প্রেতের পাঁচালি

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

পাহাড়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিয়েছে। সেই রুপালি আগুনঝরা রাতে তিন পথিক এগিয়ে চলেছেন গাঢ় অন্ধকার ঠেলে। পূর্ণিমার উছলে পড়া আলো তাদের হাতছানি দেয়, ঘরছাড়া করে। চারপাশ সুনসান। তক্ষক কিংবা ঝিঁঝিরা করে রাতের জয়গান। জোনাকির দল জ্বলে-নেভে সেই শাল-মহুয়ার বনে। রাতজাগা পাখিরা ডানা ঝাপটায়। কখনো কলজে–কাঁপানো তীক্ষ্ণ চিৎকারে কেঁপে ওঠে বন। সে ক্ষণিকের জন্য। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে আবার। দুনিয়া ভুলে তাই তিন পথিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন বনপথের অলিগলিতে। একজন একটু বেশিই সৌন্দর্যপিয়াসী। মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়ছেন তিনি। অন্য দুজন জানেন লোকটার খেয়ালিপনা। তাই নির্বিকার মনে এগিয়ে চলেছেন। হঠাৎ এক আর্তচিৎকারে থেমে যান তাঁরা। বুঝতে পারেন, বিপদে পড়েছেন তাঁদের সঙ্গী। পেছন দিকে ঘোরেন সঙ্গীকে খুঁজতে। বেশি দূর যেতে হয় না। পাহাড়ের ঢালে বসে পড়েছেন তাঁদের বন্ধু। জোছনার ম্লান আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পেলেন তাঁর আতঙ্কিত চেহারা। সঙ্গীদের উপস্থিতিও ভয় দূর করতে পারে না লোকটার। ভয়ার্ত কণ্ঠে বারবার বলছেন, ‘এ আমি কী দেখলাম, এ আমি কী দেখলাম!’ সঙ্গী দুজন তাঁকে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ দিলেন। একসময় অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন ভদ্রলোক। বললেন তাঁর ভয় পাওয়ার কারণ। অবিশ্বাস্য সে গল্প। বোঝা আর না বোঝার দোলাচলে সঙ্গীরা।

বনপথের সৌন্দর্যে আনমনা লোকটা পিছিয়ে পড়েন খানিকটা। ভাবেন, জোর পায়ে হেঁটে ধরবেন সঙ্গীদের। তখনই দেখতে পান একটা শবযাত্রা। একদল লোক খাটিয়া কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছে শ্মশানের দিকে। ক্ষণিকের জন্য থেমে যায় দল। কাঁধ থেকে নামায় খাটিয়া। পথিক ভদ্রলোক ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন শবযাত্রীদের খুব কাছে। তাঁর ইচ্ছা হলো মৃত লোকটার মুখ দেখার। মৃতের মুখের কাপড় সরিয়ে দেখলেন। সর্বনাশ, এ কাকে দেখছেন! নিজের লাশ খাটিয়ায়! চোখ কচলে দেখলেন কোনো ভুল হচ্ছে কি না। কিন্তু হুবহু নিজের চেহারা। আত্মসংবরণ করতে পারলেন না পথিক। ভয়ে জমে গেলেন স্রেফ। শিরদাঁড়া বেয়ে চলেছে ভয়ের শীতল স্রোত। গগনবিদারী একটা চিৎকার দিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গী দুজন যতক্ষণে চলে এসেছেন কাছে, ততক্ষণে শবযাত্রীরা সরে পড়েছে ওখান থেকে।

এ ঘটনার পর কখনো সুস্থ হতে পারেননি ভদ্রলোক। মৃত্যুভয় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। ধরেই নেন, ওপারের ডাক এসে গেছে। এ জন্যই দেখেছেন নিজের লাশ। মাসখানেকের মধ্যেই মারা যান ভদ্রলোক। বাংলা সাহিত্য অকালে হারায় কালজয়ী এক কথাসাহিত্যিককে।

ওপরের গল্পটার সঙ্গে আর কোনো কাহিনির মিল পাওয়া যায়, সেই চাঁদের পাহাড়—সে উপন্যাসে আফ্রিকার রিখটারভেল্ট পর্বতমালায় ডিয়াগো আলাভারেজ আর বাঙালি তরুণ শংকরের কথা মনে আছে? তাঁরা চলছিলেন এর চেয়ে ভয়ংকর পথ ধরে। কখন যেন দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেন। শঙ্কর যখন তাঁকে খুঁজে পান, আলভারেজের দেহ তখন ক্ষতবিক্ষত। কাতরাচ্ছেন যন্ত্রণায়। এক ভয়ংকর প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। চোখে-মুখে তাঁর বিস্ময় আর আতঙ্ক।

আতঙ্কের সঙ্গে এ কাহিনির কোথায় যেন মিল আছে! একই রকম পরিবেশ আর অলৌকিকতার গন্ধ। গল্পে যেমন মিল, বাস্তবেও মিল আছে একটা। মিলটা লেখক আর লেখনীতে। রিখটারভেল্ট পর্বতমালা আর চাঁদের পাহাড়ের কাহিনির লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই সেদিন সেকালের ভারতের বিহার রাজ্যের বনপথে নিজের লাশ দেখে ভয় পেয়েছিলেন। সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বিভূতিভূষণ আপাদমস্তক শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা যেমন করেছেন, ভূগোল, মহাকাশচর্চা কিংবা বিজ্ঞান আন্দোলনেও তিন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অজপাড়াগাঁয়ে নিজের স্কুলে তাঁরই উদ্যোগে আয়োজিত হতো বিজ্ঞান উৎসবের। তা না হলে আচার্য প্রফুল্ল রায়ের মতো বিজ্ঞানীর সাহচর্য তিনি পেতেন না। সেই মানুষটাই কখনো কখনো অদ্ভুত সব কাজকর্ম করতেন, যা একজন লেখকের চরিত্রের সঙ্গে বেমানান।

পথের পাঁচালী লিখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই সিকুয়েল ছিল অপরাজিত। পথের পাঁচালীর নায়ক অপু অপরাজিত উপন্যাসে সম্পূর্ণ এক অন্য মানুষ। পরিণত, কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী। কিন্তু এর লেখক বিভূতিভূষণ পুরোপুরি যুক্তিবাদী কিংবা কুংসংস্কারমুক্ত ছিলেন না। তিনি তন্ত্রমন্ত্র মানতেন, প্রেতচর্চা করতেন, প্ল্যানচেট করে আত্মা নামানোর দাবি করেছেন। এ জন্য চাকরিও চলে গিয়েছিল তাঁর।

বিভূতিভূষণের মধ্যে তন্ত্রচর্চার বিষয়টা প্রথম ধরা পড়ে, তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরীর মৃত্যুর পর। মাত্র কয়েক মাসের সংসার ছিল। তারপর হঠাৎ করেই টাইফয়েডে মারা যান গৌরী। বিষণ্ন হয়ে পড়েন বিভূতিভূষণ। এর আগে-পরে বাবা, দুই বোন ও মায়ের মৃত্যু—একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনা সইতে হয় তাঁকে। কাপালিক-তান্ত্রিকদের খপ্পরে পড়েন, তাঁদের দর্শনে আকৃষ্ট হন। নিজেও জড়িয়ে পড়েন প্রেতচর্চায়।

দুই

বিভূতিভূষণ তখন হুগলির জাঙ্গিপাড়ার দারাকানাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কথায়–কথায় একদিন ত্রিপুরাবাবু নামের এক বয়স্ক লোকের কাছে বলে ফেলেন নিজের প্রেতচর্চার কথা। আর যাবে কোথায়। তিনি চেপে ধরলেন। এরপর সারা গ্রামে মুখর হয়ে পড়ল। শুরু হলো নিয়মিত প্ল্যানচেটের আসর, মৃত মানুষদের আত্মা নামিয়ে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় ইত্যাদি। প্রথম দিকে গ্রামের ছেলে–বুড়োর বেশ আমোদ পেল ব্যাপারটাতে। কিন্তু এতে নাকি ছেলেদের পড়ানোর ব্যাপারে দিন দিন উদাসী হয়ে পড়েছিলেন। গ্রামের মানুষ দুভাগে বিভক্ত হলেন। একদল বিভূতিভূষণের প্রেতচর্চার ব্যাপারটাতে কোনো সমস্যা দেখেন না। আরেক দল মনে করেন, তিনি এ কাজ ভালো করছেন না। বিশেষ করে গাঁয়ের শিক্ষিত তরুণেরা। বাংলাদেশের পল্লি এমনিতেই কুসংস্কারে নিমজ্জিত, এর মধ্যে একজন শিক্ষিত শিক্ষক যদি ভূত-প্রেতের চর্চা করেন, তাহলে কুসংস্কার আরও ডালপালা মেলবে। থেমে যাবে কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলন। এই দুই পক্ষের টানাটানিতে তৃতীয় আরেক পক্ষ হাজির। গ্রামে বাস করেছেন অথচ ভিলেজ পলিটিকসের শিকার হননি, এমন মানুষ পাওয়া মুশিকল। তা সে মানুষ যতই পলিটিকস এড়িয়ে চলুন না কেন। স্কুলের তৎকালীন হেডমাস্টার চেয়েছিলেন, তার অবসরের পর বিভূতিই হবেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু ভেতরে–ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী একজন ছিলেন। তিনি সে গাঁয়েরই লোক। সুযোগে ছিলেন বিভূতিভূষণকে হেনস্তা করার। মওকা মিলে গেল। প্রেতচর্চাবিরোধীদের খেপিয়ে তুললেন। শেষমেশ অভিযোগ গেল মহকুমা সদরে। শিক্ষা কর্মকর্তা, মহকুমা প্রশাসকেরা ভালোভাবে নিলেন না ব্যাপারটা। একজন পরিদর্শককে পাঠালেন ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করতে।

পরিদর্শক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন যুক্তিবাদী মানুষ। বিভূতিভূষণকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কম যান না। হ্যাঁ, তখনো বিভূতিভূষণের কোনো বইপত্র বের হয়নি। একটা গল্পও ছাপা হয়নি কোথাও। কিন্তু ভেতরের শিক্ষাটা, যুক্তিটা তো তত দিনে জাগ্রত হয়েছে। প্রচুর বই পড়েন, দেশি-বিদেশি। বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলে প্রচণ্ড দখল। আর পড়েন লন্ডনের বিখ্যাত স্পিরিচুয়াল ম্যাগাজিন। বিশ্বের তাবড় তাবড় মনীষীর ভৌতিক অভিজ্ঞতা ছাপা হয় সেখানে। বড় বড় মানুষ লেখেন ভূত-প্রেতের পক্ষে। বিভূতিভূষণও তত দিনে ভিড়ে গেছেন সেই দলে। সুতরাং তার খুঁটি অতটা নড়বড়ে নয়। তিনি তর্কে কুপোকাত করলেন ইন্সপেক্টরকে। তারপর প্রমাণ দিলেন ইন্সপেক্টরের আত্মীয়ের আত্মা নামিয়ে।

ইন্সপেক্টরকে ভোলানো গেল সহজেই। কিন্তু ওপর মহল ভুলল না। তাঁকে সরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকেই প্রধান শিক্ষক করা হলো। এমনকি বিভূতিভূষণকে স্কুলছাড়া, গ্রামছাড়ার সমস্ত আয়োজন করা হলো।

তিন

সাহিত্যিক হিসেবে নাম করার পর বেশ কিছুদিন তাঁর প্রেতচর্চায় ভাটা পড়ে। কিন্তু কাপালিক-তান্ত্রিকদের দেখা পেলেই তাঁদের পিছু নেন, ভাব জমিয়ে ফেলেন, আড্ডা দেন, চলে প্রেতচর্চা। সাহিত্যিক বন্ধুদের ভর্ৎসনায় ছাড়তে হয় ওসব। তবে ছাড়তে কি পারেন? শেষ বয়সে বিভূতিভূষণের তন্ত্রচর্চা আরও জোর পায়। কুসংস্কারেও জর্জরিত হন। সেটা এতটাই, নিজের মৃত্যু ডেকে আনেন ভয় পেয়ে। যে কথা লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে।

একবার বিখ্যাত গবেষক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তর্কে জড়ালেন। ভূত আছে—এ কথা মানতে নারাজ সুনীতি। বিভূতি তখন প্ল্যানচেটে বসে নামিয়ে আনেন সুনীতির মৃত ছোট ভাইয়ের আত্মা। এর পর থেকে নাকি প্রায়ই ছোট ভাইকে দেখতে পেতেন সুনীতি।

চার

জমির করাতির বিধবা স্ত্রী বিভূতিভূষণকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। তাঁর ছেলে স্কুলে বিভূতির সহপাঠী ছিলেন, ছোটবেলাতেই সে গাছ থেকে পড়ে মারা যায়। তার পর থেকেই বিভূতির প্রতি বড্ড মায়া বৃদ্ধার। গ্রামে এলেই তিনি বিভূতিকে দেখতে আসবেন। জঙ্গল থেকে পেড়ে আনা নোনা আতা কিংবা বুনো পেয়ারা তাঁর হাতে থাকবেই। বিভূতিকে খাওয়ানোর জন্য। একবার গ্রামে গিয়ে সেই বৃদ্ধাকেই দেখতে পান দাঁড়িঘাটার পুলের কাছে। বিভূতিকে দেখেও না দেখার ভান করেন তিনি। বিভূতি অনেক চেষ্টা করেন তাঁর সঙ্গে কথা বলার, বুড়ি কিন্তু নীরব। বুড়ি বড্ড অভিমানী। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন বিভূতি। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁর এমন আচরণের কারণ। জানা যায়, জমির করাতির বউ সেদিন সকালেই মারা গেছেন। আর বিভূতিভূষণরা গাঁয়ে ফেরার আগেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে, সেটা ওই দাঁড়িঘাটার পুলের কাছে। বিভূতিভূষণ এই বৃদ্ধাকে নিয়ে পরে লিখেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘আহ্বান’। কিন্তু মৃত বুড়িকে দেখলেন কী করে তিনি?

পাঁচ

প্ল্যানচেট, তন্ত্র-মন্ত্রচর্চা যাঁরা করেন, দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা মিথ্যা বলছেন। সেটার পেছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে। তাঁরা বুজরুকি করে লোকের পয়সাকড়ি হাতিয়ে নেন। কিন্তু বিভূতিভূষণের বিরুদ্ধে এ অপবাদ তাঁর শত্রুরাও দিতে পারেননি। আরেকটা কারণে মানুষ বুজরুকি করে। বেশির ভাগ মানুষই খ্যাতির কাঙাল, যে যার জায়গা থেকে খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা করে। খ্যাতির লোভে, অন্যের সমীহ আদায় করতে, নিজের ক্ষমতা, নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে বুজরুকি করার উদাহরণও আছে। তা–ই যদি হতো, অত সহজে জাঙ্গিপুর ছাড়তেন না বিভূতিভূষণ। পরে সাহিত্যিক হয়ে দেশজুড়ে নাম কামিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তায় সেকালে তিনি প্রায় শরৎচন্দ্র কিংবা একালের হুময়ূন আহমেদের মতোই সমকক্ষ ছিলেন। তাই খ্যাতির জন্য, টাকার জন্য প্রেতচর্চা করার দরকার ছিল না বিভূতিভূষণের। অর্থাৎ বুজরকি তিনি করেননি। যেটা করেছেন, সেটা বিশ্বাস থেকেই করেছেন। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ, নস্টালজিক মানুষ ছিলেন, কাতর ছিলেন একের পর এক আপনজন হারানোর বেদনায়। মৃত বাবা-মা-ভাই-বোনেদের কথা ভুলতে পারেননি কখনো। খুব বেশি স্মৃতিকাতরতা, বেশি আবেগও কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থতার লক্ষণ নয়।

সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা অনেক সময় কাল্পনিক কিছু চরিত্র তৈরি করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেন, ঝগড়া করেন। অন্য কেউ তাঁদের দেখলে ঘাবড়ে যাবে। অনেক মানুষ স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য বোঝে না। স্বপ্নে দেখা ঘটনাগুলোকেই বাস্তব মনে করতে শুরু করে। ২০১৪ সালে এ নিয়ে একটা গবেষণা করেন সুইস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা। তাঁরা রীতিমতো ৪৮ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে কৃত্রিমভাবে ভৌতিক অবস্থা সৃষ্টি করেন। স্বেচ্ছাসেবীরা প্রায় প্রত্যেকেই জানান, তাঁরা ভূত দেখেছেন বা ভূতের উপস্থিতি আঁচ করেছেন। ওই গবেষক দল দেখান, ভূত দেখা আসলে পুরোটাই মস্তিষ্কের ব্যাপার। এ ধরনের অনুভূতির জন্য আসলে কিছু না থাকলেও চলে।

লেখকেরাও মানুষ। আর দশটা মানবীয় গুণাবলি থেকে দূরে থাকা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করতেন। গভীরভাবেই করতেন সেটা। তাঁর বহু লেখায় অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আরণ্যক-এর তাড়বারো, চাঁদের পাহাড়-এর বুনিপের মতো বারবার রহস্যময় জীবের অস্তিত্ব তিনি তুলে ধরেছেন। এমনকি দেবযান উপন্যাসটাও লেখা হয়েছে নিজের এসব বিশ্বাস থেকেই। এ কথা পাওয়া যায় তাঁর ডায়েরিগুলোতে। বিভূতিভূষণ নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেগুলো লিখতেন খোলামনেই রাখঢাক না করে।

অন্য লেখকেরা ভূতের গল্প লেখেন বা লিখতেন। কিন্তু বেশির ভাগই অবিশ্বাসী মন নিয়ে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে ভূতের গল্প লেখেন। বিভূতিভূষণের ভূতের গল্পগুলো কাল্পনিক হলেও সেগুলোতে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস রেখেছেন। তাই পথের পাঁচালী যেমন জীবন আর প্রকৃতির সত্যিকারের পাঁচালি হয়ে উঠেছিল, তেমনি তাঁর অলৌকিক গল্পগুলোও ছিল নিজের ভেতর পুষে রাখা প্রেতটার পাঁচালি।