‘জি মানে জেলখানা। জিপিএ-৫ মানে জেলখানার ৫ নম্বর সেল!’ — মুস্তাফা মনোয়ার

মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে বাচ্চাদের আতঙ্কগ্রস্ত মলিন চেহারা তাঁকে ব্যথিত করে। তাই বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সেই শরণার্থী শিবিরেই আয়োজন করেন জীবনের প্রথম পাপেট শো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশের শিল্পজগতে তিনি মেলে ধরেন পাপেটের এক নতুন রূপ। ‘পাপেটম্যান’ নামে সমাদৃত এই মানুষটি আর কেউ নন, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। কবি গোলাম মোস্তফার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মুস্তাফা মনোয়ারের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছবি আঁকা আর গানের প্রতি আকর্ষণ। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় যোগ দেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। জেলে যান ছবি আঁকার অপরাধে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের লাল সূর্যের অন্যতম স্থপতি তিনি। সৃষ্টি করেছেন ‘পারুল’-এর মতো জনপ্রিয় চরিত্র। জড়িত ছিলেন ‘মীনা’র সঙ্গে। নির্মাণ করেছেন শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশে বাংলাদেশের সবচেয়ে মানসম্পন্ন ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নতুন কুঁড়ি। তাঁর নির্মিত অনুষ্ঠান মনের কথাও ব্যাপক সমাদৃত। কর্মজীবনের শুরুটা পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, শিল্পকলা একাডেমীসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন। ২০০৪ সালে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘একুশে পদক’। সম্প্রতি এই গুণী ব্যক্তিত্ব নিজের স্টুডিওতে মুখোমুখি হয়েছিলেন কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের। সেই দলে ছিল ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউটের রাইয়ান রহমান, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জিনাতুন নেছা, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অহর্নিশ অহনাজারিন তাসনিম, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামিয়া রহমান এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শেখ সিন্থিসা সারার। ছবি তুলেছেন কবির হোসেন

আপনি কেন ছবি আঁকেন?

অন্য কিছু পারি না বলেই ছবি আঁকি। (হাসি) তা-ই কি সত্যি? না। ছোটবেলা থেকে আমার প্রকৃতি ভালো লাগে। আমি যে পৃথিবীতে বাস করি, তার প্রতিটি জিনিস আমার ভালো লাগে। সে জন্যই মনে হয় ছবি এঁকে নিজের মতো করে সেসব প্রকাশ করি। আমি একসময় গঙ্গা নদীর একদম ধারে বাস করতাম। সেখানে প্রতিদিন সকালবেলা ভোরের সূর্য ওঠা, পানিতে প্রতিচ্ছবি, নৌকা যাওয়া—সবকিছু দেখে আমার মনটা ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে গিয়েছিল। আমার মেজো ভাই, তিনি কিন্তু ছবি আঁকতেন। তাঁর রংটং দিয়েই আমি শুরু করে দিতাম। আর তাঁর ভালো কাগজটাগজগুলো নষ্ট করতাম।

ছবির প্রতি আগ্রহ, তাহলে বিজ্ঞান শাখায় কেন ভর্তি হয়েছিলেন? মা-বাবার চাপে?

না, আমার ভীষণভাবে কিছু একটা বানানোর শখ ছিল। তখন যুদ্ধের সময়—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ট্রেন দেখতাম, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান দেখতাম। ওই সব দেখে আমি ভাঙাচোরা ভবনে গিয়ে লোহালক্কড় জোগাড় করে অনেক কিছু বানাতাম। পুরোনো লোহালক্কড়ের দোকানদারের একটা ছোট ছেলে ছিল। তার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও আমাকে অনেক কিছু দিত, আমিও বানাতাম। খুঁটিনাটি জিনিসপত্র বানাতে খুব ভালো লাগত। সে জন্যই বিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। আমি স্কুলে থাকতেই নিজে পড়ে পড়ে ফটোগ্রাফি শিখে ফেলেছি। কীভাবে প্রসেস করে, প্রিন্ট করে। এভাবে বিজ্ঞানের ব্যাপারটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের সব ভালো লাগত কিন্তু অঙ্কটা বিরক্ত লাগত। আমি ভর্তি হয়েছিলাম নামকরা এক কলেজে, ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’। সেখানে ভর্তি হওয়াও ভারি মুশকিল। আমার ছবি আঁকা, গান গাওয়া—এসব দেখে ভর্তি করল। প্রতি মাসেই পরীক্ষা হতো। প্রথমে অঙ্ক পরীক্ষা। আমি কিছুই বুঝি না। পরীক্ষার তিন-চার দিন পর শিক্ষক খাতাগুলো নিয়ে আসতেন। বলতেন, ‘নিরানব্বই, আটানব্বই পেয়েছে এই ছেলে।’ ছেলেটি দাঁড়াত আর সবাই হাততালি দিত। এভাবে একের পর এক বলা হলো। একসময় বললেন, ‘মুস্তাফা মনোয়ার’। আমি তো খুব খুশি হয়ে দাঁড়িয়েছি। ‘তুমি কত পেয়েছ?’ আমি বললাম, ‘স্যার, জানি না তো।’ স্যার বললেন, ‘তুমি ৪ পেয়েছ।’ আমি হো হো করে হেসে ফেলেছি। স্যার বললেন, ‘৪ পেয়ে তুমি খুশি হচ্ছ?’ আমি বললাম, ‘স্যার কোনটা যে সঠিক হয়ে গেল!’ (হাসি) একটা কিছু তো সঠিক হয়েছে, না হলে ৪ পেলাম কী করে? সেটাতেই আমার আনন্দ। পুরো ক্লাস হেসে দিল। এই হলো আমার বিজ্ঞান পড়া। এক বছর পরে কলকাতা আর্ট কলেজে যাই।

আপনার জন্ম ঝিনাইদহে, বাবার কর্মসূত্রে কলকাতায় থেকেছেন, ছিলেন নারায়ণগঞ্জেও। এর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে ভালো লাগত?

খুব ছোটবেলায় কলকাতায় ছিলাম। কলকাতা কেন জানি খুব ভালো লাগত। ওখানে বিরাট মাঠ ছিল। ছোটবেলায় কলের গান খুব ভালো লাগত, দম দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজানো হতো। সেই কলের গান সবাই বাজাতাম। আমাকে সবাই মানা করত যে হাতে পিন ফুটে যাবে। তবু লুকিয়ে লুকিয়ে বাজাতাম। পছন্দমতো রেকর্ডার নিতাম। তখন কিন্তু অক্ষর পরিচয় হয়নি। কিন্তু আমি ঠিক বের করতে পারতাম। একদিন সত্যিই সাউন্ড বক্সটা নামিয়েছি। আর পিনটা হাতে ফুটে গেল। তারপর কান্নাকাটি। পরে পিনটা বের করা হলো। এই হলো আমার গানের গল্প। ওখানে অনেকে আসতেন। পরে শুনেছি কাজী নজরুল ইসলামও আসতেন। সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগত। এমনিতেও কলকাতার বড় বড় দোকান দেখতে খুব ভালো লাগত। আমার মা মারা গিয়েছিলেন একদম ছোটবেলায়। আমার তখন তিন বছর বয়স। একটা স্মৃতি মনে আছে। ‘ওয়াসেল মোল্লা’ বলে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল, যেখানে সবকিছু পাওয়া যায়। সেখানে আব্বা নিয়ে গেছেন। ওখানে মেয়েদের মূর্তির মতো ডামি মডেল শাড়ি পরিয়ে সাজানো ছিল। ওইগুলো তখন সবে আমদানি করেছে। আমি ডামি মডেলগুলো দেখিয়ে বলেছিলাম, আরে ইনি কে! এ রকম দাঁড়িয়ে রয়েছে। আব্বাকে বললাম, আচ্ছা, এখান থেকে একটা মা কিনে নেওয়া যায় না। এ কথা শুনে কেউ কেউ দুঃখ করল। কেউ কেউ হাসল। তখন হুগলি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। হুগলি একদম গঙ্গা নদীর ধারে। সেখানে ব্রিটিশ আমলের এক বাড়িতে আমরা ছিলাম। একদম নিচে তাকিয়ে নদী দেখতে হতো। সেখান দিয়ে ইলিশ মাছ ধরার নৌকা যেত। তার লালচে পাল, বাদামি রঙের পাল, ছেঁড়া, ছোট পাল—সব দেখতাম। ভীষণ সুন্দর লাগত। এরপর আমার আরও ভালো লেগেছিল যখন শুকনো দেশ থেকে, যেমন বাঁকুড়া থেকে ফরিদপুরে এলাম, সেখানে চারদিকে পুকুর, গর্ত, নদী-নালা। সেখানে মাছ দেখা যাচ্ছে। সেটাও খুব মজা লেগেছে। আমার কেন জানি প্রকৃতির মোটামুটি সবকিছুই ভালো লাগে। শুকনোও ভালো লাগে। অনেক সাঁওতাল দেখা যেত বাঁকুড়ায়। ওরা তির-ধনুক বানাত। সরগাছ দিয়ে লাঠি বানাত। সেই চার-পাঁচ মাইল দূরের সুসুনিয়া পাহাড়ে সরগাছ পাওয়া যেত। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেখান থেকে সরডাল ভেঙে নিয়ে এলাম। লোহার পাত জোগাড় করে সেটা কেটে তির-ধনুক বানালাম। ওখানে অনেক বানর আসত। একবার এক বানর এসে তাড়া করল। সবাই দৌড় দিলাম। পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি। এই হলো আমার শিকারের গল্প। ঢাকায় তো সব সময় ‘যাস না’, ‘এটা করিস না’, ‘ওটা করিস না’, ‘মাঠে যাস না’—এই অবস্থা। ঢাকার এই অবস্থা পরিবেশের জন্য। ওখানে কার খবর কে রাখে? আমার বড় বুবুরাই আমাকে মানুষ করেছে। তারা বলত, এখানে যাস না, ওখানে যাস না। সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত। তবু পালাতাম।

আপনার বাবা প্রখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা। বাবা হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন?

উনি কবি মানুষ তো, খুব উদার ছিলেন এতে সন্দেহ নেই। আমাদের বাড়িতেও খুব একটা বাঁধাধরা নিয়মকানুন ছিল না। আব্বা গান শেখাতেন, মাঝে মাঝে কবিতা পড়ে  শোনাতেন, আর মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। দাওয়াত করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব আসতেন বাড়িতে। কবি নজরুল ইসলামের আগেই কিন্তু কবি গোলাম মোস্তফার গান প্রকাশিত হয়েছিল। ‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামী’, তারপর ‘ইয়া নবী সালামালাইকা’—এগুলো ভীষণভাবে চলেছিল বাংলাদেশে। উদার হতে শিখেছি আব্বার কাছে। এর জাত খারাপ, ওর জাত খারাপ—এ রকম কখনো শুনিনি তাঁর মুখে। আমার ধর্ম আমি পালন করব, কিন্তু অন্যের ধর্ম খারাপ বলার অধিকার আমার নেই। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আব্বার কাছে শিখেছি। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবাসতেন। তাঁর কাছে প্রথম গান শিখেছিলাম ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’। তখন বুঝতাম না, বলতাম ‘পাগলা গান’। বন্ধুবান্ধব এলে আব্বা বলতেন, ‘ও একটা পাগলা গান জানে’। এ রকমই ছিলেন আব্বা।

খুব ছোটবেলায় একদিন নাকি পুকুরে ডুবে যাচ্ছিলেন, আপনার বোন আপনাকে উদ্ধার করেন...

ছোটবেলায় খুবই চঞ্চল, দুষ্টু, বজ্জাত প্রকৃতির ছিলাম। একদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। সেখানে পুকুরের ওপর মাচা। পানির কাছেই দু-তিনটে মাচা। মেজো বুবু সম্ভবত মুখ ধুচ্ছিল। আমাকে ওখানে দাঁড় করিয়েই ও বলল, ‘খবরদার, তুই নামবি না।’ আমি করেছি কী, নেমে নেমে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ওখানে আবার পিছলা। কী করে যেন আমি ঝপ করে পানিতে পড়ে গেছি। ও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়েই পেয়ে গেছে আমাকে। তুলে তারপরে চিৎকার। অনেক লোক এসে তুলল আমাকে। প্রাণে বাঁচলাম। সবই বড়দের কথা না শোনার ফল। আমাদের দেশে কিন্তু অনেক শিশু এখনো পানিতে ডুবে মরে। কারণটাও ও রকম। শিশুরা তো করবেই। পানিটা ভীষণ আনন্দের, তাই না? পানিটায় প্রতিফলন হচ্ছে, একটা ইট মারলে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের একটা খেলা ছিল—খাপড়া বলতাম। ছোটবেলাতেই পারতাম ওটা। ইটের টুকরো ছুড়ে দিলে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যেত। ওগুলো মজা লাগত। তোমরা তো এখন শহরের ছেলেমেয়ে হয়ে গেছ, এসব দেখতে পাও না, কিছু কিছু দেখো হয়তোবা, কিন্তু আমাদের সময় বেশ স্বাধীনতা ছিল। পড়ার সময় পড়া আর পড়াশোনার চেয়েও এসবই করতাম বেশির ভাগই।

পুকুরের ও ঘটনার পর আপনাকে নাকি সবাই চোখে চোখে রাখতেন। তারপরও আপনি দুরন্তপনা করতেন। খালে-বিলে মাছ ধরতেন।

আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে চারপাশে খোলা জায়গা ছিল। বাড়ির আশপাশে আর কোনো বাড়ি ছিল না। বাড়ির পাশেই অন্য এক লোকের আমবাগান ছিল। একদিন সেই আমবাগানে গিয়ে দেখি কাঁচা কাঁচা অনেক আম ঝুলছে। পাড়লাম, তারপর গেঞ্জিটা থলের মতো বেঁধে আমগুলো নিয়ে এলাম। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত্ত কাঁচা আম পেড়ে নিয়ে এলি কোত্থেকে?’

আমি গর্বের সঙ্গে বললাম, ‘আনলাম।’

সেই লোক এসে আব্বার কাছে অভিযোগ করল। বলল, ওর তো আমাদের কাছে আম চাইলেই হতো। পাকা আম দিতাম। কত আম নষ্ট করেছে। আব্বা ভীষণ রেগে গেলেন। গ্রামের তো উনি একজন সম্মানী ব্যক্তি। আমি দৌড় দিলাম। আব্বাও দৌড়ে আমাকে ধরে ফেললেন। বেড়ার জন্য একরকম ছোট ছোট গাছ হয়। সেটা ভেঙে আমাকে মারা শুরু করলেন। লোকজন তাঁকে থামালেন। খুব কান্নাকাটি করে বাড়ির মধ্যে বসে আছি। দেখি অনেক আম আসছে। গ্রামের অনেক বাড়ি থেকে আম পাঠাচ্ছে। তারা ওই লোকটাকেও খুব বকা দিয়েছিল যে কেন সে এমন নালিশ করল। সে আসলে নালিশ করেনি। এমনি বলেছিল। গ্রামের লোকেরা এ রকমই ছিল। গ্রামটা ছিল একটা পরিবার।

আর স্কুলের দিনগুলো? কেমন ছিল সময়টা?

কিছু কিছু শিক্ষক ছিলেন মজার। একজন শিক্ষকের কথা আমার খুব মনে আছে। হুজুর ছিলেন। উর্দু আর আরবি পড়াতেন। উনি পাগড়িটাগড়ি পরে আসতেন। ওনাকে আমার খুব ভালো লাগত। ওইখানেই যত গন্ডগোল। একদিন হয়েছে কী, আমি হলাম স্কুলের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। একদিন বন্ধুকে বললাম, হুজুরের পাগড়িটা খোলা যায় কি না। উনি উর্দু সুর করে পড়াতেন। সবাই পড়ছে, আমি তখন কোনো গান হয়তো করতে থাকতাম। পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা সব খুব মজা পেত। একদিন গেছি হুজুরের কাছে, ‘হুজুর, আপনার পাগড়িতে একটা ছারপোকা।’ হুজুর বললেন, ‘ছারপোকা!...’ আমি বললাম, ‘আপনি দাঁড়ান, আমি সরিয়ে দিচ্ছি।’ খুলতে খুলতে পাগড়িটা খুলে ফেলেছি। খুলে গেছে। ‘হায় হায়! আমার পাগড়ি খুলে ফেলেছে।’ মারলেন দুই-চারটে থাপ্পড়। থাপ্পড় খুব জোরে মারতেন না। খুব ভালো লোক ছিলেন। আস্তে মারতেন, একদম লাগতই না। হেডমাস্টার ছিলেন আমার আব্বা। হুজুরের ক্লাসে কেউ দুষ্টুমি করলে তিনি ক্যাপ্টেনকে বলতেন, ‘নিয়ে আয়, ধরে নিয়ে আয়।’ নিয়ে যেত। বলতেন, খোল, পিঠ খোল। শার্টটা খোলা হতো আর উনি মারতেন খুব আস্তে। আমি তো দুষ্টুমি করি। আমাকেও ধরে নিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন বলল, ‘হুজুর পিঠ খুলিয়েছি, এবার মারেন।’ হুজুর বলত, ‘না না, হেডমাস্টারের ছেলে।’ (হাসি) তো ছেড়ে দিয়েছেন। ওরা সব বলছিল, ‘হুজুর আপনি মারলেন না যে,’ হুজুর বললেন, ‘ঠিক আছে, এটা পাওনা রইল, অন্য দিন মারব।’ এই রকম মজার ছিল।

ছবি আঁকার কারণে কিশোর বয়সে আপনাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল...

ও, সেটা তো একেবারে সেই রাষ্ট্রভাষার সময়। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন। উনি প্রথম ঢাকায় এসেছেন। ওনার বক্তৃতা হবে। আব্বা সেখানে আমাকে নিয়ে গেলেন। জিন্নাহ বললেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ দেখি চারদিক থেকে ‘নো’, ‘নো’ শব্দটি আসছে। আমি তখন জানতাম না যে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করছে। ওই তখন আমার মাথায় ঢুকল সেটা। তারপর অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। আব্বা কবি মানুষ, লেখায় ব্যস্ত থাকতেন। কেউ তো দেখার নেই। আমার মেজো বুবু আমাকে তার ওখানে ওনার বাসায় নিয়ে গেলেন। শুনলাম, গুলি করেছে, ছাত্ররা মারা গেছে। পরদিনই মিছিল বের হলো, ভীষণ গন্ডগোল। আমি ভাবলাম, এগুলোর একটা ছবি আঁকা যাক। আমি কিন্তু গিয়েছিলাম মিছিলে। তারপর ছবি আঁকলাম রাতের বেলা। পাঁচ-ছয় দিন ধরে খালি ছবি আঁকছি। আর আমার বন্ধুবান্ধব সব সেগুলো লাগাত দেয়ালে দেয়ালে। একটা ছবির কথা বলি, অনেকগুলো হাত এসে গলাটা টিপে ধরেছে। তার পরে ধরো ক, খ অক্ষরগুলোর ওপর একটা জাল এসে পড়েছে। এই ধরনের সব ছবি আঁকতাম। খুব প্রশংসা করত সবাই। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ভালো লাগত প্রশংসা, ‘বাহ্! কে এঁকেছে?’ বড় যারা ছাত্রনেতা ছিল কলেজের, তারা বলে দিয়েছিল যে বলার দরকার নেই ছবিগুলো কে এঁকেছে। যা-ই হোক, একদিন মেয়েদের মিছিল বের হলো। যে পোস্টার লাগবে সেগুলো আমি এঁকে দিলাম, সেই পোস্টার হাতে তারা যাচ্ছে। তারপর প্রধান শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা কিছুতেই নিতে দেবে না। রাস্তায় সব গাছ কেটে ব্যারিকেড দিয়েছে। আমার একটা র্যালি সাইকেল ছিল। বড় ভাই কিনে দিয়েছিল। সেই সাইকেলে করে গন্ডগোলের জায়গাটাতে গেলাম। দেখি যে গাড়ি থেকে লোকজন বের করে নিয়ে আসছে। তখন কী যে হলো আমি হঠাৎ হাতে একটা সূক্ষ্ম টায়ার ফুটা করতে গেলাম। অনেকবার চেষ্টা করে ফুটো হলো। এদিকে এসে দেখি সাইকেলটা নেই। খেয়াল নেই যে এত ভিড়ে সাইকেলটা রেখে দিলে কেউ নিয়ে যাবে। তারপর মিলিটারিরা রাতের বেলা ঢাকায় এল। ওখানে কর্নেল এম এ জি ওসমানীর বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিলাম। এমন সময় হঠাৎ চার্জ করে আমাদের ধরে ফেলেছে। রাত বারোটার দিকে একজন এসে উর্দুতে বলল, এদের সবাইকে ঢাকার জেলখানায় পাঠাতে হবে। তার আগে এদের আচ্ছাসে পেটাও। লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করল। আমার ভালো লেগেছিল যে আমাদের যারা বড় ছিল, তারা ছোটদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। ভোরবেলা বাসে তুলে নিয়ে এল ঢাকায়। একজন-দুজন করে গুনে গুনে বাসে ওঠাচ্ছে আর মারছে। আমি বললাম, ‘পেটাচ্ছেন কেন, পেটাচ্ছেন কেন? পেটাবার তো কথা ছিল না।’ (হাসি)। জেলখানায় অন্য কারাবন্দীরা আমাদের অনেক খাতির করত। আমাদের জন্য আলাদা মাছ-মাংস রান্না করত। ফ্যান না থাকায় আমাদের হাতপাখা দিয়ে বাতাস করত। এভাবে এক মাস দুদিন পর জেলখানা থেকে ছাড়া পেলাম।

আপনার আর্ট কলেজে পড়ার পেছনে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা বড় ভূমিকা ছিল। তাঁর সঙ্গে আপনার কী রকম সম্পর্ক ছিল?

আমার বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটের একটি ঘরে সৈয়দ মুজতবা আলী থাকতেন। উনি কলকাতার বাইরেই থাকতেন। যখন আসতেন, ওই ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হতো। উনি আমার ছবির খুব প্রশংসা করতেন। অসাধারণ সুন্দর কথা বলতে পারতেন। যখন আমরা চা-টা খেতাম, তখন টেবিল জমিয়ে রাখতেন। আমি তখন বিজ্ঞান পড়ছি। তিনি বললেন, ‘তোমার ছবি তো খুব ভালো, তোমার আর্ট কলেজে পড়া উচিত।’ বড় ভাবি বললেন যে আর্ট কলেজে পড়াবেন।

তখন কলকাতা আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন শ্রদ্ধেয় রমেন চক্রবর্তী। সেবার চার মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে সেশনের। অমন সময় আমাকে নেওয়াটা মুশকিল। আমার ছবিগুলো নিয়ে ভাবি, সৈয়দ মুজতবা আলী আর আমি গেছি। ছবিগুলো রমেন চক্রবর্তীর ভালো লেগেছিল। একদিন আমাকে বললেন, ‘ছবি আঁকা কিন্তু সহজ না, খেলা নয়, মনোযোগ দিতে হবে, সাধনা করতে হবে। এসো আমার সঙ্গে।’ উনি যেখানে থাকেন সেখানে নিয়ে গেলেন, ওনার স্টুডিওটায়। মেঝে পর্যন্ত বড় বড় জানালা ছিল তখন। ভোরবেলায় যে জায়গা দিয়ে আলো আসে, সে জায়গায় রং, তুলি, ফুল—এসব সাজানো আছে। উনি আমাকে বললেন, ‘এখানে আমি রোজ পূজা করি।’ আমি ভাবলাম, পূজা তো অন্য রকম হয়। রং, তুলি, ফুল দেখে বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বললেন, ‘রোজ ভোরে উঠে স্নান করে আমি এখানে আসি এবং একটা ছবি আঁকি। এটাই আমার পূজা।’ তিনি বুঝিয়ে দিলেন ছবি আঁকাটা পূজার মতোই পবিত্র ও শ্রদ্ধার, হেলাফেলার জিনিস নয়।

আমি আর আমার বড় ভাই গান শিখতাম। সন্তোষ রায় আমার ওস্তাদ ছিলেন। উনি শেখাতেন। ক্লাসিক্যাল ঢঙের গানগুলো। শেখাতেন রাগসংগীত। খুব মুক্ত প্রাণের মানুষ ছিলেন। বলতেন, ‘তুমি যেকোনো ধরনের গান করতে পারো।’ আমি ফোক সংও করতাম আব্বাসউদ্দীন সাহেবের। কে এল সাইমনের গান করতাম। হিন্দি, উর্দু এগুলোও করতাম। খুব ছোটবেলায় যখন আমি কলের গান বাজাতাম, তখন একটা গানের সুর আমার খুব ভালো লাগত। সেইটা শিখে ফেলেছিলাম। তখন যে কী বলতাম জানি না, কিন্তু আসলে যে কথাটা ছিল, ‘তোমেন মুঝকো প্রেম সিখায়া, যোয়ে হু দিলকে জাগায়া।’ ছোট মুখে ‘প্রেম সিখায়া’ গান বড়রা শুনলে খুব হাসত। পরে অনেক জায়গায় গাইতাম। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। সৈয়দ মুজতবা আলী আমার গানের ত্রুটি কিংবা ধাপ সবকিছু ধরিয়ে দিতেন। উনিও খুব গানের সমঝদার ছিলেন। দেশে-বিদেশে লেখার সময় তাঁকে আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে তিনি পড়ে শোনাতেন। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম—কী সুন্দর তাঁর লেখা! বইটা যেদিন বেরিয়েছে, সেদিন দোকানে লাইন লেগে গেছে।

আরও গুণী মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। আবু সৈয়দ আয়ুব আরেক লেখক। উনি, হেমন্ত বাবু, নির্মলেন্দু চৌধুরী বাড়িতে আসতেন। আমার বড় ভাই গানের সঙ্গে এমন সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনি বড় শিল্পীদের আপ্যায়ন করা খুব পছন্দ করতেন। ওস্তাদ ফাইয়াজ খান বিখ্যাত ওস্তাদ। আমার ওস্তাদও তাঁর শিষ্য ছিলেন। আর্ট কলেজে যখন ছিলাম, তখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় সেট করতে যেতাম। কস্টিউম ডিজাইন করতাম। কলকাতার কালচার বেশ বড়, যদি তার মধ্যে সৎভাবে থাকা যায়। অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায়। সত্যজিৎ রায় আমার আব্বার ছাত্র ছিলেন। আমারও গর্ব শিল্পী জয়নুল আবেদিন যেখানে পড়েছেন, আমি সেখানে পড়েছি। জয়নুলের বন্ধু একজন ছিলেন, তিনি বলতেন, জয়নুলের কাগজ কেনার পয়সা ছিল না, সস্তা দামের কাগজ কিনেই এঁকেছিলেন। এ রকম সব গল্প হতো। খুব গর্ব লাগত।

ধানমন্ডিতে নিজের অফিস কক্ষে কিশোর আলো সাক্ষাৎকার দলের সঙ্গে মুস্তাফা মনোয়ার

সংগীতের প্রতি আপনার অনুরাগের কথা বললেন। ছবি আঁকতে গিয়ে কি আর গায়ক হয়ে ওঠা হয়নি?

অনেকটা তা-ই। আমি একটা প্রতিযোগিতা করেছি, ‘ইয়াং আর্টিস্ট ট্যালেন্ট’। বড় ভাবি বললেন, ‘তুমি অবশ্যই গান দেবে।’ তো নাম দিলাম। ডাকল। নির্বাচিত হলাম। তখন কলকাতার সবচেয়ে বড় হল ছিল ‘সফেসটিকেটেড হল’। সেই হলে বিরতির সময় খুব নামকরা সংগীতশিল্পীর একটা জীবনী এসেছিল, সেটাকে কেন্দ্র করে একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। যারা নির্বাচিত হবে তারা মেট্রোতে বিরতির সময় গাইবে। আধা ঘণ্টা সময়। আমরা চারজন নির্বাচিত হলাম। আমি, সুবীর সেন, বশীর আহমেদ আর গীতা। গীতাকে পরে দেখিনি, বশীর আর আমি গান করেছিলাম। একেক দিন একেকজন। নামটাও টাঙানো থাকত, ‘মুস্তাফা মনোয়ার’। তার বহুদিন পর টেলিভিশনে যখন বশীর এল তখন দেখা। বলল, ‘তুমি গান করেছিলে মেট্রোতে, আমিও করেছিলাম।’ তখন মনে পড়ল, আরে এ তো সেই বশীর। পরে আর্ট কলেজে ডুবে গেলাম ছবি আঁকায়। কলেজে পড়া পর্যন্ত গান করেছি। কলকাতার বহু জায়গা, কলকাতার বাইরে। বিখ্যাত ফোক সিঙ্গার নির্মলেন্দু চৌধুরীর সঙ্গে গান করেছি। আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, তখন সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী করছেন। আমার ছবি দেখাতে গেলাম। বললাম, আমি গোলাম মোস্তফার ছেলে। উনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার স্যার ছিলেন। এসো এসো।’ গিয়ে দেখি উনি কী যেন আঁকছেন। ওখানে একটা ক্যামেরা ছিল পুরোনো, টেপ দিয়ে লাগানো। রং ওঠা। তিনি সিংহের মতো কী যেন আঁকছেন। তখন বলছেন, ‘না, ঠিক হচ্ছে না। রাজমিস্ত্রিরা যে রকম গ্রামে সিংহ বানায়—সিংহ কিন্তু সিংহের মতো পা’ও না, গা’টাও না—অথচ সিংহের মতো লাগে। যতই আমি চেষ্টা করছি অন্য রকম আঁকতে কিন্তু আমার তো ঠিক সিংহের ভাবটা এসে যাচ্ছে, রাজমিস্ত্রির সিংহের মতো হচ্ছে না।’ আমি অবাক হলাম যে সত্যজিৎ রায় এত নামকরা শিল্পী, তিনিই বলছেন হচ্ছে না! ব্যাপারটা কী? যা-ই হোক, আমার ছবি দেখছেন। জলরং দেখলেন। আমি একটা পেনসিল স্কেচ করেছিলাম সেটা, জলরং করিনি। তার উল্টো পিঠে রং করেছি। পেনসিল স্কেচটা খুব টান দিয়ে অল্প লাইনে করেছি। সত্যজিৎ রায় ছবি দেখছেন; ভালো-মন্দ বলছেন যে, এত কাজ কোরো না, জলরং আরেকটু কম, যত অল্পে পারো—এইসব। পরে বুঝেছি যে কত বড় কথা তিনি বলেছেন। ‘কত অল্পে পারো’... এই যে অল্পে কত পারো—এটা তো বিশাল ব্যাপার তাই না? তখন তো বুঝিনি অল্প মানে কী? কিন্তু শিল্পকলার সৌন্দর্য মানে অল্প দিয়ে খেলা। উনি স্কেচটা দেখে বললেন, ‘বাহ্! সুন্দর টান তো তোমার।’ হ্যাঁ, এ রকমভাবে টেনে যাও। আমার একটু মন খারাপই হলো যে জলরং করেছি ওইটা পছন্দ করলেন না। কিন্তু স্কেচটা করতে গিয়ে এত ভালো বললেন, ‘বাহ্! বাহ্! সুন্দর টান, হ্যাঁ এই রকমভাবে করবে।’ পরে বুঝেছি যে সুন্দর মানেই অল্প।

আপনি পাপেট তৈরির আইডিয়া কীভাবে পেয়েছিলেন?

বাঁকুড়ায় এক মেলা হলো। গিয়ে দেখি একরকম পাপেটের অনুষ্ঠান হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রামে বোধ হয় ছোট পাপেট দেখেছিলাম। আমাদের ওদিকে কম ছিল পাপেট। এখানে দেখলাম বিরাট। চার-পাঁচ ফুট লম্বা বাঁশের মাথায় লাগানো। আর নিচে একদম কোমরের সঙ্গে বাঁশটা বাঁধা থাকত, এক হাতে গলা ধরত আর আরেক হাতে হাত এ রকম এ রকম (দেখিয়ে) করত। কিংবা দুজন করত। বেশ ভালো লাগল, মজার। তখন তো ওসব গল্প। বিশেষ করে পুরাণের গল্প ও ধর্মীয় কিছু গল্পের উপস্থাপন। গান হতো বাইরে, মানে মঞ্চের বাইরে গানের দলটা বসত, কথক বসত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাপেট যেটা, একই রকম। আমার খুব মজা লাগত। এ ছাড়া আমাদের আর্ট কলেজের একটা নিয়ম ছিল। প্রতি মাসেই একটা ফোক আর্টমতো কিছু একটা দেখানো হতো। কাউকে আমন্ত্রণ করে আনা হতো। একবার রাজস্থানের পাপেট এনেছিল। মাত্র দুই সুতো দিয়ে পুরো পাপেটটা নাড়ানো হতো। সাধারণত খুব কম সুতো হলেও তিন সুতো থাকে। আর পাঁচ সুতো হলো পাপেটের সর্বনিম্ন সুতো। মানে স্ট্রিং পাপেট বা সুতোর পাপেট যেটাকে বলে। তাদের মুখটা খুব ভালো লাগে। আমরা সব ভাস্কররা মাঠে গিয়ে এসব বানালাম। তখন কিন্তু পাপেট হিসেবে ভালো লাগেনি। তবে আর্ট কলেজে থাকার সময় আমার কার্টুন অ্যানিমেশন ভীষণ ভালো লাগত। হুগলিতে যখন থাকি তখন তো ক্লাস ওয়ানে পড়ি, ছোট্ট। সেখানে আমার এক বন্ধু ছিল। পালানো টাইপের। এক আনা পয়সা হলেই আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম। ওখানে ওপরে মেয়েরা বসত। এক মহিলা ছিল, পাহারা দিত, টিকিট দিত। ওখানে গিয়ে বলতাম, ‘মাসি মা, একটু দেখতে চাই এক আনা পয়সা।’ ‘যাহ্! তোরা বেশি ছবি দেখিস।’ ওই কার্টুন দেখতে ভীষণ ভালো লাগত। আমরা পুরো ছবি দেখতাম না। কার্টুন যেই শেষ, আমরা চলে আসতাম। তোমাদের তো কত সুবিধা—রিমোট চাপলেই দেখতে পারো। সারা বিশ্ব তোমাদের কাছে। আরেকটি কথা—আমি কিন্তু হুগলিতেই ছবি আঁকতাম। ওখানে গঙ্গার ধারে খুব সুন্দর ঘাট ছিল। ঘাটে বসেই ছবি আঁকতাম। ওপারের নদী, নৌকা-টৌকা আঁকতাম। আমার এক বন্ধুর খুব পছন্দ ছিল ছবি আঁকা। বলল, ‘শিখিয়ে দে, শিখিয়ে দে, কী করে রং করব।’ বললাম যে ‘যাহ্! নিজে শিখে নে, আমি পারব না।’ এসব বলতাম আরকি, দাম বাড়াতাম। একদিন বলল যে ‘তোকে আমি চা রান্না করা শেখাব’। আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ কাগজটাগজ নিলাম, ছবি আঁকাটাকা দেখালাম। আমি তখন আর কী জানি। তাও শেখালাম। সেই ছেলেটা বড় হয়ে ঠিক শিল্পীই হয়েছে। নাহার তার ডাকনাম। কিছুদিন আগে মারা গেছে। তারপর দিল পয়সা। সেই পয়সা দিয়ে দুজনে মিলে একটু চা-নাশতা, মিষ্টি কিনে খাওয়া হয়ে গেল। এই প্রথম আমার রোজগার। আবার হুগলিতে সার্কাস দেখতে গেছি। আরে বাপ্ রে! কত সুন্দর! দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে। ভারি সুন্দর লাগল। বাসায় এসে ভাবছি যে ‘এত্ত সুন্দর করে হাঁটল দড়ির ওপর, এগুলো কি পারা যায় না? নিশ্চয়ই পারা যায়, আমিও চেষ্টা করি।’ করলাম কী, দোতলায় বারান্দার ওপরে রেলিং আর ওপরে দড়ি টাঙানো। যেখানে কাপড় শুকায়। আমি বললাম, বাহ্। এই দড়িটা ধরে এই রেলিংয়ে হাঁটি। দড়িটা ধরে নিয়ে হাঁটছি...তারপরে আর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম মাথার এখানে কিছুটা লেগেছে শুধু।  

আপনি প্রথম পাপেট প্রদর্শনী করেছিলেন শরণার্থী শিবিরে। কী ভেবে ওটা করেছিলেন?

কার্টুন অ্যানিমেশন ছিল বলেই আমি কার্টুনের ছবি আঁকতাম। পরে পাপেট তৈরি করা হয়। আমরা তো শরণার্থী শিবিরে যেতাম। বাচ্চাদের কারও মুখে হাসি নেই। আতঙ্কিত চেহারা, অসহায়। একদম গম্ভীর হয়ে গেছে। তখন বললাম, ‘নাহ্, এদের শুধু পেটের খাবার খাওয়াতে হবে না, এদের মনের খাবারও খাওয়াতে হবে।’ আমি বললাম, একটা পাপেট শো করি। ইতিমধ্যে কয়েকজন গিয়েছিল, যারা আমার সঙ্গে পাপেট করত। টেলিভিশনে করেছিল। তাদের বললাম, তোমরা একটা শো তৈরি করো, পাপেট আমি বানাই। তখন ওখানে সেই কাঠের গুঁড়ো-হেনতেন দিয়ে সব বানালাম। পাপেটের মধ্যে একজন কৃষককে এক রাজাকার এসে ধরেছে, ‘মুক্তি কাহা বলো?’ বলল, ‘জানি না।’ রাজাকার বলল, ‘বোলো, নেহি তো গুলি কারেগা।’ রাজাকার আরও বলে, ‘হুজুর আমাকে রাজার মতো অধিকার দিয়েছে। আমার নাম রাজাকার।’ তো কৃষক বলে না। ‘গুলি করো। এক, দো-তিন বলেগা, গুলি কারেগা।’ এক-দো-তিন বলেছে। কৃষক বলে, ‘বলি, বলি, বলি। মুক্তি থাকে এইখানে (বুকে হাত দেখিয়ে)।’ রাজাকার খোঁজে। বলে, ‘মিথ্যে কথা। এইখানে তো কিছু নাই। তোমার ছিঁড়া জামা খালি।’ এমন সময় এক মুক্তিসেনা এসে ধরে রাজাকারকে খুব মারতে গেল। সেই সময় এত হাসে বাচ্চারা। মারের কায়দাও আছে। ‘তুমি মুক্তি খোঁজো?’ এই যে এই যে।’ একটা ঘুষি মারে আর তার টুপি খুলে দেয়। আর কী খুশি বাচ্চারা, ‘আরও মারো! আরও মারো!’ এই যে আনন্দটা হলো, এইটা দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আমেরিকা থেকে তখন ফিল্মমেকার এসেছিলেন। তিনি ওটা এত পছন্দ করেছিলেন যে আমরা ওটা কয়েকবার করেছিলাম এবং তিনি সেটা ফিল্ম করেছিলেন। মুক্তির গান-এ এটা আছে।

পাপেট চরিত্রগুলো তৈরির সময় আপনার মাথায় কী ভাবনা খেলে?

পাপেটটা হলো দুই রকম, চিন্তার দুটি ধারা। একটা হলো তুমি বিদেশি পাপেট বা কার্টুন দেখে দেখে কপি করতে পারো। আমার কাছে যেটা ভালো লাগে সেটা হলো প্রতিটি দেশে রূপকথার কাহিনির যে চেহারা, ‘পটোলচেরা চোখ’, ‘মেঘের মতো চুল’—আমি সেগুলোকে কল্পনা করে পাপেট তৈরি করি। অর্থাৎ আমার দেশের রূপটা থাকে পাপেটের মধ্যে। যেমন পারুল আমার পাপেটের একটি চরিত্র যে সাত ভাইকে জাগাতে পারে। পারুল ছবি আঁকতে বা গান গাইতে পারে, অন্যকে সাহায্য করতে পারে। ভালো কিছুর মধ্যে তার আগ্রহ। পশুপাখির প্রতি যেমন ভালোবাসা, মানুষের প্রতিও। অর্থাৎ প্রধানত আমাদের দেশের ঐতিহ্য, গান, ছবি, প্রবাদবাক্য—সব মিলেই পাপেট চরিত্র তৈরি করি।

লালী চরিত্রকে কী জন্য রাখা? গাভি ছিল যে...

গাভি ছিল না। ওটা বোধ হয় ছাগল ছিল। গাভিও ছিল একটা। হাতুড়ে ডাক্তার। মাথায় চুল নেই, সে পরচুলা পরে বসত। তারপর ছাগলটা এসে ধরে বলে, ‘তুমি সব মিথ্যে কথা বলো। তোমার চুলটা আগে খাব।’ ‘কী! চুলটা আমার। চুল খাবে?’ তারপরে চুলটা ধরে টান দিয়ে দিল। তখন বুঝল যে হাতুড়ে ডাক্তার চুলের তেল বিক্রি করে, অথচ নিজেরটাই নাই। ষাঁড় ছিল, ষাঁড় হলো বলবান। তবে একটু বোকা। কিন্তু স্পষ্ট কথা বলে। একটু খাওয়ার আগ্রহ বেশি। আর সাহায্যও করে। বাউলের সঙ্গে ঝগড়া হয়। বাউল কিন্তু আবার ভালোও বাসে। ষাঁড়ের কিছু হলে ছুটে যায়, সাহায্য করে। ষাঁড় কোনো আর্ট পছন্দ করে না। খালি খাই-খাই করে। সবুজ দেখলেই খায়। ‘এত সুন্দর সুন্দর রং তুমি খাইয়া ফেলো।’ কিন্তু আবার ওকে পাঠানোর জন্য বাউল একটা চেষ্টা করল। বলল যে, ‘যাও ওখানে রিটার্ন টিকিট। ওখানে বুলফাইট হচ্ছে। অনেক প্রাইজ পাওয়া যাচ্ছে।’ টিকিট পেয়ে খুব খুশি। সবুজ মলাটওয়ালা টিকিট। খুব পছন্দ করল। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’ রিটার্ন টিকিট খুলিয়া রাখিয়াছি, আর ফিরিতে পারিবে না।’ বইয়ের ভাষায় কথা বলে। এই সময় ডাকে, ‘হাম্বা’... তারপরে বলল, ‘তুমি যাও নাই? এত দামি টিকিট দিলাম। তোমার ওখানে কত সম্মান। এত সম্মান ফেলিয়া তুমি এখানে ঘুরিতেছ?’ বলল যে ‘না, তুমি যে সবুজ রঙের টিকিট দিয়েছিল খুবই মজা লেগেছে।’ (হাসি) মানে খেয়ে খেলেছে। আবার পারুল সব সময় প্রটেকশন দেয়। ওকে ভালোবাসে, একেও ভালোবাসে।

‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...’ আপনি এই গানটির কাহিনিরূপ করিয়েছিলেন পাপেটের মাধ্যমে...

হ্যাঁ, ওটা খুব শুদ্ধ। লোকগীতি আজকাল আর কেউ শোনে না। বাচ্চারা তো নয়ই। আমি একটা চ্যালেঞ্জ নিলাম। আমাদের দেশে যে এ রকম একটা লোকগীতি আছে, এটাও বিরাট ব্যাপার। একটা পাখিকে নিয়ে এত সুন্দর একটা গান লিখেছে যে একটা পাখির প্রতিও দরদ আসে। আর আব্বাসউদ্দীন সাহেব অসাধারণ গেয়েছেনও বটে। দৃশ্যটা অনেকটা এ রকম—পাখিটা নদীর পাড়ে আসে, পাখির ডাক, একটা সাপ উঠে আসে, ফেলে দেয়, তারপর একটা মাছ উঠে আসে। মাছটা বলে, ‘ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমার বাচ্চারা অসহায় হয়ে যাবে, শোল মাছে খেয়ে নেবে’—এসব আরকি। একপর্যায়ে ছেড়ে দেয়। এরপরে বকটা ফাঁদে পড়ে যায়। ওই জায়গাটা খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। সত্যিই কষ্ট হয়। এ সময় দর্শক যারা শিশু তারা একদম ‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’ করে ওঠে। বকের প্রতি দরদটা হয়! এই যে দরদটা হচ্ছে, এটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এমনটা করেছিলাম। সঠিকভাবে যদি কোনো কিছু উপস্থাপন করা যায়, তাহলে সবারই ভালো লাগবে।

সিসিমপুর ও মীনা কার্টুনে আপনার ভূমিকা ছিল। এ রকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান বা কার্টুন কি পর্যাপ্ত আছে বলে আপনি মনে করেন?

না, খুব একটা নেই। সরকারেরও করা উচিত। আমাদের টেলিভিশন যে চ্যানেলগুলো বাচ্চাদের অনুষ্ঠান খুব একটা করে না। খুব যত্ন করে ‘চিলের কোঠা’ তৈরি করেছি, ‘নতুন কুঁড়ি’ করেছি। আরেকটি করেছিলাম। ওইটা ভীষণ প্রশংসিত হয়েছিল, ‘ছোট্ট খবর’। এতটুকু একটা ছেলে বাচ্চাদের খবর পড়ত। টাই বাঁধা একটা ছেলে গড় গড় করে খবর পড়ত। ছোটদের আর কী খবর? ওই বেণি থেকে ফিতা হারিয়ে গেছে এসব। বানানো হতো খবর। বিদেশের কিছু খবর থাকলে দিতাম। একটু কার্টুন দেখানো হতো। কিন্তু ওই ছোট্ট খবরটা বেশ চলেছিল।

ক্লাস এইটে তো এখন ‘চারু ও কারুকলা’ বিষয়টি আবশ্যিক হয়ে গেছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

এটা খুবই ভালো। আবশ্যিক হলেই যে সবাইকে করতে হবে এমন তো নয়। সেই গুরুত্ব কী দেওয়া হচ্ছে? খুব একটা দেওয়া হচ্ছে না।

যারা এ বিষয় পছন্দ করে না, এটা তো তাদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করছে।

পছন্দ না করার কী আছে? আমি বুঝতে পারছি না। তুমি করো আর না করো, আর্ট তুমি অনুসরণ করছই। তুমি মুখে বলো আর না বলো। তুমি আর্ট অনুসরণ না করলে বাঁচতে পারবে না। তুমি মুখে বলছ আর্ট পছন্দ করো না। কিন্তু দোকানে গিয়ে চোখ বন্ধ করে কাপড় কিনছ না কেন? ‘একটা এই সাইজের কাপড় দেন। দিয়েছেন? এত টাকা।’—এ রকম তো হয় না। যদি এ রকম করতে পারো, তাহলে বলব যে আর্টের দরকার নেই। তুমি রং পছন্দ করে কিনছ। যেই রং পছন্দ করলে, তুমি আর্ট অনুসরণ করছ। তোমার কাজ হলো পোশাক পরা। ঠান্ডা-গরম থেকে বাঁচার জন্য, সমাজের লজ্জা নিবারণের জন্য। আমরা তো শুধু ওই কাজটা শেষ করেই করছি না। কোন রং, কোন ডিজাইন...আবার হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখো কখনো। সবকিছু মিলে সব জায়গায় আর্ট। আমাদের গ্রামের মেয়েরা কাঁথা বোনে। কাঁথা সাধারণত রাতের বেলা শীত নিবারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এ সময় অন্ধকার থাকে। আসল কাজের সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তার আগেই যা অনুভূতিটা, সেটা বড় কথা। কাঁথা সোজা সোজা সেলাই করলেই হতো। কিন্তু কেন কষ্ট করে নকশা করে তোলে? সোজা সোজা সেলাই করলে সেলাই হতো কিন্তু ওই আগ্রহটা জন্মাত না। ওই যে নকশাটা করছে, সেটার মাধ্যমে বিভিন্ন কাহিনি ফুটে উঠছে, আরও ভালো লাগছে। সেটাকে আর কাজ মনে হচ্ছে না। সে জন্য যখনই তুমি নিজের মনকে নিয়ে ভালো লাগাবে, তখন সেটা তোমার প্যাশন হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের একদম প্রথম গান, ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো, পৌষ-ফাগুনের পালা, তারি মধ্যে চির জীবন বইব গানের ডালা।’ এই জীবনটা কান্নাহাসির। একবার কান্নাতে যাচ্ছে, একবার হাসিতে যাচ্ছে। তারই মধ্যে চিরজীবন বইব টাকার ডালা নয়, বইব ভাতের ডালা নয়, বইব গানের ডালা। ‘এই যে তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা। সুরের গল্পমালা।’ মানে ঈশ্বরের কথা বলছেন। যা-ই হোক। এই কবিতায় আরও আছে, ‘রাতের বাসা হয়নি বাঁধা, দিনের কাজে ছুটি।’ রাতের বাসা আমি বাঁধতে পারি নাই, কেন? দিনের কাজে ছুটি নিয়েছি। রাতের বাসা বাঁধিনি। ‘বিনা কাজে সেবার মাঝে পাইনি আমি ছুটি।’ যারা কাজের কাজ করেছে তারা ছুটি পেয়ে গেছে। মাটি কাটার পর এত বড় পয়সা নিয়ে চলে গেছে। ছবি আঁকছ, তুমি কবিতা লিখছ, গান লিখছ। গান লিখে কী লাভ? ছবি এঁকে কী লাভ? কিন্তু যে করে তার আর ছুটি নেই। ‘শাণিত কোথায় মোর তরে হায়, বিশ্ব—ভুবন মাঝে, অশান্তিতে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।’ মানে তোমার জীবনে অনেক অশান্তি আসবে, আঘাত করবে। কোনো বাদ্যযন্ত্র আঘাত ছাড়া বাজে না। আঘাত করতেই হবে।

পরিবারের চাপে অনেকে এ প্লাস পেতে পড়াশোনা করে। তখন সৃজনশীল বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

আসলে পুরো পড়াটা যদি সৃজনশীল হতো, তাহলে আটকে রাখা যেত না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এ ধরনের পড়া হলো একটা ফ্যাক্টরির বস্তার ওপর মার্কা মারা ছাপ। এই কোম্পানির এই জিনিস। এ প্লাস দরকার কী তোমার? অন্য কিছু পেলেই তো হয়। পরিবারের চাপ, এ প্লাস—পুরো সোসাইটি মার্কা মারার দিকে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব বড় মানুষকে দেখো, এ প্লাস কে পেয়েছে খুঁজে বের করো। কিংবা একেবারে ফার্স্ট হয়েছে। খুবই কম। পৃথিবীতে এ+ পাওয়া বড় মানুষ নেই। ওরা চাকরি করে, গোলামি করে। ব্যস! বড় মানুষ না। তবে চাকরি পাবে। তোমার জীবন যদি অন্যের গোলামি করা চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তুমি সৃজনশীল কিছুই করবে না। তোমার ছবি আঁকতে ভালো লাগে, এটা তো তোমার নিজের জন্য নয়, ছবিটা কি তুমি বাক্সে তুলে রাখবে? না। তুমি নিশ্চয়ই দেখবে। দেখাবে, আর ভালো লাগবে। তোমাদের প্রকৃতিকে ভালো লেগেছে। সেটা কি তোমরা প্রকাশ করবে না?

আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশন আর এফডিসিতে কর্মরত ছিলেন। খুব কাছ থেকে আমাদের অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র তৈরি হতে দেখছেন। আপনার মতে, আমাদের চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠানের মান কেমন?

চলচ্চিত্রগুলো বেশির ভাগ বাণিজ্যিক তো, অর্থাৎ আমজনতার জন্য যে চলচ্চিত্র তৈরি হয়, সেটার মান খুব নিম্নমানের, উঁচুমানের হয় না। অর্থাৎ লঘু চিত্তবিনোদন। তুমি যে তোমার মনকে শিক্ষিত করেছ, তোমার ধ্যানকে শিক্ষিত করেছ, আত্মাকে শিক্ষিত করেছ—এরপর এ লঘু চিত্তবিনোদন ভালো লাগবে না। আর যদি তোমার চৈতন্যই শিক্ষিত না হয়, তাহলে তুমি নিম্নমানে চলে যেতে থাকবে। সুড়সুড়ি দিয়ে তোমাকে হাসানো লাগবে। লঘু জিনিসে তুমি তখন খুশি হবে। আর চিন্তা যখন উন্নত হয় তখন এগুলো নিম্নমানের মনে হয়। আমজনতা যেটা পছন্দ করে, সেটা ভীষণ নিম্নমানের হয়ে যেতে পারে। যদি বাণিজ্যিক হয় তখন তারা আরও নিম্নমানের বানায় যাতে মানুষ তা পছন্দ করে। অর্থাৎ যত তারা মানুষের পছন্দ নামাতে পারে তত তাদের সুবিধা।

প্রতিভা বিকাশের অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র রূপকার আপনি। এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে। এই বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

একটু আগে তোমরা বলেছ, অনেকে বাচ্চাদের এসব পছন্দ করে না, গানটান শেখে না। আমি ভাবলাম, একটা প্রতিযোগিতা করা যায়। গান, নাচ, গল্প বলা, আবৃত্তি, দলীয় সংগীত, অভিনয়—সব বিষয়ে যেন উঠে আসে বাচ্চারা। এই শুরু হলো। তারপর তো আস্তে আস্তে বিশাল অনুষ্ঠান হলো। বন্ধ হয়নি। আবার বোধ হয় শুরু হবে। ওটা রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। সেটা আর আলোচনা নাই-বা করলাম। এটা কিন্তু আমার করা। অন্য কারও না। আমি ডিআইটিতে থাকতে করেছিলাম। এরপরে ওরা বলেছে ওই পার্টি করেছে, তারা বলেছে ওই পার্টি করেছে। পার্টির ব্যাপার নেই এখানে। এ নিয়ে অনেক পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে।

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে জলরঙের চর্চায় আপনার ভালো অবদান আছে। জলরঙের প্রতি কি আপনার আলাদা আকর্ষণ আছে?

হ্যাঁ, জলরঙের প্রতি আমার ভীষণ এক আকর্ষণ। কারণ, জলরং সৌন্দর্যবোধের এক মূল সত্যকে প্রকাশ করে। কত অল্পে তুমি প্রকাশ করতে পারো। উপন্যাসে প্রকাশ করা যায় না? এত মোটা ৫০০ পৃষ্ঠার বই, সেটা দিয়েও করা যায়। আবার ছোটগল্প দিয়েও করা যেতে পারে। উপন্যাস পড়লে হয়তো তোমার ভালো লেগেছে, কিন্তু একটা ছোটগল্প পড়লে হয়তো আরও ভালো লাগবে। কিন্তু একটা বড় কবিতা পড়ে বললে, ‘বাহ্! কবিতা বড় সুন্দর তো,’ কিন্তু পরে ছোট কবিতাও ভালো লাগে। একটা গানের মধ্যে যখন এল, তখন আরও ছোট হলো, আরও ছোট হলো। ‘হয়তোবা কালো মেঘ, হয়তোবা ফুল...’ কী সুন্দর গানটা! ‘কালো তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো রঙের চোখ।’

জলরং হলো, অল্প কথায় ছুঁয়ে যাওয়া। অল্প কথায়, বেশিক্ষণ লাগে না। ভাবতে অনেকক্ষণ লাগে, সেটাকে ধারণ করতে অনেকক্ষণ লাগে। আর দিনের পর দিন দেখার পর তোমার রঙের একটা বোধ উন্নত হয়। দেখেছি হয়তো এক বছর বা পাঁচ বছর। কিন্তু জলরং দিয়ে আঁকছি ১০ মিনিট বা ২০ মিনিট। কিন্তু দেখার ব্যাপারটা তো অনেকটা কবিতার মতো।

আপনার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া কী?

সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে জীবনটাকে পাওয়া। এ থেকে পাওয়া আর কী হতে পারে। তবে এ পৃথিবীটা যে কত সুন্দর, সেটা দেখার যে চোখ তৈরি হয়েছে বা প্রকাশ করায় ইচ্ছা হয়েছে, সেটা সবচেয়ে বড় পাওয়া। এত সুন্দর পৃথিবীতে আমি দেখেই শান্ত হইনি, সেটা আমি দশজনকে বলতে পারছি, দেখাতে পারছি, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।

আপনার নাতি নাফিস বিন যাফর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অস্কার জয় করেছেন। পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান, মেগামাইন্ড, কুংফু পান্ডার মতো অনেক জনপ্রিয় ছবির অ্যানিমেশন ও কারিগরি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ কেন অ্যানিমেশনে এগোচ্ছে না?

ও বাবা! অ্যানিমেশনের পেছনে প্রচুর অর্থ দরকার। ওই অর্থ দিয়ে এখানে কেউ তা করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেরা সব পারে। নাফিসের মামা অর্থাৎ আমার ভাগনে মইনুল হোসেন স্মৃতিসৌধের নকশা করেছে। ছোটবেলায় ও খুব ছবি আঁকত। আর নাফিসও ছবি আঁকত—লম্বা লম্বা ছবি। ছবি আঁকলে মনটা চারদিকে ছড়িয়ে যায়। তখন তোমার মধ্যে ‘পথ বন্ধ’ প্রবণতাটা কমে যাবে। আর কী যেন বললে, জিপিএ-৫? গরুর পেছনে লোহা পুড়িয়ে যেমন ছাপ দেওয়া হয় না, সে রকম তোমাদেরও ছাপ দেওয়া হয় জিপিএ-৫-এর মাধ্যমে।

২০০৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়ে আপনার কেমন লেগেছিল?

ওটা তো সত্যিই খুবই আনন্দের। সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালো লেগেছে, বাংলা ভাষাকে আরও ভালো লেগেছে। রবীন্দ্রনাথকে আরও নিবিড়ভাবে জানতে চেষ্টা করেছি, এখনো করছি। কিন্তু পুরস্কারের জন্যই যে করেছি তা কিন্তু না। পুরস্কার পেলে ভালো, তবে পুরস্কারের জন্য তো কাজ করিনি। কাজ করেছি, সেই কাজ পুরস্কার এনে দিয়েছে।

কেউ যদি আপনার কাছে আবদার করে যে সেও আপনার মতো ছবি আঁকতে চায়, পাপেট বানাতে চায়, আপনি তাকে কী পরামর্শ দেবেন?

আমি শেখাচ্ছি তো। সব ছোটদের বলছি, শেখো। আমি তো প্রতি মাসেই শেখাচ্ছি। আমি যেটা জানি, সেটা কি আমার কাছে রেখে দেব? না। আমি প্রচুর ছেলেকে পাপেট বানানো শিখিয়েছি। ওরা খালি পয়সার ধান্ধায় আছে, কী করে পাপেট দিয়ে পয়সা করা যায়। পয়সার পেছনে ঘুরলে হবে না। আমি যখন করেছি, তখন একবারও ভাবিনি এটা দিয়ে পয়সা করা যাবে। পয়সা এসে গিয়েছে। একাগ্রতা মানে জানো? যেকোনো কাজই তোমার সারাক্ষণ করতে ইচ্ছে হবে। সেটাকে বলে একাগ্রতা। তাই বলে সারাক্ষণ তোমার খারাপ কাজ করতে ইচ্ছে করলে, সেটা না। সারাক্ষণ তুমি ভালো কিছু করতে চাও। ভালো মানে যেটা মানুষের উপকার করে। মানুষ নামের একটি প্রাণী পৃথিবীতে আছে। রবীন্দ্রনাথ এক কবিতায় বলেছেন, আজকের প্রকৃতি সন্ধ্যাবেলায় এত সুন্দর হয়েছে যে এটা বর্ণনা করার ভাষা ভগবান আমাকে দেননি। রবীন্দ্রনাথ—পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি—বলছেন, এ বর্ণনা লেখার শক্তি নেই। তার মানে কত্ত সুন্দর এ পৃথিবী! ক্ষমতা নেই কিন্তু প্রকাশ করার ইচ্ছেটা তাঁর আছে। এই যে করতে পারছেন না প্রকাশ, এটা জরুরি। একটায় হচ্ছে না, আরেকটা। সেটায় হচ্ছে না, আরেকটা। যদি পেয়েই যেতেন, তাহলে বলতেন, যাও ওইটাতে সব লিখে ফেলেছি, ওইটা পড়ো। কিন্তু তা তো হয় না। মানুষ হিসেবে বাঙালির বিশাল সম্পদ হলো রবীন্দ্রনাথ। আরও আছে নজরুল, পাশাপাশি বাউল—সবকিছু মিলিয়ে এগুলো এত মহান চিন্তাধারায় নির্মিত আমরা খুব গর্বিত জাতি—বাঙালি।

আমার এক বন্ধু পড়াশোনা করে বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হতে চায়। কিন্তু বাসা থেকে তাকে কোনোভাবেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সবার ধারণা চারুকলা মানেই নেশা করে...

নেশা করতে হয়? শিল্প করাটাই তো নেশা। আবার নেশা করতে হবে কেন? শিল্পটাই যখন নেশা হবে, রাতের বাসা বাধা হবে না, দিনের কাজের ত্রুটি হবে। এটা তো বিনা কাজ। সমাজ বলে বিনা কাজ। ‘বিনা কাজে সেবার মাঝে পাইনি আমি খুঁজে’। আগে তো খেলাধুলা নিয়ে ‘এই যে খালি খেলেই বেড়ায়’ বলে দিত মার। আর এখন তো যারা ক্রিকেট খেলছে, তাদের নিয়ে নাচানাচি করে। অনেক পয়সা করছে তো, তাই ক্রিকেটে এখন আর কোনো অসুবিধা নেই। এখন বলে, ‘সবাই জিপিএ-৫ পাবি। যা পড়’। এই জি মানে জেলখানা। জিপিএ-৫ মানে জেলখানায় ৫ নম্বর সেল! ওখানে থাকো। আমাদের পয়সার দরকারটা কী? আমি বেশি পাইনি। অল্প পেয়েছি। চলে যাচ্ছে তো। এখনো নেশার মধ্যে আছি। এখনো বাচ্চাদের জন্য কাজ করছি, বড়দের জন্য করছি। এটা বিশাল নেশা।

বাবা-মায়েরা অনেক সময়ই আমাদের চিত্রশিল্পী বা চলচ্চিত্রনির্মাতা হতে দিতে চান না। কারণ, এ ক্ষেত্রটাতে কাজের সুযোগ কম। এ সমস্যার সমাধান কী?

সমাধান নেই বলে তো আমরা ঘুরি। পাগল হতে পারে কয়েকজনে। পাগল হতে হবে। নিজের সুযোগ নিজেই বানাতে হবে। তোমার ইচ্ছাটা বড় কথা। সুযোগ তোমাকে বানাতে হবে। তোমার ইচ্ছা নেই, সুযোগ হবে কী করে?

এস এম সুলতানসহ অনেক শিল্পীর জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায়, তাঁরা  জীবনের একটা সময়ে ঘরসংসার ছেড়ে নিভৃতে বসবাস শুরু করেছিলেন। শিল্পী হতে চাইলে কি সত্যিই বৈরাগী হতে হয়?

না তো, কোনো শিল্পী বৈরাগী নন। খুব কম। এই সংসারের ক্যাঁচরম্যাচর, এটা-ওটা এড়ানোর জন্য একটু বাইরে থাকে আরকি। প্রাত্যহিক কাজের বাইরে থাকে, এ জন্য বলে যে শিল্পীরা বৈরাগী হয়। কিন্তু না তো, সব শিল্পীই সংসারী।

আপনি কি কখনো ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন?

আমি তো ঘর ছেড়ে পালিয়েই আছি...(হাসি) ঘরে ঢুকলাম কখন?

আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার দলের ছয়জন ছাড়াও আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে: আলাভী নূর-ই জান্নাত, ফারহানা হক, মালিহা হক, নাফিসা বিনতে মমিন, নিশাত তাসনিম, রোদেলা রংধনু, সাদিয়া বিনতে লিয়া, শেখ মো. আশফাক, সৃষ্টি বৈদ্য, তাবাস্সুম ইসলাম, তানজিলা তাসাবা ও জাকারিয়া মাহফুজ।