ভয় পেলে তো আর যুদ্ধ করতে পারতাম না — হাবিবুল আলম

...এরপর আমরা গ্রেনেড চার্জ করলাম
শহীদ রুমী-আজাদ-বদিদের সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম তোমাদের অনেকেরই পরিচিত নাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের অকুতোভয় ও দুর্ধর্ষ এই সদস্য ঢাকায় একের পর এক অপারেশন করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ভারতের মতিনগরে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরেন ঢাকায়। তাঁদের দিলু রোডের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ‘সেফ হাউস’। এ বাড়িতেই তাঁর পিতা হাফিজুল আলম একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার নির্মাণ করিয়েছিলেন। বোনেরা দেখতেন আশ্রয়প্রার্থী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার দিকটা। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাবিবুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। বর্তমানে তিনি একজন ব্যবসায়ী। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই ব্রেভ অব হার্ট। ব্যক্তিজীবনে বেশ মিশুক এই যোদ্ধা অবসরে প্রচুর বই পড়তে আর পুরোনো দিনের বাংলা গান শুনতে ভালোবাসেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নড়াইলে। স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ভিত্তি কাঁপানো বিভিন্ন অভিযান এবং তাঁর ব্যক্তিজীবন ও চিন্তাভাবনাসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন কিশোর আলোর সাক্ষৎকার দলের সঙ্গে। সেই দলে ছিল বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের তাসফিয়া নিশাত, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ের হামীম ইসলাম, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের রাফিকা ইসলামসৈয়দা আশফাহ্ তোয়াহা এবং রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজের মো. সাইফুল ইসলাম

প্রশ্ন :

মুক্তিযোদ্ধারা তো অনেক সাহসী। আপনি কি ছোটবেলা থেকেই সাহসী?

ছোটবেলা থেকে সাহসী কি সাহসী না, সেটা বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধ করতে গেলে সাহস থেকে বড় যেটা দরকার, সেটা হলো আত্মবিশ্বাস। নিজের ওপর যদি বিশ্বাস থাকে, তাহলে সবকিছুতেই সুফল আসে।

প্রশ্ন :

ছোটবেলার কথা যদি একটু বলতেন...

আমি পশ্চিম পাকিস্তান জুনিয়র হকি ক্লাবে খেলতাম। স্কাউটিংও করতাম। হকি দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম হকি খেলতে।

প্রশ্ন :

মাত্র ২১ বছর বয়সে আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ঠিক কোন বোধ থেকে এই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিলেন?

বাংলাদেশের তখনকার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।

প্রশ্ন :

মাকে ছেড়ে দেশ বাঁচাতে গেলেন। মা আগে না দেশ আগে—এ রকম কোনো দ্বিধা কি কাজ করেছিল?

সেই বয়সের চিন্তাটা একটু ভিন্ন হয়। যখন তুমি টের পাচ্ছ যে তোমার অস্তিত্ব নিয়ে কেউ টান দিচ্ছে, তখন সিদ্ধান্তটা খুব তাড়াতাড়ি নিতে হয়। আমরা যারা তাড়াতাড়ি নিতে পেরেছি, তারা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছি। আর যাদের মধ্যে দ্বিধা ছিল, তারা পরে গেছে বা যেতে পারেনি। তখনকার প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে ২৫ মার্চ যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, যখন পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদের মেরেছে, হলগুলোয় যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ২৭ তারিখ রাস্তাঘাট দেখার পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। একই সঙ্গে ইচ্ছাশক্তি তো লাগেই। এ ছাড়া সাতই মার্চের ভাষণে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আরও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম রেডিওতে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায়। বাঙালিরা যুদ্ধ করছে—এটা প্রচুর সাহস দিয়েছে।

প্রশ্ন :

যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অনুপ্রেরণা কে বা কী ছিল?

অনেক বই পড়তাম। তখনকার প্রজন্ম আবার চে গুয়েভারাকে খুব মেনে চলত। তা ছাড়া মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা, ভাষা আন্দোলনের পদক্ষেপও আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।

প্রশ্ন :

আপনি যে প্লাটুনের হয়ে কাজ করেছিলেন, তার নাম ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ কেন?

নামটা কীভাবে এসেছে, সেটা আমার মনে নেই। তবে মে মাসের শেষের দিকে আমি ১৭ জনকে নিয়ে ঢাকায় আসি। তারপর যে কয়েকটা অ্যাকশন হয়েছে আগস্ট পর্যন্ত, সে কয়েকটা নিজেরা করেছি। এর পর থেকে প্রচার হয়ে গেছে, ঢাকা শহর পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে নেই। নাম কিন্তু কখনো কেউ দেয় না। ওটা এমনিতেই চলে আসে। নির্দিষ্ট করে কাউকে বললে ভুল হবে। তবে ঠিক কীভাবে এসেছে, আমি তা বলতে পারব না।

প্রশ্ন :

ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধাদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব ছিল?

সবার সঙ্গে। আমি তো ১৭ জনকে প্রথমে নিয়ে আসি। তাই, মোটামুটি ১৭ জনকেই ভালোমতো চিনি।

কিশোর আলো দলকে কাছে পেয়ে তিনি শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধর্ষ সব অভিযানের গল্প
ছবি: কবীর শাহরিয়ার

প্রশ্ন :

এর ভেতরে কেউ কি বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ। গাজী দস্তগীর আছে, মায়া আছে। আরও অনেকেই বেঁচে আছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাদের মধ্যে কেউ বিএনপি করে, কেউ আওয়ামী লীগ করে, কিন্তু আমার এতে আসে যায় না। যুদ্ধের সময় তো কপালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ লেখা ছিল না।

প্রশ্ন :

আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা কে ছিলেন?

সব কজনই। আমি জানি না তোমরা পড়েছ কি না, ব্রেভ অব হার্ট—বইয়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছি।

প্রশ্ন :

রাতের আঁধার, নাকি দিনের আলো—ঠিক কোন সময়টায় অপারেশন করা সহজ বা কঠিন ছিল?

সন্ধ্যা সাতটা ছিল সবচেয়ে ভালো সময়। এ সময় বিহারি, পাঞ্জাবি, বাঙালিরা খেতে বসত। তো, কাজটা লক্ষ্য ঠিক রেখে করা যেত। আর যুদ্ধমাত্রই কঠিন ছিল; সেটা দিন হোক বা রাত হোক!

প্রশ্ন :

যুদ্ধ করার সময় পরিবারের কথা মনে পড়লে কী করতেন?

সে সময় পরিবারের কথা মনে পড়েনি। আগে নিজের জান বাঁচানো ফরজ...(হাসি)।

প্রশ্ন :

আপনার অংশ নেওয়া অভিযানগুলোর মধ্যে ‘অপারেশন পেট্রলপাম্প’ ও ‘অপারেশন ফাইভ পাওয়ার সাবস্টেশনস’ অন্যতম। এগুলো সফল করার পেছনে আপনার ভূমিকা কেমন ছিল?

আমার ভূমিকা কেমন ছিল, সেটা তো বলতে পারব না। সবাই না থাকলে করা সম্ভব হতো না। বিস্তারিত বলছি। মে মাসের শেষের দিকে প্রথম দলটাকে নিয়ে আসি। প্রথমটা ছিল ‘রূপসী বাংলা’র ওখানে, যেটাকে তখন ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল’ বলা হতো। তো, অপারেশনের জন্য ৭ জুন গুলশানে এখন যে ‘পিৎজা হাট’, তার উল্টো দিকে বসা একটা বিহারির গাড়ি হাইজ্যাক করতে হবে। আমার সঙ্গে ভাষণ, মায়া, আর বাদল ভাই। গুলশান ১ নম্বর সার্কেল দিয়ে মহাখালীর রাস্তা তখন পাকা ছিল না। কাঁচা রাস্তা—খুব কষ্ট করে যেতে হতো। মূলত আড়ংয়ের সামনে দিয়ে। তো সেদিন যে গাড়িই ধরি ভাষণ বলে, ‘একে তো আমরা চিনি। এ অমুক, ও তমুকের চাচা।’ এটা করতে করতে কাউকেই ধরতে পারছি না। এই করে দুই ঘণ্টা পার হলো। আমরা প্ল্যান বাদ দিলাম। পরদিন হাতিরপুলে একটা কাজে পাঠিয়ে ভাষণকে সরালাম। কারণ, ওকে বাদ না দিলে গাড়ি আর নেওয়া যাবে না। ৯ জুন আমরা একটা ‘ডাটসান ১০০০’ গাড়ি পেলাম। ওটাকে দাবড়িয়ে নিতে নিতে ২ নম্বর সার্কেল পার হয়ে রাশিয়ান এমবাসির ওখানটায় আটকালাম।

সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার দিকে রূপসী বাংলার ওই দিকে সব টুপিওয়ালা বসে আছে। খুব তালি দিচ্ছে। জাতিসংঘের লোকেরা টাকা দিতে এসেছিল। তখনকার দিনে সরকারি গাড়ি হচ্ছে শ্যাভরোলেট। দেখছি যে ওরা আসছে। আরেকজন ছিল আমাদের সঙ্গে—কামরুল হক স্বপন। তো স্বপন গাড়িটার সামনে বসা, বাঁ পাশে মায়া, মাঝখানে জিয়া, পেছনে আমি আর বাদল ভাই। ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রথম গ্রেনেড জিয়া লক করে। এর পরেরটা আমি না মায়া করেছিলাম, মনে নেই। জিয়া যখন লক করে, তখন গ্রেনেডটা ওদের গাড়ির ভেতরে পড়ে। ‘ধুপ’ করে গাড়িটা বসে পড়ে। যখন গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি, তখন আসতে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় মিনিট লেগেছে। দেখি, ফোয়ারার সামনে থেকে কাকরাইল পর্যন্ত লুঙ্গি, টুপি, স্যান্ডেল রাস্তায় ফেলা। কোনো মানুষ নেই। সব গায়েব। (হাসি)।

প্রশ্ন :

যুদ্ধের সময় আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কী?

কোনটা বলি? ‘ডেসটিনেশন আননোন’ বলা যায়। এটার কিছু অংশ জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে আছে। ২৫ আগস্টের ঘটনা। আমরা দুইটা গ্রুপ করেছিলাম। একটা গ্রুপকে তখনকার গভর্নর হাউস—এখন যে বঙ্গভবন, সেখানে পাঠানো হলো। তখনকার বঙ্গভবন আবার এখনকার মতো অর্ধেক ছিল না। বিশাল ছিল। সেখানে একটা নাড়া দেওয়া দরকার। কারণ, মালেক মিয়া যথেষ্ট শান্তিতে ছিল, রাও ফরমান আলীও এখানে বসেন। আরেকটা ব্যাপার, ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে কোনো এক ব্রিগেডিয়ার থাকে। এখন হয়তো ওটা ৯/এ। সেখানে অনেক আর্মি পাহারা দেয়। ২০ নম্বর রাস্তা তখন ধানমন্ডির একমাত্র ডাবল লেন রাস্তা। এসব অ্যাকশনে নামতে হলে গাড়ির দরকার। আমার বাবার গাড়ি আছে। তাতে কী? আরেকজন বিহারির গাড়ি নিলে আরও লাভ! আমরা দুটো গাড়ি নিলাম। একটা ধানমন্ডি ৭ থেকে। একটু এগিয়ে আমরা ধানমন্ডি ৭ আর ৫-এর মাঝে দাঁড়ালাম। আরেকটা ফিয়াট গাড়ি। সেখানে আলি, জিয়া, হ্যারিস। আবার আমার পাশে বদি, পেছনে স্বপন, বদির পেছনে কাজী, মাঝে রুমী। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর কালভার্ট পার হলাম। এরপর মসজিদ পার হয়ে ২০ নম্বর রাস্তায় আসি। সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখি, কেউ বের হচ্ছে না। ১৮ নম্বরে ব্রিগেডিয়ার বাড়ির সামনে গেলাম। দেখি, সেখানে আর্মি বসা। বদি আর কাজীকে বললাম, ফায়ারিং শুরু করতে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। গাড়ি সামনে থেকে ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে এলাম। বদি বন্দুকটা তাক করল। আমি বললাম, একটা শব্দ বলব। আর সেটা হবে ‘ফায়ার’। এরপর তুমি ফায়ার ওপেন করে সামনে এগিয়ে যাবে। সামনে তিন থেকে চার সেকেন্ড যেতেই স্বপন আমার কলার টেনে বলল, ‘আমরা কী করব? আমরা কি আমসত্ত্ব খাইতে আসছি নাকি?’ আমি বললাম, দেরি কর একটু, হয়ে যাবে। সেখানে দু-এক মিনিট দাঁড়িয়ে কোনো লাভ হলো না দেখে বঙ্গভবনের দিকে যাব। ৮ নম্বর ব্রিজ আর মসজিদ পার হয়ে এসে দেখি আর্মি ব্যারিকেড বসিয়ে দিয়েছে। কয়েকটা গাড়ি থামানো হয়েছে। দুটো গাড়ি মিরপুরের দিকে, আরেকটা জিপ নিউ মার্কেটের দিকে মুখ করা। স্বপনকে বললাম, স্বপন রেডি থাক। এই যাত্রায় যদি পার না হতে পারি, তবে সবার খবর আছে। একটা জিপ নিয়ে বাঁ দিকে ওরা যে বসে আছে, সেটা খেয়াল করিনি। আরেকটু সামনে যাওয়ার পর বদি বলল, বাঁ দিকে আরেকটা আছে। আমি হেডলাইট বন্ধ করলাম। ওরা গালি দিয়ে বলল, ‘রোকো!’ মনে হলো ফাজলামো করা দরকার। তাই ডান দিকে ইন্ডিকেটর দেখালাম আর বললাম, এবার যদি যেতে পারি তো বাঁচলাম। না হলে সব কটা খালাস। ডান দিকে ইন্ডিকেটর দেওয়া, যাব কিন্তু বাঁ দিকে। স্বপনকে বললাম, সবগুলোকে মারতে হবে। তা না হলে সবার কপালে দুঃখ আছে। তো বাঁ দিকে মিরপুর রোড থেকে গ্রিনরোড—এই রাস্তাটা এখনকার ল্যাবএইডের পরে। স্বপন ডান দিক থেকে ফায়ার শুরু করল। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে কিন্তু ভয়, আতঙ্ক, আফসোস কিছুই ছিল না। ভাবনা ছিল শুধু এদের মেরে বেরিয়ে যেতে হবে। অন্য কোনো চিন্তা মাথায় ছিল না। আবার গ্রিনরোডে বাঁ দিকে গিয়ে ইন্ডিকেটর দেখালাম। ডান দিকে যাওয়া শ্রেয় মনে হলো। নিউ মার্কেটের দিকে গেলাম তখন, পেছন থেকে রুমী বলল, ‘দেখ আলম, ওইখান থেকে জিপ আসছে।’ কিছু বলার আগেই রুমী পেছনের কাচ ভেঙে ফায়ার শুরু করল। কপাল ভালো যে গুলিটা ড্রাইভারের গায়ে লেগেছিল। সেখানে দুটো ইলেকট্রিক পোল ছিল। গ্লাসে দেখেছিলাম, জিপটা পোলের সঙ্গে ধাক্কা খেল। এটা নেহাত কপাল, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি ছিল। রুমীকে এলিফ্যান্ট রোডে নামিয়ে দিয়ে আমি আর স্বপন চলে গেলাম ভূতের গলিতে। সেখানে গাড়ি রাখার জন্য একটা বিরাট বিহারির বাড়ি পেলাম। বাঙালির বাসার সামনে রাখলে ধরে নিয়ে যাবে তো। সেখানে গাড়িটা রেখে আমরা আস্তে আস্তে চলে গেলাম।

প্রশ্ন :

আপনি মেজর খালেদ মোশাররফের দলে যুদ্ধ করেছেন। যোদ্ধা ও নেতা হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন?

অধিনায়ক, যোদ্ধা বা প্ল্যানার হিসেবে তার মতো আর কেউ বোধ হয় সেনাবাহিনীতে ছিল না। তোমরা মনে হয় একটা সিডি পেতে পারো—খালেদস ওয়ার। এটা জুন মাসের ২২ তারিখে বের হয়। ওটাতেই প্রথম পৃথিবীর সবখানে দেখানো হয় যে পাকিস্তানে সরাসরি যুদ্ধ হচ্ছে। ওনার নেতৃত্বে যে কটা যুদ্ধ হয়েছে, সবগুলোই খুব মারাত্মক হয়েছে।

আগস্ট মাস কিংবা জুলাই মাস। ১৯ তারিখ। সেদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পাঁচটা পাওয়ার স্টেশন একসঙ্গে উড়িয়ে দেব। হাতিরপুলে একটা সাবস্টেশন আছে। তেজগাঁওয়ে রয়েছে, শান্তিবাগে আরেকটা আছে—এ রকম পাঁচটা ছিল। মধুমিতা সিনেমা হলের ডান দিকে একটি গলি ছিল। ওখানে পাকিস্তানি আর্মি ছিল। তারা রাতে ঢাকাকে অন্ধকার করে দিত। আমরা পাঁচটা দল করলাম। একটা দেওয়া হলো গাজী দস্তগীরকে; আরেকটা ছিল আমার নেতৃত্বে; বাকিগুলো মায়া, জিয়া আর আবু সাঈদের নেতৃত্বে গেল। আবু সাঈদ বছর খানেক হলো মারা গেছে। ওখানকার দুটো পাওয়ার স্টেশন আমরা ওড়াতে পেরেছিলাম আর তিনটা কিন্তু ওড়াতে পারিনি। আমি যেটাতে ছিলাম, পরিবাগের পাশে যে পাওয়ার স্টেশনটা, ওখানে গিয়ে দেখি ২০ থেকে ২৫ জন আর্মির লোক। কিন্তু আমরা যখন সাত দিন ধরে রেকি করেছিলাম, তখন আমরা দেখেছিলাম চার থেকে পাঁচজন মাত্র। তারা ফায়ার করলে আমরা ব্যাক ফায়ার করলাম। মনটা খুব খারাপ হলো। খালেদ মোশাররফকে বলতে পারছি না যে পাঁচটার মধ্যে দুইটা হয়েছে। খুব তো লাভ হলো না। প্রথম আমরা পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে ফায়ার এক্সচেঞ্জ করলাম। তখন বিবিসিতে উঠে আসে যে স্ট্রিট ফাইট ইজ অন উইথ মুক্তিবাহিনী। আমরা যখন খালেদ মোশাররফকে সব বলি, তখন তিনি হাসেন এবং বলেন, না না, কী করেছ ওটাতে কিছু আসে যায় না। বিবিসি প্রচার করেছে যে তোমরা রাস্তায় যুদ্ধ করেছ। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝার ধারণাটা তাঁর ভিন্ন ছিল।

প্রশ্ন :

আপনাদের মধ্যে তো ভয় বলে তেমন কিছু ছিল না। তবু কোনো অপারেশনে কি ভয় পেয়েছিলেন?

ভয় পেলে তো আর যুদ্ধ করতে পারতাম না।

প্রশ্ন :

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান কেমন ছিল?

বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করলেই তো যথেষ্ট নয়, তাই না? খালেদ মোশাররফ তাঁর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই একটা হাসপাতাল করেছিলেন, যেখানে মেয়েরা যোগ দিয়েছিল। এই হাসপাতালটি না থাকলে, আমাদের ক্যাজুয়ালটি বেড়ে যেত। সেখানে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে, আমার দুই বোন এবং আরও অনেকে যোগ দিয়েছিল। এখন যদি বলো, বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করলেই একমাত্র যুদ্ধ হবে, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করলে প্রথমে ফ্রন্টডোর ফাইট করতে হবে, কিন্তু এর পরের বাকি সহায়ক জিনিসগুলো প্রয়োজন, তার একটা চিকিৎসা। এই জন্য বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল করা হলো। সেখানে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ, মবিনসহ আরও অনেকে। তবে শুরু করেছিলেন মেজর আখতার। শেষের দিকে ক্যাপ্টেন সেতারাও ছিলেন। সেখানে আরও অনেকে যোগ দেন এবং শ খানেক বেডের হাসপাতাল করে ফেলেন। এঁরা খুব ভালো সেবা দিয়েছেন। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয় মেয়েদের নিয়ে হাসপাতাল করার। মায়েরা যদি সাহস না দিতেন, আর তাঁরা যদি রাজি না হতেন, তবে যুদ্ধ করাটা বেশ মুশকিল হতো। আমার বাসায় যখন অস্ত্র রাখি, আমার মা তো তখন জানছেন যে আমি রাখছি। নারীদের আসলে প্রচুর সাহস। কিন্তু তাঁরা তা দেখান না।

প্রশ্ন :

যুদ্ধে শত্রুদের না মেরে আপনাদের উপায় ছিল না। শত্রুসেনাদের মারতে গিয়ে কোনো মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?

হতাম না যে তা না। মাঝে মাঝে হতো।

ছবি: কবীর শাহরিয়ার

প্রশ্ন :

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এমন কোনো গানের কথা মনে পড়ে, যেটা রক্তক্ষয়ী মুহূর্তগুলোকে প্রাণোচ্ছল করেছিল?

সবচেয়ে মজার ছিল এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’। তোমরা বোধ হয় শোনোনি, আমরা সবাই শুনতাম। এখানে যেমন বগুড়ায় কোনো ঘটনা ঘটলে বগুড়ার ভাষায় কথা বলছে, আবার নোয়াখালীতে কিছু হলে নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলছে। শুনতে আকর্ষণীয় ছিল, উঠে আসতে পারবে না। আমাদের কাছ থেকে ঘটনাগুলো পেয়ে এম আর আখতার মুকুল নিজে স্ক্রিপ্ট লিখতেন। এটা মনে হয় এমন কোনো বাঙালি নেই, যে শোনেনি। গানও শোনা হতো, আপেল মাহমুদের গান। সেখানে আমাদের আজম খানও ছিল। ৬ নম্বর প্লাটুনে।

প্রশ্ন :

স্বাধীনতার পর দেশ নিয়ে আপনার কোনো স্বপ্ন ছিল? সেই স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে?

আমাদের মূলত তিনটা কাজ ছিল। যুদ্ধ করা, দেশটাকে স্বাধীন করা, দেশটাকে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেওয়া। এখন তারা তাদের মতো দেশটা চালাচ্ছে, আমরা দেখছি!

প্রশ্ন :

দেশে এখন যে ধরনের রাজনীতি চর্চা হচ্ছে, তাতে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। এতে কি আমাদের দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? যারা ছাত্রনেতা হচ্ছেন তাঁরা লেখাপড়া করা কি না? যদি লেখাপড়া করা থাকে, তাহলে অবশ্যই দেশটা ভালো থাকবে। আর যদি লেখাপড়া করা না হয়, তাহলে ডাকাতই হবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের অবস্থাও তা-ই। লেখাপড়ার বিকল্প খোদা এখন পর্যন্ত কাউকে করে দেননি। তো লেখাপড়া না করলে এই ত্রুটির কোনো বিকল্প নেই। প্রথমত লেখাপড়া, দ্বিতীয়ত লেখাপড়া, তৃতীয়ত লেখাপড়া, দশ নম্বরেও লেখাপড়া। শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু এটা সত্য।

প্রশ্ন :

নতুন প্রজন্ম নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

এই প্রজন্ম নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। কারণ, তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। তাদের বোকা বানানো সহজ না। তা ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা অনেক তথ্য জানতে পারে বিধায় তাদের নিয়ে আশা করা যায়।

প্রশ্ন :

বর্তমানে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে গেলে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ ক্ষেত্রে আসলে আমাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?

আন্দোলনটা যদি ন্যায়বিচার বা কর্মসংস্থানের জন্য হতো, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো আন্দোলনটা হয়েছে? আন্দোলন হয় খালেদা জিয়ার জন্য, না হয় শেখ হাসিনার জন্য হয়েছে। মানুষের বুঝতে হবে যে এটা জনগণের বাংলাদেশ, দুই পরিবারের নয়। এটা শিগগিরই হবে বলে আমার ধারণা। এই প্রজন্ম কিন্তু ধীরে ধীরে এটা বুঝতে পারছে।

কিআ সাক্ষাৎকার দল এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে পেরে গর্বিত

প্রশ্ন :

হলিউডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধ নিয়ে দারুণ সব ছবি নির্মিত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু সেসব তুলনায় কম দুঃসাহসিক ছিল না। তার পরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সে রকম চলচ্চিত্র হয়েছে কমই। এই বিষয়টি নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

চলচ্চিত্র বাদ দিই, বই কয়টা পড়েছ? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েক হাজার বই আছে। বই পড়লে তো চলচ্চিত্র বানাতে পারবে। চলচ্চিত্রের নির্মাতারাও তো বই পড়ে না। তাহলে বানাবে কী?

প্রশ্ন :

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পৃথিবীর কাছে আরও ভালোভাবে তুলে ধরার জন্য আমরা যারা কিশোর, তাদের কর্তব্য কী?

তোমরা যা করবে, তা হলো প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এই প্রযুক্তির যুগে তথ্য কিন্তু খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিছু না। অনেক জানতে হবে। তবে সব জানা ভালো না। কিছু তথ্য ঊহ্য থাকাই ভালো!

প্রশ্ন :

সব না জানলে আমরা বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরব কীভাবে?

কেউ কিছু বললেই ইতিহাস হয় না। ইতিহাস নিজের কথা নিজেই বলে। মুক্তিযুদ্ধও নিজের কথা নিজেই বলবে। সঙ্গে তো তোমরা আছই!

প্রশ্ন :

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাদেরও অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থেকো সবাই।

সাক্ষাৎকার দলের এই পাঁচজন ছাড়াও আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে—লামিয়া হাসান, মাশরাবা আহমেদ চৌধুরী, মিনাহুর জাহান, মো. নুরুল করিম, নাহার আল রাজি, রাফিদ আজাদ, সাদীয়া ইসলাম, সত্যজিৎ দে, সুমাইয়া তাসনীম ও তানভীর আহমেদ।

(কিশোর আলোর এপ্রিল ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)