পরীক্ষার ভূত

পরীক্ষার ভয়কে করো জয়

ব্যাকরণের প্যাঁচ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রায়ান। সামনে তার জেএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে ভাত, মাছ, সবজির সঙ্গে হিমশিমও খায় সে। হঠাৎ একচিলতে ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তার শরীর। চমকে উঠল রায়ান। এত ঠান্ডা বাতাস এল কোত্থেকে? পেছনে ঘুরতেই সে বিস্মিত হয়ে দেখে, বিশাল একটা অবয়ব তার সামনে দাঁড়িয়ে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উদ্ভট ভঙ্গিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে অবয়বটা। কী এটা? ভাবল রায়ান।

ওর মনের কথা বোধ হয় টের পেয়ে গেল অবয়বটা। বজ্রকণ্ঠে হুংকার দিয়ে উঠল সে।

হিয়াউ!

কিসের হিয়াউ? কে আপনি?

হু?...ও, আচ্ছা। আমি ভূত। তোমাকে ভয় দেখাতে এসেছি।

ও, আচ্ছা, অন্যদিকে যান। সামনে আমার জেএসসি পরীক্ষা। এখন ভয় পাওয়ার সময় নেই। পরে আসেন।

এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে ভূতটা ভালোই পরিচিত। ভূতদের সেই ‘সোনালি অতীত’ আর নেই। বাচ্চাকাচ্চাদের কাছে ভূত এখন একটা ‘কিউট’ জিনিস। ভূতদের বদলে ভয় পাওয়ানোর দায়িত্বটা নিয়েছে ‘পরীক্ষা’। পরীক্ষা নামক এই ভূত সবার ঘাড়ে এমনভাবে চেপে বসেছে যে, অন্য কোনো ভূত বাচ্চাকাচ্চাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারছে না। এ তথ্য জেনে রুটিনও তৈরি করেছে ভূতটা। এখন ছুটি—এই ভেবেই ভয় দেখাতে এসেছিল। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার কথা মাথায়ই ছিল না তার। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, প্রি-টেস্ট, টেস্ট...এত পরীক্ষার কথা মনে রাখা যায়? ‘ধুর, হুদাই আইলাম!’—মনে মনে বলল ভূতটা। হতাশ হয়ে রায়ানকে বলল, যাই তাহলে।

যান। পরীক্ষার পর আসবেন। ফ্রি থাকব।

আচ্ছা। কিন্তু...পরীক্ষাকে এত ভয় কেন? এখনই যদি এত ভয় পাও, বাকি জীবন কী করবে? আরও কত হেভিওয়েট পরীক্ষা বসে আছে...

অযথা জ্ঞান দেবেন না তো। জেএসসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। বাবা-মা বলেছে, জেএসসিতে ভালো না করলে তারা মুখ দেখাতে পারবে না। সো, বিষয়টা এত সোজা না।

সে তো সব পরীক্ষার সময়ই বলে। পিএসসি পরীক্ষার সময় বলে, এই পরীক্ষাটা ভালোমতো দিলেই আর চিন্তা করতে হবে না...এটাই তোমার ভবিষ্যৎ...তারপর আবার জেএসসিতে বলে, এরপর এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা...সেই তো একই কথা।

তা ঠিক।

ভালোমতো লেখাপড়া করো, পরীক্ষা দাও। তাই বলে শুধু পরীক্ষার জন্য বাকি সব ভুলে যাওয়া কি ঠিক? জীবনে হাসি, আনন্দ, খেলাধুলারও তো দরকার আছে। আর...মানে...মাঝে মাঝে একটু ভয় পাওয়ারও দরকার আছে। যাহোক, এখন আসি। পরীক্ষার পর দেখা হবে।

বলেই ভূতটা অদৃশ্য হয়ে গেল। রায়ান মনে মনে ভাবল, ‘ইশ্, এভাবে যদি পরীক্ষার ভূতটাও অদৃশ্য হয়ে যেত।’

আসলেই। পরীক্ষার ভূত ঘাড় থেকে তাড়ানো খুব কঠিন। পরীক্ষা নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত, সত্যি সত্যি যদি ভূত আসেও কখনো, কেউ হয়তো খেয়ালই করবে না। অনেকেরই জেএসসি পরীক্ষা সামনে। কারও আবার এসএসসি। পরীক্ষার ভয়ে যে সবার ঘুম পালিয়েছে পরীক্ষার্থী না হয়েও কিন্তু আমরা তা টের পাচ্ছি। কারণ তোমাদের এমন অনেক চিঠি আসে কিআ কার্যালয়ে।

‘সামনে আমার জেএসসি। আমার খুব ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে হলে গিয়ে কিছু লিখতে পারব না, সাদা খাতা জমা দিয়ে আসব।’

কিংবা, ‘আব্বু-আম্মু বলেছে জেএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস না পেলে খেলতে যাওয়া বন্ধ। তাই সব বাদ দিয়ে শুধু পড়ালেখা করছি।’

দুঃখজনক হলেও সত্য যে এমন চিঠির সংখ্যাটা অনেক। অনেকে এতই চাপে আছে যে চিঠি পাঠানোর সময়টাও পাচ্ছে না। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই যাবতীয় গল্পের বই, ব্যাট বল বন্দী হয়ে যায় আলমারিতে। আর যাদের অবস্থা বেশি শোচনীয়, তারা নিজেরাই হয়ে যায় গৃহবন্দী।

তাই না চাইলেও পরীক্ষাকে ভয় পেতে হয়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পরীক্ষাকে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। সাকিব আল হাসান কত ভালো খেলোয়াড় তা কি একটা দুটো ম্যাচ দিয়ে বিচার করা যায়? তোমার-আমার বেলাতেও তা-ই। সারা বছর কেমন পড়ালেখা করলে তা পরীক্ষা দিয়েই যাচাই করা হবে। সেই পরীক্ষায় ভালোও করতে হবে। তার মানে এই নয় যে ওই নির্দিষ্ট পরীক্ষাটাই সব। তার জন্য একেবারে জীবন দিয়ে দিতে হবে। সারা বছর যদি ঠিকমতো পড়ো, তাহলে পরীক্ষাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। শার্লক হোমসের মতো পুরো বইটাই তো তোমার মাথায়। পুরো সময় সেটা মাথাতেই রেখেছ, ভেবেছ। এখন পরীক্ষার সময় শুধু সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খাতায় ‘ফাঁস’ করে দেওয়া, ব্যস। এই তো। এ নিয়ে এত ভয়ের কী আছে?

ভয়টা আসলে ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’। পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, ভালোও করতে হবে সেখানে। কিন্তু সে জন্য খাওয়া, ঘুম বাদ দিয়ে অস্থির হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। পর্যাপ্ত খাবার যেমন দরকার, তেমনি দরকার আট ঘণ্টার নিশ্চিন্ত ঘুম। ঘুম তোমার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেবে, যা খুব দরকার। নইলে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের সব বাক্যকেই মনে হবে ‘জটিল বাক্য’।

আর ‘আমি মনে হয় কিছু পারব না’ বা ‘হায় হায়, কিছুই পারি না, ফেল করব’ টাইপ চেতনাও পরিহার করা দরকার। ‘এটা একটা পরীক্ষা, যতটুকু পারি একদম ফাটায় দিব’ টাইপ চেতনা থাকাই বরং ভালো। নেগেটিভ চিন্তা তোমার মস্তিষ্ককে কাজ করতে আরও নিরুত্সাহিতই করবে। এর চেয়ে যে যা পারো তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। শত্রু তো একটাই, পরীক্ষা। তাকে যদি ভয়ই পাও, তো হারাবে কী করে?

টেম্পল রান গেমটা খেলেছ না? পরীক্ষা ওই রকমই। শিক্ষার্থীরা ছুটবে আর নানা রকম পরীক্ষা এসে বাধা দেবে তাদের। একটা একটা করে পরীক্ষা টপকে যেতে হবে শুধু। সতর্ক থাকলে এটা কোনো ব্যাপারই না। এর চেয়ে কত কঠিন কঠিন বাধা প্রতিনিয়ত পার করছ তোমরা, আর এ তো কেবল একটা পরীক্ষা। অতএব, পরীক্ষাকে ভয় নয়, বরং এমন ভালো প্রস্তুতি নাও, যেন পরীক্ষাই তোমাকে ভয় পায়।

(কিশোর আলোর অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)