ক্যালিগ্রাফিতে কাটছে সময়

বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে আমরাই সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যাচ, যারা মাধ্যমিক পরীক্ষার পরবর্তী তিন মাসের বন্ধ কয়েদিদের মতো ঘরে বসে কাটাচ্ছি। বড় ভাই–আপুরা বলত, এই বন্ধে নাকি স্বর্গের সুখ পাওয়া যায়! এ রকম বন্ধ আর এই জীবনে কোনো দিন পাব না। জীবনের যত শখ–আহ্লাদ সব যেন এই তিন মাসেই মিটিয়ে ফেলি। তারপর ইন্টারের যুদ্ধ শুরু হলে আর চন্দ্র–সূর্যের মুখ দেখতে পাব না। আমরাও পরীক্ষার আগে পড়াশোনার প্রতি এতটাই অতিষ্ঠ বোধ করছিলাম যে পরীক্ষার চেয়ে বেশি চিন্তায় ছিলাম পরীক্ষার পরে কী করব তা নিয়ে। আব্বু সিঙ্গাপুর–থাইল্যান্ডের ভিসা আর টিকিট নিয়ে এসে আম্মু আর আমাকে চমকে দিল। ফ্লাইট ছিল ২০ মার্চ সকাল ১০টায়। তখন চীন ছাড়া অন্য কোথাও করোনা ছড়ায়নি। তাই এটা নিয়ে তেমন ভ্রুক্ষেপ করেনি কেউ। দিন যেতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হলো। প্রতিদিন ইউটিউবে সিঙ্গাপুরের হোটেল, ম্যারিনা বের সুইমিংপুল, ব্যাংককের নাইট সিটি ট্যুর, ফুকেটের বিচ নিয়ে লেখা ব্লগ ঘাঁটি। কাছে–দূরে সব বন্ধুদের বাসায় এক দিন করে আড্ডা দেওয়ার রুটিন বানালাম। পড়াশোনার রুটিন বাস্তবায়িত না হলেও এটা ঠিকই হলো। কিন্তু এর মধ্যেই ব্রেকিং নিউজগুলোতে একে একে সারা বিশ্বে করোনা ছড়ানোর গুরুতর তথ্য সবাইকে ভয় পাইয়ে দিল। চীনের উহান থেকে ১৪টি দেশ, তারপর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ল করোনা। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে একজন করোনায় আক্রান্ত হলেন। আম্মু ভয় পেয়ে আব্বুকে ফ্লাইট ক্যানসেল করতে বলল। টিকিট ক্যানসেল করল আব্বু। ভিসা–টিকিটের কোনো টাকাই ফেরত এল না। এদিকে ঢাকা শহর ফাঁকা হতে লাগল। শুরু হলো হোম কোয়ারেন্টিনে দিন গোনা। এসএসসির জন্য বুকশেলফের গোটা ত্রিশেক বই আমার না পড়া ছিল। বই আর মুভি দেখা চলতে লাগল সমানভাবে।

বড় ভাই–আপুরা বলত, এই বন্ধে নাকি স্বর্গের সুখ পাওয়া যায়! এ রকম বন্ধ আর এই জীবনে কোনো দিন পাব না। জীবনের যত শখ–আহ্লাদ সব যেন এই তিন মাসেই মিটিয়ে ফেলি।

ভাবলাম আরও কিছু করা দরকার। ভয়ে ভয়ে বাইরে বের হলাম। পাশের গলিতেই লাইব্রেরি ছিল। গোটা দশেক বিভিন্ন রঙের জেল পেন আর আর্ট পেপার এনে ঘরে ডুডল আর ক্যালিগ্রাফি শুরু করলাম। তিন–চার দিন টানা একই ছাঁচের কাজ করতে ভালো লাগছিল না। প্রতিবেশীর বাসা থেকে অ্যাক্রেলিক রং ধার করে এনে শুরু করলাম কন্সেপচুয়াল আর্ট। এদিকে আব্বুর অফিস ছুটি দিয়ে দিল। যেদিন ছুটি দিল, সেদিন আব্বু ক্যারম কিনে নিয়ে এল। এখন প্রতি রাতে এক গেম খেলা হয়। আব্বুর ক্যারমের হাত পাকা। তার হাতেই আমার ক্যারম খেলা শেখা। আম্মু আমাদের সঙ্গে কাজের ফাঁকে যোগ দেয়। সে স্ট্র্যাটেজি না মেনেই জোরে জোরে মারে, তাতেই আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যেই আমি ১৫টি বই আর ২০টির বেশি সিনেমা দেখে ফেলেছি। কন্সেপচুয়াল আর্টগুলো মনমতো হচ্ছে না দেখে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। প্রতিদিন নতুন ২০টি করে ইংরেজি শব্দ শিখছি। উইকিপিডিয়া থেকে ইতিহাস, দেশ ও আন্তর্জাতিক ঘটনা নিয়ে পড়ছি। প্রথম আলোর প্রতিদিনের সুডোকু আর শব্দের সমাধান তো আছেই! সব মিলিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে সামনাসামনি আড্ডা দিতে পারছি না, তাই মেসেঞ্জারের ভিডিও কলেই তা সারতে হচ্ছে। এই পৃথিবীটা আবার একদিন সুন্দর হয়ে উঠবে, তখন আমরা সব বন্ধু মিলে রমনার ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দেব, শিশু একাডেমির লাইব্রেরিতে বই পড়ব, শাড়ি পরে সরোবরে সব বন্ধুরা মিলে ছবি তুলব। একদিন এই পৃথিবীটার মতো আমরাও সব দূষণ আর বিষাদ থেকে মুক্তি পাব, এই আশা নিয়েই কেটে যাচ্ছে একেকটি দিন।

লেখক: একাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে, ঢাকা