তোমারও সময় আসবে

ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষিত হবে একটু পরই। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে সবাই। অধীর আগ্রহ নিয়ে কান পেতে রয়েছে শুনতে, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড হলো কারা।

উত্তেজনায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় রাজুরও। সেটা অবশ্য সবার সামনে প্রকাশ করছে না সে। ভাবখানা এমন, যেন রেজাল্টে কিছু যায় আসে না তার। আগের বছরগুলোতেও এমন ভাবই দেখিয়ে এসেছে সে। ফলে এবারও যে রেজাল্টের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল সবাই।

তবে রাজুর নিজের মাথায় চলছে ভিন্ন চিন্তা। মনে মনে সে আশা করছে, ক্লাসের সেরা তিনজনের তালিকায় এবার উচ্চারিত হবে তার নাম। কে জানে, ভাগ্যে থাকলে প্রথম স্থানও অধিকার করে ফেলতে পারে সে!

কারণ, এবার আক্ষরিক অর্থেই পরীক্ষার আগে প্রচুর পড়াশোনা করেছে সে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যে ভালো ফল এবার করতেই হবে। ঘোচাতে হবে তাকে নিয়ে তার মা–বাবার সব দুঃখ। তাই দিনরাত একাকার করে পড়েছে রাজু। নিংড়ে দিয়েছে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু। কোথাও প্রচেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি রাখেনি। তার ধারণা, এত পড়াশোনা আর পরিশ্রম করার পর তার ফার্স্ট-সেকেন্ড না হওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না।

কিন্তু স্কুল প্রাঙ্গণের মাইকে প্রধান শিক্ষক ক্লাস সেভেনের সেরা তিনজন শিক্ষার্থীর নাম উচ্চারণ করতেই ঘোর ভাঙল রাজুর। কই, তার নাম তো নিলেন না স্যার! এমনকি নোটিশ বোর্ডে পুরো ক্লাসের ফলাফল টাঙিয়ে দেওয়ার পরও আশাভঙ্গ হলো তার। সেরা তিনে থাকা তো দূরের কথা, প্রথম দশজনের মধ্যেও যে নেই তার নাম! যুগ্মভাবে একাদশ স্থান অধিকার করেছে সে!

সবার সামনে উদাস মুখ করে রইল রাজু। বুঝতে দিল না, বুকের মধ্যে কী উথালপাতাল হচ্ছে তার। যথাসাধ্য চেষ্টা করল হাসি হাসি মুখ করে রাখতে। নিজেই নিজের রেজাল্ট নিয়ে উপহাস করে বলতে লাগল, ‘আরে, এসব রেজাল্ট কোনো ব্যাপার নাকি! ১ নম্বর হওয়াও যা, ১১ নম্বর হওয়াও তা-ই!’ ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড হওয়া শিক্ষার্থীদের ঘিরে অন্যরা যখন আনন্দ-উল্লাস করল, ট্রিট চাইল, সেদিকে তাকিয়ে নিজের দীর্ঘশ্বাস গোপন করল রাজু। আর ভাবল, ‘ইশ্‌, আজ আমিও তো পারতাম সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতে!’

বাসায় ফিরেই কেবল নিজের সত্যিকারের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারল রাজু। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকল সে। হুট করেই তার মনে উঁকি দিল একটা চিন্তা, ‘এবার এত চেষ্টা করেও যখন ভালো রেজাল্ট করতে পারলাম না, তাহলে হয়তো সবার কথাই ঠিক। আমি আসলেই একটা অকাজের কাজি। আমাকে দিয়ে পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট—এসব কিছু হবে না। খুব বেশি হলে একজন গড়পড়তা ছাত্র হিসেবেই জীবনটা পার করতে হবে আমাকে।’

গল্পের এই রাজুর সঙ্গে বোধ হয় নিজেদের মিল খুঁজে পাচ্ছ অনেকেই। কিংবা হয়তো সবাই। কারণ জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই শতভাগ সফল হয়েছে, এমন অসামান্য প্রতিভা তো খুবই বিরল। অন্যদের কথা ছেড়েই দাও, এমনকি সাকিব আল হাসানও তো সব সময় সব ম্যাচে ভালো করতে পারেন না! তাঁর ক্যারিয়ারেও আছে প্রচুর উত্থান-পতন। কেউ হয়তো কোনো একটি দিকে দারুণ সফল, কিন্তু অন্য কোনো দিকে পুরোপুরি ব্যর্থ না হলেও তুলনামূলক কম সফল।

সাফল্য-অসাফল্যের এমন গল্পই আসলে স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক কোনো ক্ষেত্রে জানপ্রাণ দিয়ে, নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়েও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা না পাওয়া আর তারপর প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে শুরু করা, নিজের সামর্থ্যকে সন্দেহ করা, এমনটা ভাবা যে ‘আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না!’

