কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ও আমার ‘রকিব হাসান’ হয়ে ওঠার গল্প

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসানছবি : কবির হোসেন, কিশোর আলো
২০১৫ সালে কিশোর আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জনপ্রিয় লেখক রকিব হাসান জানিয়েছিলেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার ও মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার গল্প।

আমার ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালো লাগে। মানে বই পড়তে ভালো লাগে না শুধু, ছাপার অক্ষর এতই পছন্দ, রাস্তায় যদি ঠোঙা পড়ে থাকত, সেটাও তুলে নিয়ে পড়তাম। ওর মধ্যে কী লেখা আছে সেটা মূল কথা না, ছাপার অক্ষরটাই আসল। পড়তে পড়তেই বড় হলাম, তো দেখলাম বাংলা বইয়ের সংগ্রহ আর তেমন নেই, বাংলা বই তেমন পাওয়া যেত না আমার সময়ে। আমার তখনকার সম্বল ছিল ভারত থেকে আসা বই, সেগুলোও খুব একটা পাওয়া যেত না। যেগুলো যেত সেগুলো পড়ে পড়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম—শরৎচন্দ্র মুখস্থ, নীহাররঞ্জন মুখস্থ, যেটা পাই সেটা-ই মুখস্থ। দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন। আরও ছিল স্বপনকুমার সিরিজ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফেনী শহরে থাকতাম তখন, ওখানে বই পাওয়াটা খুব কঠিন। তারপরেও একটা বড় সুবিধা ছিল যে আমাদের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বইয়ের ভক্ত। যার ফলে পাঠাগারটা ছিল অস্বাভাবিক সমৃদ্ধ। ইংরেজি এবং বাংলা বই সবই ছিল। আমি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র না, কাজেই উপন্যাস বোঝার মতো অবস্থা নেই। পড়ালেখার ইংরেজি আর উপন্যাসের ইংরেজি এক না। শিকারের গল্প আমার খুব প্রিয়। জিম করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতার অনুবাদ পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। ক্লাস সিক্স বা সেভেনে। ও ভারত থেকে বই আনাত। বইটা অর্ধেক পড়ার পরেই ঘণ্টা পড়ে গেল—ছুটির ঘণ্টা। আমার বন্ধু, যেহেতু ওটা নতুন বই, সেটা আমাকে দিল না। পরে দিবে বলে নিয়ে গেল এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে বইটা সে হারিয়ে ফেলল। ফলে রুদ্রপ্রয়াগের চিতা আমার কল্পনার যে জায়গাটাতে ছিল, ওই জায়গাতেই আটকা পড়ে রইল। পরে মূল ইংরেজি বইটা আমি পেলাম আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের পাঠাগারে। ওখান থেকে এনে পড়া শুরু করলাম। বারবার ডিকশনারি দেখতে হয়েছে, কিন্তু দেখলাম যে পারি। তখন থেকে ইংরেজি কাহিনি পড়তে লাগলাম। ইংরেজি বইয়ের দোকানে ঘুরতাম অনেক, পুরোনো বইয়ের দোকানে।

ঢাকায় তখন অনেক পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল, এখনই বরং কমে গেছে। একদিন এক পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক বসে আছেন—খুব শুকনো একজন ভদ্রলোক। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, ঝাঁকড়া চুল মাথায়, সেগুলো ব্যাকব্রাশ করা, একটা কালো চশমা, একটা ইজিচেয়ারের মতো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বসে পা দোলাচ্ছেন আর গভীর মনোযোগের সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছেন একটার পর একটা। দোকানদার বলল, ‘অনেক নতুন বই আসছে।’ আমি দেখেটেখে বললাম, ‘ধুর! এগুলো সবই তো পুরোনো, আমার পড়া। নতুন বই তো তুমি কিছু আনো নাই।’ তখন ওই লোক সিগারেটটা সরিয়ে বললেন, ‘আপনি কী করেন?’ আমি বললাম, ‘আমি কিছু করি না।’ বললেন, ‘আপনি তো অনেক বইয়ের নাম জানেন।’ বললাম, ‘আমি পড়ি।’ তিনি বললেন, ‘আপনি কি মাসুদ রানা পড়েছেন?’ বললাম, ‘পড়েছি।’ তিনি বললেন, ‘কেমন লাগে আপনার?’ বললাম ‘কাজী আনোয়ার হোসেন আমার খুব প্রিয় মানুষ হয়ে গেছেন মাসুদ রানার কারণে।’ বললেন, ‘এগুলো তো বিদেশি বই থেকে লেখা হয়, সেটা জানেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, জানি।’ বললেন, ‘বইয়ের প্লট কী করে জোগাড় করতে হয় সেটা জানেন?’ বললাম, ‘জানি না।’ উনি বললেন, ‘আমরা ইংরেজি বই পড়ে বিদেশি বইয়ের ছায়া অবলম্বনে বই লিখি। আপনার তো অনেক বই পড়া আছে, আপনি এমন এমন সব লেখকের নাম বললেন যেগুলো আমি জানিও না!’ আমি বললাম, ‘আপনাকে তো চিনলাম না।’ দোকানদার তখন পরিচয় করিয়ে দিল, ‘উনি শেখ আবদুল হাকিম।’

শেখ আবদুল হাকিম। তাঁর সঙ্গে রকিব হাসানের প্রথম দেখা হয়েছিল নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে

তখন আমি বললাম, ‘ও, আপনিই শেখ আবদুল হাকিম! আপনিই কাজী সাহেবের ছদ্মনামে মাসুদ রানা লেখেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘সে জন্যই তো ইংরেজি বইয়ের খোঁজ চাচ্ছি। আপনি যেগুলোর নাম বললেন, সেগুলো তো আমার চেনা না। অজানা, অনেক নাম। এগুলোর মধ্যে কি মাসুদ রানার প্লট আছে?’ আমি বললাম, ‘প্লট তো আছেই।’ বললেন, ‘আপনি প্লট দিতে পারবেন?’ আমি বললাম, ‘পারব। অনেক প্লটই দিতে পারব।’ তিনি বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হলো না।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” তিনি বললেন, ‘আমরা প্লট খুঁজে খুঁজে হদ্দ, বই-ই পাই না।’ আমি বললাম, ‘আপনি তো অনেক বইয়ের লেখকের নামই জানেন না। আপনি প্লট পাবেন কোথায়?’ তখন আমি একটু রুক্ষ স্বভাবের ছিলাম। বয়স অনেক কম। হাকিম সাহেব পা দুলিয়ে সিগারেট খাচ্ছেন, ওই জিনিসটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কারণ, আমি সিগারেট খাই না। ধোঁয়া ছাড়ছেন, সেটা আমার নাকে লাগছে, হাত দিয়ে থাবা মেরে সেই ধোঁয়া সরাতে হচ্ছে, তাতে আমি রেগে গিয়েছিলাম তাঁর ওপরে। তারপরে উনি সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘বলেন তো কয়েকটা ইংরেজি বইয়ের নাম?’ বললাম। হাকিম সাহেব দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কি ওসব বই আছে?’ দোকানদার বলল, ‘না, এখানে নেই।’ হাকিম আমাকে বললেন, ‘আপনি কি তাহলে আগামী শুক্রবার সেবা প্রকাশনীতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন? আমি কাজী সাহেবকে বলে রাখব। দুইটা মাসুদ রানার প্লট নিয়ে দেখা করতে পারবেন?’ বললাম, ‘পারব। দুইটা না, দশটা নিয়ে দেখা করব।’

আমি দশটাও না, বারোটা নিয়ে দেখা করেছিলাম। কাজী সাহেবকে দেখেই আমার পছন্দ হলো। শেখ আবদুল হাকিমও খুব ভালো মানুষ, পরে যখন রহস্য পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গেছি, তখন বুঝলাম আমিই হচ্ছি এই পুরো দলটার মধ্যে বাজে লোক... হা হা। এঁরা সবাই অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, আমি দুর্বিনীত। সবার মধ্যে বয়সও কম আমার। ২৭ বছর।

