ভয়ংকর সুন্দর গল্প!

রাত ৪টা বেজে ৫৪ মিনিট। এটাকে পুরোপুরি রাত বলা যায় না। কেননা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুনসান সকাল নামতে শুরু করবে ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কে। কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ আর আবছায়া অন্ধকার মিলে এল কাপিতানের পশ্চিম ধারটায় এখনো আধিভৌতিক আবহ তৈরি করে রেখেছে। এমনই এক পরিবেশে ২০১৬ সালের নভেম্বরের কোনো এক ভোরে খাড়া গ্রানাইটের দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করেছেন অ্যালেক্স হোনোল্ড। পেশাদার পর্বতারোহীরা এই মুহূর্তে তাঁকে দেখলে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকতেন। তাঁরা এত দিন যেটাকে ‘অসম্ভব’ বলে সংজ্ঞায়িত করে আসছেন, সেটিই করে দেখাচ্ছেন হোনোল্ড। একদমই খালি হাত এবং একজোড়া রাবারের জুতা পায়ে পৃথিবীর অন্যতম খাড়া পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছেন দক্ষ আরোহীর মতো! কোনোরকম সতর্কতা নেওয়া হয়নি, দড়ি বা অন্য কোনো সরঞ্জামের সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে না। একটু পিছলে গেলেই পড়তে হবে আধা মাইল নিচের পাথুরে শিলার ওপর।

মৃদু বাতাস এসে এলোমেলো করে দিয়ে যায় তাঁর চুল। চতুর দৃষ্টিতে তিনি খুঁজতে থাকেন পাথরের কোনো ভাঙা অংশ কিংবা খাঁজ, যেটা বেয়ে ওঠা যাবে কিংবা রাখা যাবে পা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর ওপর কয়েক ফুট অংশ যেন মসৃণ পাথর! তাঁর গায়ে ভাঙা অংশ, খাঁজ কিংবা এবড়োখেবড়ো জায়গা একটুও নেই। শুধু বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে শরীরের ভরকে নিয়ন্ত্রণ করে খুব সাবধানে ঘেষে ঘেষে এটুকু পথ উঠতে হবে অ্যালেক্স হোনোল্ডকে। তাঁর মতে, এটা অনেকটা পাতলা কাচের ওপর হাঁটার মতো, যেখানে সূক্ষ্ম কোনো ভুল করলেই ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হবে কাচের তৈরি পথ। নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ দরকার শরীরের ভর এবং ভার সামলানোর ওপর।

পায়ের আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। কেমন অসাড় হয়ে আছে। ডান পায়ের গোড়ালিটা ফুলে শক্ত হয়ে আছে। মাস দুয়েক আগে এখানে প্র্যাকটিস করতে এসে পা পিছলে পড়ে এ অবস্থা হয়েছে। তবে সেবার দড়ি বাঁধা ছিল কোমরে। কিন্তু এবার পা ফসকানোর কোনো সুযোগ নেই। এভাবে পাহাড়ে ওঠাটা কোনো বিপজ্জনক খেলার মতো নয়, যে ভুল করলে হয়তো এতে মৃত্যু হতে পারে। এখানে ‘হয়তো’–এর কোনো জায়গাই নেই। পাহাড়ি খাদ হাতছানি দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে ডেকে বেড়ায় সারাক্ষণ।

ছয় শ ফুট নিচ থেকে অ্যালেক্সের কোমরে ঝোলানো বাতিটাকে অনেকক্ষণ ধরে স্থির দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে ওটা নড়ছে না। কারণও আছে! সাত বছর আগে যখন এই ইচ্ছাপূরণের পরিকল্পনা করে, তখন থেকেই এই অংশটুকু ওঠাটা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। নামকরা আরোহীদেরও এটুকু উঠতে ঘাম ঝরে যায়। কোনো রকম সাহায্য ছাড়া ওঠাটা তো কেউ ভাবতেই পারেন না! এখন তাঁকে সেটুকুই পাড়ি দিতে হবে কোনো সাহায্য ছাড়া, একক নৈপুণ্যে।

অবশেষে নড়ে উঠল আলোক উৎসটা। একটু একটু করে ওপরে উঠতে থাকলেন। সম্ভব হলো তবে! কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অ্যালেক্স হোনোল্ড পাড়ি দিলেন দুর্গম অংশটা।

ব্যাপারটাকে পাগলামি লাগছে না? এভাবে জীবন বাজি রেখে একক নৈপুণ্যে পাহাড়ে ওঠার কথা শুনলে বেশির ভাগ মানুষই তাই বলবেন। বলার কারণটাও তো ফেলনা নয়! বেশির ভাগ মানুষই এই চেষ্টা করতে গিয়ে মারা গেছেন। সুদীর্ঘ সেই মৃত্যুতালিকার জন্য সমালোচকেরাও এটাকে বাজে আর বিপজ্জনক খেলা হিসেবে দেখেন। হাতে গোনা কয়েকজন কেবল এতে খেলার রোমাঞ্চকর অনুভূতি টের পান। তাঁদের মধ্যে বড় নাম অস্ট্রিয়ান পর্বতারোহী পল প্রয়েস। যাঁকে ‘একক নৈপুণ্যে পাহাড়ে ওঠা’র জনক বলা যায়। তাঁর মতে, সত্যিকারের পর্বতারোহণ হচ্ছে কোনোরকম কৃত্রিম যন্ত্রপাতির সাহায্য না নিয়ে কেবল শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা দিয়ে পাহাড় জয় করা। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই দড়ি ছাড়া একক নৈপুণ্যে প্রায় ১৫০ বার পর্বতারোহণ করে ইউরোপজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন পল প্রয়েস। কিন্তু ১৯১৩ সালের ৩ অক্টোবর অস্ট্রিয়ান আল্পসের ম্যান্ডকোজেলের উত্তর ভাগের পাহাড় একক নৈপুণ্যে আরোহণ করার সময় পড়ে গিয়ে তাঁকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়।

