প্রশ্ন :

প্রথমে ছিলেন মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুলে। তারপর নটর ডেম কলেজে আসা। মফস্বল শহর থেকে একটা বড় শহরে এসে পড়াশোনা করা, এ ব্যাপারটা কীভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন?

এটা একটা বড় পরিবর্তন। নটর ডেম কলেজে পড়তে এসে দেখলাম, অনেক ভালো ভালো ছাত্র এখানে পড়াশোনা করছে। তারা অনেক বেশি জানে, অনেক ভালো ইংরেজি জানে। তখন তাদের দেখে আমার মনে হলো, তাদের সমান হতে হলে আমাকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। অনেক বেশি পড়ালেখা করতে হবে। তা ছাড়া মফস্বল থেকে ঢাকায় আসার ফলে আমার মধ্যে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, নিজেকে আরও একটু দক্ষ করে তোলার।

প্রশ্ন :

দেশের বাইরে প্রথম পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর একে একে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অধ্যয়নের সুযোগ পান। এত দীর্ঘ পথচলায় অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কার কাছে?

আমাদের দেশে তো বিজ্ঞানের পথে সেভাবে অনুসরণীয় কেউ ছিলেন না। আমি রসায়নে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন প্রায়ই আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি, পরীক্ষায় পাস করছি—এ রকম এক অবস্থা। কিন্তু বিদেশে গিয়ে বিশেষ করে আমেরিকায় গিয়ে আমি দেখি বিজ্ঞানের একটা সংস্কৃতি আছে যে, ‘বড় বড় বিজ্ঞানীদের ছাত্রদের সংস্পর্শে এসে কথা বলা’, যেটা আমাদের দেশে মূলত কবিদের মধ্যে বা কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে দেখা যায় না। যিনি একজন বিজ্ঞানী, তাঁর সঙ্গে নতুন বিজ্ঞানীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন—এটা দেখা যায় না কখনো। ওই সংস্কৃতিটা আমাদের দেশে নেই। কিন্তু ওখানে এ বিষয়টি সাধারণ সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যদিও আমি অনেক কম বয়সী বিদেশি মানুষ ছিলাম, তবু ওই সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেলাম। আর সেই সংস্কৃতির সুবাদেই, আমি সবকিছু অতি দ্রুত শেখা শুরু করলাম।

প্রশ্ন :

আপনি স্নাতক করেছেন মৌলিক বিজ্ঞানের একটি শাখা রসায়নে। বর্তমানে দেখা যায়, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ইত্যাদি মৌলিক বিজ্ঞানের শাখায় শিক্ষার্থীদের পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

এখন সবাই খুব দ্রুত চাচ্ছে যে এমন কিছু একটা করবে, যাতে একটা চাকরি পেয়ে যাবে। এমন একটি ধারণা এসে গেছে, মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনা করলে কেউ চাকরি পায় না। সবাই যেন বিবিএ পড়ব, ব্যাংকিং পড়ব, ফিন্যান্স পড়ব, অ্যাকাউন্টিং পড়ব। কমার্সের দিকে অনেক ঝোঁক বেশি। এটা ঠিক না। বিজ্ঞান গবেষণায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন রসায়নে যদি কেউ পড়ে সে তো অনেক ভালো কিছু শিখতে পারবে, যদি সে বুদ্ধিমান হয়। বাইরের ক্ষেত্রে যারা বিজ্ঞান থেকে আসবে, যদি চাকরিতে তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে সবাই বিজ্ঞানের দিকেই আসবে। আরেকটা হচ্ছে যে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্রাংশ গবেষণায় যায়। সবাই তো আর গবেষণায় যায় না। কিন্তু আমেরিকায় যেটা দেখেছি যে যারা বিজ্ঞানে অধিক দক্ষ হয়, তারা গবেষণায় যায় এবং সে রাস্তাটা খোলা আছে। সেই আর্থিক সহায়তা তাদের দেশে আছে। আমাদের দেশে গবেষণায় যারা আসছে, তাদের এই পেশায় আগ্রহী করার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। সবাই ব্যাংকে চাকরি খোঁজে বা বিদেশে চলে যেতে চায় কিংবা অন্য যেকোনো চাকরি খোঁজে। যার ফলে তাদের যে ওই মেধা, আগ্রহ সেটা নষ্ট হয়। বিজ্ঞান গবেষণায় ভবিষ্যৎ তৈরির যে একটা রাস্তা, সেটা তৈরি করার জন্য মূলত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আর্থিক নির্ভরতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

আপনি একাধারে গবেষক, শিক্ষক, লেখক এবং কবি। নিজের কোন পরিচয়টা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?

