সন্তানকে যে ১৫টি আচরণ শেখানো উচিত

সন্তানকে বড় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তাদের ভালো আচরণ শেখানো। জীবনে সফল হতে সহায়তা করবে ভালো আচরণ। সন্তান হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক। সাধারণ আদবকেতা না জানার কারণে অনেক শিশুই বড় হয়ে নানা সমস্যায় পড়ে। প্রভাবিত হয় তাদের জীবনের প্রতিটি ধাপ। আদবকেতা আমাদের স্কুলেই শেখানো উচিত। কিন্তু আসলে স্কুলে এ ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পরিবারই হতে পারে এই আচরণগুলো শেখার জায়গা।

আচরণগুলো জানার আগে জেনে নেওয়া দরকার কীভাবে শিশুদের আচরণ শেখাবেন। এ ব্যাপারে পাঁচটি সহজ পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানারস্মিথ কনসাল্টিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা জোডি আর আর স্মিথ। চলুন, শুরুতে পরামর্শগুলো জানা যাক।

ক. ঘরে বসে অনুশীলন করুন: বাচ্চাদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রথমে ঘরে বসেই প্রস্তুত করুন। এতে ঘরের বাইরে গিয়ে তারা অস্বস্তিতে পড়বে না।

খ. বয়স উপযোগী প্রত্যাশা রাখুন: আপনার শিশু জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কী শিখতে পারবে বা কী করতে পারবে, সে ব্যাপারে ধারণা রাখুন। অনেক মা-বাবা জানেনই না, সুযোগ পেলে তাঁদের সন্তান কী করতে পারে।

গ. ভালো উদাহরণ স্থাপন করুন: বাচ্চারা খুবই অনুকরণপ্রিয়। আপনাকে যা করতে দেখবে, আপনার বাচ্চাও সেটাই করার চেষ্টা করবে। তাই আপনার নিজের আচরণের দিকে মনোযোগ দিন। এমনকি যদি আপনি মনে করেন, আপনার শিশুরা তা দেখছে না, তবু প্রথমে নিজের আচরণের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত।

ঘ. হুমকি বা শাস্তি এড়িয়ে চলুন: অনেক শিশুই শৈশব থেকে দুষ্টুমি করে। তাদের বুঝিয়ে বলুন। রাগারাগি করলে বা শাস্তি দিলে শিশুদের কাছে আপনি খারাপ হয়ে যাবেন। তখন আপনার শিশু আপনার কথা শুনতে চাইবে না।

ঙ. সন্তানের সঙ্গে সব সময় কথা বলুন: শিশুদের মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। এই বয়সে তাদের জানার আগ্রহ থাকে প্রচুর। তাই আপনি শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ করুন, যেন তারা বুঝতে পারে, প্রশ্ন করার জন্য আপনিই উপযুক্ত মানুষ। শিশুরা যেন নির্ভয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে পারে।

চলুন এবার জানা যাক, কোন আচরণগুলো আপনার সন্তানকে অবশ্যই শেখাবেন। প্রায় ভুলতে বসা এই আচরণগুলোই আপনার বাচ্চার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।

১. কখন ফোন বন্ধ রাখতে হবে, তা জানান

কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিজনেস অব ম্যানারসের প্রতিষ্ঠাতা আদেওদাতা সিস্ক বলেন, ‘বেশির ভাগ শিশু এমনকি অনেক অল্প বয়সীদের নিজস্ব স্মার্টফোন রয়েছে। অনেকে আবার মা-বাবার মুঠোফোন ব্যবহার করে। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুঠোফোন ব্যবহারের আদবকেতা শেখানো উচিত। মুঠোফোন কখন বন্ধ রাখতে হবে, কখন সাইলেন্ট মোডে রাখতে হবে—এসব ব্যাপারে শিশুদের শেখানো জরুরি। যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল, কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানের সময় মুঠোফোন ব্যবহার করা উচিত নয়।’

২. ‘আপনাকে স্বাগত’ বলতে শেখান

কারও সঙ্গে কথা বলার সময় ‘প্লিজ’ ও ‘ধন্যবাদ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা উচিত। কেউ ধন্যবাদ দিলে শিশুরা কীভাবে তা গ্রহণ করবে, সেটাও শেখানো দরকার। অনেক শিশুই ‘সমস্যা নেই’, ‘যাহোক’ কিংবা ‘ঠিক আছে’ শব্দগুলো ব্যবহার করলেও ধন্যবাদ দিলে কোনো উত্তর দেয় না। ধন্যবাদের সঠিক প্রতিক্রিয়া জানাতে হলে অবশ্যই ‘আপনাকে স্বাগত’ বা ‘মাই প্লেজার’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা উচিত।

৩. ছোট ছোট সেবামূলক কাজ করতে শেখান

শিশুরা চাইলেই কিছু ছোটখাটো সেবামূলক কাজ করতে পারে। যেমন খোলা দরজা বন্ধ করে রাখা, নিচে পড়ে থাকা জিনিস তুলে রাখা বা লাইনে কাউকে প্রথমে যেতে দেওয়ার মতো ব্যাপারগুলো শিশুদের বিকাশকে প্রভাবিত করে। এ আচরণগুলোই ভবিষ্যতে তাদের উন্নতি নিশ্চিত করবে। অনেক সময় শিশুরা অন্য শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্কদের সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এই আচরণগুলো অবশ্যই পরিচিত কোনো প্রাপ্তবয়স্কদের সাহায্যের মাধ্যমে শেখাবেন। অপরিচিত কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দেখিয়ে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করা উচিত নয়।

৪. সেবাকর্মীদের ধন্যবাদ বলতে শেখান

সব ভালো আচরণের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ধন্যবাদ’ বলা। কিন্তু এখনকার শিশুরা এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও বাসচালক, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, বাসার কাজের লোক, অফিস সহকারী বা সিকিউরিটি গার্ডদের ধন্যবাদ দিতে চায় না। অনেকে তাঁদের ছোট চোখেও দেখে। কিন্তু ওনারাই আমাদের প্রতিদিন সাহায্য করেন। শুধু ভদ্রতা হিসেবে নয়; বরং সবার কাজ যে মূল্যবান, সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য হলেও তাঁদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।

৫. নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে অন্যকে সাহায্য করা

সাধারণত বাসে গর্ভবতী নারী, বয়স্ক মানুষ উঠলে নিজের আসন ছেড়ে দিতে হয়। তবে আজকাল অনেক মা-বাবা অন্যদের চেয়ে তাঁদের নিজেদের সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেন। ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা বাসে দাঁড়িয়ে থাকলেও শিশুরা সিট দখল করে বসে থাকে। অনেক সময় বয়স বাড়লেও তারা আর এই ভদ্রতা শিখতে পারে না। শিশু যদি অসুস্থ বা খুব অল্প বয়সী না হয়, তাহলে তাদের এই ভদ্রতা শেখানো উচিত। সহমর্মিতা দেখানো এবং অন্যদের সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখানোর এটাই সবচেয়ে ভালো সুযোগ।

৬. সবাইকে খাবার পরিবেশনের আগপর্যন্ত অপেক্ষা করা

বাড়িতে বা কোনো রেস্তোরাঁয় খাবার খাচ্ছেন। নিশ্চয়ই সবাইকে একসঙ্গে খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। কাউকে কিছুক্ষণ আগে খাবার দেওয়া হবে, কাউকে কিছুক্ষণ পরে। অর্থাৎ খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখতে নিশ্চয়ই কিছুটা সময় লাগবে। যতক্ষণ সব খাবার প্রস্তুত না হবে, ততক্ষণ আপনার বাচ্চাকে ধৈর্য ধরতে শেখান। খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া শুরু না করে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। একসঙ্গে খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা।

৭. উচ্চস্বরে কথা না বলতে শেখান

অনেক বাচ্চাই যেখানে–সেখানে চেঁচামেচি করে এবং উচ্চস্বরে কথা বলে। এটা পাশের মানুষদের জন্যও বিরক্তিকর। অনেকে আবার স্থান–কাল চিন্তা না করে উচ্চস্বরে হাসাহাসি বা কান্নাকাটি করে। তাই সব মা-বাবার উচিত তাঁদের সন্তানদের পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে শেখানো। শিশুদের জন্য আপনি এটা একটা মজার খেলায় পরিণত করতে পারেন। যেমন সিনেমা হলে গিয়ে কে সবচেয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে পারে, তা পরীক্ষা করার খেলা খেলতে পারেন। এটিকে খেলা হিসেবে নিয়ে শিশুরা আস্তে ও নম্রভাবে কথা বলা শিখবে।

৮. পালাক্রমে কথা বলা

অনেক সময় শিশু কথা বলা শুরু করলে বলতেই থাকে। আবার দেখা যায়, বড়রা কথা বলছেন, তার মধ্যে একজন শিশু এসে কথা বলা শুরু করছে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের ধৈর্য ধরতে শেখাতে হবে। শিশুরা ধৈর্য ধরতে না চাইলেও তাদের ওপর চড়াও হওয়া যাবে না। শান্তভাবে তাদের বুঝিয়ে বলুন। এবং এমন পরিস্থিতিতে তাদের বোঝান যে কথা বলার মাঝে কথা বলা একধরনের বেয়াদবি। শিশুদের নিশ্চিত করুন যে আপনি একটু পরে তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।

৯. নম্র আচরণ করতে শেখান

অনেক শিশুই মানুষকে দেখে হঠাৎ মন্তব্য করে বসে। হয়তো একজনের মুখে ব্রণ আছে। কিংবা কারও মাথায় টাক। তখন শিশুরা যদি বলে বসে যে তোমার মুখে ব্রণ কেন বা আঙ্কেল, আপনি টাক কেন, তাহলে তারা অস্বস্তিতে পড়তে পারে। শিশুদের শেখানো উচিত যে তাদের কথাগুলো অন্যদের প্রভাবিত করে। কোনো ব্যাপারে শিশুদের মনে সন্দেহ বা জিজ্ঞাসা থাকলে সরাসরি প্রশ্ন বা মন্তব্য না করে অপেক্ষা করা উচিত। যতক্ষণ ওই ব্যক্তি নিজ থেকে তার ব্যাপারে ব্যক্তিগত কথা না বলে, ততক্ষণ কারও ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয়।

১০. মুখ ঢেকে হাঁচি বা কাশি দিতে শেখান

হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় মুখে টিস্যু, হাত বা কনুই দেওয়া শেখানো উচিত। এটি কেবল স্বাস্থ্যবিধি বা ভদ্রতার বিষয় নয়। একজন হাঁচি-কাশি দিলে তা থেকে জীবাণু অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। আপনার পাশের ব্যক্তি এটা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। তাই আপনার শিশুকে কাশি দেওয়ার আগে মুখে টিস্যু বা হাত দিতে শেখান। তারপরও কারও সামনে হাঁচি বা কাশি দিলে ‘এক্সকিউজ মি’ বা ‘আমাকে ক্ষমা করবেন’ বলতে শেখান।

১১. ধন্যবাদ নোট বা টেক্সট লিখতে শেখান

যাঁরা উপহার দেন, তাঁরা অনেকেই জানতে পছন্দ করেন যে তাঁদের উপহার গ্রহণ করা হয়েছে এবং প্রাপক এটি পেয়ে খুশি হয়েছে। শিশুরা উপহার পেলে তাদের ধন্যবাদ কার্ড লিখতে বা আঁকতে শেখানো উচিত। আরও একটি আধুনিক উপায় আছে। মেসেজ বা ই–মেইল ‘ধন্যবাদ’ লিখে পাঠানো যেতে পারে। বিশেষ করে বাচ্চার হাতে উপহার দিয়ে একটি ছবি তুলে পাঠাতে পারেন উপহারদাতার কাছে।

১২. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে আদবকেতা শেখান

অনেক শিশুই আজকাল বেশির ভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকে। অনলাইনে তাঁদের অনেক বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়, সে ব্যাপারে তাদের বোঝানো দরকার। হতেই পারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আপনার শিশুর ব্যক্তিগত জায়গা। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয় তাদের বোঝানো উচিত। যেমন কী ধরনের ছবি পোস্ট করবে বা অন্য কারও ছবি পোস্ট করলে তাদের অনুমতি নেওয়া—এ ধরনের বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কখনোই এমন কোনো ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া উচিত নয়, যা আপনি ব্যক্তিগতভাবে অন্যকে বলবেন না।

১৩. অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া

অনেক শিশুই অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হলে কীভাবে নম্রভাবে অভিবাদন জানাতে হয়, তা শেখানো জরুরি। অন্যদের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় করানোর সবচেয়ে আদর্শ উপায় হলো প্রথমে চোখে চোখে যোগাযোগ করা। তারপর হাত মিলিয়ে একটু উষ্ণভাবে হাসা। শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্য ব্যাপারটি সত্য। তবে যদি কোনো শিশু হাত মেলাতে উৎসাহী না হয় বা অন্য কোনো শিশুকে স্পর্শ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে, তবে মাথা নাড়িয়ে হলেও অভিবাদন জানানো উচিত।

১৪. সময়মতো উপস্থিত হওয়া

যেকোনো জায়গায় বা অনুষ্ঠানে সময়মতো যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এতে শিশুরা শুধু সময়ের ব্যাপারে সচেতন হবে, তা নয়। বরং সহপাঠী, শিক্ষক বা পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে।

১৫. ফোনে কথা বলার ব্যাপারে সতর্ক করুন

নতুন প্রজন্ম স্মার্টফোন ব্যবহারে বেশ দক্ষ, এটা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবে নতুনদের চেয়ে বয়স্করা ফোনে কথা বলার সময় ভালো আচরণ করেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, অনেক শিশু ফোনে কথা বলার আদবকেতা সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা অনেক সময় হ্যালো বলে চুপ করে থাকে। হয়তো এক হাত দিয়ে কানের কাছে ফোনটা ধরে অন্য হাত দিয়ে কম্পিউটার গেম খেলছে কিংবা টিভি দেখছে। ফলে তারা মনোযোগী হয় না। তাই কেউ ফোন করলে কীভাবে আরও কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে, তা শেখান। ফোন রিসিভ করে কীভাবে কথা বলা শুরু করতে হয়, নিজের পরিচয় দিতে হয় এবং কীভাবে পালাক্রমে কথা বলা চালিয়ে যেতে হয়, তা শিশুদের শেখানো জরুরি।

সূত্র: রিডার ডাইজেস্ট