আমাদের ভূত-টুতের গল্প

বুরুন অতিশয় শান্ত একটা ছেলে ছিল; এই আমার মতো। অঙ্কে খুব একটা ভালো না, ইংরেজিতে একটু কেমন যেন সমস্যা হয়। স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়াটা কিছুতেই হয় না। লাফ, বিস্কুট দৌড়; কোনো কিছুতেই মেডেল মেলে না।

সেই বুরুন একদিন বদলে গেল। ক্লাস ফাইভের বুরুন দিব্যি কলেজের সব অঙ্ক কষে ফেলতে লাগল। ইংরেজিতে বাঘা বাঘা স্যারদের ঘোল খাইয়ে দিল। আর দৌড়ে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলল। ব্যাট করতে নেমে ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙে দিল। লাফ দিয়েও বিশ্ব রেকর্ড করতে পারত। করল না, লোকে কী মনে করবে, তাই ভেবে!

বুরুন কী করে এমন বদলে গেল?

কারণ আর কিছুই না। বুরুনের সঙ্গে একটা ভূত ছিল—নিধিরাম। নিধিরাম যখন বেঁচে ছিল, মস্ত এক পালোয়ান ছিল। এখন ভূত হয়ে গেছে। ভূত হয়েও তার শক্তি মোটেও কমেনি। মাঝে মাঝে একটু পেটে ব্যথা হয়, দাদুর পাচন খেয়ে ঠিক হয়ে যায়। পেটে ব্যথা না থাকলেই নিধিরাম ভূত বুরুনের হয়ে সব কাজ করে দেয়।

এ আবার কেমনতর ভূত! হ্যাঁ, এ হলো শীর্ষেন্দুর ভূত। মানে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার জগতে তৈরি হওয়া ভূত। শীর্ষেন্দুর ভূতেদের গল্প বলেই শেষ করা কঠিন। তার ভূতেরা এমনই। কেউ মানুষের ভয়ে জড়োসড়ো, কেউ বুড়োদের হুকুম তামিল করতে ব্যস্ত, কেউ আবার শীতে বড় কষ্ট পায়, কেউ বাচ্চাদের উপকার করে বেড়াচ্ছে। এরাই সব শীর্ষেন্দুর ভূত।

বাংলা সাহিত্যে শীর্ষেন্দুর ভূতেরা খুব নাম করে ফেলেছে। তাই বলে ভূত যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একার সম্পত্তি, এমনটা ভেবো না। আসলে তোমরা এমন ভাববেই বা কেন? এই বয়সেই আমি নিশ্চিত, তোমরা শত শত ভূতের গল্প পড়ে ফেলেছ। আর বুঝে ফেলেছ, আমাদের এই বাংলা ভাষায় এমন দুষ্টু-মিষ্টি থেকে শুরু করে একেবারে শরীর ঠান্ডা করে দেওয়া ভূতেদের কোনো অভাব নেই। আমাদের ভূতের ইতিহাস প্রায় বাংলা সাহিত্যের সমান বয়সী।

এই ঠাকুরমার ঝুলির কথা ধরো না কেন। শ্রীদক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের এই হিরের টুকরোর সংকলন আজও কিন্তু আমার খুব প্রিয় বই। এরপর এই ভদ্রলোক আরও তিনখানা এমন চমৎকার বই দিয়ে গেছেন আমাদের—ঠাকুরদাদার ঝুলি, দাদা মশায়ের ঠোলায়ঠানদিদির ঝোলায়। তিনটে বইজুড়েই তুমি দেখা পাবে পেতনি, শাকচুন্নি, চোরাচুন্নি, মেছোভূত, গেছোভূত, ব্রহ্মদৈত্য, স্কন্ধকাটা, এমনকি কানাভুলো বা ডাইনিরও গল্প।

বুঝতেই পারছ, সেই আদিকাল থেকে আমাদের সাহিত্যে কত শত ভূতের ঘোরাঘুরি। যদিও বাংলার নয়, তারপরও আদিকালেই বেতালের গল্প বা ইশপের গল্পেও ভূতরা দিব্যি যাতায়াত করেছে।

এরপর তোমরা কষ্ট করে যদি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, হেমেন্দ্র রায়, পরশুরাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটদের জন্য লেখাগুলো পড়ে ফেলো, দেখতে পাবে আরও সব মজার মজার ভূত। দারুণ ভূত আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের কাছেও। তাঁদের ভূতেরা রীতিমতো জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতো কারও কারও ভূত ঠিক মজার আর থাকেনি, ভয়ের ভূতই হয়েছে বটে। একজন মহান লেখকের নাম শুনে থাকবে তোমরা—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশি ভূতের গল্প লেখেননি। তবে ‘হলুদ পোড়া’ বলে যে একটা গল্প লিখেছেন, তা সারা জীবনের ভয়ের ব্যাপার হয়ে থাকতে পারে।

এ তো গেল দুই বাংলা মিলিয়ে আজকের ভারতের পশ্চিম বাংলার ভৌতিক ব্যাপারস্যাপার। আমাদের এখানে, মানে ঢাকা থেকে যে সাহিত্য হয়েছে, তারও শুরু থেকে দারুণ সব ভূতের উপস্থিতি টের পাবে। সেকালের কথা না বলে একটু এগিয়ে এলে দারুণ সব ভূত এসেছে আমাদের তিন সোনার কলমের মালিক ভ্রাতা হুমায়ূন আহমেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবের কাছ থেকে। এ ছাড়া সেবা প্রকাশনী থেকে মৌলিক ও বিদেশি ভূতের যে কত গল্প বের হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সব গল্পই আলাদা আলাদা করে ভুতুড়ে, মজার ও ভয়ের। সব এটুকু জায়গায় বলি কী করে!

তবে হুমায়ূন আহমেদের কথা একটু আলাদা করে না বললে অন্যায় হয়ে যাবে।

এই কিংবদন্তি লেখক বড়দের জন্য লিখেছেন, মেজোদের জন্য লিখেছেন, ছোটদের জন্যও লিখেছেন। মজার মজার সব ভূতের গল্প লিখে আলাদা একটা বইও বের করেছিলেন। সেখানে তোমরা ভূত নয় শুধু, টুতদেরও গল্প জানতে পারবে। কী সব অসহায়, দুষ্টু ভূতদের গল্প!

তবে শেষবেলায় হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্প আজই পড়ে ফেলতে বলছি—ভয়।

ভয় গল্পে কোনো ভূত নেই; এক্কেবারেই ভূত নেই। একটু পারলে সাহস করে পড়ে ফেলো। টের পাবে, ভূত ছাড়া কী করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়টা আসতে পারে। ভয় এক ভূতহীন ভূতের গল্প।

এবার বসে পড়ো টেবিলে বইগুলো নিয়ে। তারপর বলো দেখি, কোন ভূতের জোর বেশি?

শুধু দেশি ভূত-টুতের গল্প করলাম। লোকে কী বলবে? একটু বিদেশি ভূতের গল্পও করা উচিত ছিল। কিন্তু মুশকিলটা হয়েছে কী, বাংলার বাইরে যে অগুনতি ভাষায় লাখো ধরনের, লাখো রুচির ভূতের গল্প সেই আদ্যিকাল থেকে শিহরণ জাগিয়েছে, সেসব কী আর দুই মলাটে আটকে ফেলা সম্ভব!

এই ধরো শুধু ইউরোপের কথাই যদি ধরো, তাহলে সেই মহান কবি হোমারের ওডিসি মহাকাব্যে ভূতদের খুঁজে পাবে। এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী এগিয়ে আছে ইউরোপ, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকায়; রুশ, ফরাসি, ইংরেজি সাহিত্যে হু হু করে বেড়েছে ভূতের প্রভাব। শেক্সপিয়ারের মতো মহান নাট্যকার একের পর এক ভূতের গল্প বলেছেন। হ্যামলেটে বলা গল্প তো দুনিয়ার কিংবদন্তি হয়ে আছে।

সে যুগের কথা বাদ দিয়ে ভূতের স্বর্ণযুগ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যদি আসো, তাহলে দেখতে পাবে এডগার অ্যালান পো থেকে শুরু করে সেদিনের ব্রাম স্ট্রোকার পর্যন্ত একেবারে অবশ করে রেখেছেন ভয়ংকর সব ভূতের গল্প দিয়ে।

এখানে একটা মজা আছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলার ভূতের সাহিত্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটদের জন্য লেখা বলে সন্দেহ হয়। বড়দের জন্য যেন ভূতের গল্প হতে নেই। কিন্তু বিদেশি ভূতের গল্পে ছোটদের পাশাপাশি একেবারে বড়দের জন্যও গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাওয়া সব গল্প লেখা হয়েছে।

আজও রাতে সেই ভয়ানক দুর্গে বড়দেরই হাতছানি দিয়ে ডাকে লম্বা এক ওভারকোট পরা দুটো রক্তভেজা দাঁত বের করা ড্রাকুলা।

থাক। আজ রাতে আর বাইরে বের হয়ো না।