পিউটার হবে কম কম নট বেশি বেশি

কাগজের ভাঁজে নৌকা বা বিমান না বানিয়েই তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ না তো?ছবি: কবীর শাহরীয়ার

আমি যখন এই লেখা শুরু করলাম, তখন কোনো এক কারণে আমার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি নষ্ট। কলম হাতে কাগজ নিয়ে বসে পড়তেই আমার ছোট ভাই বলল, ভাইয়া, কোন ফন্টে লিখছ, নরমাল সুতন্বী, নাকি সুতন্বী বোল্ড?

সবকিছুতেই এখন প্রযুক্তির বেশি বেশি প্রভাব। একবার ভেবে দেখেছ কি, তোমার যদি বৃদ্ধাঙ্গুলটাই না থাকত, তাহলে তুমি কী করে কলমটা ধরতে, ভাত তুলে খেতে! অথবা উল্টো করে ভাবো, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি কোনো কিছু ধরার চেষ্টাই না করতেন, তাহলে আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুলটির জন্মই হতো কি না সন্দেহ। বিবর্তনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ত মানুষ, আমাদের মেধা এতটা বিকশিত না-ও হতে পারত। একেকটা ছোট কাজের জন্য আমাদের মস্তিষ্কের কত কোষ যে তাদের মধ্যে কত নতুন যোগাযোগ তৈরি করে, তার কোনো ইয়ত্তাই নেই। নতুন কাজের চেষ্টা মানেই আরও নতুন যোগাযোগ, নতুন সম্ভাবনা, মস্তিষ্কের আরও আরও বিকাশের পথ তৈরি হওয়া। আর তুমি কিনা কোনো দিন কাগজ কেটে ফুল বানানো ছাড়া, কাগজের ভাঁজে নৌকা কিংবা বিমান বানানো ছাড়া, নারকেলের পাতা দিয়ে চশমা, ঘড়ি আর বাঁশি বানানো ছাড়া, কোনো দিন নিজের বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে তাঁর পিঠে না চড়েই বড় হয়ে যাচ্ছ?

তুমি এখন কেবলই একটা বড় আকারের ‘দ’ হয়ে বসে থাকছ কম্পিউটারের সামনে, বেসুরো আওয়াজ তুলে একই তালে তোমার আঙুলগুলো কট কট আওয়াজ তুলছে কি-বোর্ডে। না সে আঙুলগুলো আর পিয়ানোয় সুর তোলার স্বপন দেখায় না। তুমি মাটিতে গাছ লাগাচ্ছ না কখনো, কি-বোর্ডে কট কট আওয়াজ তুলে তুমি ফার্মভিলে গাছ লাগাও। তুমি গুলতি দেখোনি, আমগাছে ঢিল ছুড়ছ না, কট কট আওয়াজ তুলেই তুমি মিসাইল ছুড়ছ শত্রুশিবিরে। কারাতে শিখতে যাচ্ছ না তুমি, আঘাত থেকে শেখোনি প্রতিরোধের মন্ত্রও, কিন্তু কট কট আওয়াজ তুলে তুমি ফটাফট উড়িয়ে দিচ্ছ মস্ত বড় শত্রুকে এক লাথিতে। তুমি সাইকেলে চড়ছ না, কট কট আওয়াজ তুলে তুমি চালাচ্ছ ফেরারি। তোমার পা স্থবির হয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অথচ তুমি নাকি খেলছ ফিফার ফুটবল, দিচ্ছ গোলের পর গোল। কিন্তু গোলবারের নিচে হাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে যাওনি কোনো দিন! কাদা মাখামাখি হয়ে বাসায় ফেরার পথে মাকে দেওয়ার জন্য যুক্তি খুঁজতে তোমার মস্তিষ্ক যুদ্ধ করেনি কখনোই। কখনোই পাশের পাড়ার সঙ্গে ক্রিকেটে হেরে, দেয়াল পত্রিকা বানিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য দিনের পর দিন মিটিং করোনি। অভিজ্ঞতার ভান্ডারে কত কিছুই না অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে অনেকের!

একবার কয়েকজন গবেষক নাকি একটা শিশুকে বদ্ধ ঘরে রেখে বড় করে তুলেছিলেন, যেখানে তাকে কেবল একজন নারী নির্দিষ্ট সময় পর পর গিয়ে দুধ খাইয়ে আসতেন। কিছুদিন পর দেখা গেল, শিশুটির যখন কথা বলার কথা, তখন সে কেবল কট কট করত। কারণ, সে তার ওই ছোট্ট জীবনে তার দুধ-মায়ের জুতার হিলের কট কট আওয়াজটা ছাড়া আর কিছুই শোনেনি। তোমরা আবার একটা কট কট প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছ না তো?

এই যে বসে বসে কট কট করেই যাচ্ছ, তোমার এইটুকুন ছোট্ট শরীরে কিন্তু তখন জমে যাচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ফ্যাট, তোমার রক্তে জমে যাচ্ছে ক্ষতিকর চর্বি, তোমার অস্থির জোড়ায় জোড়ায় জমে যাচ্ছে স্থবিরতা, বেড়ে যাচ্ছে কোমরে ব্যথা আর মেরুদণ্ডের নানা সমস্যার আশঙ্কা। তোমার না এখন কত কাজ! তোমাকে বই পড়তে হবে, গোল্লাছুট খেলতে হবে, দুষ্টুমি করতে হবে, ভাইবোনকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে হবে, কাগজ ছিঁড়ে ফুল বানাতে হবে। বিজ্ঞান প্রজেক্টের বই দেখে দেখে মাকে লুকিয়ে দামি গ্লাসটায় চুনের পানি রেখে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করা বিজ্ঞানী হতে হবে তো তোমাকেই। পুরোনো রেডিওটা ভেঙে নতুন একটা টিভি বানানোর চেষ্টা তুমি না করলে কে এ দায়িত্ব নেবে বলো, বড়রা তো অনেক আলতুফালতু কাজে ব্যস্ত, তাই না?

নারিকেল পাতাও মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে সুন্দর ঘড়ি কিংবা চশমা!
মডেল: রাকিন, এলিন, ফাহাদ ও অহর্নিশ

তুমি কোনো দিন শুনেছ, বড়রা ইংরেজি বইয়ের মাঝে রেখে ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ার আনন্দ পাচ্ছে? পায় না। ওই মজা কেবলই তোমার জন্য বরাদ্দ আছে।

এত কিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে তুমি কিনা সারাক্ষণ পড়ে আছো কম্পিউটারের সামনে। কিংবা ইন্টারনেটে, ফেসবুকে। গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটা জরিপ করে জানিয়েছে, রাতে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় ১০ শতাংশ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে স্থায়ী ঘুমের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

আমার পরিচিত এক লোকের কথা বলি, তাঁর সারা দিন কাটে কম্পিউটারে বসে। ডেটা অ্যানালাইসিস করা, সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা, প্রতিবেদন তৈরি করা—এসবই তাঁর কাজ। বয়স ৫০ বছর পার করেছেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, যদি কলম দিয়ে কিছু লিখতে যান, তবে তাঁর হাত এমনই কাঁপে যে নিজের পুরো নাম লিখতেই দু-তিন মিনিট সময় লাগে। শুধু তা-ই নয়, অক্ষরগুলোও আঁকাবাঁকা আর ছোট-বড় হয়ে যাচ্ছে, নিজের কলমের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না তাঁর। কী জন্য এ সমস্যা হয়েছে, জানো? কেবল অতিরিক্ত কি-বোর্ড ব্যবহারের কারণে।

আমরা সবাই এখন কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত। কারণে কিংবা অকারণে সময় কাটানোর জন্য ফেসবুক, টুইটার বা ব্লগিংয়ে অনেকক্ষণ ধরে ডুবে থাকি। কিন্তু আমরা আমাদের শারীরিক সাবধানতা বা সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো সম্পর্কে কতটুকু জানি? কম্পিউটার আমরা অবশ্যই ব্যবহার করব, তবে সাবধানতা মেনে চলে। কেননা, অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহার করার কারণে অনেকক্ষণ ধরে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে চোখের পলক অনেক কম নড়াচড়া করায় চোখ শুষ্ক হয়ে যায়। একে বলে ড্রাই আই সিনড্রোম। চোখব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি তো হতেই পারে।

অনেকক্ষণ ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করলে হাতের আঙুল ও কবজি ব্যথা করে। এ সমস্যা থাকলে কার্পাল-টানেল সিনড্রোম নামের রোগ হয়, যাতে শুধু আঙুল বা কবজি নয়, পুরো হাতেও ব্যথা হতে পারে, যা তোমাকে কিছুতেই শান্তি দেবে না।

কম্পিউটার ব্যবহারের সময় যদি তোমার আসনটি ঠিক না হয় বা বসার পজিশন ঠিক না থাকে, তবে শিরদাঁড়া বা মেরুদণ্ডের ব্যথায় কাতর থাকতে হবে সারাক্ষণ।

তোমাদের মা-বাবা কিন্তু খুব অবাক হন, যে পিচ্চি শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেললে সেটা তুলতেই ভুলে যায়, সে কী করে ৩৮ অক্ষরের পাসওয়ার্ড মনে রাখে? এখন কিন্তু তোমারই দায়িত্ব, তাদের আরও অবাক করিয়ে দিয়ে কম্পিউটারে অতিরিক্ত সময় না কাটিয়ে জীবনের আরও নানা দিককে তোমার পদচারণে মুখরিত করে তোলা। তুমি কম্পিউটার, মোবাইল ফোর ব্যবহার করো, কিন্তু কম্পিউটার আর ফোর যেন তোমাকে ব্যবহার না করে। রাঙিয়ে তোলো তোমার জীবন নানান রঙে।

(কিশোর আলোর মে ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)