যকের ধন

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজা। রূপকথার গল্পের চিরায়ত সূত্র অনুযায়ী, রাজার থাকবে এক রানি। সুয়োরানি কিংবা দুয়োরানির মতো দুটো থাকলেও আটকায় কে। আরও থাকবে এক সাহসী রাজকুমার। আর পরির মতো সুন্দর এক রাজকুমারী। রূপকথার গল্পের মতো আমাদের এই রাজার এসব ছিল কি না, জানা যায়নি। তবে বিপুল ধনরত্ন ছিল। একবার যুদ্ধে যাওয়ার আগে নিজের সব ধনরত্ন এক মঠে গচ্ছিত রেখে যান তিনি। ধনরত্নের পাহারায় রাখেন এক যককে। এরপর সেই পথের হদিস সাংকেতিক ভাষায় লিখে রাখেন এক মড়ার খুলিতে। কিন্তু যুদ্ধে চরমভাবে হেরে গিয়ে সেগুলো উদ্ধারে আর ফিরে আসতে পারেননি তিনি। তার পর থেকে মহামূল্যবান সেসব ধনরত্ন মাটিচাপা পড়ে থাকে অনেক দিন।

এ ঘটনার অনেক অনেক দিন পরে কলকাতায় ঘটল আরেক ঘটনা। ১৭ বছর বয়সী কুমারের ঠাকুরদাদা মারা গেলেন একদিন। তাঁর লোহার সিন্দুকে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে পাওয়া গেল ছোট্ট একটি বাক্স। দামি জিনিস আছে মনে করে বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এল রংমাখা বিদঘুটে এক মড়ার মাথার খুলি। তা দেখে ভয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে পাড়া মাতালেন কুমারের মা। মায়ের নির্দেশে সেটি তক্ষুনি বাড়ির পাশের এক আবর্জনার স্তূপে ফেলে আসতে হলো। সে ঘটনা পাড়ার করালী মুখুয্যের কাছে কথায় কথায় জানিয়েছিল কুমার। সেদিন রাতেই তাদের বাড়িতে চোর এসে সিন্দুক ঘেঁটে গেল। সব লক্ষণ দেখে বোঝা গেল মড়ার খুলিটিই নিতে এসেছিল চোর। কিন্তু এত সব জিনিস থাকতে ওটি কেন?

সে প্রশ্নের উত্তর জানতে, আবর্জনার স্তূপ থেকে মড়ার খুলি ফের কুড়িয়ে আনল কুমার। অবাক ব্যাপার, পানি লেগে খুলি থেকে রং উঠে কিছু অদ্ভুত অঙ্ক উঁকি দিয়েছে। পানি দিয়ে ধুয়ে সব রং তুলে আজগুবি এক সারি সংখ্যা দেখতে পেল কুমার। চৌবাচ্চা বা বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্কও সম্ভবত এর চেয়ে অনেক সোজা। মড়ার মাথার মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝতে পেরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিমলের কাছে ছুটে গেল কুমার। বিমলের আবার মাথা একেবারে সাফ। গায়েও জোর আছে মাশাল্লাহ। বন্দুক চালাতেও সিদ্ধহস্ত।

অনেক গবেষণার পর বিমল পাঠোদ্ধার করল বিদঘুটে সেই অঙ্কের রহস্য। দেখা গেল, সেটি আসলে এক গুপ্তধনের পথের হদিস। করালী কেন মড়ার খুলি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেটি বুঝতে বাকি রইল না। অবশ্য সেদিন রাতেই চুরি হলো মড়ার খুলি। বিমল আর কুমারের গতিবিধির দিকেও নজর রাখতে লোক লাগিয়ে দিল করালী মুখুয্যে। তাই পদে পদে বিপদের হাতছানি থাকা সত্ত্বেও অনেকটা তড়িঘড়ি করে গুপ্তধন উদ্ধারে আসামের খাসিয়া পাহাড়ের দিকে ছুটল বিমল আর কুমার। পিছু নিল খুনে সাক্ষাৎ শয়তান করালী আর তার দলবল। শুরু হলো এক রুদ্ধশ্বাস অভিযান।

সত্যি বলতে কি, বাংলা ভাষায় এ রকম মৌলিক রহস্য-রোমাঞ্চ আর দুঃসাহসী অভিযানের গল্প খুব কমই আছে। এমন অসাধারণ রহস্য উপন্যাসটি লিখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩ খ্রি.)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯০৩ সালে সে সময়ের নামকরা বসুধা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্পটি। এরপর হেমেন্দ্রকুমার হাত দিয়েছিলেন ছোটদের জন্য রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরপুর গোয়েন্দা আর অভিযানের গল্প লিখতে। অবশ্য ভূতের গল্পও বাদ যায়নি তাঁর কলম থেকে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সৃষ্ট চরিত্র বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক জুটি পাঠকের কাছে এখনো জনপ্রিয়। বিমল আর কুমার জুটি নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস যকের ধন। যারা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য সব সময় ছোঁক ছোঁক করো, তাদের এ বই অবশ্যপাঠ্য। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে। যেটি খুশি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলতে পারো।