গান শোনার স্পিকার টাকা দিয়ে কেনা যায় কিন্তু আমাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না — শিরীন শারমিন চৌধুরী

আগেকার বাংলা সিনেমার নায়কেরা খবরের কাগজ হাতে চিৎকার করে বলত, ‘মা, মা, আমি ফার্স্ট হয়েছি!’ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সে রকমটা না করলেও জীবনের বেশিরভাগ পরীক্ষাতেই বরাবর ফার্স্ট হয়েছেন। ১৯৮৩ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তখন এখনকার মতো জিপিএ পদ্ধতি ছিল না, নম্বরের ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারিত হতো বলে কে প্রথম বা দ্বিতীয় হলো, তা সহজেই জানা যেত। ১৯৮৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় একই বোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে অর্জন করেন দ্বিতীয় স্থান। ওই একবারই সেকেন্ড হওয়া, এরপর আবারও ফার্স্ট হন এলএলবি পরীক্ষায়। সেটা ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৯০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায়ও হন ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট। ২০০০ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম নারী স্পিকার তিনি। ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও। ২০১৪ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনে এই গুণী মানুষ মুখোমুখি হয়েছিলেন কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের। সেই দলে ছিল—ঢাকা বিজ্ঞান কলেজের জান্নাতুল নাঈম, এমইএইচএ কলেজের মাহাথির হক, ঢাকার অরণি বিদ্যালয়ের মনন মাহমুদ, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজের ইসমত জাহান এবং হলি ক্রস কলেজের আনতাসুম মুনতাজেরিনতানজিনা আলম

প্রশ্ন :

আপনি তো হলি ক্রস স্কুলে পড়েছেন। কলেজও সেটাই। সেখানকার শিক্ষকেরা আপনার মতো হতে বলেন। কেমন লাগে নিজেকে একজন রোল মডেল হিসেবে দেখতে?

আমার মতো হতে বলেন নাকি? (হাসি) এটা আসলে অন্যের পক্ষে বলা যেমন সহজ, নিজের পক্ষে গ্রহণ করা ঠিক ততটাই কঠিন। আমি এমনটা মনে করি না। স্কুল-কলেজ থেকে নিয়ম মেনে চলে এসেছি, তাই হয়তো এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। তবে এটা ঠিক, এমনটা শুনলে ভালো লাগে।

প্রশ্ন :

কেমন ছিল হলি ক্রসের দিনগুলো?

হলি ক্রসেই আমি কেজি থেকে একেবারে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি। কাজেই স্কুলজীবন বলতে হলি ক্রসকেই বুঝি। স্কুলজীবন অবশ্যই সুখের একটা সময়। বড় হয়ে পেছন ফিরে তাকালে এর মূল্যটা বেশি বোঝা যায়। সেখানেই সব বন্ধুত্বের ভিত রচনা হয়। স্কুলজীবনে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, সেটাই সবচেয়ে সুদীর্ঘ ও সুদৃঢ় হয়। পরবর্তী সময়ে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই বন্ধুত্ব হয় কিন্তু স্কুলে সেই শৈশব জীবনের বন্ধুত্বটা একটা অন্য রকম বিষয়। একসঙ্গে বেড়ে ওঠার কারণে, তুমি আসলে যা, সেটাই সেখানে প্রকাশ পায়। এ কারণেই বোধ হয় এই বন্ধুত্বটা একটা বিশেষত্ব বহন করে।

প্রশ্ন :

আগেরকার দিনের বাংলা সিনেমায় দেখা যেত নায়ক দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলছে, ‘মা, মা, আমি ফার্স্ট হয়েছি।’ আপনি তো জীবনের বেশির ভাগ পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছেন। প্রথম হওয়ার পর আপনি কী করতেন?

মাধ্যমিক পরীক্ষায় যখন প্রথম হলাম, তখন সেই অনুভূতিটা অন্য রকম ছিল। কারণ, সেটাই ছিল প্রথমবার বোর্ডে প্রথম হওয়া। পরিবারের একটা আশা ছিল হয়তো ফলাফল ভালো হবে কিন্তু একেবারে প্রথম হওয়াটা তো কখনোই নিশ্চিত না। রেজাল্ট পাওয়ার পর বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত-আনন্দিত ছিলাম।

প্রশ্ন :

জীবনে কোনো বিষয়ে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন নম্বর কত ছিল?

(হাসি) আমি আমার জীবনের সর্বনিম্ন নম্বরটা পেয়েছিলাম ম্যাট্রিক পরীক্ষায়। যদিও আমি ৭৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু ইংরেজিতে মাত্র ৪৩ পেয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি বেশ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ৮০ না পেলেও অন্তত ৬০ তো পাওয়া উচিত। পরে জানতে পারলাম, সেবার ইংরেজিতে সবাই কম নম্বর পেয়েছিল।

প্রশ্ন :

আপনি কি সারা দিন শুধু পড়ালেখা করতেন? নাকি পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা বা সহশিক্ষা কার্যক্রমেও আপনার আগ্রহ ছিল?

আমরা স্কুলে অনেক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকতাম। তা ছাড়া স্কুল প্রেসিডেন্ট, কলেজ প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে নানা ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, সেগুলোর আয়োজন করা নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতাম। সারাক্ষণ লেখাপড়া করতাম না। তবে টেস্টের পরে এসএসসির আগে যে তিন মাস স্কুল বন্ধ হয়ে থাকে, সেই সময়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছি।

প্রশ্ন :

খেলাধুলা কিংবা সৃজনশীল কর্মকাণ্ড থেকে যাঁরা ছেলেমেয়েদের বিরত রাখতে চান, তাঁদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?

আমি মনে করি পড়াশোনার পাশাপাশি আর কোনো কিছু না করাটা পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে না। আমরা যেমন স্কুলে নানা ধরনের বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, অন্যান্য বিদ্যালয় বা কলেজের সঙ্গেও যে অনুষ্ঠান আয়োজন হতো, সেখানেও অংশগ্রহণ করতাম। ছাত্রছাত্রীদের সবকিছুতেই উৎসাহিত করা উচিত।

প্রশ্ন :

আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ও পড়েছেন। প্রতিষ্ঠান দুটিতে শিক্ষার মানের পার্থক্য কতটুকু বলে আপনার মনে হয়?

আসলে ওদের আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের পড়াশোনাটা থিওরিভিত্তিক আর ওরা প্র্যাকটিক্যালটাকেও বেশ অগ্রাধিকার দেয়। আমি যখন পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম, তখন যাঁর অধীনে পিএইচডি করেছি, তিনি কোনো বিষয় বোঝানোর পর জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি কি বুঝতে পেরেছ?’ আমি যদি বলতাম, ‘হ্যাঁ’, তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে বলতেন। তাঁরা থিওরি বা মুখস্থ কিছু লিখতে দেখলে বিরক্ত হতেন। তাঁদের মতে ছিল, ‘সামথিং হ্যাজ টু বি নিউ!' তা ছাড়া তাঁরা সমালোচনার দিকটিও পছন্দ করতেন।

প্রশ্ন :

এখন তো বেশির ভাগ অভিভাবক সন্তানদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করাতে চায় যেন তারা বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। একই সঙ্গে একটা ধারণা আছে যে মানবিক বিভাগে যারা পড়ে, তারা অতটা মেধাবী না। অথচ আপনি নিজেই মানবিক বিভাগে পড়েছেন। প্রচলিত এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আমি মনে করি না বিভাগ দিয়ে মেধা যাচাই হয়। কিংবা সেটা সম্ভব। যার যেটা ভালো লাগবে, সে সেটা পড়বে। ‘বিজ্ঞান’ বিভাগে পড়লে অনেক সুযোগ থাকে। কারণ, সেখান থেকে খুব সহজেই অন্য বিভাগে যাওয়া যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় শুধু বিজ্ঞান বিভাগেই পড়তে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরকে দেখলেই বুঝতে পারবে। তিনি পড়াশোনা করেছেন বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু কাজ করছেন ব্যাংকে। এটা আসলে একটা থিংকিং প্রসেস। সঠিকভাবে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সব সম্ভব। আমার মানবিকে আসার কারণ আমি আইন পড়তে চেয়েছি।

প্রশ্ন :

এত চমৎকার রেজাল্ট করার পর অন্যান্য অনেক পেশায় নিয়োজিত হতে পারতেন। রাজনীতিতেই কেন জড়ালেন?

আমি ছোটবেলা থেকেই আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে চাইতাম। সে কারণেই আমি মানবিক বিভাগে পড়েছি। পরবর্তী সময়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে আইনজীবী হয়েছি। ১৫ বছর সুপ্রিম কোর্টে কাজ করেছি। আইন পেশাটা বেছে নিয়েছিলাম মূলত দুটো কারণে। এটা হচ্ছে একটা স্বাধীন পেশা। যেহেতু এই পেশাটা নিজেই করা যায়, সেহেতু রাজনীতি করার সুযোগ থাকে। সরকারি চাকরি করলে তো আর রাজনীতি করা যাবে না। কিন্তু আইন নিয়ে পড়লে বা আইনজীবী হলে সেই জায়গাটাতে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগগুলো বেশি থাকে। আর রাজনীতি আমার কাছে সব সময় খুব আগ্রহের একটা বিষয় ছিল। কারণ, আমি রাজনৈতিক পরিবারের আবহের মধ্যে বড় হয়েছি। আমাদের বাড়িতে সব সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো। সেখান থেকে হয়তো রাজনীতি করার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। ম্যাট্রিকের পরে আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। সেখানে আমি বলেছিলাম যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনজীবী হতে চাই। সেই লক্ষ্যেই রাজনীতিতে আসা। আর মানুষের জন্য কাজ করার সবচেয়ে বড় সুযোগটা হয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে।

প্রশ্ন :

রাজনীতি বর্তমানে এতটা নেতিবাচক বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যে এখনকার অনেক কিশোর-তরুণ রাজনীতি পছন্দ করে না। বিষয়টা কীভাবে দেখেন?

রাজনীতি বলতে আমরা এখন যা বুঝি, সেটার কারণে বোধ হয় এ ধরনের ধারণা হচ্ছে। কিন্তু আসলে সংসদ হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল তিনটি অঙ্গের একটি, যেটা আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ জায়গা। বিচার বিভাগের সঙ্গে জাতীয় সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের সম্পর্ক কী হবে; এসবই কিন্তু রাজনীতি। কীভাবে একটা রাষ্ট্র কাজ করবে, এ বিষয়গুলো খুবই গভীর। যে আইনটা এখান থেকে পাস হচ্ছে, সেটা আমাদের সবার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সিগন্যালে লাল বাতি জ্বললে গাড়ি থামবে, সবুজ বাতি জ্বললে গাড়ি চলবে, তুমি রাস্তার কোন পাশ দিয়ে হাঁটবে এগুলোও আইন। অর্থাৎ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র আইন দ্বারা প্রভাবিত। আর এ আইন প্রণীত হচ্ছে জাতীয় সংসদে। তোমরা যদি মনে করো যে কোন আইন তোমাদের পছন্দ না বা এ আইন তোমাদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে এবং তোমরা এর পরিবর্তন চাও, তাহলে নিজেদের কথা বলতে পারা এবং সেটার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হবে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তোমরা তো আর সংসদে আসতে পারছ না। জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের মতামতের প্রতিফলন সংসদে ঘটবে। এখন এমন যদি একটা আইন প্রণয়ন করা হয় যে দেশের কোনো নারী বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না—সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এ আইন পাস হলেও সেটা কেউ মেনে নেবে না। কারণ, এটার কারণে নারী সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন এ আইন পাস হওয়ার আগেই জনপ্রতিনিধিরা এটার বিরোধিতা করবেন। রাস্তায় মিছিল করে ওটা তুমি যতখানি না বন্ধ করতে পারবে, তার চেয়ে তুমি সংসদের ভেতর একটা কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে সেটা বন্ধ করতে পারো। কারণ চূড়ান্ত সমাধান তো সংসদেই হতে হবে। এসব কিছুই কিন্তু রাজনীতির অংশ। এর বাইরে আমরা কেউ নেই।

প্রশ্ন :

আপনি সংসদের ‘স্পিকার’। সেই হিসেবে আপনার শুধু বলার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সাংসদেরা আপনার উদ্দেশে কথা বলেন আর আপনি তা শোনেন। আপনার এই পদটার নাম কি তাহলে ‘লিসেনার’ হওয়া উচিত ছিল না?

খুবই মজার ব্যাপার (হাসি)। কিন্তু একটা কথা আছে, ‘বক্তা হলো সে-ই, যে সবচেয়ে কম বলে।’ আর অনেক দেশে স্পিকারকে প্রেসিডেন্ট, প্রিসাইডিং অফিসারসহ বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়।

প্রশ্ন :

সংসদে যে কারও মাইক বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। রাস্তায় যখন প্রচণ্ড শব্দে মাইক বা হর্ন বাজে, সে সব বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা করে না?

হ্যাঁ করে। এই ধরনের শব্দ রাস্তায় একেবারেই হওয়া উচিত না। এটা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের শ্রবণশক্তির ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। এটা আসলেই কাম্য নয়।

সংসদ চালানো যেমন কঠিন তেমনি কঠিন কিআ টিমের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া
ছবি: কবীর শাহরীয়ার

প্রশ্ন :

সংসদের স্পিকার আর গান শোনার স্পিকারের মধ্যে মিল বা পার্থক্য কী?

(হাসি) সেদিন একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার ইলেকট্রনিকসের জিনিসপত্রের প্রতি ভীষণ আগ্রহ আছে। সে একটা বিদেশি স্পিকারের কথা বলছিল। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আমার আর গান শোনার স্পিকারের মধ্যে পার্থক্য হলো গান শোনার স্পিকার টাকা দিয়ে কেনা যায় কিন্তু আমাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না।’

প্রশ্ন :

টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সময় নষ্ট হয় ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সবাই ব্যস্ত—আমি এই কথার সঙ্গেই একমত না। কারণ, সংসদ অধিবেশন লক্ষ করে দেখবে, প্রথম এক ঘণ্টা প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। এ পর্বে সাংসদেরা মন্ত্রীদের আর প্রতি বুধবার একটা নির্ধারিত সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছেন। এবং লক্ষ করবে যে, সাংসদেরা যথেষ্ট আগ্রহী প্রশ্ন করার ব্যাপারে। তাঁরা এত হাত তোলেন যে স্পিকার হিসেবে আমার সবাইকে সেই সময়ের ভেতর সুযোগ দেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমি চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব সুযোগ দিতে। কারণ, তাঁরা জনপ্রতিনিধি। তাঁরা যদি সংসদে ভূমিকা রাখতে চান তাহলে তাঁদের সুযোগ নিশ্চিত করা স্পিকার হিসেবে আমার বড় দায়িত্ব। এই প্রশ্ন করার বিষয়টা তো তাৎক্ষণিক। এটা এমন না যে, আপনি আগে থেকে তৈরি হয়ে এসেছেন। যেমন, একজন সদস্য লিখিত প্রশ্ন দিয়েছেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী সেটার জবাব দেবেন। তারপর সেই সদস্য এবং আরেকজন সদস্যও মন্ত্রীর জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে একটি করে সম্পূরক প্রশ্ন করতে পারবেন। সম্পূরক প্রশ্নগুলো কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি করতে হয়। তাই আমি মনে করি, এখানে কাজের কথাই বলা হয়ে থাকে।

প্রশ্ন :

প্রচলিত আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ কিন্তু সংসদ শান্তিপূর্ণ হতে পারে কীভাবে?

সংসদ আসলে একটা বিতর্কের ক্ষেত্র। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে, আইন প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা হবে, এখানে ভিন্নমত থাকবেই। এখানে বিরোধিতা থাকবে, গঠনমূলক সমালোচনা থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ বা ওই ধরনের বিষয়গুলো যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শান্তি বিঘ্নিত না করে গঠনমূলক সমালোচনার দ্বারা ভালো কিছু বের হয়ে আসতে পারে।

প্রশ্ন :

কোনটি সামলাতে বেশি বেগ পেতে হয়? সংসদ না সংসার?

এটা তো খুব কঠিন প্রশ্ন! (হাসি) সংসার সামলাতে বেশি বেগ পেতে হয়। সংসার এমন একটা জায়গা, যেখানে কোনো ছুটি নেই, তুমি স্পিকারই হও আর মন্ত্রীই হও। এ কারণে তুমি রাত ১০টায় বাড়িতে ফিরলেও বাড়িতে যারা তোমার সঙ্গে কাজ করে, তারা মনে করে, ‘এখন তো উনি ফিরে এসেছেন, আমার এখন ছুটি।’ এমন না যে তুমি খুব সুখকর, আয়েশি, আরামদায়ক পরিবেশ থেকে বাড়ি ফিরেছ। এখানে নানান কিছু সামাল দিয়ে তুমি যখন বাসায় ঢুকছ, তখন তুমি একটু প্রশান্তি, একটু বিশ্রাম আশা করো। মনে করো, যেদিন তোমার ছেলের জন্মদিন এবং সেদিনই সংসদের প্রথম অধিবেশন। সেখানে কিন্তু তুমি আর ছাড় দিতে পারছ না। তখন বাচ্চাকে বোঝাতে হবে যে, ‘আজ রাস্তায় জ্যাম বেশি থাকবে, জন্মদিনের পার্টিটা আজকে না করাই ভালো। এটা শুক্রবারে হলে ভালো হবে। তোমার বন্ধুরাও সহজে আসতে পারবে। এটা অবশ্য এক-দুই বছর বোঝানো যায়। কিন্তু পরে সে ঠিকই বোঝে যে মা নিজের কাজ ঠিকভাবে করার জন্য এ রকম করছে। এ ধরনের অনেক ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার থাকে। তবে আমার পরিবার এ দিক থেকে অনেক সাহায্য করে। তারা বোঝে, আমি অনেক দায়িত্বসম্পন্ন একটা পদে আছি।