আমি তো প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম। ওই সময় তো বিজ্ঞানের কোনো সুর আমার মধ্যে ছিল না। সে জন্য কবিতাটাই বেশি ভেতরে আছে। আর এখন তো একধরনের সামাজিক কাজ করি। গ্রামে কাজ করি। দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করি। আমার কাছে মনে হয়, সবকিছু সমান একটা পরিচয় বহন করে।

প্রশ্ন :

আপনার প্রিয় কোনো কবিতার লাইন যেটা এখন মনে পড়ছে?

দিলওয়ারের কবিতার অল্প কয়েকটা লাইন বলতে পারি। লেখক একজনকে উদ্দেশ করে বলছেন—

‘অতএব তুমি এসো
যেখানে জীবন চায়, সমুদ্র সম্মানবোধ
শূকরেরা কাদাজল ছোড়ে, হরিণীরা যেতে চায়
স্বচ্ছপ্রাণ ঝর্ণার বন্দরে।
এক হাতে বজ্র তার আর অন্য হাতে ফুলের নম্রতা
আমার স্বদেশ হাতে,
সংগ্রাম করা সত্যের শুভ্রতা।’

প্রশ্ন :

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত অনেকেই বলে জীবিবিজ্ঞান প্রচুর মুখস্থ করতে হয়। কেউ কেউ বলে স্রেফ মুখস্থই করতে হয়, বোঝার অংশ খুবই কম। এ বিষয়ে আপনার কী মতামত?

মুখস্থ তো খুবই খারাপ। আর জীববিজ্ঞান মুখস্থ মানে এর চেয়ে খারাপ কিছু আর চিন্তা করা যায় না!

প্রশ্ন :

তবে কবিতাটা তো মুখস্থই বললেন!

(হাসি) কবিতা তো মুখস্থই বলতে হবে। কবিতাটা ভেতরে না থাকলে সব সময় কোথায় কবিতার বই খুঁজবে? কিন্তু জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় যেটা, সেটা তো আত্মস্থ করতে হবে। ডিএনএকেন্দ্রিক চিন্তা বা বিবর্তনভিত্তিক চিন্তা, এ চিন্তাটা মাথায় ঢুকে গেলে তখন সবকিছুতেই মনে হবে একটা নতুন জীবন চলে এসেছে। একজন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী বলেছেন, ‘Nothing in Biology makes sense except in the light of evolution.’ গোটা প্রাণী জগতে বিভিন্ন জাতের পাখি আছে, একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। এটা যদি কেউ বিশ্বাস না করে বা এভাবে চিন্তা না করে বা একজন মানুষ যদি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করে, তাহলে তার মুখস্থ করতেই হবে। সব পাখির নাম মুখস্থ করতে হবে, সব লতাপাতার নাম মুখস্থ করতে হবে। আর যদি এই বিশ্লেষণমূলক চিন্তা, যা একটা বিশাল ইতিহাসের মতো। জীববিজ্ঞানের মৌলিক ইতিহাস। তখন সবকিছুতেই মনে হয় যে একটা জীবন চলে এল।

প্রশ্ন :

সে ক্ষেত্রে কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের কোনো ত্রুটি রয়েছে?

পাঠ্যবইয়ে তো বিরাট সমস্যা। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো যে আকর্ষণীয় বিষয়গুলো বলা হয় এমএ পড়ার সময়। ছোটবেলায় বলা হয় না। ছোটবেলায় বলা হয় সব কঠিন জিনিসপত্র, তাই না? জীবনের বড় রহস্য কাহিনি যেটা, সেটা এমএসসি করতে গিয়ে, পিএইচডি করতে গিয়ে মানুষ জানে। আমরা ‘আলোর মশাল’ নামের একটা প্রতিষ্ঠান করেছি। যেখানে আমরা প্রথমেই এসব রহস্যের গল্প ছোটদের জানিয়ে দিই। বিগ ব্যাং থিওরির কথা...অমুক তমুক, সব বাচ্চা এটা বুঝতে পারে। এটা না বলার ফলে তারা এটাকে কঠিন মনে করছে। আর বিভিন্ন নাম দিয়েছে। জেনেটিকসের একটা কঠিন নাম আছে কৌলিতত্ত্ব। জিনের কারণে জেনেটিকস। জিন শব্দটি একটি মিলিত শব্দ। কোডন কথাটা কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্সের আগে জীববিজ্ঞানে এসেছে। কোডন, অ্যান্টিকোডন, কোডিং স্ট্র্যান্ড, নন-কোডিং স্ট্র্যান্ড, কোডন নিউক্লিয়েসিস...জীবনের সব ডিএনএ একেক প্রকার কোড এবং এ কথাগুলো চল্লিশের দশকের, পঞ্চাশের দশকের। কম্পিউটার সায়েন্স তখনো এত বেশি কোড কথাটা ব্যবহার করে না, তবে জীববিজ্ঞানেই বেশি ব্যবহার হয়। তো এ কোডনটা যে জীবনের কোড, এই চিন্তা থেকে সবকিছু করতে হবে। একদিকে ডিএনএভিত্তিক চিন্তা, আরেকটি হচ্ছে একধরনের প্রাচীন ইতিহাস, বিবর্তনভিত্তিক চিন্তা। তখন হঠাৎ করে জীববিজ্ঞান জীবিত হয়ে যায়। সেসব না করে আমাদের পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হচ্ছে জটিল নতুন নতুন শব্দ। আমাকে সবাই তো বলে জিন, জেনেটিকসের জিন। কৌলি তো বলে না! কিন্তু কৌলি কথাটা চালু আছে। আমি গিয়েছিলাম হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে দেখলাম কৌলি লেখা। এত কথা তো মানুষ মনে রাখতে পারে না। ফলে বিষয়টা সহজ হবে যখন ছোট্ট কথাগুলোর মানে যত ছোট থাকে। চায়নিজরা দেখা যাচ্ছে গণিতে সবচেয়ে ভালো। যেমন উনিশ শ চুরাশি, এ কথাটা চায়নিজ ভাষায় সবচেয়ে দ্রুত বলা যায়। আর ছোটখাটো একটা বাক্য হয়ে যায় এটা ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলতে গেলে। এ কথাটা বলা খুব কঠিন ফরাসি ভাষায়। তো এভাবে শব্দের সঙ্গে বিষয়কে সহজ ও বোধগম্য করার একটা ইঙ্গিত আছে।

প্রশ্ন :

জীববিজ্ঞানে আমাদের দেশের অনেক অর্জন আছে। পাটের জিনরহস্য উন্মোচিত হয় বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে দেশীয় গবেষণার মাধ্যমেই। তাহলে আপনার কি মনে হয় আমাদের দেশে বসেই এ ধরনের গবেষণা চালানো সম্ভব?

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার মনে হয়, গবেষণা করতে হলে এটা থাকবে, ওটা থাকবে, দামি যন্ত্র থাকবে এগুলো বিষয়টাকে জটিল করে ফেলে। যেমন আমার খুব প্রিয় একজন জীববিজ্ঞানী আমাকে বলেছেন, ‘Everything is in the dirt and the mud.’ এটার মানে হচ্ছে ওই মাটির মধ্যেই সব মিশে আছে! বাংলাদেশের ইউনিক ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আমরা কেউ জানি না। ঢাকার ব্যাকটেরিয়া কী, সিলেটের ব্যাকটেরিয়া কী, হাজারীবাগ ট্যানারিতে ব্যাকটেরিয়া কী? এটা জানতেই বা কী লাগে? সেখানকার ওই পচা দুর্গন্ধ জায়গার মাটির একটা স্যাম্পল। লুই পাস্তুর এভাবেই গবেষণা করতেন। দেখা যাবে, নতুন একটা ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু এটা করার তো কোনো সুযোগ নেই। এটা করতে হয়তো ৫০ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু এই চিন্তাটাও নেই। সবাই দুই মিলিয়ন ডলারের জন্য অপেক্ষা করছে, যেটা কখনো আসবে না। অণুজীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমি বলছি। এক জাতের ধানের সঙ্গে আরেক জাতের ধানের ডিএনএ ক্রস করে আমরা যেটা করলাম, ১২ বছর ধরে এগুলো মাঠের কাজ। এটা খুবই কঠিন কাজ যখন খুব গরম পড়ে। এটা কোনো আরামদায়ক গবেষণাগারের কাজ না। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে, তাদের দেখলে মনে হয় মাঠের রাখাল বা কৃষক। কিন্তু এই কাজটা তারা করতে পেরেছে। বড় বড় বিজ্ঞানী যেমন লুই পাস্তুর কিংবা এখনকার সময়ের বিজ্ঞানীরা, আমার শিক্ষকেরা তাঁরা খুবই সাধারণ। দেখা যাচ্ছে, একটা পাত্রের মধ্যে স্যুপ জ্বাল দিয়ে তাতেই খেয়ে নিচ্ছেন। বাটিতেও ঢালছেন না। কিন্তু আমাদের দেশের সব অভিজ্ঞতা উপনিবেশবাদ থেকে আসা। গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা সব স্যুট পরে, খুব দামি জায়গায় বসে তারপর বিজ্ঞানের কাজ করে—এ রকম ধারণা আছে আমাদের। চারদিকে কাচযুক্ত ল্যাব থাকবে, সব সময় আলো ঝলমল করবে, মিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি আসবে—এসব ধারণা তো ঠিক না। বিজ্ঞানের গবেষণা ধূলি-কাদার মধ্যে হতে পারে, অজপাড়া গাঁয়ে হতে পারে। বিজ্ঞান একটা চিন্তার মতো। কবিতা যেমন একটা উৎকৃষ্ট চিন্তা থেকে আসে, বিজ্ঞানও তেমনি চিন্তার ব্যাপার। কবিতা লেখার জন্য চিন্তা করে লিখলেই হয়, এর জন্য তো টাইপরাইটারের দরকার পড়ে না। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন কীভাবে একটা উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম হয়: ‘অবণী বাড়ি আছো ’-এর থেকেই শুরু হয়ে গেল একটা কবিতা, তাই না? বিজ্ঞানও এ রকম। ক্ষুদ্র প্রশ্ন থেকেই শুরু। হাজারীবাগের ট্যানারিতে কী ব্যাকটেরিয়া আছে? একজন আইসোলেট করল, ট্রিপ্লেটে দিল। একটা নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু এ রকম কাজ কেউ করছে না কেন? এটাই আমার প্রশ্ন। এ রকম কাজ না করে শুধু বলে, আমি আমেরিকা যাব। অভিভাবকেরা সংগঠিত হয়ে এ ধরনের গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। গণিত অলিম্পিয়াডের সম্পাদক মুনির হাসানের মতো সংগঠক বলছে, প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নামে ল্যাব হোক। কিন্তু সব লোক এগিয়ে এসে এটা করছে না কেন? আমি জানি না কতটা সহায়তা সে (মুনির হাসান) পাচ্ছে। পেলেও বড় কিছু নয়। এটাই এখানকার মানুষের মাঝে বিজ্ঞান-অজ্ঞতা।

প্রশ্ন :

পিতৃহীন বীজ উৎপাদনপ্রক্রিয়া ‘এপোমিক্সিস’ বাংলাদেশের কৃষির তৃণমূল পর্যায়ের জন্য কতটা উপযোগী?

এটা এখনো তৃণমূল পর্যায়ে আসেনি। এটার কতগুলো প্রযুক্তিগত সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, এটাকে তৃণমূল পর্যায়ে উপযোগী করে তোলার জন্য এখনো বেশ কিছু গবেষণার প্রয়োজন। কিন্তু ইদানীং ধানের ক্ষেত্রে বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে। তো আস্তে আস্তে এই এপোমিক্সিস প্রজেক্ট তো আমরা অনেক দিন চালালাম। এখন অন্যরা এগিয়ে আসছে। আমি চিন্তা করলাম, গ্রামে এসে কাজ করব। এ জন্য আমি আধুনিক বিজ্ঞানকে কিছুটা ত্যাগ করলাম। এক রকম হাইপাওয়ার্ড ল্যাব, অনেক মিলিয়ন ডলার...এগুলো ছেড়ে আমি গ্রামের রাতের অন্ধকারে চলে এলাম। গৃহহীন যেমন বাড়ি ত্যাগ করে, ওই রকম আরকি। প্রথমে বাংলাদেশে এসে নতুন ধরনের কাজ শুরু করলাম এবং এ জন্য আমি অনেক খুশি।

প্রশ্ন :

গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? তাঁরা আপনার কাজকে কীভাবে গ্রহণ করছেন?

আমি তো ওই গ্রামেরই মানুষ। আমার পূর্বপুরুষদের জায়গা এটা। গ্রামে থাকার যে সমস্যা, সেগুলো তো আছেই। পল্লী বিদ্যুতের ইলেকট্রিসিটি বেশির ভাগ সময় থাকে না, গরম পড়ে। আমি তো বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকি, যদিও বিদেশে যাই। সেখানেও আমার কাজ আছে। কৃষি একটা কঠিন কাজ। বীজ লাগালেই সব হয়ে যায় না। ঢাকায় যেমন আমার কাছে যারা আসে, আমার সঙ্গে দেখা করতে, তাদের আমি একটা বীজ ধরিয়ে দিই। বলে দিই, এটাকে নিয়ে তুমি আরেকটা বীজ উৎপাদন করে আমাকে কল দিয়ো। তো প্রায়ই বলে, স্যার এই সমস্যা, সেই সমস্যা, খালার বাড়ি গিয়েছিলাম, বিয়েতে গিয়েছিলাম, পানি দিতে পারিনি, গাছটা মারা গেছে। এই যে গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখা, এটা একধরনের চরিত্র গঠন করা। আমার তো মনে হয় কৃষিকাজ করলে একজন মানুষ সবকিছুর জন্য উপযোগী হয়ে যায়।

প্রশ্ন :

আপনি সিলেটে একটা রিসোর্ট তৈরি করেছেন। তো সেখানে আমাদের অর্থাৎ কিশোরদের কৃষি সম্পর্কে আগ্রহী করার জন্য কী কী আছে?

হ্যাঁ, একটা রিসোর্ট চালু করেছি সেখানে। আমাদের গ্রামে চালু হয়েছে এটা। সব মিলিয়ে তিন-চারটা বাংলো আছে। প্রায় ৩০-৪০ জন থাকতে পারবে। পাশেই ধানখেত। রাতে ধান গবেষণা নিয়ে আলোচনা হবে। কিশোরদের জন্য খুবই উপযোগী।

প্রশ্ন :

এখন যারা কিশোর আছে, তারা যদি বিজ্ঞানী হতে চায় বা গবেষক হতে চায় তবে কী করা উচিত?

প্রথমে আমাদের এলাকায় আসুক। আমরা মজার লেকচার দিয়ে তাকে খুব উত্তেজনার সঙ্গে গবেষণার রাস্তায় পাঠিয়ে দেব। প্রথমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করতে হবে। এই যে হাজারীবাগ ট্যানারির কথা বললাম, এ রকম ছোটখাটো ১০টা পরীক্ষা করার উপায় আমরা শিখিয়ে দেব। খুব দ্রুত তাদের বিজ্ঞানী বানানোর রাস্তায় পাঠিয়ে দেব। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা এভাবে এগোতে পারি।

(কিশোর আলোর এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)