যে গল্পে ‘ছোট’ নয় ‘ছোট’রা!

‘লেখা নিয়ে কত যে মজার সব ঘটনা ঘটবে, বলে শেষ করা যাবে না। একদিন আলী ইমাম, মুনতাসীর মামুন আর আমি ললনা অফিস থেকে ইত্তেফাক -এ দাদাভাইয়ের কাছে যাচ্ছি। তখন বেশির ভাগ সময় হেঁটে চলাফেরা করতাম। নীলক্ষেত থেকে সেগুনবাগিচা, সেখান থেকে হাটখোলা মোটেই দূর মনে হবে না। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা আলোচনা করছিলাম গল্পের বিষয় নিয়ে। বলাবলি করছিলাম যেকোনো বিষয় নিয়ে গল্প লেখা হতে পারে। মতিঝিলে আমেরিকান এক্সপ্রেস ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার এক পাশে ন্যাড়া একটা গাছে ছোট একটা সাদা ফুল ফুটে আছে দেখে বললাম, এই গাছটা নিয়েও গল্প হতে পারে। তখন আমাদের তিনজনের ভেতর কে ভালো গল্প লেখে এ নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হতো। তখন জাহির করার এমন সুযোগ সবাই লুফে নিল। সাত দিন পর তিনজন সেই ন্যাড়া গাছ নিয়ে তিন রকমের গল্প নিয়ে দাদাভাইকে দিয়ে এলাম। তিনটা গল্পই ছাপা হয়েছিল।’

ওপরের লেখাটুকু আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৮ সালে বেরোনো মিছিলের একজন বইয়ের ভূমিকা থেকে নেওয়া। লেখক আলী ইমাম এবং ইতিহাসবিদ লেখক মুনতাসীর মামুনকে আমরা সবাই চিনি। আর ওই দুই লেখকের বন্ধুর লেখা গাছ নিয়ে ওই গল্প তোমরা পাবে মিছিলের একজন বইয়ের শেষ গল্প হিসেবে ‘সাদা প্রজাপতি’ নামে। গল্পটা আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে লেখা; আগেও পড়া বহুবার। আজ আবার নতুন করে পড়তে নিয়ে বরাবরের মতোই স্তম্ভিত হয়েছি। কী অসামান্য গল্প! অথচ যখন লেখক লিখেছেন ওই গল্প, তখন বয়সে তিনি কিশোর থেকে তরুণের মাঝামাঝি মাত্র।

এই লেখকের নাম শাহরিয়ার কবির।

আমাদের কৈশোর রাঙিয়ে দেওয়া এক লেখক। আমাদের বাংলা ভাষায় হাতে গোনা যে কটি লেখা তৈরি হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য, যেখানে তাদের ‘ছোট’ ভাবা হয়নি, বরং ‘পুরো মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেই সব লেখার প্রায় পুরোটাই এক হাতে লিখে গেছেন এই সাহিত্যিক। শিশু-কিশোর সাহিত্য যে নিছক হাস্যরস কিংবা ছেলে ভোলানো গল্প নয়, সেই গল্পেও থাকে দেশপ্রেম-সংগ্রাম, রাজনীতি এমনকি এক-আধটু রোমান্সও, সেই ধারণাটি দাঁতে দাঁত কামড়ে রীতিমতো একাই প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন এই শাহরিয়ার কবির।

তাঁর লেখা নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় বইটি বেরোয় ১৯৭৬ সালে এবং বেরোনো মাত্রই সদর্পে জায়গা করে নেয় চিরসবুজ কিশোর উপন্যাসের তালিকায়। বাবু, আবির, টুনি, নেলী খালা, পোষা কুকুর স্ক্যাটরা, নিকুঞ্জ পাকড়াশী, বুড়ো বুৎজুদ্ধি ওরফে তানভীর সাহেব—এই অন্য রকম অ্যাডভেঞ্চার গল্পে? নেলী খালার জলপাই সবুজ চিঠির কথা দিয়ে শুরু হওয়া এই গল্প একবার পড়লে ভোলা অসম্ভব এই এক জীবনে। হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানার মতো কিশোর উপন্যাস আর কটাইবা লেখা হয়েছে এই বাংলায়, কিংবা বিশ্বসাহিত্যেও, সেটিও প্রকাশ পেয়েছিল ওই একই বছরে? ‘হারিয়ে যাওয়ার সময়’ নামের অধ্যায় দিয়ে শুরু হয়ে। ‘হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা’য় শেষ হওয়া এই উপন্যাসে স্কুলের বছর শেষের পরীক্ষার পরে গল্পটি চোখ বন্ধ করলে এখনো আমি দেখতে পাই ঠিক সিনেমার মতো; পড়ার এত বছর পরেও!