প্রশ্ন :

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত নারীদের অগ্রগতি আসলে কতখানি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

অনেক। এটা কিন্তু একটা ইতিবাচক বিষয় যে আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, একটি বড় দলের শীর্ষ নেতা, স্পিকারসহ শীর্ষস্থানীয় অনেক পদেই নারীরা আছেন। এটা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এ পদগুলো দক্ষতা, যোগ্যতা এবং মেধাসম্পন্ন একজন নারীর জন্য সব সময় উন্মুক্ত।

প্রশ্ন :

আপনি নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। প্রশাসনের এতগুলো স্তর পার হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো কি আপনার কানে পৌঁছাতে পারত?

অবশ্যই। কোথাও এমন কোনো সংবাদ শুনলে ছুটে গিয়েছি, চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখতে গিয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকেই কিন্তু আমরা পারিবারিক সহিংসতা আইন পাস করেছি। এসব রোধে পুরুষদের মাঝেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন :

আমাদের দেশে অনেক রাজনীতিবিদ খুব অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যান, কিন্তু আপনাকে এ ক্ষেত্রে বেশ সহনশীল দেখা যায়। নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন?

উত্তেজিত হয়ে গেলে তো হেরে গেলে। সবকিছুতে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করলেই সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অন্যে উত্তেজিত হলেও তুমি যদি সহনশীল থাকো, এটারও ইতিবাচক দিক আছে।

প্রশ্ন :

জীবনে কখনো হতাশ হয়েছেন?

অনেক বারই হয়েছি।

প্রশ্ন :

হতাশা কাটিয়ে উঠেছেন কীভাবে?

জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো দেখে। আমরা অনেক সুবিধাপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের একজন মুসলিম নারী হিসেবে সমাজে অবস্থান এবং যে সুযোগগুলো পেয়েছি এটা তো অনেকের জন্যই উন্মুক্ত না। পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি, নিজের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সেই ইতিবাচক দিকগুলো দেখে হতাশা কাটিয়ে উঠেছি। আর এতদূর যে আসতে পেরেছি সেটার জন্য তো সব সময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।

প্রশ্ন :

আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত কোনটি?

শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত বলা খুব কঠিন! অনেক মুহূর্তই মূল্যবান। যেমন প্রথম মা হওয়া একটা অন্য রকম অনুভূতি। পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো প্রথম হওয়া, সেটাও অনেক মূল্যবান। একেক মুহূর্তের গুরুত্ব একেক রকম। তবে দেশের প্রথম নারী স্পিকার হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা অনেক বড় বিষয়।

প্রশ্ন :

সংসদে সদস্যদের যেমন ঘড়ি ধরে কথা বলতে দেন, তেমনি জীবনের সব ক্ষেত্রে কি আপনি ঘড়ি ধরে চলেন?

একদম না। একটাই জীবন। এটাকে উপভোগও করতে হবে।

প্রশ্ন :

এমন একটা সংসদ, যেখানে শিশু কিশোরেরাই সাংসদ, তারাই সরকারি দল, তারাই বিরোধী দল—আপনি সেই সংসদের স্পিকার। বড়দের সংসদ নাকি ছোটদের সংসদ—কোনটা বেশি উপভোগ্য বা চ্যালেঞ্জিং হবে?

ছোটদের সংসদ উপভোগ্য, বড়দেরটা চ্যালেঞ্জিং। কারণ ছোটরা অনেক নতুন চিন্তার উদ্ভাবক। এবং তারা তো ফ্রেশ, মানে তারা কোনো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসেনি। আর এ রকম ছোটদের সংসদ তো হয়। আমাদের ছায়া সংসদ আছে। আমি অবশ্য সেখানে কখনো স্পিকার হইনি। ছোটরাই স্পিকার হয়। আমরা শুধু অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখি। আর চ্যালেঞ্জিং বড়দেরটাই হবে। কারণ, ছোটদের সংসদটা তো আর আসল সংসদ না। বড়দের সংসদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছোটদের সংসদে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, সেখান থেকে ভুলগুলো বেরিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে বড়দের সংসদে সেই ভুলগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনে আলোচনা হতে পারে।

প্রশ্ন :

বেশির ভাগ বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, নায়কের সঙ্গে ভিলেনের মারামারি চলছে, একপর্যায়ে পুলিশের আগমন ঘটে এবং তাঁরা বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ আইনের প্রতি আমরা সবাই কীভাবে শ্রদ্ধাশীল হতে পারি?

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হলে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রশাসন, জনগণসহ এটা সবার দায়িত্ব। তোমরা নিজেরাই দেখবে, বেশির ভাগ মানুষ রাস্তা পার হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এটা কিন্তু আইনকে অশ্রদ্ধা করা। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে তোমাদের বিরত থাকতে হবে। এর জন্য দরকার সচেতনতা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য সবাইকে অবশ্যই সচেতন হবে।

প্রশ্ন :

এখন আপনি অনেক ব্যস্ত। নিরাপত্তার বেড়াজালেও থাকতে হয় আপনাকে। এসবের ভিড়ে কখনো সাধারণ জীবনযাপনটাকে মিস করেন না?

সাধারণ জীবনটা মিস করি। দোকানে গিয়ে শাড়ি কেনাটাও মিস করি। এখন দোকানে ঘুরে শাড়ি কেনার সুযোগ নেই। কারণ, বের হলেই মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে। ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটা অবশ্য অন্য রকম বিষয়। আমি খুবই আনন্দ পাই।

সংসদ ভবনে নিজ কার্যালয়ে কিআ হাতে পেয়ে দারুণ খুশি শিরীন শারমীন চৌধুরী। সাক্ষাৎকার দলও খুশি তাঁকে পেয়ে

প্রশ্ন :

এখন যারা কিশোর, তাদের উদ্দেশ্য কিশোর আলোর মাধ্যমে আপনি কী বলতে চান?

তোমরা এখন যেই যুগে কিশোর, পৃথিবীতে তোমাদের জন্য একটা অবারিত সম্ভাবনার দ্বার সব দিকে উন্মোচিত। কাজেই এ সম্ভাবনার সর্বোত্তম সুযোগ তোমরা গ্রহণ করো নিজেদের তৈরি করার জন্য। ভবিষ্যতের পৃথিবী আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। নিজেদের উন্নত করতে না পারলে সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হবে। নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করে নাও।

প্রশ্ন :

‘আমার দুচোখ ভরা স্বপ্ন, ও দেশ তোমারই জন্য...’ বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনা আমরা যেন বাস্তবায়ন করতে পারি। সেটা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে মানুষগুলো এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের সেই দারিদ্র্যের ভেতর থেকে বের করে সবারই সম-অধিকার যেন নিশ্চিত করতে পারি। কেননা, এখনো আমাদের দেশের অনেক শিশু সুবিধাবঞ্চিত। তাদের সুবিধাগুলো যেন আমরা নিশ্চিত করতে পারি, আমাদের নারীরা যেন আর পিছিয়ে না থাকে সে রকম একটা ব্যবস্থা যেন আমরা করতে পারি, সেটাই আমার স্বপ্ন।

প্রশ্ন :

আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ। তোমরা সবাই ভালো থেকো।

সাক্ষাৎকার দলের এই পাঁচজন ছাড়াও আরো যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে— অদিতি বড়ূয়া, আহমেদ রাইয়ান জাবির, বাঁধন বিশ্বাস, দেওয়ান তাহমিদ, ফাহমিদা চৌধুরী, ফয়সাল আলম, ইশমাম উল হক, ইশতিয়াক ইসমাইল, জিতু আহসান, জুমাইনা নাসির, মাহমুদ ইসলাম, মেহেদী হাসান, মির্জা সিরাজুম ফাহিয়া, মুঈদ হাসান, এন এম তাহসিন ইনতেয়াজ, নাজিরা রহমান খান, নাহার আল রাজি, নওশীন ইবনাত, নওরীন জাহান, রাফিউস সালেহীন, রুকাইয়া জাহান, সাব্বির হায়দার, সামিয়া শারমিন, সৈয়দ নাভিদ ইকবাল, শামসুন নাহার, শিহাবুজ্জামান মল্লিক, তাবাস্‌সুম ইসলাম, তাবাসসুম খান, তাহমিদুল ইসলাম, তানজিন এ আলামিন ও তাসফিয়া তাবাসসুম।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)