প্রয়েস মারা যান, কিন্তু বেঁচে থাকে তাঁর আইডিয়া। যেটা ষাট ও সত্তরের দশকের আরোহীদের নিজ নৈপুণ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই পাহাড়ে চড়তে উৎসাহী করে তোলে। তবে আবার সাড়া ওঠে ১৯৭৩ সালে, যখন হেনরি বারবার ইয়োসেমাইটের সেন্টিনেল রকের উত্তর ভাগের খাড়া ১ হাজার ৫০০ ফুট উঠে যান কোনো দড়ি ছাড়াই। কিন্তু ১৯৮৭ সালে কানাডিয়ান যুবক পিটার ক্রফট তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। এক দিনেই পরপর ইয়োসেমাইটের বহুল পরিচিত দুই পাহাড় অ্যাস্ট্রোম্যান ও রস্ট্রাম জয় করে ফেলেন।

ক্রফটের কীর্তির বহুদিন পর, ২০০৭ সালে ইয়োসেমাইটের উপত্যকায় আসেন ২২ বছর বয়সী লাজুক যুবক অ্যালেক্স হোনোল্ড। ক্রফটের কীর্তির পুনরাবৃত্তি মানে এক দিনেই আবারও অ্যাস্ট্রোম্যান আর রস্ট্রাম জয় করে শোরগোল ফেলে দেন হোনোল্ড। পরের দুই বছর আরও কয়েকটি পাহাড়ি পথ একক নৈপুণ্যে আরোহণ করে ফেলেন। কিন্তু তাতে মন ভরছিল না তাঁর। আরও বড় কোনো অর্জন চাই!

২০০৯ সালে প্রথমবার হোনোল্ড এল কাপিতানকে খালি হাতে জয় করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আশপাশের সবাই পাগলাটে এক ইচ্ছাই ভেবেছিল এটাকে। কিন্তু তিনি বদ্ধপরিকর। আত্মবিশ্বাসও আকাশচুম্বী। সঙ্গে পাথুরে দেয়াল বেয়ে ভোজবাজির মতো তরতর করে উঠে যাওয়ার দক্ষতা তো ছিলই।

যে–ই ভাবা সেই কাজ! এল কাপিতান নিয়ে গবেষণায় নেমে পড়েন অ্যালেক্স। দিনের পর দিন পড়ে থাকেন এটা নিয়েই। কখনো দড়ি নিয়ে পুরোটা ওঠেন। কখনো–বা খালি হাতে কিছু অংশ। কখনো মধ্যদুপুরে, যখন রোদের তাপে পাথর আগুনের মতো হয়ে থাকে, তো কখনো শীতের ভোরে যখন আঙুল অসাড় হয়ে যেতে চায়। দড়ি নিয়ে ওঠার সময়ও চলতে থাকে পরীক্ষা। হাতের আঙুল, কাঁধ, পা, বাহু—শরীরের যত অংশের সাহায্যে বেয়ে ওঠা যায়, সবগুলোর সাহায্যেই উঠতে থাকেন। সঙ্গে দম, ফুসফুসের জোর, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ, আচমকা ঘটা সমস্যার সমাধান আর মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করাটা তো ছিলই। কিন্তু প্রতিবারই মসৃণ কয়েক ফুট পার হওয়া ছিল ভয়ানক অংশের শুরু। কারণ ওপরের দিকটা আরও ভয়াবহ। চিমনির মতো ফাঁকা পাথুরে ভাঙা অংশ রয়েছে, যেটায় হাত-পা সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রশস্ত করে দিয়ে কেবল হাত-পায়ের তালু ব্যবহার করে এক এক ইঞ্চি করে উঠতে হবে। তার ২ হাজার ৩০০ ফুট ওপরে রয়েছে আরও জটিলতর ব্যাপার, যেটাকে বলে বোল্ডারস প্রবলেম বা নুড়ি পাথরের সমস্যা। যেটা উঠতে সবচেয়ে বেশি কসরত করতে হয়।

বছরখানেক ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই অনুশীলন করে গেছেন হোনাল্ড। সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে প্রতিবার উঠেছেন দুরূহ পাহাড় বেয়ে। তবে পিছলেও পড়েছেন মাঝেমধ্যেই! কিন্তু ব্যর্থতা সফলতার স্তম্ভ। আর হোনাল্ড তো আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি, তাঁর মনোবলে চির ধরাতে পারেনি। হাতের তালুর মতো চিনে নেওয়া পথটাকে খালি হাতে তো জয় করেছেনই, বরং প্রায় দশ-বারোবার উঠেছেনও কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়া। পর্বতারোহণের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়েই থাকবে একক নৈপুণ্যে অ্যালেক্স হোনোল্ডের এল কাপিতান জয় করাটা।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক