ইলিশ-পান্তা কি পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য নয়

পান্তা এ অঞ্চলের মানুষ অনেক আগে থেকেই খায়। এই দেশ ধানের দেশ। ভাত এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। মাছে-ভাতে বাঙালি, এটা তো প্রবাদই আছে। আগে তো রেফ্রিজারেটর ছিল না। এ দেশের কৃষক-পরিবারগুলো আগের রাতে বেশি করে ভাত রাঁধত আর ভাতে পানি ঢেলে রেখে দিত। সকালবেলা এটা পান্তা হয়ে যেত। শুধু লবণ হলেই পান্তা খেয়ে নেওয়া যায়। একটুখানি মরিচ, একটুখানি পেঁয়াজ হলে তো কথাই নেই।

আমাদের রংপুর অঞ্চলে ছোটবেলায় দেখেছি, কিষানেরা কৃষিখেতে যেতেন ভোরবেলা, সূর্য ওঠারও আগে। সকাল নটা-দশটার দিকে তাঁদের বিরতি দেওয়া হতো। এটাকে বলা হতো পান্তাবেল বা পান্তাবেলা। বাড়ি থেকে তখন কোনো ছোট ছেলে হাঁড়িতে করে পান্তা আর থালা নিয়ে চলে যেত খেতে। কিষানেরা তখন খেতের আলে বসেই পান্তা খেয়ে নিতেন। এই পান্তার সঙ্গে তরকারি থাকত না বললেই চলে। তবে পান্তার সঙ্গে লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, কোথাওবা শর্ষের তেল মাখানোর চল ছিল। কেউবা শাক, কেউবা আগের দিনের বাসি ডাল পান্তার সঙ্গে মিশিয়ে নিতেন। তাতে মজাটা বাড়ত। কোথাওবা একটুখানি শুঁটকি জুড়ে দেওয়া হতো; নিয়মিত নয়, কখনো কখনো।

কাজেই পান্তার সঙ্গে ইলিশ আগেকার দিন বাংলার মানুষ খেত না। এটা ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না।

পয়লা বৈশাখে গৃহস্থবাড়িতে ভালো খাওয়ার চল ছিল। সাধারণ একটা কথা ছোটবেলায়, আজ থেকে ৫০ বছর আগে, আমরা বলাবলি করতাম, বছরের প্রথম দিন ভালো খেলে সারা বছরই ভালো খাওয়া জুটবে। লঘু স্বরেই সবাই এই কথা বলত। কাজেই বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখে কারও বাড়িতে পায়েস রাঁধা হতো, কারও বাড়িতে পোলাও। দোকানে দোকানে হালখাতা উপলক্ষে মিষ্টি থাকত প্রচুর।

ইলিশ তো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। প্রাচীন পুঁথিতে ইলিশের তেমন বর্ণনা পাওয়া যায় না। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য ও ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ইলিশের উল্লেখ আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘শাহ-ইন-শাহ বাদশাহ সালামত মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইলিশ চড়ে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে যাবেন না তো কোথায় যাবেন। ইলিশ খেয়ে যে প্রাণ দেয়, সে তো শহীদ—মর্টর।’ মুজতবা আলীর বর্ণনায় পাওয়া যাচ্ছে, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক সিন্ধু দিয়ে লাহোর–যাত্রার সময় নদের একটা অচেনা মাছ খেয়েছিলেন। রমজান মাসে রোজা থেকে এবং আগে থেকে অসুখে তিনি দুর্বল ছিলেন। তেলওয়ালা মাছ তাঁর পেটে সয়নি। তিনি মারা যান।

যাহোক, আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে ইলিশের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে। কিন্তু পান্তা দিয়ে আগেকার দিনের লোকেরা ইলিশ খেত, তা শোনা যায়নি। পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে পান্তা খাওয়ার রেওয়াজও আগে ছিল না।

এটার প্রচলন করল কে?

ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সন্‌জীদা খাতুন জানাচ্ছেন, ‘এ দেশের বাঙালি স্বাধীন হবার পরেই দড় হয়ে উঠল ব্যবসাবুদ্ধিতে! পয়লা বৈশাখের মাঠে যেখানে–সেখানে গজিয়ে উঠতে লাগল দোকান। খাবারের দোকান তো ভালো কথা, দোকান কিনা পান্তাভাতের! শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। নাকি সানকিতে করে সে পান্তা কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে সুবেশধারী মানুষজন। বিপ্লবের কতই রকম। গ্রামদেশের দুঃখী মানুষের নিত্য–আহার একদিন চেখে দেখে এ আবার কোন বাঙালিয়ানা। সমালোচনা শুরু হতো ছায়ানটেরই। তারাই নাকি গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বিদ্রূপ করে এই পান্তা খাওয়ার চল করেছে।’ (ভোরের কাগজ, ১৪ এপ্রিল ১৯৯৬) ছায়ানট এটা প্রচলন করেনি, তারা পান্তার দোকানের বিরোধী। এই ব্যবসায়িক বুদ্ধিওয়ালারাই বিক্রি বাড়াতে পান্তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ইলিশ মাছ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এ ধরনের নিয়মকানুনের ফলে দেশে ইলিশ মাছের উৎপাদন বেড়েছে।

প্রচারণার কারণে এবার পান্তা-ইলিশ নিয়ে মাতামাতিও বেশ কম দেখা গেল। রমজান মাসে পয়লা বৈশাখও হয়তো ১৪৩০ বঙ্গাব্দে ইলিশ-পান্তা নিয়ে মাতামাতি কমার একটা কারণ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পান্তা-ইলিশ এই দুটো মিলিয়ে বাঙালি আগেকার দিনে খেত না। এটা প্রাচীন ঐতিহ্য নয়। পয়লা বৈশাখে আলাদা করে এ দেশের মানুষ পান্তা খেত না। বরং নববর্ষে ভালো খাওয়ার চেষ্টা ছিল বাড়িতে বাড়িতে।

আর ইলিশ-পান্তার ব্যাপারটা স্বাধীনতার পরে রমনা-পার্কে যাঁরা স্টল দিতেন, তাঁদের আবিষ্কার। ছায়ানট এসবের বিরোধী। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হকও রমনায় পয়লা বৈশাখে পান্তা বিক্রির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন।