আমের বনে ঘ্রাণে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বৈশাখে আম পাকে না। তবে যে কবি লিখেছেন? এককালে আমের হরেক জাত ছিল। টক-মিষ্টি, সিঁদুরে, হালকা সবুজ, কালচে সবুজ, ছোট-বড়, গোল-লম্বাটে হরেক স্বাদের, হরেক রঙের। দেশি-বুনো জাত—সব। বৈশাখ থেকে শুরু করে আশ্বিনে গিয়ে শেষ হতো আম পাকার সব হিসাব। কবি যখন লিখছেন, তখন হয়তো বেশির ভাগ আম বৈশাখেই পাকত। এখন পাকে জ্যৈষ্ঠে। তাই বলে জ্যৈষ্ঠ অবধি অপেক্ষা করব আমরা? কক্ষনো নয়। সুকুমার রায় যা-ই বলুন, পল্লিকবি যে আবার বলেছেন, ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়ানোর সুখের কথা। এ সুখ পাকা আমে নয়। সবুজ-সবুজ, কাঁচা-কাঁচা আমের ভারে নুয়ে পড়া ডালগুলোতেই যেন আমাদের সব আনন্দ। বুভুক্ষুর মতো চেয়ে থাকি, ঢিল ছুড়ি। ব্যর্থ হয়ে অপেক্ষা করি ঝড়ের জন্য।

বৈশাখের বিকেলে হঠাৎ করেই আকাশের ঈশান কোণ কালিগোলা মেঘে ঢেকে যায়। অন্ধকার নেমে আসে মাটিতে। কিছুক্ষণ থমথমে নীরব! হঠাৎ গুড়ুম গুড়ুম করে বিকট শব্দে মেঘ ডাকে। পথভোলা রাখাল হকচকিয়ে যায়। ভয় পেয়ে গরু–বাছুর দড়ি ছিঁড়ে পালায় বহু দূরে…। ধুলো উড়িয়ে ঝড় আসে। প্রথমে গা-সওয়া, তারপর প্রচণ্ড তাণ্ডবে গাছপালার হাত-পা ভাঙতে চায়। পারলে ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে ফেলে অন্য কোনো গাঁয়ে। ঝড়ের বাতাস হিমঠান্ডা। সঙ্গে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। ধারালো। পিঠে–মাথায় আঘাত হানে চাবুকের মতো। কখনো কখনো শীল পড়ে। শীলাবৃষ্টি। তবু কি দুরন্ত শৈশব হার মানে?

আক্ষরিক অর্থেই মামার বাড়িতে আম কুড়ানোর সুখ তখন পেয়ে বসে।

মামাবাড়ির বহির্বাটিতে নানার কাঁচা বৈঠকখানা, সামনে একটা বুড়ো কামিনীগাছ। সেটাকে ছাড়িয়ে আমাদের চোখ বড় আমগাছ দুটোর দিকে। বাতাস কেটে গাছপালারা টিকে থাকার সংগ্রামে যখন খাবি খায়, আমরা তখন বৈঠকখানার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে গান ধরি। ঝড়ে ঝড়ে নড়ে একটা আম পড়ে…। ধপাস করে আম পড়ে। আমরা ছুটে যাই। কাড়াকাড়ি লাগে। যে বিজয়ী, আমের মালিক সে-ই। অন্যরাও বঞ্চিত হয় না। একটা যখন পড়ে, কিছুক্ষণ পর তার সঙ্গীরা বোঁটা ছিঁড়ে নেমে আসে একে একে। তাই সবাই সুখী আম কুড়ানোর খেলায়।

আমের জন্য আমাদের প্রতীক্ষার শুরুটা আরও আগে। মাঘ মাসের শেষ দিকে আড়মোড়া ভেঙে যখন গাছেরা জাগে, আম্রকুঁড়ির দল তখন উঁকি মারে সূর্যের প্রথম আলো দেখার জন্য। ফাগুনে আমের মুকুলেরা নিজেরাই জাগিয়ে দেয় আমাদের। ঘ্রাণে, ম–ম সুবাসে। কালো ভোমরার দল ছুটে আসে, আসে হলদে কিংবা লাল ভিমরুল, মৌমাছিরাও। পরাগায়ন ঘটায়। জ্যৈষ্ঠে দৃশ্যমান হয় আমের গুটি। তখন থেকে আমাদের মনে চঞ্চলতা বাড়ে। আরেকটু, আরেকটু…আরেকটু বড় হলেই খাওয়া যাবে। আকারে যখন মার্বেলের মতো হয় আমের দানাগুলো, আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। ঘাটে-মাঠে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। ঝড়ে পড়া, ঢিলিয়ে পাড়া আম পেটে চালান করি। বৈশাখে আম পূর্ণতা পায়। আমাদেরও অপেক্ষার পালা ফুরোয় পুরোপুরি।

নিজেদের বাগান আছে, তবু মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢিল ছুড়ি অন্যের বাগানে। কখনো ঢিলের আঘাতে নেমে আসে বড়সড় আম। ঘষা ঝিনুকের ধার দিয়ে আম ছিলি, ফালি ফালি করি। লবণ আর পোড়া মরিচের মসলায় ডুবিয়ে সেই আম যখন জিব স্পর্শ করে, রাজ্যের সুখ যেন সেই টক স্বাদেই ঝরে ঝরে পড়ে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে আরামে, জারক রসে ভরে যায় জিব।

আমের বন থেকে বেরিয়ে আসি। অন্য কোনো দিনে। অন্য কোনো বৈশাখের দুপুরে। খালের ধারে অড়হরগাছে ফল ধরেছে। কালচে সবুজ। আমাদের গন্তব্য সেদিকে। খাল পেরিয়ে ওপারে। খালের ঢাল বেয়ে নেমে পড়ি। খাড়া পাড়ের এখানে-সেখানে গর্ত। মাছরাঙার। উড়ে ভেতরে ঢোকে মা কিংবা বাবা পাখি। পোকা ঠোঁটে নিয়ে। বাচ্চাকে খাইয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা ভাবি আজ পেয়েছি। গভীর গর্ত। ভেতরে উঁকি মারি। ঘন অন্ধকার। হাত ঢুকিয়ে দেখব ভাবি। কিন্তু দাদির বারণ মনে পড়ে। ইতিহাসের কোন অতলে নাকি কোনো এক বালক হাত ঢুকিয়েছিল পাখির গর্তে। ছানার বদলে জুটেছিল জাত গোখরার কামড়। রক্ত হিম হয়ে যায়। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে। ভয়ের। বিদ্যুৎগতিতে হাত সরিয়ে আনি। সাপে যে বড্ড ভয় আমার! সেই হতভাগা কিশোরের জন্য মন খারাপ করি। সাপের ওপর রাগ হয়।

বৈশাখী গরমে সাপেদের উৎপাত বড় বেশি। একটা আমবাগান ছিল আমাদের। তার লাগোয়া একটা বিশাল গা ছমছমে বাঁশবাগান। বড্ড ভালোবাসতাম বাগানটাকে। বৈশাখের গরম বাতাস সেখানে পরাজিত হয় সবুজ পাতাদের কাছে। সেখানে সাপেরা আসে শীতলতা পোহাতে। আমরাও যাই, কারণে-অকারণে, কাজে কিংবা বিনা কাজে। আমবন-বাঁশবনে তখন সুনসান নীরবতা। শুকনো পাতার দঙ্গলে ভরে গেছে চারপাশ। একটু বাতাস হলেই খসখস আওয়াজ আসে। কুসংস্কারে ভরা মনে তখন জাঁকিয়ে বসে ভূতের ভয়। তবু এগোই। বাগানের গহিন থেকে ঘুঘুর ডাক আসে। একটানা করুণ স্বর। বৈশাখের দুপুরের সঙ্গে এই ডাক আজীবন জড়িয়ে যাবে স্মৃতিকোষে, তখন কে ভেবেছিল? আজও বাংলার পথে-প্রান্তরে, বিজন বাগানে ঘুঘু ডাকে—বৈশাখের উত্তপ্ত দুপুরে। কিন্তু নস্টালজিয়ার সেই ঘুঘুটি আজ কোথায় হারিয়ে গেছে শৈশবের সেই ঘোরলাগা দুপুরটাকে চুরি করে।

শুকনো পাতার ওপর আমাদের খালি পায়ের আওয়াজ ওঠে। মর্মর, খসখস। পাতার ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা রাতচরা পাখিটার ছদ্মবেশ খসে পড়ে। ভয়ে পালানোর জন্য ডানা মেলে বাতাসে। বেশি দূরে যায় না। আবার নিজেকে মিশিয়ে দেয় শুকনো পাতার সঙ্গে গায়ের রং মিশিয়ে। বোকা পাখি ভাবে, আমি বুঝি আর দেখি না ওকে। আমার হাসি পায়, পাখির বোকামিতে। এগিয়ে যাই ধরার জন্য। পাখিও দেখে না দেখার ভান করে। খুব কাছে গিয়ে যখন ভাবি, এবার যাবে কোথায় বাছাধন! তখন পাখি আমাকে বোকা বানায়। ফরফর করে উড়ে গিয়ে প্রতিশোধ নেয়। আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।

এই বাগানেই সাপের খপ্পরে পড়েছি কয়েকবার। বিরাট একটা সাপ বাস করত। নিয়মিত দেখা হতো ওর সঙ্গে আমার। ছয় থেকে আট ফুট লম্বা কমসে কম। গরমের দুপুরে ওর ভয়ে কখনো খালি হাতে মাঠে যেতাম না। কিন্তু সাপের যে ভয় আমার, কোনো দিন যদি তেড়ে আসত, তাহলে হাতের লাঠি কিংবা দা উঁচিয়ে ধরতে পারতাম কি না, এ কথা ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। বহুদিন দেখেছি সাপটাকে। কী সাপ জানি না। সাপ আমি চিনতাম না। তবে এই আকারের সাপ হয় গোখরা, না হলে দাঁড়াশ। ফণা দেখে সাপ চেনার বয়স তখনো হয়নি। ভয় পাওয়ার জন্য তো বয়স লাগে না!

এই আম-বাঁশের পাশাপাশি বাগানেই প্রথম শিয়ালের মুখোমুখি হয়েছিলাম। শিয়াল নিয়ে গাঁয়ের শিশুদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে। এমন নয় যে শিয়ালে কাউকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু গাঁয়ের মায়েরা–খালারা, দাদি-নানিরা ছোটদের ভয় দেখানোর জন্য শিয়ালের ভয়ংকর সব কাহিনি ফাঁদতেন। সুতরাং সেই ছেলে একটু বড় হয়ে যখন প্রথম শিয়ালের মুখোমুখি হয়, তখন আতঙ্কটা কোন পর্যায়ে পৌঁছায়, ভেবে দেখো। আমবাগানে আমি যেদিন প্রথম শিয়াল দেখেছিলাম, সেদিন সঙ্গে কেউ ছিল না। ভয়ে স্রেফ জমে গিয়েছিলাম। শিয়াল মানুষকে ভয় পায়, কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে নয়। সেদিনের সেই শিয়ালটা আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছিল দূর থেকে। আমি তখন গলার স্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম, চিৎকার করেছিলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হয়নি। আজও গরমে কিংবা বর্ষায় গ্রামে গেলে সেই শিয়ালটাকে খুঁজি।

বৈশাখের দুপুরে আগুনের হলকা নামে আকাশ থেকে। গাঁয়ের মাঠে, হাটে, ধূলি-ধূসরিত মেঠো পথে। সেই পথে গাড়োয়ান যায় গরুর গাড়ি নিয়ে, হুরুরর, হাট হাট বলে। ছইওয়ালা, কিংবা ছই ছাড়া। আমরা পিছু নিই। পেছন ধরে চেপে বসি গাড়িতে। গাড়োয়ান ভয় দেখায়। আমরা ভয় পাই না। মেঠো পথে গাড়িতে চলায় আনন্দ আছে। সেই স্বাদ নিতে নিতে গাড়ি ঢুকে যায় নির্জন মাঠে। ওই যে দূরে মসুর কিংবা গম কাটা পড়েছে। ওখানে তার গন্তব্য। মাঝখানে কত পথ। পথের দুপাশে আকন্দফুল বেগুনি সাদা পাপড়ি মেলে আছে হিরের আংটির মতো করে। রোদে ঝিলিক মারে ওগুলো। কালো ভ্রমরের সঙ্গে বড্ড সখ্য ওদের। ভাঁটঝোপে বান ডেকে। সাদা মুড়ির মতো ফুটে আছে থোকা থোকা ফুল। বড্ড মায়াবী মিষ্টি গন্ধ এর। একেই কিনা ডাইনির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন রূপসী বাংলার কবি! কেন কে জানে? ভাঁটফুলের, আসশেওড়ার দঙ্গলে ছোট পাখিরা আসে মধু খেতে। মৌটুসি কিংবা নীলটুনি। আর আসে ছোট কালো মুনিয়ার জোড়া কিংবা তিলা মুনিয়ার ঝাঁক। আক্ষরিক অর্থেই নৃত্য করে ওরা ভাঁট-আসশেওড়া পলকা ডালে বসে। গাড়ি এগিয়ে চলে।

ধানকাটা মাঠে, কিংবা সদ্য কাটা গমের খেতে, কৃষকের বিরাম নেই। এক টুকরো গামছা মাথায় বেঁধে কিংবা তালপাতার মাথাল মাথায় তুলে গ্রীষ্মের আগুনঝরা রোদে তাঁরা হাড়ভাঙা খাটুনি করে কীভাবে, এ রহস্য আজও ভেদ করতে পারিনি। সারা মাঠ দাপিয়ে, খাল পেরিয়ে যখন ঘর্মাক্ত গায়ে ইছামতীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন এক টুকরো স্বর্গ নেমে আসে যেন ছোট্ট নদীটির বুকে। নদীর পানিও উত্তপ্ত। কিন্তু ফুটখানেক গভীরেই পাওয়া যায় ঠান্ডা পানি। জলকেলিতে কখন যে ঘণ্টাখানেক সময় চলে যায় টেরই পাই না।

ইছামতীর তীর ঘেঁষে, পথের দুপাশে সোনালুগাছের সারি। যেন সোনার তৈরি নেকলেস কিংবা মালা ঝুলে আছে লম্বা লম্বা মঞ্জুরিতে ভর দিয়ে। কবেকার কোন শৌখিন বুড়ো ইছামতীর দুপাশটকে এভাবে সোনায় মুড়িয়ে দিয়েছিল, কে জানে? এ সৌন্দর্য সহ্য করা যায় না। মেঠো পথের দুপাশ যদি সোনালি-হলুদে ঝিকিয়ে ওঠে, পথচারী স্বপ্নাবিষ্ট কিশোরের বুকের ভেতর হু হু করবেই! হু হু এখনো করে। গ্রামে গিয়ে সেই মেঠো পথ আজও পাই। কিন্তু সেই সোনালি আলো কোথায় হারিয়ে গেছে। বড় সোনালুগাছগুলো কে কবে কেটে ফেলেছে, তার খবর কেউ রাখে না। কিন্তু সোনালুগাছকে অত সহজে মারা যায় না। কেটে ফেললে মোথা থেকে বেরোয় নতুন গাছ। কিন্তু সে গাছ বেড়ে উঠে ফুলবতী হওয়ার আগেই আবার কে বা কারা দা চালায়, সৌন্দর্য তাদের আক্ষরিক অর্থেই সহ্য হয় না। এখন তাই গাঁয়ে গেলে সেই সোনালুগাছের ফসিলই চোখে পড়ে। সোনাঝরা ফুলে মন হু হু করার দিন আর নেই।

পৃথিবী বদলে গেছে। বদলের চিহ্ন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গাঁয়ের বসতবাড়িতে। পাকা ইটের গাঁথুনি পড়েছে প্রতিটা বাড়িতে। ছাদ যদি না–ও হয়, নিদেনপক্ষে টিনে ছাওয়া ঘর সব। ছেলেবেলার দৃশ্যটা এখন বিরল। নব্বই দশকেও কাঁচা খড়ের বাড়ি ছিল বেশি। যাদের পাকা বাড়ি, সে বাড়িতেও অন্তত রান্নাঘর, গোয়াল আর ধান রাখা গোয়ালঘরগুলো ছাওয়া হতো খড় দিয়ে। বেশির ভাগই গমের খড়। গ্রামে যাকে ‘নাড়া’ বলে। বৈশাখে গম কাটার পর নাড়া দিয়ে ঘর ছাওয়ার ধুম পড়ে যেত। বছরে একবারই হয় গম। ঘরও ছাওয়া হতো তাই একবারই। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকতাম। ঘরের চাল থেকে পুরোনো নাড়া সরানো হতো, তখন খোলা চালের ভেতর দিয়ে আসা সূর্যের আলো পাল্টে দিত ঘরের চেহারাটাই। কেন যেন আলগা রান্নাঘরাটাকে অন্য রকম লাগত আমার। তারপর সারা দিন ধরে ঘরামিদের কাজ দেখতাম। এখন আর কেউ নাড়া দিয়ে ঘর ছায় না। ঘরামি পেশাটাও বিদায় নিয়েছে গ্রাম থেকে। আজও আমার ঘরামিদের জন্য মন কেমন করে। মন কেমন করে রান্নাঘরের খোলা চাল দিয়ে দেখা বৈশাখের দুপুরটার জন্যও।

দুপুরের মতো গাঁয়ের রাতটাও অন্য রকম ভালোবাসা হয়ে আমাদের শৈশবটাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। গরমের ছুটি হতো প্রায় ১৫ দিনের। স্যাররা বলতেন আম খাওয়ার ছুটি। মা–ও অপেক্ষা করতেন আমার এই ছুটির জন্য। স্কুল ছুটির পরদিনই মামাবাড়ি যেতাম। গরুর গাড়ি চেপে। খরবৈশাখের এক দুপুরে যাচ্ছিলাম। পথে খুব পানি পিপাসা পেল। বড় মামা আছেন সঙ্গে। গুড়দহ নামে একটা বাজারে গাড়ি থামানো হলো। মামা পানি নিয়ে এলেন হোটেল থেকে। সঙ্গে ডালপুরি। গরমে ক্লান্ত, পিপাসার্ত সেই ছোট্ট মুখে প্রথম ডালপুরির স্বাদ আজও জিবে জল এনে দেয়। ডালপুরি খেয়ে সবে গাড়ি ছাড়ার জোগাড় চলছে, তখন বাজারের আরেক কোনায় চলে গেল চোখ। একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ। বিশাল তার আকার। তার মাথায় যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে বৈশাখের লেলিহান শিখা। ভরবৈশাখের দুপুরে দূর থেকে যারা ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়াগাছ দেখেনি, তারা আসলে দুর্ভাগা। কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার নিচে এত ভিড় কেন?

একটা দলছুট হনুমান এসেছে। তাকে ঘিরে উৎসাহী বালকদের জটলা। কেউ কলা ছুড়ে মারছে, কেউ একটা রুটি, হনুমানটা দক্ষ ফিল্ডারের মতো লুফে নিচ্ছে কলা কিংবা পাউরুটির ক্যাচ। কেউ আবার ভেংচি কাটছে। দাঁত–মুখ খিঁচিয়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছে হনুমানও। হনুমান আমার সেই প্রথম দেখা। ডালপুরি, ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া, একটা দলছুট হনুমান, একটা গ্রাম্য বাজার আর বৈশাখের দুপুর একাকার হয়ে একটা ল্যান্ডস্কেপ হয়ে আমার মগজে ছাপ রেখে দিয়েছিল। বহু বছর পর যখন কলেজে ভর্তি হয়েছি, তখন সেই বাজারে মেস বানিয়ে থাকতাম বন্ধুদের সঙ্গে। তখনো সেই কৃষ্ণচূড়াগাছটা ছিল, ছিল সেই ডালপুরির দোকানটাও। সেবার বৈশাখে যখন ফুলে ফুলে ভরে গেল গাছটা, সেই দলছুট হনুমানটার কথাই সবার আগে মনে পড়েছিল।

২৫ কিলোমিটার দূরের মামার বাড়ি পৌঁছাতে সারাটা দিন লেগে যেত। গরুর গাড়ি বলে কথা। সন্ধ্যায় পৌঁছাতাম মামার বাড়ি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জগৎটাই বদলে যেত। মামারা নিম্নমধ্যবিত্ত। কাঁচা খড়ের চালের বাড়ি। কিন্তু ছিমছাম, সাজানো–গোছানো। বড় উঠানের অর্ধেকটাই দখল করে ছিল বিশাল একটা ফুলের বাগান। গোলাপ, রঙ্গন, ঝাউ, টগর, রজনীগন্ধা, দোপাটি, বাগানবিলাস, পেনসিল ক্যাকটাস আর হরেক রকম মৌসুমি ফুল। বাড়িতে ঢোকার আগে বহির্বাটি। দুটি আমগাছ, দুটি জামগাছ মাঝখানে। পশ্চিম পাশে কাঁচা খড়ে ছাওয়া বৈঠকখানা। গ্রাম্য বিচার–সালিস নানা এখানে বসেই করতেন। রাতে সেখানেই ঘুমাতেন ছোট মামা। তার আগে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কলব্রিজ চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। আমি খেলা দেখার ছুতোই সেখানে রয়ে যেতাম। আসলে খেলার চেয়ে গন্ধই আমাকে বেশি টানত। বৈঠকখানার সামনেই একটা বুড়ো কামিনীগাছ। টগর, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ আর হাসনাহেনা তার বন্ধু। বৈশাখের রাতে পূর্ণিমার চাঁদ যখন রুপালি আগুন ঝরায় পৃথিবীতে, তখন পাঁচ ফুলের সুবাসে আমি যেন মারা যেতাম। ঠিক যেমন করে ছোট কিছুর জন্য মারা যেতে চাইতেন বিখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। কী সুখের অনুভূতি! সেই গাছগুলোর একটাও আজ অক্ষত নেই। ২০১৯ সাল পর্যন্তও অক্ষত ছিল বুড়ো কামিনীগাছটা

বৈশাখের যে রাতগুলো নিজেদের বাড়িতে কাটত, সেগুলোও অন্য রকম সুন্দর ছিল। সে অন্ধকার রাতই হোক, কিংবা জোছনার মায়াবী রাত। বৈশাখে রাতেও ভীষণ গরম পড়ে। তখন তো গ্রামে বিদ্যুতের বালাই ছিল না। হাতপাখা আর কতক্ষণ টানা যায়! কিন্তু অবারিত খোলা আকাশ আছে। চাচা-চাচি, ভাই-বোন নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার আমাদের। খাওয়া আলাদা হলেও বাড়ি একটা, বিশাল তার উঠোন। ছাদেও প্রচুর জায়গা। উঠোনে বাঁশের মাচা থাকত, কখনো কখনো খেজুরপাতার পাটি বিছিয়েও বসে পড়তাম আমরা। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোনদের মধ্যে কত্ত গল্প! বেশির ভাগই ভয়ের। বিশেষ করে অন্ধকার রাতে। ভয়টা যেমন ভূতের গল্পে পেতাম, তেমনি শিয়াল, নিমপ্যাঁচা কিংবা রাতচরা পাখিদের নিয়ে কত ভুতুড়ে কাহিনি। আকাশের তারাদের নিয়ে কত গল্পগাথা। তখন জোনাকির দল একটা–দুটো করে এসে একসময় এক শ–দু শ তিন শ করে ঝাঁক বাঁধে উঠোনের নিমগাছটাকে ঘিরে। হঠাৎ একটা নিমপ্যাঁচা কুউ কুউ করে ডেকে ওঠে ভীতিকর স্বরে। ভয়ে সিঁটিয়ে যাই আমরা। তখনই হয়তো দূর মাঠ থেকে আসে শিয়ালের ডাক। অন্য পাশ থেকে তখন জবাব দেয় আরেকজন। এভাবে চারপাশে থেকেই রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। আরেকবার ভয় পাই আমরা। তখনই হয়তো ঘরের পেছন দিকে ভাঁট আর আসশেওড়ার যে জঙ্গল আছে, সেখান থেকে বিকট চিৎকার! ট্রাউ-ট্রাউ-ট্রাউ। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তখনো জানতাম না, মাঝদুপুরে বাঁশবাগানে যে ছদ্মবেশী পাখিটাকে প্রায়ই ধরার চেষ্টা করি, সেই রাতচরাই এভাবে ডাকে। অথচ একে নিয়ে কত কিংবদন্তি!

এই যে এত ভয়, সাপ, শিয়াল, রাতচরা, নিমপাখি, ভূতপ্রেতের গল্প, তা সত্ত্বেও জীবনটা সুন্দর ছিল। ভয়ের সঙ্গে তপ্ত দুপুর, গরম রাত, উষ্ণ হাওয়া, ভাঁটফুল, আমের মুকুলের গন্ধ মিলিত হয়ে অদ্ভুত ঘোরলাগা নস্টালজিয়া তৈরি করেছিল, তা এখনো খুঁজে বেড়ায় অফিসের চারপাশে, রাজধানীর উদ্যানে, নদীর তীরে কিংবা শহর থেকে দূরে। কিন্তু যে শৈশব বিদায় নিয়েছে, যে নস্টালজিক গন্ধ হারিয়ে ফেলেছি, তা আর ফিরে পাব না কখনো। তাই স্মৃতির নিউরনে ঢুঁ মারি প্রতি রাতে। সেই ডালপুরির স্বাদ পরখ করি, হনুমানটাকে ইশারা দিই, চুরি যাওয়া বৈশাখের দুপুরটাকে মাঝরাতে ডেকে আনি শোবার ঘরে—রোমন্থনে, স্বপ্নে।

পৃথিবী বদলে গেছে, বদলে গেছে সংস্কৃতি। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাকে মেনে নিতেই হবে। গ্রামে এখন বিদ্যুৎ আছে, ব্রডব্যান্ড লাইন আছে, ল্যাপটপ-স্মার্টফোন আছে। আছে ফেসবুক-টুইটারও। আছে আমবাগান, বাঁশবন, ভাট-আসশেওড়ার দঙ্গল। রজনীগন্ধা, টগর, হাসনাহেনা, গন্ধরাজেরা আজও গন্ধ বিলায়। কিন্তু এগুলো কি সেভাবে অনুভব করতে পারে এ প্রজন্ম? না করলেও ক্ষতির কিছু নেই। নিজেদের শৈশবকে নিজের মতো করেই তারা উপভোগ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যারা পৃথিবীটাকে বদলে যেতে দেখেছি, ঘুঘুর ডাক যাদের বৈশাখী দুপুরটা চুরি করে নিয়ে গেছে, খুব ছোট কিছুর জন্য আজও তারা মারা যাবেন।