হাকিমের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, অথচ শুক্রবার দিন যেতেও ইচ্ছে করছে। কারণ সেবা প্রকাশনী—কাজী আনোয়ার হোসেন থাকেন—এমন একটা জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব! শেষ পর্যন্ত যা থাকে কপালে ভেবে বারোটা বই ব্যাগের মধ্যে নিয়ে গেলাম।

কাজী সাহেবের অফিসটা তখন একটা টিনের বাড়ি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমি উঁকি দিলাম। উঁকি দিয়ে দেখি একজন ভীষণ কট্টর মেজাজের লোক বসে বসে লিখছে। কাজী সাহেবের হিসাবরক্ষক। সালাম দিলাম, তাকালেন না। খুব ভয়ে ভয়েই ‘এই যে ভাই’ বললাম, একটু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বললাম, ‘শেখ আবদুল হাকিম সাহেব কি এসেছেন?’ খুব রুক্ষভাবে মুখ ভেংচে তিনি বললেন, ‘কত লোক যে আজ হাকিম সাহেবকে খুঁজল!’ আমি বুঝলাম, আমার এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত, আর হবে না। এমন সময় ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে? নাম জিজ্ঞেস করুন।’ দেখলাম হিসাবরক্ষক সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতেই পারেননি কাজী সাহেব অন্য দরজা দিয়ে নিজের অফিস ঘরে ঢুকে বসে আছেন। হিসাবরক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কী নাম?’ বললাম, ‘রকিব।’ ভেতরের অফিস থেকে জবাব এল, ‘আসতে বলেন।’ ঢুকলাম। কাজী সাহেব বসে আছেন, বললেন, ‘হাকিম সাহেব চলে আসবেন এখনই।’ হাকিম সাহেব এলেন খানিক পরে। তাঁকে আমি ইংরেজি বইগুলো দিলাম।

এ-ই হচ্ছে সেবা প্রকাশনীতে আমার ঢোকার গল্প। সম্ভবত সেটা ’৭৭-এর শেষ দিকে।

কাজী আনোয়ার হোসেন

পাঁচ-সাত দিন পরে কাজী সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেদিন বিকেলে দেখা করতে বললেন। ভাবলাম, কিছু অপমান-টপমান আছে কপালে। কারণ, বড় বড় কথা বলেছি তো! বয়স কম, আত্মবিশ্বাসের কিছুটা অভাব আছে। তারপরও হঠাৎ করে শক্ত হয়ে গেলাম। কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম, শাহাদত চৌধুরী, সাজ্জাদ কাদির, জ্ঞানে-গুণে বড় বড় সব মানুষ—আমার তাতে কী? আমার মতো ইংরেজি বই তো তাঁরা পড়েননি... হাহা। সবাই আমার চেয়ে কম পড়ছেন। তখনো জানি না, ওঁরা কোনো অংশেই আমার চেয়ে কম পড়া মানুষ নন। আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত, বয়সে বড়, অভিজ্ঞ। আমি ভাবলাম, হতে পারেন কেউ বড় কবি, কেউ পত্রিকার সম্পাদক, কেউ লেখক; কিন্তু আমার মতো এত ইংরেজি থ্রিলার কেউ পড়েননি। এসব ভেবে নিজেকে বোঝালাম আরকি, সাহস সঞ্চয় করলাম। গেলে আর কী হবে? বড়জোর বলবেন, আপনার বই দিয়ে মাসুদ রানা হবে না। তখন চলে আসব।

তারপর গেলাম সেবায়। আমাকে বসতে বলা হলো। হাকিম শুরুতেই বললেন, ‘ভাই, এত পড়লেন কী করে? এত অল্প বয়সে?’ বললাম, ‘একটা বই পড়তে দু-তিন দিন লাগে, কত বই-ই তো পড়া যায়!’ তিনি বললেন, ‘আপনার বইগুলো প্রায় সবগুলোই হবে।’ কাজী সাহেব একটু নাটক করে বলতে চেয়েছিলেন, হাকিম তাঁকে সেটা করার সুযোগ দিলেন না, প্রথমেই আসল কথাটা ফাঁস করে দিলেন। আমি বললাম, ‘ওই দিন আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি দোকানে...’ বাধা দিয়ে হাকিম বললেন, ‘ধুর সাহেব, কবে ভুলে গেছি সে কথা! আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, এতগুলো মাসুদ রানা দিয়েছেন। আমি তো প্লট পাচ্ছিলাম না, লিখতে পারছিলাম না।’ তখন আমি চিন্তা করলাম পড়তে পারি, লিখতে অসুবিধে কী? আমি একটা মাসুদ রানা লিখব। একটা বই পড়লাম, খুব ভালো একটা বই ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো, এটা মাসুদ রানা হয়েই আছে। কাজী সাহেবকে গিয়ে বললেই হয়। তারপরে গিয়ে কাজী সাহেবকে বললাম যে এই বইটা মাসুদ রানা হয়। তিনি বললেন, ‘যেগুলো দিয়েছেন, ওগুলোর চেয়ে ভালো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, ওগুলোর চেয়ে ভালো।’ তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘এটা আগে না দিয়ে নিজে রেখে দিলেন কেন?’ বললাম, ‘হাতের কাছে যা পেয়েছি তা-ই নিয়ে ছুট দিয়েছিলাম।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘তো, লিখতে পারবেন?’ বললাম, ‘আমি পারব কি না আপনি বলেন।’ তিনি বললেন, ‘পারবেন।’ আমি বললাম, ‘কী করে বুঝলেন পারব?’ তিনি বললেন, ‘কারণ, আপনি পড়তে পারেন। লিখতে পারার মূলে হলো পড়া। আপনার বাংলাও পড়া আছে, ইংরেজিও পড়া আছে।’ সেই প্রথম একটা মাসুদ রানা লিখলাম। ভুল-ভাল হয়েছিল অনেক। কাজী সাহেব বইটা পড়লেন। পড়ে আবার ডেকে পাঠালেন। গেলাম এবার ভয়ে ভয়ে। পাণ্ডুলিপিটা আমার সামনে ছেড়ে দিলেন। দেখলাম যে অনেক লাল কালির দাগ, বানান ভুল, কাটাকুটি। ভাবলাম, আমাকে দিয়ে হবে না। উনি বললেন, ‘না, হবে। হয়েই আছে। খুব ভালো লিখেছেন।’ আমি একটু সাহস পেলাম। তিনি বললেন, ‘এই এই জিনিসগুলো একটু মেরামত করে নিয়ে আসেন। তারপর হাকিমকে দিয়ে সম্পাদনা করাব। সবশেষে আমি দেখব।’ সেসব করার পর বেরিয়ে গেল মাসুদ রানার বই। খুব সহজেই বলতে হবে। তখন সাহস পেয়ে গেলাম। বললাম এরপর কী লিখব? উনি বললেন, ‘মাসুদ রানা আর লিখতে যেয়েন না। কারণ এটা লিখতে অভিজ্ঞতা দরকার, অনেক কঠিন কাজ। আপনি সহজ কোনো কাজ দিয়ে শুরু করেন।’ পরে চিন্তা করলাম যে কী দিয়ে শুরু করতে পারি? জুল ভার্ন আমার খুব ভালো লাগত। বললাম যে জুল ভার্ন অনুবাদ করলে কি চলবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চলতে পারে। আপনি চেষ্টা করেন।’ বললাম, ‘মাসুদ রানা তো লিখলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে, জুল ভার্ন-এর অনুবাদটায় কী হবে?’ হাকিম আমাকে সাবধান করল, ‘রকিব! খবরদার! নিজের নামে লিখতে যেয়েন না! কাজী সাহেবকে রাজি করান। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে অনুবাদ করেন।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল, ‘ওই নামে লিখলে ভুল হলেও বই চলবে।’ হাহা... তো কাজী সাহেব বললেন, ‘না, জুল ভার্ন-এর অনুবাদ ওর নিজের নামেই বের হবে। আপনার সাহস নাই। যদি ওর সাহস থাকে লিখুক।’ আমি কিন্তু আমার নামে লিখতে রাজি আছি। কিন্তু হাকিম আমাকে কিছুতেই ছাড় দিল না। তারপর কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, একটা ছদ্মনামে লিখেন, শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লিখেন।’ শামসুদ্দীন নওয়াব হচ্ছে কাজী সাহেবেরই আরেক নাম। তখন থেকেই শুরু হলো অনুবাদ। প্রথম অনুবাদ করলাম শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে পাতাল অভিযান, তারপর সাগরতলে, তারও পর রহস্যের খোঁজে। তিনটা লিখলাম, এর মধ্যে একদিন সাজ্জাদ কাদির এনে হাজির করলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে একটা বই। সাজ্জাদ কাদির খুব প্রশংসা করতে লাগলেন বইটার। বললেন, অসাধারণ সব গল্প আছে। আমি বইটা পড়িনি। উল্টেপাল্টে দেখলাম। বললাম, ‘এ তো পড়ি নাই।’ সাজ্জাদ হো হো করে হাসলেন। বললেন, ‘রকিব পড়ে নাই, এমন বই আমরা পড়েছি! তো রকিব, কী করবা?’ আমি বললাম,‘এটা আমাকে দিয়ে দেন। আমি এটার অনুবাদ করব।’ তিনি বললেন, ‘এটা তো আমি অনুবাদ করব ভেবে কিনেছি। এই জন্যই কাজী সাহেবকে দেখাতে এনেছি।’ তিনি যে খেপাচ্ছেন আমাকে, উত্তেজনায় সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘না, এটা আমাকে দিয়ে দেন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কী করে বুঝলা এটা ভালো হবে?’ আমি বললাম, ‘ব্যাককাভার পড়েই বুঝেছি।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা এটা নিয়ে যান। দেখি, কী করে আনেন।’ করে আনলাম এবং ওইটাও শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে ছাপা হলো। এবং এটা হলো এখন পর্যন্ত আমার ছদ্মনামে লেখা সুপারহিট বইগুলোর একটা। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লেখা।

