ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষ

বন্যার ভয়াবহ রূপ যারা দেখেনি, তারা কল্পনাও করতে পারবে না প্রবল পানির স্রোতে কীভাবে গোটা জনপদ ভেসে যেতে পারে। এখন সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা চলছে। তবে পানি নামতে শুরু করলেও কমেনি দুর্ভোগ। কী দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে বন্যাকবলিত মানুষ! বাড়িতে বাড়িতে বুকপানি, গলাপানি। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সব তলিয়ে গেছে পানির নিচে। ঘরে খাবার আর সুপেয় পানি নেই। চলাচলেরও উপায় নেই। ফলে এখনো অনেক স্থানে ঘরবন্দী মানুষ!

বন্যার পানিতে উপদ্রব বেড়েছে সাপ, জোঁক আর পোকামাকড়ের। বাড়ছে পানিবাহিত রোগব্যাধি। ভেসে গেছে খেতের ফসল, তলিয়ে গেছে পুকুরের মাছ। পানিতে ডুবে মারাও গেছেন অনেকে। ডুবে মারা গেছে শত শত গবাদিপশু-পাখিও। এত হতাহতের পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীর বইখাতাও পানিতে ভেসে গেছে, ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। টানা ভারী বৃষ্টি হওয়ায় রোদের দেখা মেলেনি সপ্তাহখানেক। ফলে ভিজে যাওয়া বইপত্র শুকাতেও পারেনি শিক্ষার্থীরা। একই অবস্থা ঘটেছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও। ডুবে গেছে তাদের বেশির ভাগ পরীক্ষাকেন্দ্রও।

বন্যার কারণে আপাতত এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলেও কদিন পরই তা অনুষ্ঠিত হবে। তাই বইখাতা হারিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা এখন হাপিত্যেশ করছে। এখন মন ভালো নেই কারও। কী কষ্টেরই না বিষয়টি! যেমন বলা যায়, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তারিন বেগমের কথা। গেল ৩ জুন তারিনের বাবা মারা যান, এরপর ১৫ জুন সিলেটজুড়ে আসা বন্যার পানি তারিনদের ঘরেও ঢুকে পড়ে। এক রাতের ব্যবধানেই হাঁটুপানি রূপ নেয় কোমরপানিতে। ভিজে যায় তারিনের বইখাতা। পড়াশোনা তো দূরের কথা, তারিনদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয় উঁচু স্থানে, নিরাপদে। বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই বইখাতা হারিয়ে তারিনকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে।

অনেক বয়স্ক মানুষেরা বলছেন, তাঁরা জীবদ্দশায় এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখেননি। পানির তীব্রতা আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা এর আগে এতটা বাবা-দাদাদের মুখেও শোনেননি তাঁরা। অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) একটা তথ্য দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। আইএমডি জানিয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জি সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। ১৭ জুন ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। মূলত এ বৃষ্টির প্রভাবই বাংলাদেশে পড়েছে।

ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর সিলেটে টানা ভারী বৃষ্টির প্রভাব এতটাই ভয়াবহ হয়েছে, যত দূর চোখ যায় কেবল বন্যার পানিই চোখে পড়ে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই নৌকা কিংবা কলাগাছ দিয়ে বানানো ভেলায় করে চলাচল শুরু করতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। যাঁদের নৌকা কিংবা ভেলা নেই, পুরোপুরি ঘরবন্দী হয়ে পড়ে তাঁরা। এমনকি বন্যার পানি ক্রমশ বাড়তে শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবেন বানভাসি মানুষ, এর জন্যও কোনো সুযোগ তাঁদের কাছে ছিল না। জেনে অনেকের মনে বিস্ময় জাগবে, যে রাস্তা দিয়ে দাপিয়ে বেড়াত ট্রাক, মাইক্রো আর বাস, সেখানেই কোমরপানি থেকে বুকপানি। এর চেয়ে বড় কথা পানিতে রান্নাঘর আর চুলা তলিয়ে যাওয়ায় বাড়িতে বাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ ছিল। অনেকে খেয়ে না খেয়ে কিংবা আধপেট খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার শুধু চিড়া–মুড়ি খেয়েই দিনরাত কাটিয়েছে।

আশার কথা হচ্ছে, পানি ক্রমাগত কমছে। আরও কয়েক দিন গেলে পানি হয়তো পুরোপুরি নেমে যাবে। এখন যেসব স্থান থেকে পানি নেমে গেছে, সেসব এলাকায় দুর্ভোগ বরং আরও বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, বন্যার পানির তীব্র স্রোতে মাটি, ছন, বাঁশ আর টিনের ঘরের বেড়া দুমড়েমুচড়ে গেছে, দেবে গেছে মেঝে, হেলে পড়েছে খুঁটি। তোশক, কাপড়চোপড় ভিজে বিনষ্ট হয়েছে। কারও গোয়ালের গরু কিংবা পুকুরের মাছ গেছে ভেসে। চেয়ার-টেবিল পানিতে দীর্ঘদিন তলিয়ে থাকায় কাঠ পচে বিনষ্ট হয়ে পড়েছে, এতে শিক্ষার্থীরা পড়েছে মহাবেকায়দায়। তবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। ২৫ জুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুরে আয়োজিত এক সভায় জানিয়েছেন, বন্যার পানি নেমে গেলেই এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বন্যা চলে গেলেই কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে বাধা থাকবে না। শিক্ষার্থীরা অনায়াসে পরীক্ষা দিতে পারবে। তখন অবশ্যই পরীক্ষা নেওয়া হবে।

এসএসসি পরীক্ষার রুটিন নিশ্চয়ই দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরায় ঘোষিত হবে, কিন্তু এর আগে পরীক্ষার্থীরা বন্যার ক্ষত মুছে নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে পারবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এমন বিপদের পর পড়াশোনায় মন বসানোই কঠিন একটা কাজ। তোমরা যারা বন্যার কবলে পড়োনি, চেষ্টা করবে আক্রান্ত বন্ধুদের সাহস দিতে। তোমাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণাই পারে ক্ষতটা দ্রুত দূর করিয়ে দিতে।

(কিশোর আলোর জুলাই ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত)