ক্রিকেটে শূন্যকে কেন ডাক বলা হয়

শিরোনাম থেকেই বুঝতে পারছ, ডাক বিভাগের কথা বলছি না। ক্রিকেটের ডাকের খবর নিয়ে হাজির হয়েছি আজ। সম্প্রতি ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচে ঘটেছে অদ্ভুত এক ঘটনা। কোনো রান যোগ না করেই আউট হয়েছেন ভারতের শেষ ৬ ব্যাটার। ৪ উইকেটে ১৫৩ রান করা ভারত অল আউট হয় সেই ১৫৩ রানেই। শূন্য রানে আউট হয়েছেন ৬ জন।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ক্রিকেট খেলায় কোনো ব্যাটার শূন্য রানে আউট হলে সেটাকেই বলা হয় ডাক। প্রিয় দলের খেলা যখন চলে, তখন সেই দলের খেলোয়াড়দের কেউ যদি ‘ডাক মারে’, অর্থাৎ শূন্য রানে আউট হয়ে যায়, তোমাদের মন খারাপ হয় নিশ্চয়ই? রান এগোল না, কিন্তু একটা উইকেট চলে গেল। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের বেলায় এমন কিছু ঘটলে অবশ্য খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ডাকের কিন্তু নানা ধরনও আছে; যদিও সব ক্ষেত্রেই ফল একই, অর্থাৎ স্কোরবোর্ডে কোনো রানই যোগ হয় না।
শূন্যকে কেন ডাক বলা হয়, জানো? আমরা বাংলায় যেমন গোল করে শূন্য লিখি, ইংরেজিতে জিরোর আকার কিন্তু ততটা গোল নয়। বরং ওপরে-নিচে খানিকটা লম্বাটে ভাব থাকায় একে দেখায় ডিমের মতো। হাঁসের ডিমের সঙ্গে সেই শূন্যের বেশ সাদৃশ্য থাকায় সেখান থেকেই ‘ডাক’ হিসাবে ‘ডাকনাম’ পেয়ে গেল স্কোরকার্ডের শূন্য। ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় হাঁস কবে কীভাবে ঢুকে গেল? ১৮৬৬ সালের এক ক্রিকেট ম্যাচের রিপোর্ট লিখতে গিয়ে এক সংবাদপত্রে প্রথম ব্যবহার করা হয় এই শব্দটি। সেই ম্যাচে সপ্তম এডওয়ার্ড আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে, যিনি ছিলেন ওয়েলসের রাজপুত্র (পরে অবশ্য রাজ্যশাসনও করেছেন)।

অ্যানিমেশনে ডাক

১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কেরি প্যাকার ব্যাটারদের এই ভীষণ মন খারাপের বিষয়টির সঙ্গে জুড়ে দিলেন হাঁসের এক অ্যানিমেশন। এই হাঁসের নাম দেওয়া হলো ড্যাডলস। শিশু–কিশোরদের জন্য মজার এক উপকরণ হিসেবে ক্রিকেট সম্প্রচার মাধ্যমে যোগ হয়ে গেল এই অ্যানিমেটেড হাঁস। শূন্য রানের হতাশা নিয়ে ব্যাটার বেচারি যখন প্যাভিলিয়নের পথে হেঁটে যেতেন, টেলিভিশনের পর্দায় তখন তাঁরই সঙ্গে সঙ্গে রাগ ও দুঃখের এক মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করতে করতে হেঁটে যেত ড্যাডলসও। ড্যাডলসের হাতেও থাকত একটা ব্যাট। কেরি প্যাকার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার ধনকুবের, তাঁর টেলিভিশন চ্যানেলে (চ্যানেল নাইন) তখন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ দেখানো হতো।

ডাকের কথকতা  

মুত্তিয়া মুরালিধরন
ফাইল ছবি

শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরনের নাম তো শুনেছ নিশ্চয়ই। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই স্পিনার কিন্তু ব্যাটার হিসাবে নেমে ৫৯ বার শূন্য রানে আউট হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তাঁর চেয়ে বেশিবার শূন্য রানে আউট হননি কেউই। অনাকাঙ্ক্ষিত এই র‍্যাঙ্কিংয়ের তালিকার ‘সেরা’র নামটা তাই অবধারিতভাবে তাঁরই। নিকটতম ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ যাঁকে বলা যায়, তাঁর নাম কোর্টনি ওয়ালশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই ক্রিকেটারও অবশ্য বিশ্ববিখ্যাত বোলার। দুটি নাম পড়েই কি ভাবছ, এই তালিকায় কেবল বোলাররাই আছেন? তাহলে তোমার ভাবনা একেবারেই ভুল। তালিকায় তিন নম্বরে থাকা নামটা একজন ব্যাটারের। শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত ব্যাটার সনাৎ জয়াসুরিয়া ৫৩ বার শূন্য হাতে, মানে শূন্য রানে ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে এই তিনজন ছাড়া আর কারোরই শূন্যের ‘অর্ধশতক’ নেই। সবচেয়ে বেশি শূন্যের তালিকায় থাকা বাকি সবারই শূন্য রানে ফেরার সংখ্যাটা পঞ্চাশের কম। এই তালিকার পঁচিশ নম্বরে আছেন তামিম ইকবাল। আমাদের তামিম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৩৬ বার আউট হয়েছেন শূন্য রানে।

সেরার দুঃখ ডাক

ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান
ছবি: এবিসি

ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যানের জীবনের শেষ ইনিংসটা ছিল ডাক। তখনো অবশ্য কেউ জানতেন না, এটিই তাঁর শেষ ইনিংস হতে চলেছে। তবে পরে হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেল, তিনি যদি মাত্র চারটি রান করতেন ওই ইনিংসে, তাহলে তাঁর ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় হতো এক শ। ‘দ্য ডন’ হিসাবে পরিচিত এই ডানহাতি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল ৯৯.৯৪ গড়ে। ভাগ্যই বটে!

দেশের অভিষেকে ওপেনারের ডাক

১৮৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন ওপেনার অ্যালবার্ট রোজ-ইন্স। ওয়ান ডাউনে নামা ফিলিপ হাচিসনও ফিরেছিলেন শূন্য হাতেই। একটা দেশের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনো রান যোগ হওয়ার আগেই দুজন ব্যাটার আউট হয়ে যাওয়ার এই ঘটনাটিও দুঃখজনক, তা–ই না? সেই ইনিংসে আরও দুজন ব্যাটার শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন চার্লি ফিনলাসন এবং গুস কেম্পিস। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম ডাকের ‘মালিক’ অ্যালবার্ট রোজ-ইন্সের কিন্তু শূন্যসংক্রান্ত ‘প্রথম কীর্তি’ আছে আরও একটা। তা জানানোর আগে ডাকের রকমফের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন

ডাকের রকমফের

শূন্য রানে আউট হলে ডাক তো বলা হয়ই। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই ডাককে আরও বিশেষ নামেও ডাকা হয়। কোনো ব্যাটার যদি প্রথম বলের মুখোমুখি হয়েই আউট হয়ে যান, তাহলে বলা হয় গোল্ডেন ডাক। আর তা যদি হয় একেবারে ম্যাচেরই প্রথম বল, তাহলে তা প্লাটিনাম ডাক। প্লাটিনাম ডাককে আবার রয়্যাল ডাকও বলা হয়। টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হওয়াকে বলা হয় পেয়ার। আর দুটিই যদি হয় গোল্ডেন ডাক, তাহলে তাকে বলে কিং পেয়ার। একেবারে রাজকীয় ব্যাপারস্যাপার সব! স্বর্ণ আর প্লাটিনামই কেবল নয়, হীরাও রয়েছে শূন্যের মধ্যে। কোনো ‘বৈধ’ বল না খেলেই যদি আউট হয়ে যান কোনো ব্যাটার, তাঁর রানসংখ্যাও শূন্য। সেটিও তাহলে ডাক। এই ডাকের নামই হলো ডায়মন্ড ডাক। এমনটা কখন হতে পারে?

ধরা যাক, কোনো ব্যাটারের ইনিংস শুরু হলো নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে। তিনি মাঠে নামার পর স্ট্রাইকিং প্রান্তে ব্যাটার যে বলটার মুখোমুখি হলেন, সেই বলে রান নেওয়ার জন্য দৌড়ালেন দুজনে। নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকা সেই ব্যাটার যদি প্রান্তবদল করার সময় রান আউট হয়ে যান, তাহলে তাঁর রান শূন্য। আর তা হবে ডায়মন্ড ডাক। আবার এমনটাও হতে পারে, ব্যক্তিগত রানের খাতা খোলার আগে একজন ব্যাটার একটি ওয়াইড বলের মুখোমুখি হলেন। বলটা হয়তো উইকেটকিপারেরও নাগালের বাইরে ছিল। ব্যাটার দুজন এই সুযোগে দৌড়ালেন রানের জন্য। কিন্তু এবার সেই স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটার প্রান্তবদলের সময় আউট হয়ে গেলেন। যে বলটা তিনি খেলেছিলেন, সেটা ক্রিকেটের আইনে ‘বৈধ’ বল না হওয়ায় তাঁর এই ‘অর্জন’টাও হবে ডায়মন্ড ডাক।

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জিরো অব জিরো

ডায়মন্ড ডাকের বিষয়টা বেশ মজার, তা–ই না? শূন্য বলে শূন্য রান। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে জিরো অব জিরোর প্রথম ‘কীর্তি’র ‘মালিক’ (নাকি শিকার?) সেই অ্যালবার্ট রোজ-ইন্স। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে তাঁর স্কোর ছিল জিরো অব জিরো। তাঁর আগে কেউই ডায়মন্ড ডাক করেননি। এরপরও করেছেন অল্প কজন।

আরও পড়ুন

জিরো অব জিরোর ‘দীর্ঘতম’ গল্প

হ্যাজেলউড
ছবি: ফক্স স্পোর্টস

বুঝতেই পারছ, জিরো অব জিরোর ঘটনা শিগগিরই ঘটে না। ব্যাট করতে নেমে বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও জিরো অব জিরোতে আউট হওয়ার ঘটনা তো আরও বিরল। এমন ঘটনার কথা বলতে গেলে জশ হ্যাজেলউডের নামটা আসবে অবধারিতভাবেই। সবচেয়ে লম্বা সময় উইকেটে থেকে জিরো অব জিরো নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে এমন ব্যাটার হিসাবে এখন পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটাই লেখা আছে। ২০১৭ সালে ইডেন পার্কে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমে ২৬ মিনিট উইকেটে টিকে ছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান। তাঁর সঙ্গে মার্কাস স্টইনিসের জুটিতে ৫৪ রান যোগ হয়েছিল। কিন্তু বেচারি হ্যাজেলউডের স্কোরটা ফাঁকাই রয়ে যায় সেবার। কেইন উইলিয়ামসনের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে আউট হয়ে যান হ্যাজেলউড। ২৮৭ রানের লক্ষ্যে খেলতে নামা অস্ট্রেলিয়া অলআউট ২৮০ রানে। ৬ রানের ব্যবধানে জিতে যায় নিউজিল্যান্ড।

হাঁসদের খুশি রাখতে

২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের খেলা পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ভোপালের এক ফ্যান ক্লাব সেই ম্যাচের আগে স্থানীয় একটি লেকে হাঁসদের খাবার দিয়েছিল। অনুমান করা যায়, এর উদ্দেশ্য ছিল খেলা থেকে হাঁসের ডিমকে দূরে রাখা! তবে সেই ম্যাচে ভারতের মোহিত শর্মা এবং উমেশ যাদব আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। ৯৫ রানের বড় ব্যবধানে হেরেছিল ভারত।

সূত্র: ইএসপিএনক্রিকইনফো, দ্য ক্রিকেট মান্থলি এবং বিবিসি।