বদলে যাওয়ার সময়

কণ্ঠস্বর যাচ্ছে পাল্টে। ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফের রেখা লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আত্মীয়স্বজন দেখলে হেসে বলেন, বাহ্, তুমি তো বড় হয়ে যাচ্ছ। মা-বাবাও প্রায়ই বলেন, বড় হচ্ছ তুমি। এখন বুঝতে শেখো। বড় হওয়া মানেটা যে কী, তা-ও একেবারে স্পষ্ট নয়। বড়ই যদি হলাম, তবে বড়দের মতো করে চলাটা আবার নিষেধ কেন? ওখানে যাবে না, দেরি করে ফিরবে না, এটা করবে না, ওর সঙ্গে মিশবে না—কই, বড়দের তো কেউ এত বিধিনিষেধ আদেশের জালে বন্দী করে রাখে না। তাহলে আর ‘বড় হয়েছ’ বলে আলাদা করে আঙুল তোলা কেন! টিনএজ বা বয়ঃসন্ধির আছে এমনতর নানা ক্রাইসিস। এর মধ্যে মনোজাগতিক ক্রাইসিস নিয়ে আজকাল অনেকেই কথা বলেন, অভিভাবকেরাও সচেতন টিনএজ মনের গতিবিধি নিয়ে। যে জিনিসটা নিয়ে এখনো একেবারেই সবার মুখে কুলুপ আঁটা তা হলো বয়ঃসন্ধির শারীরিক পরিবর্তন। অথচ এই বয়সে শরীরের নানা রকমের উদ্ভট ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে তোমরা যে প্রায়ই বিব্রত হও, নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ো, তা তো আমরা জানিই। কিন্তু কীভাবে যে এই ব্যাপারগুলোকে সামলে নেবে, তা নিয়ে কখনো কথা বলি না। এটা কি ঠিক, তোমরাই বলো?

ইংরেজিতে থারটিন বা তেরো বছর বয়সকেই বলা হয় টিনএজের শুরু। চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু তা বলে না। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, বয়ঃসন্ধি বা পিউবারটির নানা পরিবর্তন শুরু হয়ে যায় এরও আগে। মেয়েদের বেলায় ১০-১১ বছর বয়স থেকে, ছেলেদের মোটামুটি ১২ বছর বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায় এই পরিবর্তনগুলো। এগুলো ঘটে নানা ধরনের হরমোনের প্রভাবে। তোমাদের মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাস নামে ছোট্ট একটা জায়গা আছে নিশ্চয় জানো। আমাদের আবেগ-অনুভূতির অনেক কিছুই কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয় এই জায়গা থেকে। হাইপোথ্যালামাসের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এটি আমাদের শরীরের হরমোনের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিম পাওয়ার হিসেবে কাজ করে। তোমরা যখন শিশুকাল থেকে অল্প অল্প করে কৈশোরে প্রবেশ করছ, তখন এই হাইপোথ্যালামাস গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন (জিএনআরএইচ) নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। সেটা সরাসরি উজ্জীবিত করে মস্তিষ্কের আরেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে। পিটুইটারিও উদ্দীপনা পেয়ে তৈরি করতে থাকে প্রচুর পরিমাণে এলএইচ, এফএসএইচসহ আরও নানা ধরনের হরমোন। এই হরমোনগুলোর হঠাৎ উদ্দীপনাই তোমাকে পাল্টে দিতে শুরু করে। শুধু কি তোমার শরীর? পাল্টে দিতে থাকে তোমার মনমানসিকতা, চিন্তাভাবনাও। তোমার চারপাশের জগেক দেখার চোখও পাল্টে যেতে থাকে। তোমার শরীরটা তড়তড় করে বাড়ে, তুমি ঢ্যাঙা লম্বা হতে থাকো হঠাৎ করে। চেহারা, কণ্ঠস্বরে আসে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন লুকিয়ে রাখা যায় না। চারপাশের মানুষদের ঠিকই চোখে পড়ে যাও তুমি। তারা হাসতে হাসতে বলে, বাহ্, বেশ বড় হয়ে যাচ্ছ তো!

আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে, ছোটবেলায় এক দিন আমাকে ডেকে বলা হলো, তুমি আর এখন থেকে বাচ্চাদের মতো হাতা কাটা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক পরতে পারবে না। কেন পারব না? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। আমি বেশ কাঁদলাম-টাদলাম, অভিমানে গাল ফোলালাম। আমার অপরাধটা কী, তা নানা জনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ কিছু বলল না। তুমি বড় হচ্ছ তাই পারবে না, ব্যস। এই হলো কথা। এক দিন আমার নানু আদর করে বললেন, দেখছ না তোমার হাত-পায়ে, বগলে কেমন লোম গজাচ্ছে; এর মানে তুমি বড় হচ্ছ। এখন অমন পোশাক পরলে কি ভালো দেখাবে? আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যিই তো। কী বিশ্রী ব্যাপার! নিজেকে একটা লোমওয়ালা বানর মনে হয়েছিল আমার। খুবই মন খারাপ করেছিলাম তখন। তোমরা কিন্তু এমন মন খারাপ করো না। কেননা এগুলো বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক পরিবর্তন।

মডেল: সাবিত

তুমি একা নও, জগতে সবারই এমনটা হয়েছে। তোমার শরীরের নানা জায়গায় লোম গজাবে এখন। অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের প্রভাবে ছেলেদের গালে হালকা দাড়ি আর ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফ দেখা দিতে পারে। লোম গজাতে পারে বুক-পেটেও। গলার মাঝখানটা উঁচু হয়ে উঠতে পারে। আসলে বয়ঃসন্ধিকালে ভয়েস বক্স বা ল্যারিংস মোটা হয়ে যায় বলেই এমন হয়। আর তোমার গলার স্বরটাও কেমন ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে, টেলিফোনে তোমার স্বর শুনে অনেকেই আর চিনতে পারছে না। ধ্যাড়ধ্যাড়িয়ে লম্বা হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তোমার হাত-পাগুলোও এখন পেশিবহুল হয়ে ওঠার কথা। তবে কিনা এই সময়ে ঠিকঠাক লম্বা হওয়া আর পেশি সবল হওয়ার জন্য তোমার ঠিকঠাক পুষ্টিও প্রয়োজন। এটা মনে রেখো। কেউ যদি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারদাবার যেমন, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ না খেয়ে কেবল সারা দিন ধরে তেল-চর্বিযুক্ত ফাস্ট ফুড আর চিনিযুক্ত পানীয় খেতে খেতে মোটা হয়ে যাও, তাহলে সঠিক বৃদ্ধি হবে না। তোমার বন্ধুরা তোমার চেয়ে লম্বা আর শক্তিশালী হয়ে যাবে, তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে তখন। আর হ্যাঁ, অ্যান্ড্রোজেনের প্রভাবে এ সময় তুমি একটু বেশি বেশি ঘামতে পারো। মুখজুড়ে ব্রন উঠতে পারে। মুখটা তেলতেলে হয়ে থাকতে পারে। এ নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এগুলোও স্বাভাবিক ব্যাপার। সবারই হয়।

মডেল: অর্নিমা

মেয়েদের শরীরের পরিবর্তনগুলো অবশ্য একটু অন্য রকম। পিটুইটারির এলএইচ আর এফএসএইচ মেয়েদের ওভারি থেকে ইস্ট্রোজেন প্রজেস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মেয়েদের শরীরের গঠন ছেলেদের চেয়ে আলাদা হতে শুরু করে। ভবিষ্যতে একটা মেয়ে যাতে ঠিকঠাকভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে পারে, সে জন্যই এই পরিবর্তন। এটা যদি না ঘটত, তবে আমাদের কারও এই পৃথিবীতে জন্মই হতো না, তা-ই না? তাই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই-ই, হীনমন্যতারও কিছু নেই। কখনো যদি দেখো আশপাশের কেউ তোমাদেরই বয়সী কোনো মেয়ের শারীরিক একটু-আধটু পরিবর্তন নিয়ে কটূক্তি করছে, তবে অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। কারণ, মেয়েরা এমন হয় বলেই না আমরা এই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তাই বলে মেয়েরা যে একেবারে নরম বা কঠিন কাজে অপারগ হবে, তা-ও ভাবার কোনো কারণ নেই। ফিটনেস বা স্ট্যামিনা বা শক্তি ভিন্ন ব্যাপার। চেষ্টা করলে একটা মেয়ে শারীরিক শক্তিতে একটা ছেলেকে সহজেই হারিয়ে দিতে পারে। 

ও ভালো কথা, যা বলা হয়নি তা হলো এই বয়ঃসন্ধিতে নিজের শরীরের সঠিক যত্ন না নিলে কিন্তু খুবই বিপদ। এ সময় তোমার গ্রোথ স্পার্ট, মানে আকস্মিক শারীরিক বৃদ্ধি হওয়ার কথা। একজন বড় মানুষের শরীর যেমন হয়, সেদিকেই যাচ্ছ তুমি। এ সময় উল্টাপাল্টা হলে ভবিষ্যতে নানা সমস্যায় পড়তে হবে। তাহলে কীভাবে তুমি এ সময় নিজের দিকে নজর দিতে পারো?

এক. বাড়ন্ত শরীরের চাই বাড়তি পুষ্টি। সঠিক ক্যালরি না পেলে বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। আমিষজাতীয় খাবার, যেমন দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খেতে হবে বেশি করে। দুধ, দই, সবুজ পাতাওয়ালা শাক আর ছোট মাছে যে ক্যালসিয়াম আছে, তা তোমার হাড় লম্বা ও মজবুত করতে সাহায্য করবে। বয়ঃসন্ধিতেই হাড়ের ঘনত্ব সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। যদি এই ঘনত্ব ঠিকঠাকমতো না গড়ে ওঠে, তবে বয়স হলে তুমি হাড়ক্ষয়, বাত, ফ্রাকচারসহ নানা রোগে ভুগবে।

দুই. সূর্যের আলোতে আছে ভিটামিন ডি। ভিটামিন ডি ছাড়া শরীরে ক্যালসিয়াম কোনো কাজে আসে না। তাই সঠিক বৃদ্ধির জন্য বাইরে রোদে খেলাধুলা করাটা কিন্তু জরুরি। সারা দিন বাড়িতে টেলিভিশন, কম্পিউটার বা এক্স বক্স নিয়ে পড়ে না থেকে এ সময় বাইরে গিয়ে ছোটাছুটি করো। ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, জুডো, ব্যাডমিন্টনের মতো কায়িক পরিশ্রমের খেলাধুলা করো। যেসব অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বাইরে খেলতে দিতে চান না, ঘরে বন্দী করে রাখতে চান, (বিশেষ করে টিনএজ মেয়েদের মা-বাবা)—এই লেখাটা তাঁদের পড়ে শুনিয়ো।

মডেল: সুপ্তি

তিন. বয়ঃসন্ধিকালে যারা মুটিয়ে যেতে থাকে, তাদের নানা রকমের হরমোনের অসামঞ্জস্য হয়। ফলে পরবর্তী জীবনে দেখা দেয় নানা জটিলতা। তাই অতিরিক্ত তেল-চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।

চার. ধূমপান, নেশাজাতীয় দ্রব্য তোমার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। তাই ভুলেও, কৌতূহলেও কখনো এগুলোর দিকে হাত বাড়াবে না।

পাঁচ. শুধু শরীরের হাত-পা কেন, মস্তিষ্কেরও গঠনগত ও গুণগত পরিবর্তন হয় বয়ঃসন্ধিতে। কগনিশন, আইকিউ, বিচারিক দক্ষতা বা জাজমেন্ট পরিপক্ব হয়ে ওঠার সময় এখন। তাই তোমার চাই রাতে নিরবচ্ছিন্ন ৯ থেকে ১০ ঘণ্টার ঘুম। রাত জাগা বা নির্ঘুম রাত কাটানোর ফলে শুধু যে তোমার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ব্যাহত হবে তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে তোমার বেড়ে ওঠাও। কেননা ‘বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে বাড়ে’—কথাটা কিছুটা সত্যি। রাতেই গ্রোথ হরমোনসহ কিছু হরমোনের নিঃসরণ হয় বেশি। ঘুমের চক্র উল্টে গেলে শরীরে স্বাভাবিক হরমোন নিঃসরণে ছন্দপতন ঘটে।

লেখক: হরমোন বিশেষজ্ঞ