‘আমিও একদিন পলিম্যাথ হতে চাই’ — তাহসান

কিআ টিমের কঠিন কঠিন সব প্রশ্নের মুখোমুখি তাহসান
ছবি: সৈকত ভদ্র

তাহসান। এক নামে সবাই চেনে তাঁকে। দারুণ সব গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। অভিনেতা ও মডেল হিসেবেও তিনি জনপ্রিয়।

ছোটবেলায় পড়েছেন সেন্ট যোসেফ স্কুলে। তারপর নটর ডেমের গণ্ডি পেরিয়ে আইবিএ হয়ে আমেরিকার কার্লসন স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে করে এসেছেন এমবিএ।

অনেক আগে তাঁর এক ভাতিজা বলেছিলেন, বাংলাদেশে তেমন কোনো রোল মডেল নেই। কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল তাঁর। অতঃপর দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা নিয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছেন। সেদিনের তাহসান আজ এত কম বয়সে তরুণ প্রজন্মের কাছে সত্যিই একজন রোল মডেল।

তাহসান মুখোমুখি হয়েছিলেন কিআর সাক্ষাৎকার দলের। দলে ছিল ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের হোমায়রা মাইশাফারিহা চৌধুরী, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাহাতাব রশীদ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সুপান্থ দে এবং হলিক্রস কলেজের ফাহমিদা আলম

প্রশ্ন :

সংগীতজীবনের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

ছোটবেলায় শিশু একাডেমীতে মা জোর করে নিয়ে যেতেন। তখন সংগীতের প্রতি এখনকার মতো তীব্র অনুরাগ ছিল না। কিন্তু এখন বুঝি, শিশু একাডেমী কিংবা পরবর্তী সময়ে ছায়ানট ছাড়া আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না।

প্রশ্ন :

মা-বাবা অনেক সময়ই বলেন, গানবাজনা করলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। কথাটা কতটুকু ঠিক? আপনি কীভাবে দুটোই সামলিয়েছেন?

ধরো, প্রতিদিন তুমি আট ঘণ্টা করে ঘুমাও। বাকি ১৬ ঘণ্টাই তো তুমি পড়বে না। সব কাজের পর দেখবে, তোমার হাতে তিন-চার ঘণ্টা রয়ে গেছে। আমি সেই সময়টুকুই কাজে লাগিয়েছি।

প্রশ্ন :

আপনার কাছে বন্ধুত্ব মানে...

বন্ধুত্বে তিনটি বিষয় থাকবে—বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর একসঙ্গে থাকার আনন্দ। অর্থাত্, বন্ধুকে শ্রদ্ধা করবে। যেকোনো কথা শেয়ার করতে পারবে। একসঙ্গে থাকলে খুশি হবে। এরই নাম বন্ধুত্ব।

প্রশ্ন :

কখনো স্কুল পালিয়েছেন?

সেন্ট যোসেফ স্কুলে স্কুল পালানোটা মোটামুটি অসম্ভব ছিল। তাই তেমন স্কুল পালানো হয়নি। তবে দু-একবার পালিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আর কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন :

স্কুলে হোমওয়ার্ক না নিয়ে গেলে কী অজুহাত দিতেন?

(অবাক হয়ে) হোমওয়ার্ক নিয়ে যাব না কেন? সব সময় হোমওয়ার্ক নিয়ে যেতাম।

প্রশ্ন :

কিশোর তাহসান কেমন ছিল? দুরন্ত না শান্ত?

আমি খুব চঞ্চল ছিলাম। খেলাধুলা করতে ভালোবাসতাম। ইনডোর ক্রিকেট, ক্যারম, সাতচারা আর টেবিল টেনিস খেলতাম।

প্রশ্ন :

প্রথম মঞ্চে ওঠার অনুভূতি কেমন ছিল?

প্রথম মঞ্চে ওঠার কথা অবশ্য মনে নেই। তবে একটা ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৯২ সালে ক্লাস ফাইভে থাকতে একবার পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে গান গেয়েছিলাম। পরদিন সেই ছবিটা ছাপা হয়েছিল ইত্তেফাক-এ। বন্ধুরা দেখে ছবিটা স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে লাগিয়ে দিয়েছিল।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের অনেক মানুষ তাহসানকে দেখতে চায়। আপনার জীবনেও কি এমন কোনো ব্যক্তিত্ব আছে, যাঁর সঙ্গে আপনি দেখা করতে চান?

ছোটবেলা থেকেই আমার পলিম্যাথদের সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছা। পলিম্যাথ হলো, যিনি একই সঙ্গে অনেক বিষয়ে অনেক বেশি পারদর্শী। তাঁদের মধ্যে আছেন সত্যজিৎ রায়, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, ভিগো মর্টেনশেন। আমিও একদিন পলিম্যাথ হতে চাই।

প্রশ্ন :

‘তিন গোয়েন্দা’ নাকি ‘ফেলুদা’—কোনটা বেশি প্রিয়?

ফেলুদা। অনেকবার পড়েছি।

প্রশ্ন :

আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলে কোন তিনটি ইচ্ছা পূরণ করতেন?

আমার ‘ইচ্ছা’ গানের শেষ লাইনে আছে যে, ‘পৃথিবীর সব সৃষ্টি নিয়ে স্বর্গে যেতে চাই।’ এই ইচ্ছাটা পূরণ হলেই আসলে সব ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়।

প্রশ্ন :

হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে কী করবেন?

প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। একজন ‘লিডার’ হতে চাই, যিনি স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন এমনভাবে সবাইকে দেখাতে পারেন, যেন সবার মনে হয় স্বপ্নটা আসলে তার নিজেরই।

প্রশ্ন :

আপনাকে দেখলে অনেক শান্ত প্রকৃতির মনে হয়। আপনি কি আসলেই তাই?

এখন আমি এক মেয়ের বাবা। তাই ছোটবেলার সে রকম দুরন্তপনা আর নেই। মেয়েকে নিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়াই আমার বর্তমান দুরন্তপনা।

প্রশ্ন :

আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত কোনটি?

যখন আমার মেয়ে আইরাকে প্রথম কোলে নিই।

প্রশ্ন :

ঘুম থেকে উঠে দেখলেন এলিয়েনরা আপনাকে আক্রমণ করেছে। তাদের দাবি, মঙ্গল গ্রহে আপনাকে কনসার্ট করতে হবে। কী করবেন?

আমি বলব, তোমরা আমাকে আগে তোমাদের ভাষা শেখাও, তোমাদের টেকনোলজিগুলো শেখাও, যাতে সেখানে গিয়ে তোমাদের আনন্দ দিতে পারি। আর আমি সেখানে গেলে তারা আমাকে কী দেবে, তা-ও জানতে চাইব। আর হ্যাঁ, আমি সব সময় যেকোনো কিছু করার আগেই তা শিখে নিতে চাই।

প্রশ্ন শুনে মাঝেমধ্যে বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন তাহসান
ছবি: সৈকত ভদ্র

প্রশ্ন :

সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি...

এটা যদি আমার শেষ দিন হয়, তাহলে যেন দিনটাতে মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারি।

প্রশ্ন :

যে কাজটা কখনোই তাহসানের দ্বারা সম্ভব নয়...

ছবি তোলা। শুধু আমার মেয়ে আইরার ছবিই আমি নির্ভয়ে তুলি। কারণ, সেই ছবিগুলো শুধু আমার, এগুলো আমার জন্যই...

প্রশ্ন :

এমন কোনো ঘটনা আছে, যা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে?

যখন জি-সিরিজ থেকে প্রথম অ্যালবাম বের করার জন্য ডাক পেলাম।

প্রশ্ন :

যদি ‘কিআ’র পাঠকেরা আপনার কাছে গান শিখতে চায়, কী করবেন?

অবশ্যই শেখাব।

প্রশ্ন :

গুণীজনেরা বলেন, ‘লক্ষ্য স্থির রেখে সামনে এগিয়ে যাও; সাফল্য আসবেই।’ আপনার তো বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখা যায়, তো আপনি কিশোর বয়সে ঠিক কোন লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছিলেন?

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ‘মিউজিশিয়ান’ হব। তা ছাড়া আমি চাইতাম সেই ‘ফেমাস রোল মডেল’ হব; যাকে দেখে দেশের সবাই গর্ব করবে।

প্রশ্ন :

ভূতে বিশ্বাস করেন?

ভূতে একদমই বিশ্বাস করি না।

প্রশ্ন :

ভূত দেখেছেন কখনো?

না। তবে একবার শুটিংয়ে আমাদের এক জমিদারবাড়িতে থাকতে হয়েছিল। সেই জমিদারবাড়িতে নাকি ভূত আছে। ডিরেক্টর ভূতের ভয়ে অন্য জায়গায় রাতে থেকেছিলেন। তবে আমি ওখানেই ছিলাম। সকালে সবাই আমাকে সাহসী ভেবে বাহবা দিচ্ছিল।

প্রশ্ন :

কিশোর গায়কদের উদ্দেশে আপনার কোনো পরামর্শ?

আউটলায়ারস বইয়ের লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের একটি উক্তি আছে, ‘তুমি যদি ১০ হাজার ঘণ্টা কোনো কাজে ব্যয় করো, তবে সেই কাজে তুমি পারদর্শী।’ কাজেই তুমি যদি গান নিয়ে ১০ হাজার ঘণ্টা ব্যয় করে ফেলো ইতিমধ্যে, তবে সেটার পেছনেই লেগে থাকো।

সাক্ষাৎকার শেষে এবার গ্রুপ ছবি তোলার পালা। তাহসান দাঁড়িয়ে গেলেন কিআ হাতে
ছবি: সৈকত ভদ্র

প্রশ্ন :

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!

তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ!

প্রশ্ন :

সবশেষে কিআর পাঠকদের জন্য কি কিছু বলবেন?

হ্যাঁ। তবে না বলে লিখেই দিই—

সাক্ষাৎকার দলের পাঁচজনের ছাড়া আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে: আকিবুজ্জামান, মাশরিক ফাইয়াজ, মাহমুদ সৌরভ, মো. সিফাত, আনতাসুম মুনতাজেরিন, আহমেদ সিরাত, মাসুক-আল-ইস্তি, উম্মে হাফিজা, সিনথিয়া জামান, হামিম হামিদ, মাহবুবা শারমিন, মো. বেলাল হোসেন, তাসমিয়া রহমান, সাহিব নিহাল, তাবাসসুম খান, তানজিনা মিলি, রিফা নাজিবা, ইউসুফ, ফাবিহা হোসেন ও আহনাফ আবিদ বসুনীয়া।

(কিশোর আলোর ডিসেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত)