সম্পর্কের জয়

অলংকরণ: তুলি

কী এক হতাশ্বাসে ভরে আছে অমিতের মন
শূন্যতার বোধ নিয়ে ছেলেটা কী করবে এখন?
ফেসবুকে উদাসীন, মুঠোফোনে সাড়া নেই তার
কে তাকে ফিরিয়ে দেবে উচ্ছল জীবন আবার?

ওদিকে পিয়ার চোখ বারবার ফোনের স্ক্রিনে
নিজেকে হারিয়েছে, সে কীভাবে আবার নেবে চিনে?
অমিত আসেনি কাল, ফোন​ ছিল জবাববিহীন
অমিতের স্পর্শ ছাড়া কেটে গেল দীর্ঘ এক দিন!

পিয়ার সরল মনে ঢুকে পড়ে সন্দেহের ধোঁয়া
অমিতের জীবন কি পেল আজ দীপ্তির ছোঁয়া?
সেদিন ক্লাসের শেষে কেএফসি খেতে গিয়ে দেখে
দীপ্তি মেয়েটা শুধু অমিতের চোখে চোখ রাখে!

অমিত কি হেসেছিল, দীপ্তির চোখের ভাষায়?
পিয়া তো আকুল হয় সেই ভাষা পড়ার আশায়
কিন্তু পিয়ার হাতে অমিত তো রেখেছিল হাত!
সে স্পর্শে সুখ ছিল, কী যে হলো আজ অকস্মাৎ!

তাহলে কি এর মাঝে ফেসবুকে ওদের সাক্ষাৎ​?
গোপনে এগিয়ে গেছে সম্প্লর্কের ধারাপাত?
অমিত এখন তবে দীপ্তির কাছাকাছি আছে?
মুঠোফোন ধরছে না, পিয়া সব জেনে ফেলে পাছে?

চোয়াল শক্ত হয়, প্রতিশোধে জ্বলে ওঠে চোখ
অমিতের কাছে যাবে, পরিণতি যা হবার হোক
সওয়াল করবে পিয়া অমিতের চোখে চোখ রেখে
পরোয়া কিছুই নেই সম্প্লর্ক টেকে কি না টেকে।

‘বের হব মা এখন, কী নাকি হয়েছে অমিতের
ওর কিছু এলোমেলো হলে আমি পেয়ে যাই টের
আমাকে কি ভুলে গেল, ও কি আর ফিরে আসবে না?
কী নিয়ে থাকব আমি, চেনা পথ হবে কি অচেনা!’

পিয়া-অমিতের কথা মা জানেন বহু আগে থেকে
এদের চলার পথ এভাবে কখনো যাবে বেঁকে—
ভাবনার সীমানার সেটা তাঁর কখনো ছিল না,
তবে কি পিয়ার আর সুখস্বর্গে পা রাখা হলো না?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা-মেয়েকে জানান বিদায়
সংশয়ে মন তাঁর কোন কানাগলিতে হারায়!
তবুও আশারা জাগে, মন বলে সব হবে ঠিক
গদ্যের মাঝে ভেসে উঠবেই পুরোনো লিরিক।

২.

বিকেলের শেষ আলো মিলিয়ে গিয়েছে কিছু আগে
ঘরের বাতির দল জ্বলে ওঠে সব একে একে
হতাশা মেশানো মনে ছাইরঙা এ অস্তরাগে
পিয়ার ক্লান্ত চোখে অমিতকে অদ্ভুত ঠেকে!

‘তোমার কি ফোন নাই, ফেসবুক উঠেছে চুলোয়?
দীপ্তিময় হয়ে ওঠে আমাকে ভুলেছ একদম?

এত দিন রিলেশন, এখন তা ফেলে দেবে পথের ধুলোয়!
দী​প্তির চেয়ে বলো এই আমি কোথায় কি কম?’

অমিত নিরুত্তর, পিয়াকে ক্লান্ত চোখে দেখে
তারপর চোখ যায় জানালার আকাশের দিকে,
অমিত কি চাহনিতে সন্দেহের কিছু ঢেকে রাখে?
নাকি আরও গাঢ় করে ধরে রাখে তার প্রেমটিকে?

৩.

‘তুমি কি আমার সাথে একটা কথাও বলবে না?
চেনা এই মানুষটা কেন হলে এমন অচেনা?
সম্পর্কে তাহলে কি কারও কোনো দায় আর নেই?
ব্যর্থতার পুরো বোঝা টানতে হবে একা আমাকেই?’

হঠাৎ​ অমিত যেন দীর্ঘ এক ঘুম ভেঙে বলে
‘বাবা-মা ডিভোর্স নেবে, একসঙ্গে তারা থাকবে না
এত দিন যা গড়েছে প্রতিদিন দণ্ডে-পলে-পলে
সেই স্মৃতি দুজনের কেউই রাখবে না।

তারা নাকি বুঝে গেছে জীবনের মাঝপথে এসে
চিনছে না তারা আর একে অন্যকে
পিয়া তুমি তবে বলো, ভালোবাসা এমন একপেশে?
মানুষকে ভালোবাসা ভুল তবে, ভালোবাসা শুধু পণ্যকে?’

শান্ত হয় পিয়া, আর অমিতকে ধীর কণ্ঠে বলে
এভাবে নিজেকে শাস্তি দিয়ে আর জীবন কি চলে?
মুখোমুখি হও তুমি, বাবা-মাকে বলো সেই কথা
যে কথায় ভালোবাসা ভাঙবে অসীম নীরবতা!

৪.

তোমরা কি মনে করো এটা শুধু তোমাদের একার জীবন
আমরা এমন কেউ, যারা আর সে জীবনে ঢুকতে পারব না?
তোমাদেরই ফয়সালা, দূর হয়ে যাবে সব একান্ত আপন!
মি​লনেই হেরে যাওয়া? ডিভোর্স হলেই শুধু তুমি হারবে না!

ভুলে গেছ মা আমার, উপোস থেকেছ তুমি,
আমার পাতেই তুলে দিয়েছ খাবার
সেই কর্ষণেই তো ভরে গেছে মনভূমি
সে জীবন ফিরে চাই আমরা আবার।

বাবা, কেন করতে হবে সারা দিন প্লেনে প্লেনে প্যারিস-লন্ডন?
টাকাটাই সবকিছু, সংসারে একটুও সময় দেবে না?
খাবার টেবিল ঘিরে আড্ডা হলে জ্বলে ওঠে জীবন-লণ্ঠন
সেই সুখ ডিভোর্সে তুমি আর কোথাও পাবে না!

আমাদের ভুলে গিয়ে মা তোমার জগৎ​ হলো তোমার স্কুল
সবটুকু ভালোবাসা জড়ো হলো পড়ুয়ার বইয়ের পাতায়
সেইখানে নিখুঁত সব, ভু​ল​ নেই সেখানে একচুল
হিসেবের সব ভুল সংসারে আমাদের মনের খাতায়।

আমরা তো একদিন পথের সন্ধান পাই তোমাদের মিলিত আলোয়
কীভাবে মেধারা এসে মিশে যায় জীবন-সাগরে
কিন্তু এ ব্যস্ততায় তোমরা জড়িয়ে গেলে নিকষ কালোয়
সেই সুখ-ভালোবাসা আমাকে এখন আর কে বা দিতে পারে?

৫.

মায়ের চোখের জল বাবাকে কি খানিকটা এলোমেলো করে?
তাই কি এখন তার হাতের স্পর্শ পায় মায়ের এ হাত?

ভালোবাসা জেগে ওঠে চোখে-মুখে-ওষ্ঠে-অধরে?
তাদের মনে কি আজ দীর্ঘ বিরতির পর ফুটে ওঠে স্বর্ণ-পারিজাত?

মা এবার মুখ খোলে, ‘অনেক কথাই তুমি বললে অমিত,
আমরা বদলে গেছি, যন্ত্র হয়ে তোমাকে ভুলেছি
তুমিই এবার বলো, তোমার বিবেচনায় কার হলো জিত​?
ল্যাপটপ-স্মার্টফোন কিংবা পিয়ার কাছে আমরা হেরেছি।

এই তো কদিন আগে জ্বরের প্রচণ্ড তাপে আমি শয্যা নিলে
দীর্ঘ সে পাঁচ দিন তুমি একবারও এসে পাশে বসলে না
“মা আমার ভালো নেই” এ রকম স্ট্যাটাসও তো দিলে
অথচ পাশের ঘরে একা আমি, কাছেও আসলে না!’

এবার বাবাও বলে, ‘ভাত খেতে বসে আমি কাশির দমকে
পানি পানি বলে শুধু অমিতের দৃষ্টি চেয়েছি
স্মার্টফোন হাতে নিয়ে অমিত তখন অন্য লোকে
ওর কাছে অবজ্ঞা, ঘৃণাই পেয়েছি!’

আমরা ভেবেছি তাই, কী লাভ এ সংসারে থেকে
সবাই আলাদা যদি, একেবারে আলাদা হওয়া ভালো
কিন্তু এখন দেখি জীবনের পথ যায় স্মৃতিচিহ্ন রেখে
অকস্মাৎ এ হৃদয়ে ভালোবাসা কীভাবে চমকাল!

অমিত চমকে ওঠে, ‘বাবা, আমি খেয়াল করিনি
মা, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো!’
ভুল হয়ে গেছে সব কিন্তু আমি এখনো মরিনি।
তোমরা আমার কাছে সকলের চেয়ে বেশি প্রিয়।

ল্যাপটপের দোষ নয়, দোষ আমার জীবন-ভাবনার
আমাকে সময় দাও, শুধরে নেব ভুলচুক যত
হারিয়েছি মূল্যবান সবকিছু, আর কিছু নেই হারাবার
এবার অর্জনের পালা, হয়ে যাক সব আগের মতো।

তোমরাও কাছে এসো, কমিয়ে দাও অযথা ব্যস্ততা
ফোনে নয়, সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে কথা বলো
মুঠোফোন, ল্যাপটপে কমাও এ অভ্যস্ততা
পাখিকে আকাশ দাও, সংসারে স্থিত হয়ে চলো।

৬.

ওদের মিলন হলো, সুখের অমৃত স্বাদ ওরা যেন পায়
পিয়া তাই সরে আসে, থাকুক না পরিবার স্নেহের ছায়ায়
কিন্তু বাবার ডাকে চমকে ওঠে চপল মেয়েটা
‘এই মেয়ে, বলে যাও কবে তবে হচ্ছে বিয়েটা?

এখন সেলফি হবে, সে ছবি আপলোড হবে আজই ফেসবুকে
এসো তুমি কাছাকাছি, একসাথে এসো বেঁচে থাকি!’
মা বলেন, ‘তোকে মেয়ে হৃদয়ে বরণ করে রাখি!’

অমিতের মনে আর থাকল না কোনো সংশয়
সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সম্প্লর্কের হলো জয়।