তারপরই এল 'জঙ্গল'! তখন আমার সাহস হয়ে গেছে। তখন আমি বলেছি, আমি আমার নামেই লিখব। হাকিমের বাধা আর মানলাম না। রকিব হাসানের জন্ম হলো। 'জঙ্গল' হচ্ছে ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকারকাহিনি।

সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রকিব হাসানের বই 'জঙ্গল'
ছবি : সংগৃহীত

রকিব হাসান নামটা সৃষ্টি হওয়ার পেছনেও একটা মজার ঘটনা আছে।

আমার সার্টিফিকেট নামটা বিশাল। আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব—পাঁচটা নামের সমাহার। আমার আর ভাই নেই, সে জন্য বাবার মনে হলো পাঁচটা নাম, পাঁচটা ছেলে বানাই! হাহা... ওই পাঁচটার পরেও হয়তো আরেকটা রাখার দরকার ছিল, সে জন্য আমাকে মাঝে মাঝে ‘হাসান’ নামে ডাকত। আমি শামসুদ্দীন নওয়াব নামে বই লিখেছি, কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেও বই লিখেছি। কিন্তু আমার নামে প্রথম যে বইটা বের হয়, সেটা ছিল অনুবাদ, জঙ্গল, ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের একটা শিকার কাহিনি। সে বইটা আমি লিখলাম আবদুর রকিব নামে।

সে সময় বিখ্যাত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী প্রচ্ছদ করতে নিলেন; নামটা তাঁর পছন্দ হলো না। উনি বললেন, ‘তা তোমার এতগুলা নাম, আরেকটা নাম নেই? জোগাড় করতে পারো না?’ বললাম যে, আমার বাবা মাঝেমধ্যে হাসান নামেও ডাকত। উনি ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। যাওয়ার তিন দিন পর সেবায় গেলাম, কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ডেকে পাঠালেন। বললেন আপনার প্রচ্ছদ তৈরি হয়েছে। তখন আমরা প্রায়ই কাজী সাহেবের অফিসে আড্ডা দিতাম। তো শাহাদত চৌধুরী প্রচ্ছদটা বের করলেন। সুন্দর একটা ছবি। তার ওপর লিখলেন ‘রকিব হাসান’। অর্থাৎ রকিবের সঙ্গে ডাকনাম হাসান যুক্ত করে বললেন, ‘এখন কেমন হয়েছে দেখো তো?’ আমি বললাম, আচ্ছা রেখে দেন। যদিও মনে হয়েছে আবদুর রকিব রাখলে কী হতো? হয়তো তিন-চারটা বইয়ের পরে আবদুর রকিব নামটাই জনপ্রিয় হয়ে যেত। কারণ শুরুতে যখন হুমায়ূন আহমেদ নামটা দেখলাম, তখন সাদামাটা মনে হয়েছিল। এখন মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ সত্যিই একটা ছান্দিক নাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক—সবই কিন্তু সাধারণ নাম। কিন্তু এখন? যা হোক, আমি আর আপত্তি করিনি।

রকিব হাসান নামেই বইটা হিট হয়ে গেল। আর কিছু করার থাকল না আমার। দ্বিতীয় বইও বের হয়ে গেল, ড্রাকুলা—সুপারহিট!

কিশোর আলো কার্যালয়ে রকিব হাসান। ২০১৫ সালে।
ছবি : কবির হোসেন, কিশোর আলো

একবার কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে রহস্য পত্রিকা বের করেন আবার, একটা আড্ডাবাজি করা যাক। কারণ, খালি বই লিখতে লিখতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম; যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সবাই অফিস যায়, ছাতা মাথায় দেয়, বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে যায়। আমরা কোথাও যেতে পারি না। খালি ঘরে বসে বসে বই লেখা, টাইপরাইটারে। এমন কিছুর একটা ব্যবস্থা করেন যাতে একটু আড্ডাবাজির ব্যবস্থা করা যায়। আমি বললাম, রহস্য পত্রিকাটা আবার চালু করলে একটা সুবিধা হবে; রহস্য পত্রিকায় অনেক মানুষ আসবে, অনেক মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা হবে, আড্ডাবাজি হবে, চা খাওয়া হবে, লেখালেখি হবে, ওরা লেখাগুলো আনবে, সেগুলো কাটাকাটি হবে, একটা বৈচিত্র্য হবে। সেই সঙ্গে যদি রহস্য পত্রিকার কাজটা করে দিই, তাহলে আপনার ব্যবসা হবে। ব্যবসা হলে আমাদের চা খাওয়া, আসা-যাওয়ার খরচাপাতিটা দিয়ে দেবেন। তাহলেই তো আমাদের হয়ে গেল।’

কাজীদা বললেন, ‘আচ্ছা, আমি ভেবে দেখব।’ পাঁচ-সাত দিন পর বললেন, ‘আমি ঠিক করেছি, রহস্য পত্রিকা আবার বের করব।’ প্রথমে আমাদের যাওয়ার কোনো বিধিনিষেধ ছিল না, সবাই মোটামুটি সন্ধ্যাটাকে বেছে নিলাম এবং যার যার মতো যেতাম-আসতাম। কারণ বাঁধাধরা নিয়ম কাজী সাহেব নিজেও পছন্দ করেন না। উনি নিজেও তো চাকরি করেননি।

পুরো স্বাধীনতা আর আড্ডাবাজির মধ্যে পত্রিকাটা বের হতো।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন