শীতেও আমি ‘কুল’

‘বাতাসে ফুলের সৌরভ/ পাতা ঝরেছে/ শীত আসবে বলে/ পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে...’—তাহসানের গাওয়া গানটা শুনেছ নিশ্চয়ই? পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়লেও  তুমি ঠিকই জেগে জেগে কিআ পড়ছ। খুব কুল, তাই না! আমি আবহাওয়ার কথা বলছি। ঠান্ডা লাগছে নিশ্চয়ই? লাগবেই, শীত যে চলে এসেছে।

আসবেই। শীতের পোশাক, সবজি আর বাইরে ‘লেপ-তোশক’ স্লোগান বুঝিয়ে দেয়, শীত চলে এসেছে। আচ্ছা, এ ছাড়া আর কীভাবে বুঝবে যে শীত এসে গেছে?

খুবই সোজা, কিশোর আলোয় শীত নিয়ে লেখা দেখে!

যাহোক, বুঝেই যখন ফেলেছ, তখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শীতকাল আসলে উৎসবের। এ সময় স্কুল ছুটি, পড়ার চাপ কম, বাড়িতে নানা রকম পিঠাপুলির সমারোহ। শীত মানেই দলবেঁধে পাখি দেখতে যাওয়া, সকাল-বিকেল ক্রিকেট ম্যাচ, সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন, তারপর রাত জেগে ভূতের গল্পের আসর, না হয় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে বইয়ের দেশে হারিয়ে যাওয়া। খেয়াল করে দেখবে, আমাদের অন্য উৎসবগুলোও হয় শীতকালেই। যেমন ধরো লোকসংগীত উৎসব, কিংবা উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব, কনসার্ট, মেলা, খেলা আরও কত কিছু! অল্প কয়েক দিন স্থায়িত্ব শীতের, কিন্তু রেশটা থেকে যাবে বছরজুড়ে। ফলে উপভোগ করা চাই প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু এই শীতেই আমাদের কিছু বন্ধু জ্বরে ভোগে, না হয় দিনরাত কাশে খুকখুক করে। অসুস্থ হয়ে নিজেরা তো মজা করতেই পারে না, মজাটা কমে যায় আমাদেরও। বন্ধুরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে, কারও কি ভালো লাগে, বলো? তাদের কত বলি, এই সময়ে অর্থাৎ শীতের বিরুদ্ধে একটু প্রস্তুতি নিলেই এসব ঠান্ডা জ্বর কাবু করতে পারে না আমাদের। বলে আর লাভ হবে না বলে আস্ত লেখাই লিখে ফেললাম।

শীত মোকাবিলা কোনো ঘটনাই না। শীতে আমাদের দরকার উষ্ণতা। এক কাজ করো, মাথা গরম রাখতে চাইলে সুবোধ কোথায় গেছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাও!

চোখ গরম রাখতে চাইলে বিটিভি দেখবে।

কান গরম রাখতে চাইলে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য শুনবে।

সুতরাং বুঝতেই পারছ, একটু-আধটু শীত মোকাবিলা কতটা সহজ!

কিন্তু যে হারে ইদানীং আমাদের দেশে শৈত্যপ্রবাহ এসে হানা দেয়। কেউ কেউ তো সাম্প্রতিক বছরগুলোর শীতে এতই অতিষ্ঠ যে তাঁরা স্থানিক ব্যাপারটিকে অস্বীকার করে পৃথিবীর উষ্ণায়নকেই অস্বীকার করে বসছেন। এই তেতে যাওয়া শীতে তো শরীরের নানা অংশকে শুধু গরম রাখলেই চলবে না, শীতের প্রকোপে তৈরি হওয়া রোগবালাইয়ের সঙ্গেও যুদ্ধে নামতে হবে। অথচ দেখো, ঠিক এ সময়টাতেই কিনা আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যায়।

এ জন্যই সহজে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দ্বারা আমরা আক্রান্ত হই। তা ছাড়া আরও কিছু রোগের সমস্যাও বেড়ে যায়। শীতে শিশু ও বয়স্কদের সমস্যা হয় বেশি। তবে আশার কথা হলো, স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে একটু যত্নশীল হলে অনেক সমস্যা আমরা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারি। থাকতে পারি ‘কুল’।

এক বন্ধু বলল, শীত আসামাত্রই আমার কাশির পরিমাণ বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসে ভোগা বাবা যতবার মূত্র বিসর্জনে গেছেন, আমি তার চেয়ে দ্বিগুণবার কাশি দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার কী হয়েছে?

বললাম, তোর বাবার যেমন বহুমূত্র, তেমনি তোরও হয়েছে বহুকাশি!

তবে আমার বন্ধুটির কিন্তু খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই, ঠান্ডা লাগা বা সর্দি-কাশি এ সময়ের একটি সাধারণ সমস্যা। কুল মানুষদের অনেক ফলোয়ার থাকে, যেমন: ফ্লু, ভাইরাস। এ সময়ে তারাই কুলদের পিছু নেয়। খ্যাতির বিড়ম্বনা। আবার অধিকাংশ ঠান্ডাজনিত ভাইরাসই আক্রান্ত কুল ব্যক্তির ব্যবহূত জিনিসপত্রের মাধ্যমে রোগ অন্য একজন কুল ব্যক্তির শরীরে শেয়ারড হয়ে যেতে পারে। এই জীবাণুগুলো মানুষের শরীর ছাড়াও ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকে। তাই সারা দিনে বেশ কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। যখন-তখন চোখ, নাক ও মুখে হাত দেওয়া যাবে না। সর্দি-কাশি হলে লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করা, আদা-চা পান করা কিংবা গরম পানির ভাপ নেওয়া উচিত।

গরম পানি নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ল। রিংকু বেজায় কৃপণ। একদিন তার বাড়িতে হাজির হলো তার বন্ধু সোহেল।

সোহেল বলল, ‘কিরে রিংকু, তোর বাড়িতে এলাম, কিছু খাওয়াবি না?’

রিংকু বলল, ‘কী খেতে চাস, বল। ঠান্ডা, না গরম?’

সোহেল তো মহাখুশি, ‘নিয়ে আয়। ঠান্ডা-গরম দুটোই খাব।’

রিংকু হাঁক ছাড়ল, ‘কই রে জগাই, ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আর চুলা থেকে এক গ্লাস গরম পানি নিয়ে আয়!’

এই সময়ে তোমার, কিংবা তোমার ছোট ভাইবোন বা দাদুদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। কেননা তোমরা, বিশেষ করে তোমার ছোট্ট ভাইবোনেরা ‘কুল’ হলেও শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গই থাকে অপরিণত, ফলে হতে পারে নিউ সমস্যা নিউমোনিয়া। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগটি খুব খারাপ পরিণতির দিকে চলে যেতে পারে।

‘দেশে এত নিউমোনিয়া কেন, তা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শীতের প্রকোপ কমে যাবে বলে বুদ্ধিজীবীদের আশাবাদ’—মিডিয়ায় এমন সংবাদ দেখলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া থেকে পিছপা হবে না কিন্তু।

ঠান্ডার কারণে গলার ভেতরে টনসিলের ইনফেকশন হতে পারে। এতে জ্বর ও গলাব্যথা হয়। তা ছাড়া শীতে ঠান্ডা পানি পান করলে বা গরম কাপড়চোপড় না পরলেও গলাব্যথা হতে পারে। মাথাব্যথা হলে যেমন মাথা টেপাতে ইচ্ছে করে, ঠিক সেভাবে গলাব্যথার চিকিৎসায়ও জোরসে গলা টিপে দিতে পারো। এরপরও বেঁচে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং কমসম সমস্যা থাকলে লবণপানি দিয়ে গড়গড়া ও বিশ্রাম নিয়ে নেবে।

শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ধুলাবালির প্রকোপ থাকায় অ্যালার্জি হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডার ফলেও মানুষের নাক, কান ও গলায় অ্যালার্জি হতে দেখা যায়। ফলে অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তাই ধুলাবালু এড়িয়ে চলতে হবে। ঘরের ধুলাবালু পরিষ্কারের প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। ঠান্ডা বাতাস যেন সরাসরি শ্বাসনালিতে প্রবেশ না করে, সে জন্য মাস্ক ব্যবহার করবে। নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করবে (মানে কী? আপনার কি ধারণা আমি চোখ দিয়ে শ্বাস নেই? যত্তসব!)। মাইন্ড করো না, এটা বিশেষভাবে বলার কারণ হলো, নাক দিয়ে শ্বাস নিলে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা উভয় বেড়ে যায়।

চোখ, নাক ও মুখে হাত দেবে না। শীতকালে পকেটে হাত রাখাই ভালো। এতে একদিকে যেমন হাত উষ্ণ থাকবে, অন্যদিকে পকেটমারেরাও তেমন সুবিধা করে উঠতে পারবে না। ভালো তো। ভালো না? কুল একটা লোকের ভুল করে পকেট কাটা হয়ে গেলে ‘লুল’ হতে সময় লাগবে না।

বাসায় বলতে পারো কার্পেট ব্যবহার না করতে পারলেই ভালো। লোমযুক্ত কম্বল বা চাদর ব্যবহার করবে না। অ্যাজমা থাকলে শীতকালজুড়েই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ইনহেলার ব্যবহার করতে অবহেলা করবে না, তাহলে অবলীলায় অ্যাজমা নিয়েও কুল থাকবে তুমি।

গরমে কাঠফাটা রোদও যেখানে ত্বক ফাটাতে পারে না, শীত এটা পারে সহজে। শীত আসতেই তোমার ত্বক শুষ্ক হয়ে গেছে। এতে ত্বক চুলকাতে পারে, ফেটে যেতে পারে এবং বিভিন্ন রকম চর্মরোগ তোমাকে জ্বালিয়ে মারতে পারে। ভয়ের কিছু নেই, ত্বকের আর্দ্র্রতা রক্ষা করলেই এটি সমাধানযোগ্য। এ জন্যই টিকে আছে অলিভ অয়েল বা লোশন কোম্পানি। এগুলো ব্যবহার করো না করো, অবশ্যই বেশি করে পানি খাবে। আর শীতকালীন শাকসবজি আর ফলমূল খাওয়া অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

ও, আরেকটা কথা, শীতে ঠান্ডা যতই পড়ুক, গোসল করতে ভয় পেলে চলবে না। তুমি না খুব সাহসী, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়? তো সামান্য ঠান্ডা পানিই যদি ভয় পাও তাহলে আর কিসের সাহসী? আর যদি ঠান্ডা পানি বেশিই ভয় পাও, তবে আর কি, গরম পানি দিয়েই নাহয় গোসলটা সেরে নিয়ো। যে তুমি ভাবছ বড় হয়ে ব্যাটম্যান হবে, সে তুমি এখন সামান্য ‘বাথম্যান’ হতে পারবে না? তা হবে না, তা হবে না! তুমি তো আর রিচার্ডসনের কাঠবিড়ালি, সাপ, ব্যাঙ কিংবা অ্যান্টার্কটিকার কেউ নও যে শীতের ভয়ে শীতনিদ্রায় চলে যাবে। তোমাকে তোমার প্রতিদিনের পড়াশোনা, কাজ, খেলাধুলার মধ্য দিয়েই যেতে হবে, আবার স্বাস্থ্য রক্ষা করে শীতকে মোকাবিলাও করতে হবে। কারণ তো একটাই, শীতকালটা উৎসবের, আনন্দের, প্রকৃতিকে উপভোগের। ফলে শীতের ভয়কে করো জয়। বি কুল ম্যান!