বৃষ্টির ঠিকানা: এক স্নেহে ভেজা উপাখ্যান

আমেরিকায় থাকা টুম্পা কেন এই কিশোরীজীবনের প্রথম পাওয়া পুরস্কারের টাকা দিয়ে উড়ে আসতে চায় বাংলাদেশে! সেকি নাড়ির টান? না অন্য কোনো স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা?

বৃষ্টির ঠিকানা বইজুড়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন এই কিশোরীর কথা। লিখেছেন তার অনুভূতি, তার লড়াই আর একজন বাবা—সর্বোপরি একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে তোলার গল্প। তবে কেমন করে?

ডিভি লটারি পেয়ে একদিন শিশু টুম্পাকে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন তার মা। পেছনে রয়ে যায় দেশ, নানান সম্পর্কের মানুষ, টুম্পার অসুস্থ বাবা আর অন্তহীন অভিযোগ।

কিন্তু, না। গল্পের সূত্রপাত এখান থেকে নয়। গল্পের শুরু সেখান থেকে, ‘সাবস্টিটিউট টিচার মানেই সময় নষ্ট’, এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে যখন পর্দায় আসেন ক্রিস্টিনা হেনরিকসন। সব সময় দেশের দুর্নাম শুনতে শুনতে বড় হওয়া টুম্পা এক ভিনদেশি মানুষের কাছে শোনে নতুন বাংলাদেশের কথা। ‘কষ্টসহিষ্ণু’ এক জাতির কথা, যেখানে ‘প্রকৃতি তাদের শুইয়ে দেবার চেষ্টা করে, তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়।’ ‘প্রকৃতি তাদের কিছুতেই হারাতে পারে না।’

টুম্পার মনে ভালোবাসার প্রজাপতি দেশের জন্য পাখনা মেলতে শুরু করে এখানেই। সেই সঙ্গে বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা স্বপ্নও যেন জানান না দিয়েই বাড়তে থাকে।

টুম্পা ছবি আঁকে। ছবি আঁকাটা তার রক্তে মিশে আছে। সে শুধু মানুষের মুখই আঁকে না, আঁকে ভেতরের চরিত্রটাকেও। তাই অ্যালেন গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার কথাগুলো যেন প্রাণ পায় তার ছবিতে। আর টুম্পা পায় তার স্বপ্নভূমি দেখার টিকিট।

টুম্পার মনে ভালোবাসার প্রজাপতি দেশের জন্য পাখনা মেলতে শুরু করে এখানেই। সেই সঙ্গে বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা স্বপ্নও যেন জানান না দিয়েই বাড়তে থাকে

লেখক আট বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকের সঙ্গে পুলিশের খারাপ আচরণে টুম্পাকে যেমন প্রতিবাদী হতে দেখিয়েছেন, তেমনি টুম্পার চোখে তুলে দিয়েছেন সবুজ বাংলাদেশ দেখার মুগ্ধতা।

সুন্দর কাগজে ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির প্রায় এক–তৃতীয়াংশ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ার পর লেখক হাজির করেছেন পিতৃস্নেহ বা পিতার প্রতি ভালোবাসার এমন সব অধ্যায়, যা পাঠককে বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দেয় না।

টুম্পা তার প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজে বের করে, কিন্তু কাছে যেতে পারে না। ছুঁয়ে দেখতে পারে না তার বাবার হাত, মুখ, চুল। কিংবা জড়িয়ে ধরে বলতে পারে না, ‘বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ কারণ, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত তার বাবা তাকেও ভয় আর অবিশ্বাস করে। মনে করে, টুম্পাও বুঝি হত্যাকারী দলের একজন। টুম্পার বুকে তখন কষ্টের ঝড়। কেমন করে সে তার বাবাকে বোঝাবে, ‘মেয়েরা সব সময় তার আব্বুদের কাছে থাকে। তাদের আব্বুদের পাহারা দেয়।’

সিজোফ্রেনিয়া হয়তো পরোপুরি ভালো হয় না কোনো দিন। কিন্তু তাকে সহনীয় করা যায়। রোগী ফিরে আসতে পারে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে। ডাক্তারের বরাত দিয়ে এই বার্তাই দিয়েছেন লেখক।

তাহলে টুম্পা কি পেরেছিল তার বাবাকে মিথ্যা ভয়ের রোগ ‘ভয়ংকর মানসিক ডিজঅর্ডার’ সিজোফ্রেনিয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে? বাবার জন্য যার মনজুড়ে ঝুমঝুম বৃষ্টি, সেকি পেরেছিল বৃষ্টিতে ভেজাতে দাবদাহে পুড়তে থাকা বাবার শরীর, মন কিংবা ভাবনাগুলো? নাকি চার সপ্তাহের ছুটিতে আসা কিশোরী ফিরে গিয়েছিল তার স্বপ্নের স্বদেশ থেকে, বাবার স্নেহের হাত ছেড়ে দূরের দেশে? নাকি খুঁজে পেয়েছিল বাঁচতে শেখানো এক বৃষ্টির ঠিকানা?

জানতে হলে পড়তে হবে বইটি। আর বারবার না পড়লে এ বই পড়ে কান্নার আনন্দ পাঠক কেমন করে পাবেন!