অবসাদ সময়ের বন্ধু

প্রকৃতিপ্রেমী জীবনানন্দ দাশ নিজের নির্ভয়া আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন ঝাউ-শিরীষ গাছের তলে। দেশিকোত্তম কবি কালিদাস তরুতলে বসে আওড়েছেন শত কবিতা। মানুষ এমন এক আশ্চর্য প্রাণী, যে কিনা নির্বাক তরুলতার সঙ্গে প্রেমের, সখ্যের ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

কত শিশু এখন ভাবছে, এই বুঝি কাল সকাল হলেই জুতা-মোজা আর কাঁধে ব্যাগটি ঝুলিয়ে স্কুলে যাবে। কত কিশোরের চোখে স্বপ্ন, বিকেলবেলা পাড়ার মাঠে শখের ফুটবলটার সঙ্গে দুরন্তপনা করবে। কত তরুণ টিউশনের টাকা জমিয়ে একটা ক্যামেরা কেনার সাধ করেছে। কিন্তু এই স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যেন বাদ সেধে বসেছে মহামারি করোনা।

তাই যখন নিজেদের বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছি ঘরে, তখন ক্ষণিকের অবসরে মনে হচ্ছে, এই সামাজিক দূরত্বে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছি না তো? স্বপ্নগুলো ট্রাফিক জ্যামের মতো থমকে যাচ্ছে না তো? প্রিয় মানুষগুলোর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কিংবা রোগের সংক্রমণে মৃত্যুর হার দেখে মানসিক অবসাদে ভুগছি না তো?

জীবন মানেই আশা-নিরাশা, উত্থান-পতন। এই ক্রান্তিকালে আমাদের সব সময় থাকতে হবে হাসিখুশি ও ইতিবাচক। কারণ, উদ্বেগ থেকে জন্ম নেয় ভয় আর ভয় থেকেই হতাশা, যা কিনা বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে পদদলিত করে। পরিবারের সঙ্গে যথাসম্ভব সময় কাটানো কিংবা শখের কাজগুলো পূরণ করার এই তো সময়। আর কেউ যদি হয় বৃক্ষপ্রেমী, তবে খুব কম আয়োজনে নিজের সাদামাটা ব্যালকনিটাকে মুহূর্তেই গড়িয়ে নিতে পারেন সবুজ সোনার খনিতে।

একাকী ঘরবন্দী এই জীবনে তোমার বন্ধু হতে পারে বারান্দার কোণে রাখা চামেলী কিংবা গোলাপগাছটি। ব্যালকনির গ্রিলে ঝুলে থাকা মানিপ্ল্যান্ট কিংবা অলকানন্দায় পানি দিতেই যেন মনে হয় নিজের ইচ্ছার গোড়ায় পানি দিচ্ছি। এ যেন দুই হৃদয়ের মাঝে এক আত্মিক বন্ধন।

ক্যাকটাস–জাতীয় গাছ খুব কম আলো-বাতাসেও বাঁচতে পারে। এগুলো দেখতে যেমন বেশ নান্দনিক, তেমনি অল্প জায়গায় বেড়ে ওঠে বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই। বাড়িতে এই সময়ে থাকা পুরোনো কনটেইনারে চকপিট মাটি আর জৈব সার মিশিয়ে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখতে পারো নানা জাতের বাহারি ক্যাকটাস। এ ছাড়া এই বর্ষায় বেলি, কাঠমালতি, কেয়াজাতীয় ছোট আকারের গাছের ফুল যেমন সুগন্ধ ছড়াবে, তেমনি তোমার ছোট বারান্দায় মানিয়ে যাবে সহজেই। টিএসপি আর পটাশ সার এসব চারার যত্নে বেশ উপকারী। ঘরে আলো-বাতাসের স্বল্পতা থাকলেও জানালার পাশে মাঝারি আকারের পাতাবাহার খুব সহজেই বেড়ে ওঠে। কারও ছাদে খালি জায়গা থাকলে সেখানে পুরোনো প্লাস্টিকের বালতি, পুরোনো নষ্ট রেফ্রিজারেটরের বডি কিংবা মাটির টবে দোআঁশ ও বেলে মাটির সঙ্গে কম্পোস্ট সার মিশিয়ে বিভিন্ন সবজির বীজ বপন করতে পারো। দিন দশেক পর গজিয়ে যাবে সুন্দর কুমড়ো, শসা, বিটি বেগুন কিংবা টমেটোর চারা। আজকাল ছোট পরিসরে বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন জাতের অর্কিড ও ফণীমনসার চাষ করা হচ্ছে। তবে প্রজাতিভেদে এসব গাছের দাম যেমন একটু চড়া, তেমনি পরিচর্যা করাও বেশ কঠিন।

এই পরিশ্রমের ফলও বেশ তৃপ্তির। তাজা গোলাপের ঘ্রাণ আর কামিনী ফুলের মোহময়তা যেমনি তোমাকে মুগ্ধ করে তুলবে, তেমনি তোমার অবসাদ ভুলিয়ে একাকিত্বকে দূরে সরিয়ে দেবে। বিকেলবেলা ঝুলবারান্দায় বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর মিষ্টি গানের তালে তোমার সঙ্গে প্রিয় গাছগুলোও দুলে উঠবে। তাই তো গাছ আমাদের পরম বন্ধু। তরুলতা তার বাহুডোরে যেন তোমাকে বেঁধে রাখবে আপন গৃহে।

লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী ২০২০, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস কলেজ, ঢাকা
ছবিতে আছে: সুকন্যা, পঞ্চম শ্রেণি, হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা