ব্রাজিলে ভাষা বিড়ম্বনা

বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখতে ২০১৪ সালে ব্রাজিল গিয়েছিলেন আনিসুল হক। জুলাই মাসের প্রথম পক্ষটা তাঁর কাটে ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে। ব্রাজিলের প্রধান ভাষা পর্তুগিজ। ব্রাজিলীয়রা ইংরেজি জানে না বললেই চলে। লেখকও পর্তুগিজ জানেন না। ভালোই বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন তিনি।

ব্রাজিলের সব ভালো। কিন্তু এরা ইংরেজি জানে না। আমরাও পর্তুগিজ জানি না। গাইডের সহায়তায় মাত্র ১০ রিয়াল, মানে বাংলাদেশি ৪০০ টাকা দিয়ে একটা সিম কার্ড কিনেছি। কিন্তু চালু করতে পারিনি। কারণ চালু করতে হলে কী করতে হবে, যাবতীয় নির্দেশ আসছে পর্তুগিজ ভাষায়। খুদে বার্তা আসছে একই রকম পর্তুগিজে। বর্ণগুলো চিনি, রোমান হরফ, মানে আমাদের চেনা ইংরেজির মতোই, কিন্তু অর্থ তো কিছু বুঝি না।

হোটেলে ওয়াইফাই কানেকশন আছে। কিন্তু ইন্টারনেট খুবই ধীর। বোধ হয় বিশ্বকাপ উপলক্ষে হোটেলগুলো অতিথি দিয়ে ভরা থাকায় এদের ইন্টারনেটের ওপর বেশি চাপ পড়ে গেছে।

ফোন চালু করতে পারলাম ব্রাজিলে যাওয়ার ছয় দিন পরে। এর মধ্যে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে দেখেছি জার্মানি আর ফ্রান্সের খেলা। ব্রাসিলিয়া নামের সুন্দর গোছানো রাজধানীতে গারিঞ্চা জাতীয় স্টেডিয়ামে দেখেছি মেসির দল আর্জেন্টিনার সঙ্গে বেলজিয়ামের খেলা। তারপর আবার উড়ে গেছি আরেক শহরে। নাম বেলো হরিজন্তে। সেখানে গিয়ে হোটেলের বেশ কাছেই পেয়ে গেলাম একটা শপিং মল। তার দোতলায় মুঠোফোনের দোকানে একজনকে পেলাম, যে ইংরেজি জানে। এবার আমি তাকে আমার সমস্যা খুলে বললাম, সিম কিনেছি কিন্তু কথা বলতে পারি না। সে আমাকে একটা সিম দেবে। তারপর সেটা চালুও করে দেবে। একটু পর সে আমাকে এমন সিম দিল, যা দিয়ে দেশে কথা বলা যায়। ইনকামিং ফ্রি। ফোনটা পেয়ে দেশে কথা বলে হাঁফ ছাড়লাম। এর পরে আমি ওই শহরে আরও দুদিন ছিলাম। এবং দুদিনই আমি এই মুঠোফোনের দোকানে একবার করে এসেছি। শুধু ইংরেজিতে কথা বলতে পারব বলে। উপলক্ষ খুবই সামান্য। দেখো তো আমার মুঠোফোনে আর কত টাকা ব্যালান্স আছে?

ও বলল, খুব সোজা। *২২২# লিখে ডায়াল করো।

আমি বলি, কী অবস্থা তোমাদের? কালকে ব্রাজিল এটা কী খেলল?

খুব খারাপ খেলল।

তোমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী?

ব্রাজিল খারাপ করেছে। সাত গোল খেয়েছে। সবার মন খারাপ।

শুধু মন খারাপ? আর কিছু?

না। আর কী হবে?

আর্জেন্টিনা যদি চ্যাম্পিয়ন হয়?

হলে হবে। আমাদের প্রতিবেশীই তো।

আর আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল যদি খেলা পড়ে?

সেটা না হওয়া ভালো। হলে রাস্তায় মারামারি হবে।

ব্রাজিলের এই নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক বিশ্বকাপের রেপ্লিকা হাতে স্টেডিয়াম থেকে স্টেডিয়ামে ঘুরেছেন। এটা আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালের দিন, ব্রাসিলিয়া স্টেডিয়ামে তোলা। জার্মানির সঙ্গে হারার পরে তিনি কী করেছিলেন, জানা হয়নি

পুরো শপিং মলে সবকিছু চলছে ঠিকঠাক। আগের দিন যে খেলা হয়েছে, আর ব্রাজিল হেরে গেছে, হারা মানে যেমন তেমন হারা না, একেবারে ১-৭ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া, তা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।

ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি পোশাকের দোকানে ঢুকে পড়ি। একটা প্যান্ট কিনব নাকি? ওরা বলে, কত সাইজ?

আমি বলি, ভুঁড়ি তো বন্যার পানির মতো বাড়ছে। প্রতিনিয়ত বিপদসীমা অতিক্রম করছে। মেপে দেখতে হবে। টেপ আনো।

ওরা বোঝে না।

নিজের ভুঁড়িতে অদৃশ্য টেপ ধরে মাপ দিই। তখন বলে, ও ফিতা।

আমি বলি, টেপ, ওরা বলে ফিতা। ওদের বলি, আমাদের দেশেও ফিতা বলে।

একই অবস্থা হয়েছে দোকানে তোয়ালে দেখতে গিয়ে। বিশ্বকাপের নকশা করা তোয়ালে। বললাম, দেখি দেখি ওই টাওয়েলটা। দোকানি বলল, ও তোয়াইল্যা? তোয়ালের পর্তুগিজ Toalha. তোয়ালিয়া।

আসলে আমাদের দেশেও তো পর্তুগিজরা এসেছিল। আমাদের বাংলা ভাষায় অনেক পর্তুগিজ শব্দ আছে। গির্জা, পাদরি, চাবি, আলমারি, আনারস, জানালা, কেরানি, আলকাতরা, পেরেক, আলপিন এ রকম বহু শব্দ এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে।

যেমন, চা এখানে চা।

তবে চা খেতে চাইলে আমাদের দেশের চা-পাতা পাওয়া যায় না। পুদিনা চা, গোলাপ চা, বেলি চা যা পাওয়া যায়, তার একটাও আমাদের দেশের সিলেটের চা-বাগানের চায়ের পাতা না। যাকে কি না বিদেশে বলে ইংলিশ টি। ফলে চা না খেয়ে কফি খাই। এরা বলে ক্যাফে। ব্রাজিল কফি উৎপাদনকারী দেশ। এ দেশে এসে তো কফিই খেতে হবে। এক কাপ কফি আমাদের দেশের হিসাবে ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত। আমার তো মনে হয়, দাম ঠিকই আছে। এখানে আমরা পানি কিনে খাচ্ছি ছোট বোতল এক রিয়াল থেকে তিন রিয়ালে, মানে ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০ টাকায়। প্রথম দিনেই গাইড বলে দিয়েছেন, বোতলের পানি ছাড়া ট্যাপের পানি খাবে না। হোটেলে গ্লাসে ট্যাপের পানি নিয়ে দেখেছি, ঘোলা।

আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু দিব্যি ট্যাপের পানি খাওয়া চলে।

হল্যান্ডের সঙ্গে ব্রাজিলের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলা। ব্রাসিলিয়া স্টেডিয়ামের বাইরে সেদিনও চলছিল উত্সব। স্টেডিয়াম চত্বরে হল্যান্ড আর ব্রাজিল সমর্থকদের এই দলটির ফুর্তি ছিল চোখে পড়ার মতো

তবে পানি চাইলে এরা এনে দেয় ফ্রিজের ঠান্ডা পানি। কিন্তু আমার আগে ব্রাজিলে যাওয়া উৎপল শুভ্র ঠান্ডাজ্বরে কাতর। তিনি নাকি এমনই কাহিল হয়ে পড়েছিলেন যে হোটেলের নিঃসঙ্গ বিছানায় শুয়ে হাউমাউ করে কেঁদেও ছিলেন। শুনে আমি প্রথম থেকেই সাবধান। ঠান্ডা পানি খাব না। কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারি না নরমাল পানি জিনিসটা কী। বোঝাতে পারি না, কারণ ওরা বাংলা জানে না, ইংরেজি জানে না।

পরিস্থিতি এমন হয় যে চারপাশে লোক জমে যায়। আমি ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছি। পানি নরমাল চাই।

এর মধ্যে কেউ ইংরেজি জানলে তিনি নিজেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।

এখন আমি জানি, কী বলতে হবে। আগুয়া নাথুরা। মানে ন্যাচারাল ওয়াটার।

হোটেলে একদিন ডিম পোচ খেতে চাই। ওরা বোঝে না। আমি তখন জয়নুল আবেদিন বনে যাই। কলম বের করে টিস্যু পেপারে মুরগি আঁকি। ডিম আঁকি। তারপর ডিম পোচ আঁকি। সেটা দেখে বয়স্কা রাঁধুনি খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দেন। ডিম পোচ আসে। আমিও হাসি। একদম ঠিক জিনিসটাই রেঁধেছ।

ভাষা নিয়ে শেষ মুশকিলে পড়লাম ব্রাসিলিয়া হোটেল থেকে বের হয়ে আসার রাতে। ভোর পাঁচটায় ফ্লাইট। আমি তিনটার সময় হোটেলে চেক আউট করছি। হোটেলের নাম আমেরিকানা। আমি দুরাত থাকব। ৭০০ ডলার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে শোধ করেই হোটেলে উঠেছি। আরেক দিনের বুকিং ছিল। ক্যানসেল করেছি। এখন দ্রুত বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরব। এয়ারপোর্ট যাব। হোটেলের রিসেপশনিস্ট বলে, এক হাজার ডলার দিয়ে যাও।

আমি বলি, ৭০০ ডলার দিয়েছি। আর তিন নম্বর দিনের বুকিং ক্যানসেল করেছি। এই যে আমার কাছে কাগজ আছে।

সে ইংরেজি বোঝে না।

আমি পর্তুগিজ বুঝি না।

সে আমাকে ছাড়ে না।

আমি নিজেকে ছাড়াতে অস্থির। আমি বলি, আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।

সে তাও বোঝে না।

খেলার আগে আর্জেন্টিনা সমর্থকের মুখে জার্মানির পতাকা এঁকে দিচ্ছেন এক জার্মান তরুণী। কোপাকাবানা সৈকতে

তখন এগিয়ে এল এক লালমুখো মাতাল। সে বলে, শোনো আমি ইংরেজি পারি। কিন্তু তুমি আস্তে আস্তে বলো। তাহলে আমি বুঝব।

আমি বলি, আমি টাকা দিয়েছি। এখন আমি যাব।

সে বলে, আস্তে আস্তে বলো। আমি ইংরেজি বুঝি।

আমি বলি, আমি এখন যাব।

সে রেগে যায়। আরে আস্তে আস্তে বলো। আমি ইংরেজি বুঝি।

ওকে বলো, আমি সব টাকা পরিশোধ করেছি। আমি এখন যাব।

আস্তে আস্তে বলো, আমি

ইংরেজি জানি। মাতাল আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, আস্তে আস্তে বলো। আমি ইংরেজি জানি। বলো, তোমার সমস্যা কী।

আমি বলি, আমি সব টাকা আগেই শোধ করেছি। এই যে কাগজ।

আস্তে আস্তে বলো, আমি ইংরেজি জানি।

সে আমাকে আর ছাড়তে চায় না। কী মুশকিলে পড়লাম রে বাবা।

ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলা। এখন এই মাতালের হাত থেকে বাঁচি কী করে!

শেষে করুণাময় মুখ তুলে চাইলেন। হোটেলের রিসেপশনিস্ট কী মনে করে আমাকে ছেড়ে দিল।

আমি রিও ডি জেনিরোতে কোপাকাবানা বিচে ফাইনাল খেলা দেখব বলে দ্রুত এয়ারপোর্ট অভিমুখী ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। তারপর চলো এয়ারপোর্ট।

আসার আগে হোটেলের রিসেপশনিস্টকে পর্তুগিজ ভাষায় বললাম, অব্রিগাদো। মানে ধন্যবাদ।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)