নিজের যাবতীয় চেষ্টা, একাগ্রতা ঢেলে দেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত ফল না করার সঙ্গে অন্য কোনো দুঃখেরই তুলনা চলে না। কেবল নির্দিষ্ট একটি ব্যর্থতার চিন্তাই মাথায় জেঁকে বসে না এ রকম ক্ষেত্রে। হারিয়ে যায় ভবিষ্যতেও একই রকম আত্মনিবেদনের মাধ্যমে চেষ্টা করার উদ্যমটাও। মনে হয়, ‘কী লাভ আর এত কষ্ট করে! সেই তো আমি ফেল মারব!’

এ ক্ষেত্রে চাইলেই স্মরণ করতে পারো ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসিকে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে যায় মেসির আর্জেন্টিনা। ২০১৫ আর ২০১৬ সালে যখন কোপা আমেরিকা ফাইনালে চিলির কাছে হেরে গেলেন তাঁরা, তখন কিন্তু মেসির মনেও একই অনুভূতিই হয়েছিল। তিনিও ভেবেছিলেন, শত চেষ্টা করেও তাঁর পক্ষে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতা সম্ভব হবে! তাই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে বিদায় বলে দেন তিনি। নেন আচমকা অবসরের সিদ্ধান্ত।

এ থেকে আরও একবার প্রমাণিত হয়, সেরাদের সেরারাও বারবার হারের ধাক্কা সইতে না পেরে একসময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, এমনকি মাঝেমধ্যে হাল ছেড়ে দিতেও উদ্যত হন। কিন্তু এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। সামনে এগিয়ে চলার মধ্যেই রয়েছে জীবনের সার্থকতা। আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন বলেছেন, ‘জীবন হলো অনেকটা বাইসাইকেল চালানোর মতো। তুমি যদি নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে চাও, তাহলে তোমাকে অবশ্যই এগিয়ে চলতে হবে।’

পাশাপাশি যে জায়গায় আজ নিজেকে দেখার ইচ্ছা ছিল, সবার প্রশংসার বৃষ্টিতে ভেজার স্বপ্ন ছিল, সেখানে অন্য কাউকে দেখাটাও খুব কষ্টের ব্যাপার। ইচ্ছা না থাকলেও মনের মধ্যে হিংসার পিঁপড়া আলতো করে হুল ফুটিয়ে দেয় ঠিকই। খুব করে চাইলেও সেই ঈর্ষাবোধ থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না, মন থেকে বিজয়ীকে অভিনন্দন এবং সম্ভব হয়ে ওঠে না শুভকামনা জানানো।

থ্রি ইডিয়টস সিনেমার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে? ওই যে যেখানে মানবমনের এক আশ্চর্য দিকের কথা তুলে ধরে ফারহান কোরেশি! সে বলে, ‘প্রিয় বন্ধু পরীক্ষায় ফেল করলে খারাপ লাগে। কিন্তু যখন সে পরীক্ষায় প্রথম হয়, তখন আরও বেশি খারাপ লাগে!’ অর্থাৎ প্রিয় বন্ধুর সাফল্যেও তোমার একটু-আধটু ঈর্ষাবোধ হতেই পারে, যদি না তুমি হিমালয়ের গুহাবাসী সাধুসন্ত হও!

মনোবিদেরাও কিন্তু বলছেন, একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ঈর্ষাবোধ খুব খারাপ ব্যাপার নয়। বরং সেটি হতে পারে ইতিবাচক এনার্জির জ্বালানি। মানে যখন অবধি ঈর্ষাবোধটা স্বাস্থ্যকর থাকছে, সীমা ছাড়িয়ে টক্সিক হয়ে উঠছে না, তোমাকে অন্যের ক্ষতিসাধনে উদ্বুদ্ধ করছে না।

কেমন বিষয়টা? বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যকর ঈর্ষাবোধই একজন ব্যক্তিকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের অধিকারী করে তোলে। অন্যরা তার চেয়ে এগিয়ে গেছে দেখে সে-ও অনুপ্রাণিত হয় আরও কঠোর পরিশ্রম করতে, আরও উন্নতির মাধ্যমে নিজেকে সেরার আসনে অধিষ্ঠিত করতে।

এই স্বাস্থ্যকর ঈর্ষাবোধ না থাকলে দুনিয়ার কোনো প্রতিযোগিতাতেই আর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো না। কোনো দ্বৈরথই হয়ে উঠত না কিংবদন্তিতুল্য। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরা পরস্পর লড়াই করতে গিয়ে একে অন্যকে আরও শ্রেয় স্তরে উন্নীত করত না।

তাই আবারও বলছি, কোনো কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর সাময়িকভাবে ভেঙে পড়া, হাহুতাশ করা, অনিরাপদ বোধ করা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক নয়। একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে এগুলো সবই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এসব ক্ষণিকের নৈরাশ্যই বরং তোমাকে অনেক বেশি মানবিক করে তোলে। বুঝতে সাহায্য করে যে একই পরিস্থিতিতে যখন অন্যরা পড়ে, তখন তাদের মনের মধ্যেও কেমন ঝড় ওঠে।

তাহলে অস্বাভাবিক কী? অস্বাভাবিক বা চূড়ান্ত রকমের বর্জনীয় হলো, একটি ব্যর্থতার পর চিরস্থায়ীভাবে হতাশ হয়ে পড়া, আত্মবিশ্বাস খুইয়ে আর কোনো দিনই সেই কাজের ছায়া না মাড়ানো, সেই কাজের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত দৌড়ানোর চেষ্টা না করা। কিংবা নিজের ব্যর্থতার গায়ে প্রলেপ দিতে বিজয়ী ব্যক্তিকে আজীবনের জন্য হিংসা করা, তার সাফল্যকে খাটো করা, তাকে নিজের শত্রু বানিয়ে ফেলা।

এ ধরনের চিরস্থায়ী হতাশা বা ঈর্ষাবোধ আসলে একটি ফাঁদ। যারা এই ফাঁদে পড়ে, তারা আর কখনো জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তারা কেবলই ফাঁদের অতল গহ্বরে পড়ে থেকে ছটফট করতে থাকে। আর কখনোই কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে না তারা। বরং যারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও জয় করে, পেছন থেকে তাদের টেনে নামানোর বৃথা চেষ্টা করে। এভাবে তারা হয়ে ওঠে পরাজিত। ভোগে চরম হতাশায়। সবাই এড়িয়ে চলে তাদের, ভালোবাসে না কেউই।

তাই তুমি যদি পড়াশোনা, খেলাধুলা, গান-নাচ-আবৃত্তি-বিতর্ক কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিযোগিতায় কিংবা বাস্তব জীবনের যেকোনো কাজে ব্যর্থতার সম্মুখীন হও, তাহলে সাময়িকভাবে হতাশা আসতেই পারে। কিন্তু সেই হতাশা বা দুঃখকে সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসতে দিয়ো না।

মনে রেখো, যারা জীবনে সফল হয়, তারা রাতারাতি সফল হয় না। তাদের সফলতার পেছনে লুকিয়ে থাকে অজস্র ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু সেসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যায়। চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।

সুতরাং আজ যদি তুমি কোথাও সফল না-ও হও, তবু এতটা ভেঙে পড়ো না, যার ফলে আবার একই কাজের চেষ্টা করার মানসিক শক্তিই হারিয়ে ফেলো। আজ যদি ব্যর্থ হয়ে থাকো, দুটি দিন নিজের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নাও, যাতে করে তৃতীয় দিনে গিয়ে নতুন প্রাণোচ্ছ্বাসকে পুঁজি করে আবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো।

মেসিও কিন্তু ঠিক তা-ই করেছেন। সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেও পরবর্তী সময়ে ঠিকই নিজেকে মানসিকভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন। ফিরেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে। এমনকি ২০২১ সালে ব্রাজিলের মাটিতেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে পেয়েছেন অধরা আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ।

সময় একদিন তোমারও আসবে। আজ নয়তো কালঅথবা পরশু। বিজয় সরণির জ্যামে পড়ে তার হয়তো এসে পৌঁছাতে একটু বেশি সময় লাগছে। কিন্তু দেরিতে হলেও সে আসবেই আসবে। যতক্ষণ সে না এসে পৌঁছায়, মনে বিশ্বাস রেখে স্বপ্ন দেখা অব্যাহত রাখো। আর গলা মেলাতে থাকো বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিটিএসের প্রিয় সদস্য জাংকুকের গাওয়া গানটির সঙ্গে :

Look who we are, we are the dreamers
We’ll make it happen,’ cause we believe it!
Look who we are, we are the dreamers
We’ll make it happen,’ cause we can see it!