বন্দিদিনের সঙ্গীসাথী

ঘরে থাকার এই সময়টা কিশোর আলোর পাঠকেরা কে কীভাবে কাটাচ্ছে? সেটাই জানতে চেয়েছিলাম আমরা। অনেক লেখা এসেছে। নির্বাচিত কয়েকটি ছাপা হলো এখানে।

১.

বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা

ঘুম থেকে উঠি ৯-১০টায়, স্কুলটা যে ছুটি, সকালে উঠলে মনে পড়ে সেই সাতসকালের পিটি। গল্পের বই পড়ার এখন পাচ্ছি প্রচুর সময়, পাঠ্যবই করোনার ভয়ে শেলফে বসে ঘুমায়। রুবিকস কিউব মিলিয়েও সময় ভালোই কাটছে, প্রতিদিনের গানের রেয়াজ নিয়মমতোই চলছে। এ সময় মুভি দেখতে ভুলছি না আমি। একটা করে মুভি দেখছি প্রতিদিনই। ছুটি বলে কি বন্ধুদের সঙ্গে হবে না এখন কথা? শুধু কথাই নয়, ভিডিও কলে হয়ে যাচ্ছে দেখা।

স্কুলটা না হয় বন্ধ থাকুক, বন্ধ বিকেলের খেলা! খেলা ছাড়া অনেক কষ্টে কাটছে বিকেলবেলা। ঘুমটা হচ্ছে অনেক রাতে, ভোরে ওঠার নেই তাড়া, ‘গল্পের বই, মুভি, মোবাইল’, পাঠ্যবই কমই পড়া। অনেক গুজব শুনছি এখন করোনাকে নিয়ে—হলুদ, জিরা, চা খেলে নাকি করোনা যাবে পালিয়ে! বিশ্ববাসীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করল করোনা, তাই এখন বাইরে যাওয়ার চিন্তা ভুলেও কোরো না।

অরিত্র বিশ্বাস

দশম, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, সিলেট

২.

আমার কোয়ারেন্টিন

কলেজে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। হঠাৎ একদিন পরীক্ষা দিয়ে এসে শুনি সব স্কুল–কলেজ বন্ধ। এত খুশি লেগেছিল তখন! খুশির স্রোতে প্রথম কদিন কিছুই করা হয়নি। তারপর আস্তে আস্তে বুঝলাম যে অনেক লম্বা একটা ছুটি পাওয়া গেছে। সুতরাং প্ল্যান করে ফেললাম কী কী করা হবে এই ছুটিতে। ঘরে অনেকগুলো গল্পের বই জমানো ছিল। সময়ের অভাবে পড়া হচ্ছিল না। একটা একটা করে পড়া শুরু করলাম। পড়তে পড়তে বোরিং লাগলে ‘১০১টি ছবি, যা জীবনে না দেখলেই নয়’—এমন একটা লিস্ট থেকে বাছাই করে মুভি দেখতাম। স্কিল বাড়ানোর জন্য ইউটিউব দেখে ইলাস্ট্রেটর, ফটোশপ ও ভিডিও এডিটিং শেখা শুরু করলাম। গল্পের বইগুলো থেকে ধুলাবালু ঝাড়ার সময় পাঁচ-ছয় বছর আগের জমানো কিছু কিশোর আলো পেলাম। তখন ফোন ছিল না, ফেসবুক ছিল না, এই কিশোর আলোই ছিল অবসরের বন্ধু। যেহেতু অনেক আগের, তাই এগুলো আবার শুরু করলাম। পড়তে পড়তে হারিয়ে গেলাম সেই সুন্দর কৈশোরে।

রাতুল শিকদার

৩.

গান শুনি, মুভি দেখি

এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেশ কিছু দিন হলো। বাসা থেকে শেষ বের হয়েছিলাম ১৩ মার্চ। তারপর থেকে বাসায়ই আছি। পড়াশোনার চাপ তো এখন নেই। তাই কিছুটা অলসতার সঙ্গে আমার দিন কাটছে। অনেকগুলো গল্পের বই ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি। পুরোনো কিআগুলো বের করে রিভিশন দিচ্ছি। তা ছাড়া সিনেমা দেখা, গান শোনা (গান শুনতে শুনতে আবার একটু নাচানাচি করা), ওয়েব সিরিজ দেখা এসব করেই সময় যাচ্ছে। টেন মিনিট স্কুলের কল্যাণে  মাঝেমধ্যে ওপরের ক্লাসের পড়াশোনা একটু দেখছি। তা ছাড়া বন্ধু, কাজিনদের সঙ্গে গ্রুপ ভিডিও কলে কথা হয়। আর বাকি সময় এটা–সেটা ভাবতে ভাবতেই চলে যায়। একটি সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেদিন ভোর হওয়ার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম একটু একটু করে চারদিক আলোকিত হচ্ছে। বহুতল বিল্ডিংগুলোর মাঝখানে সুন্দর এক টুকরা আকাশ দেখা যাচ্ছে। পাখির কিচিরমিচিরও শুরু হলো। ঠান্ডা আরামদায়ক হাওয়া আসছে। অন্য রকম মিষ্টি গন্ধ। সেদিন অনেকটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটালাম। অন্যদের মতো আমারও ঘরে থাকতে সে রকম ভালো লাগছে না। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে সবাইকে কিছু নির্দেশনা মেনে এখন ঘরে থাকতে হবে। আমরা সবাই চাই, যত দ্রুত সম্ভব আগের অবস্থা ফিরে আসুক। আমাদের মিলিত প্রচেষ্টায় সেটা অবশ্যই সম্ভব হবে।

আরিয়ানা মোস্তাফিজ 

সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ 

অলংকরণ : আরাফাত করিম
অলংকরণ : আরাফাত করিম

৪.

গিটার বাজানো শিখেছি

গত ২ মার্চ আমার এসএসসি পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। এসএসসি পরীক্ষা–পরবর্তী লম্বা ছুটি নিয়ে সবার মতোই অনেক পরিকল্পনা ছিল আমারও। এখানে যাব-সেখানে যাব, এটা করব, সেটা করব, কত্ত প্ল্যান! কিন্তু পরীক্ষা যখনই শেষ হলো, তখন পৃথিবী করোনার করাল গ্রাসে ভুগছে, যদিও দেশে তখনো ছড়ায়নি। প্রথম কয়েক দিন স্বাভাবিকভাবেই অনেক আনন্দে ছুটি কাটল, অনেক জায়গায় ঘুরতে গেলাম। কিন্তু মা–বাবা চিকিৎসক হওয়ায় করোনা দেশে প্রবেশ করার আগে থেকেই সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে চলতে হয়েছে। আর ১৮ মার্চ থেকে তো শুরু হয়েছে পুরোপুরি বন্দিজীবন। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া বোনেরও স্কুল ছুটি। এখন আমার দিন কাটে গল্পের বই পড়ে, কিআ পড়ে, গান শুনে, বোনের সঙ্গে লুডু খেলে আর বাসায় বসে মুভি দেখে। এই বন্ধে গিটার বাজানোটা শিখে ফেলছি আমি। বিকেলবেলা যখন বাবা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরে, তখন করোনা প্রতিরোধে মহাযজ্ঞ শুরু হয়। গোসলের আগে বাবা কোনো কিছুতে হাত দেন না। গাড়ির শব্দ পেলে আমরা দরজা খুলে দিই, এমনকি হাত ধোয়ার জন্য কলও আমরা চালু করে দিই। এই লেখাটা যেদিন লিখছি, সেদিন আমার ঘরবন্দী জীবনের অষ্টম দিন। খুব অবাক লাগে ভাবতে, যে আমি কয়েক মাস আগে স্কুল-কোচিংয়ে ছুটতে ছুটতে বাসায় থাকার সময় পেতাম না, সেই আমি এখন বাসায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত। আশা করি এই দুর্যোগ দ্রুত কেটে যাবে, আবার সেই চিরচেনা রূপ ফিরে পাবে ব্যস্ত শহর ঢাকা, চিরচেনা রূপ ফিরে পাবে আমাদের পৃথিবী।

সারা বিনতে মতিউল

এসএসসি পরীক্ষার্থী, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, খিলগাঁও, ঢাকা 

৫.

প্রতিদিন একটি করে বই

আজ ২৫ মার্চ ২০২০, সময় রাত ১১টা ৪৮ মিনিট। করোনা ভাইরাসের জন্য আজ সপ্তম কোয়ারেন্টিন অবস্থায় বাসায় নিরাপদে অবস্থান করছি। এই দিনকাল আমার জন্য খুব চমৎকার যাচ্ছে। বাইরে বেরোতে পারছি না বটে, কিন্তু বাসায় থেকেও খারাপ লাগার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কেননা, আমার মা-বোন যারা আমার জন্য সব সময় কষ্ট করে, তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর খুব সুন্দর সুযোগ হয়েছে। প্রতিদিন একঘেয়েমি স্কুল আর প্রাইভেটের জ্বালায় তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর খুব কম সুযোগ হয়েছে। আমি তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ঘরোয়া কাজে যুক্ত হয়েছি, বিভিন্ন ঘরোয়া কাজ করা শিখছি। আম্মু আমাকে রান্না করা শেখাচ্ছে, আর এদিকে আপু আমার পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের সময় অনুযায়ী পড়ালেখা করে অন্য যেকোনো কাজ করলে তারা আমাকে বাধা দেয় না। শুধু একটাই বাধা, বাইরে যাওয়া যাবে না, এমনকি আমি বাইরে যেতে ইচ্ছুকও না। আমি বই পড়ার টার্গেট ধরেছি, যেমন ছুটির এ সময় আমি ২০টি গল্প–উপন্যাস পড়ে শেষ করব। প্রতিদিন একটা করে বই পড়ছি। শুরু করি ঘরে আর শেষ করি বাসার ছাদে মাঠ বরাবর চেয়ার পেতে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে। মাঝেমধ্যে ছাদে বসে অতিরিক্ত সময়ে আমি কবিতা লিখি। কবিতা লেখা আমার অন্যতম শখ। ছুটির এ সময়টিতে আম্মু আর আপু বিভিন্ন ঘরোয়া সুস্বাদু খাবার রান্না করছে। এই কোনো দিন সেমাই, কোনো দিন কাস্টার্ড, কোনো দিন সকালে নাশতার বদলে খিচুড়ি। আমি কোনো দিক থেকেই বাসার জীবনকে অসহায় মনে করছি না। এদিকে আমার বন্ধু থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগ আমাকে তাদের থেকে দূরে রাখেনি। প্রতিদিন ভিডিও কিংবা অডিও কলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ছুটির এ সময় আমি বাসায় বসে কিছু উৎসাহমূলক কাজ করার চেষ্টা করছি। নিজে বাসায় বিভিন্ন উৎসাহমূলক ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে যেমন সবার মাঝে উৎসাহ ছড়িয়ে দিচ্ছি, তেমনি নিজে উৎসাহিত হচ্ছি। আবার বাইরের বিশ্বের শোচনীয় অবস্থা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে ভুলিনি। সবাইকে করোনা সম্পর্কে ভিডিও তৈরির মাধ্যমে সতর্ক করেছি। সবাই আমাকে খুব উৎসাহ দিয়েছে, প্রশংসা করেছে। আমার এই দিনকাল মোটেও খারাপ যাচ্ছে না, বরং খারাপ পরিস্থিতিকে নিজের আপন অনুকূলে আনতে আমি শিখে গেছি। আমি অনেক কিছু শিখেছি এবং অনেক ভালোবাসা পেয়েছি এই সময়ে।

অনিম হাসান

১০ম শ্রেণি, আফরোজ খান মডেল স্কুল, ময়মনসিংহ