এসো কবিতা পড়ি

অলংকরণ: তুলি

কবিতা যেন একটা খুব সুন্দর পাখি, যা গাছের ডালের নীল-সবুজ পাতার ভেতর লুকিয়ে থেকে মধুর স্বরে ডাক দেয়। যেন কোকিল। কোকিল নামের সেই ছোট্ট, কালো, মিষ্টি পাখিটির ডাকে যেমন সবাই আমরা মুগ্ধ হই, তেমনি মুগ্ধ হই কবিতা পড়ে। শিশুকালে হারিকেনের আলোতে বা ভোরের বাতাসে দুলে দুলে মাথা নাচিয়ে কবিতা পড়তে শিখি। আমরা যারা কবিতা পড়েছি, সবাই বুঝেছি, কবিতা জাদু জানে। যদি কবিতা একবার ভালো লাগে, তবে আর কথা নেই, বারবার তা পড়তে হয়। ব্যাগ দুলিয়ে ক্লাসে যাওয়ার পথে, একা একা বা আকাশে লাল ঘুড়ি ওড়ানোর সময় না জেনেই তা আবৃত্তি করে ফেলি। কিছু কবিতার পঙিক্ত বলি:

  • বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

  • আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে

  • পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল

  • আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
    বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।

  • ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি ওঠরে
    ওই ডাকে যুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোটরে

  • আমি যদি হই ফুল হই ঝুঁটি বুলবুল হাঁস।

তোমরা অনেকেই হয়তো ওপরের সবগুলো কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছ। তার কারণ, এরা এত সহজে ভালো লেগে যায় যে ভুলতে দেয় না। ছোটবেলায় যখন কবিতা পড়ি, তখন কবিতার অর্থটা কিন্তু বড় হয়ে দেখা দেয় না। দেখা দেয় আরেকটা জিনিস, যার নাম ছন্দ। ছন্দ এক মোহনীয় জাদুকর, কবিতার ভেতরে যে এমন দোলা, স্বর সঞ্চার করে দেয় যে তাকে বারবার আবৃত্তি না করে পারা যায় না। বাল্যকালে যেসব কবিতা ভালো লাগে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু ছড়া, বেশ ছোট্ট ছোট্ট। ছড়ার কিন্তু সব সময়ই কোনো অর্থ থাকে না। আবার কোনো পঙিক্তর অর্থ যদি মাথা ঘামিয়ে পাওয়া গেল, তবে আবার মুশকিল হয় পরের পঙিক্ত নিয়ে। তাই আমরা ছড়ার অর্থ একটুও খুঁজি না, কেননা বুঝি না। যাকে বুঝি তাকেই খুঁজি। খুঁজে পাই মনমাতানো ছন্দ, তাল এবং শুনতে মজা লাগে—এমন একরাশ কথা। তাদের বেশ ভালো লাগে, দুর্বোধ্য, মনোরম বন্ধুর মতো। ধরা যাক:

হাট্টিমা টিম টিম
তারা মাঠে পারে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম।

এরা কারা, কী তাদের নাম? যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে, তবে আমি সোনালি ধানখেতের পাশে সবুজ নীল মাঠের দিকে তাকিয়ে, শার্টের পকেট থেকে কুল বের করে খেতে খেতে, খুব মাথা দুলিয়ে বলব, জানি না, জানি না, তাদের জানতে চাই না। জানি তারা অদ্ভুত, সুন্দর, কেননা এই ছড়ার যে ধ্বনি, তা সুন্দর!

ছড়ার সাধারণত কান-ভোলানো মন-দোলানো অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা থাকে। আর থাকে নাচ, অর্থাৎ ছন্দ। ছড়াকার আকাশের গায়ে টকটক গন্ধ পান, আবার কখনো দেখেন হয়তো একটা বিরাট জুতো, যার মধ্যে অনায়াসে চেয়ার, টেবিলসহ বাস করা যায়।

অলংকরণ: তুলি

ছন্দ জিনিসটা কী, তাও বোঝা দরকার। যারা অল্পস্বল্প বুঝি, তাদের মতে, এটি হচ্ছে কবিতায় যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলো এমনভাবে বলা হয়, যেন তাদের মধ্যে তাল জেগে ওঠে। যেমন:

ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি ওঠরে,
ওই ডাকে যুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোটরে

এই পঙিক্ত দুটিকে আমরা পড়ি এভাবে:

ভোর হলো/দোর খোল/খুকুমণি/ওঠরে/
ওই ডাকে/যুঁই শাখে/ফুল-খুকি/ছোটরে/

মধ্যে মধ্যে যে দাগগুলো দিয়েছি, সেখানে আমরা কিছু সময়ের জন্য থেমে পড়ি, আবার শুরু করি এবং দেখি, ‘ভোর হলো’ পড়তে যে সময় লেগেছে, ‘দোর খোল’ পড়তে লেগেছে ঠিক ততখানি সময়। এবং সারাটা কবিতা এভাবে পড়াতে জেগে ওঠে ঘুমিয়ে-থাকা সে জাদুকর, নাম যার ছন্দ। যদি পড়তাম;

ভোর হলো দোর/খোল/খুকুমণি/ওঠরে/
ওই ডাকে/যুঁই শাখে ফুল/খুকি ছোটরে/।

তবে ঘুমের দেশে কোনো দিন ঘুম ভাঙত না, সারা কবিতাটি কুইনাইনের মতো, নিমের মতো তেতো হয়ে উঠত। ছেলেবেলায় মিল জিনিসটি লজেঞ্চুসের মতোই লোভনীয়, মিষ্টি লাগে। মিল ছাড়া যে কবিতা, তা তো মাটির মারবেল। তাই মিল চাই। মিল কী? আমরা দেখি, সাধারণত কবিতার এক পঙিক্তর শেষ শব্দটির সঙ্গে পরবর্তী পঙিক্তর শেষ শব্দটির মধ্যে মিল থাকে। যেমন: ধেনু, বেণু, তিল, ঝিল, নীল, কাঁচা, বাঁচা:

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি
খাসা তোর চ্যাঁচানি

এখানে প্যাঁচানির সঙ্গে মিল আছে চ্যাঁচানির। যদি পরের পঙিক্তর শেষ শব্দটি হতো জামাটি তবে মিল থাকত না; তখন ছড়াটি কেমন লাগত? ছেলেবেলায় মিল চাই, বড় হলে বেশি চাই না।

কবিতা যে কত রকমের আছে, তা বলে শেষ করা যায় না। তবে সব কবিতার কাজ হলো মনকে আনন্দ দেওয়া। যে কবিতা তা দেয় না, তাকে কবিতা বলতে ইচ্ছে হয় না, আমরা বলি ওগুলো পদ্য। ‘পদ্য’ অর্থাৎ সেখানে ছন্দ-মিল সবকিছুই নিয়মমতো আছে, নেই শুধু আনন্দ দেওয়ার মধুর ক্ষমতা। যুগ যুগ ধরে, হাজার হাজার বছর ধরে কবিতা লেখা হচ্ছে। তার ফলে কবিতার রকমের শেষ নেই। কোনো কবি কবিতায় (বা পদ্যে) গল্প বলেছেন, কেউ নীতিকথা শিখিয়েছেন, কেউ যুদ্ধবিগ্রহের মহা মহা কাব্য লিখেছেন, আবার কেউ ‘সমাজ সংসার মিছে সব’ বলে নিজের মনের কথা বলে গেছেন। যাঁরা কবিতায় গল্প বলেছেন, তাঁদের আসল লোভটা কিন্তু গল্পের দিকেই। গল্পকে তাঁরা ছন্দের পাখা পরিয়ে দিয়েছেন। তার ফলে সেই গল্পগুলো টেকসই হয়েছে একটু বেশি, কেননা তার মধ্যে ছন্দ এবং মিল রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এ রকম অনেক কাব্য আছে। যেমন ধরো কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলকাব্য বা বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলকাব্য। আবার কেউ কেউ নীতিকথা বেশি প্রচারের জন্য কবিতার মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন। যেমন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সদ্ভাবশতক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও কিন্তু এ রকম নীতিমূলক ছোট ছোট পদ্য লিখেছেন। যেমন:

কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই বলি ডাক যদি, দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা।

রবীন্দ্রনাথের এটি নীতিকথামূলক হলেও, কী এক কারণে যেন এটাকে বেশ লাগে; কিন্তু নীতিকথার বাড়াবাড়ি হয়ে যায় বলে অনেকের নীতিকথাভরা পদ্য একেবারেই পড়া যায় না। যুদ্ধবিগ্রহ এবং জীবন নিয়ে লম্বা কাব্য পৃথিবীর সব দেশেই লেখা হয়েছে। এগুলো সাধারণত পুরোনো দিনেই লেখা হতো। এগুলোকে বলে মহাকাব্য। গ্রিসদেশে মহাকাব্য লিখে অমর মহাকবি হয়েছেন হোমার। তাঁর বইয়ের নাম ইলিয়ড, অডেসি। ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন মিল্টন, তাঁর কাব্যের নাম প্যারাডাইস লস্ট। সংস্কৃত ভাষায় ব্যাসদেব লিখেছেন মহাভারত এবং বাল্মিকী লিখেছেন রামায়ণ। বাংলা ভাষায় লিখেছেন মধুসূদন দত্ত। তাঁর মহাকালজয়ী কাব্যটির নাম মেঘনাদবধকাব্য। তাঁকে অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় অনেকেই হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৃত্রসংহার), নবীনচন্দ্র সেন (কুরুক্ষেত্র, রৈবতক, প্রভাস) কায়কোবাদ (মহাশ্মশান) মহাকাব্য লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বড়, প্রিয় এবং বিশ্বের একজন বড় কবি, মহাকাব্য লেখেননি। তিনি নিজের মনের কথা বলতেই ভালোবাসতেন। নজরুল ইসলাম শোনান আরেক রকম কথা। তিনি কবিতায় যারা দরিদ্র, অন্নহীন, তাদের দাবি জানান।

তোমরা আজ কি কবিতা পড়ো? স্কুলের তিনটে পদ্য পড়েই কি গুটিয়ে রেখে দাও কবিতার বই টেবিলের কোণে? নাকি ইচ্ছে হয় আরও পড়তে, ঝংকার দিয়ে কি তোমাদের ডাক দেয় না কবিতা? সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কয়েকটি কবিতার পঙিক্ত বলছি:

  • সিন্দুর টীফ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ।

  • রূপশালি ধান বুঝি এই দেশে সৃষ্টি,
    ধূপছায়া যার শাড়ি তার হাসি মিষ্টি।

তোমরা নিশ্চয় মুগ্ধ হও এই ধ্বনিতে, আর সারাটা বাল্যকাল লাফিয়ে ওঠে। বাল্যকালটা ছড়ার কাল, ধ্বনিময় কবিতা পড়ার কাল। এ সময়টা উদ্ভট, অসম্ভব কবিতার ছবি পড়ার কাল।

এসো, যখন ভূগোল পড়া শেষ হয়ে গেছে, ইতিহাস বাকি নেই, অঙ্কের ঝামেলাটা পেরোনো গেছে, তখন কবিতার বই খুলে ধরি। ছন্দের স্বরে আর কথার সুরে ভেসে যাই এক স্বপ্নভরপুর সব পেয়েছির দেশে। সে মিষ্টি মুহূর্তে সবকিছুকে কবিতা মনে হোক: আকাশ একটি কবিতা, চিল একটি কবিতা, হাঁস একটি কবিতা, হারানো মারবেলটি একটি সুন্দর, চিরকাল-মনে-রাখা মিষ্টি কবিতা।

(আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বুকপকেটে জোনাকি পোকা থেকে সংগৃহীত)