কিশোর আলোর গল্পটি মেনে মোটাসোটা এই আমি রাজ্যের আলসে। হাতি দিয়ে টেনেও বিছানা থেকে নামিয়ে আমাকে লেখার টেবিলে বসানো বড্ড কঠিন। কিন্তু নাছোড়বান্দা কিশোর আলো আমাকে বসিয়ে দিয়েছে লেখার টেবিলে, আর আমি যখন পুরোনো বইয়ের গন্ধমাখা অনেক স্মৃতিমাখা শাহরিয়ার কবিরের বইগুলো এক-আধটু পড়ছি এই লেখার জন্য; তখন, মনে মনে কিশোর আলোকে ধন্যবাদ দিচ্ছি—এভাবে এক কোমল সকালে আমার হারিয়ে ফেলা কৈশোরের ছুটির সব কিংবা অলস দুপুরগুলো ফিরে দেখার উপায় করে দেওয়ার জন্য!

আমি রীতিমতো বাজি ধরে বলতে পারি, কিশোর আলোর যে কিশোর পাঠক টিফিনের পয়সা জমিয়ে, কিংবা বন্ধুর আলমারি থেকে চুরি করে জোগাড় করে পড়ত শাহরিয়ার কবিরের লেখা এক একটি অসামান্য রচনা; সে-ও আজ থেকে দু-তিন যুগ পর কোনো এক শীতের সকালে ওই বইগুলো হাতে নিলেই হারিয়ে যাবে তার ফেলে আসা কৈশোরে।

এই শক্তি খুব কম লেখকের থাকে।

আমাদের সৌভাগ্য, শাহরিয়ার কবিরের সোনার কলমে এই জোর আছে এবং আমাদের প্রিয় বাংলায় তিনি লিখে গেছেন এমনই অবিস্মরণীয় সব গল্প-উপন্যাস।

ছোটদের ছোট মনে করেন না এই লেখক।

রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের একদল মানুষ অনেক বছর আগে গিয়েছিল জার্মানি। শাহরিয়ার কবিরের ভাষায়, ‘কেউ কেউ সেখানে বিয়েথা করে থিতু হয়ে বসেছিল, যদিও সবার মন পড়ে থাকত বাংলাদেশে’। এরই পটভূমিতে লেখা হয়েছে দুর্দান্ত উপন্যাস বাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ। কিশোরদের লেখায় রাজনীতির এমন দুরন্ত উপস্থিতি নিতান্ত বিরল।

বুলগেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দুই সন্তান রীন ও নীল। ওরা পড়ে ওখানকার সোফিয়ার আমেরিকান স্কুলে। ওই স্কুলের বাইরের সিঁড়িতে বসে শেষ চুইংগামটা মুখে ফেলে রীন বলল, ‘তোর কি মনে হয় শহরে খুব গোলমাল হচ্ছে?’ বাকিটা জানতে পড়া চাই শাহরিয়ার কবিরের লেখা ঝাউবনে ঝড়

লন্ডনে থাকে জনি আর রিনি। ওরাও দুই ভাইবোন। ওদের বাবা এক ডিপার্টমেন্ট শপের ম্যানেজার। মা কাজ করেন এক কনস্ট্রাকশন ফার্মের ডিজাইন সেকশনে। ওদের একমাত্র মামা পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বারবার তিনি ওদের পোল্যান্ডে বেড়িয়ে আসতে বলেন। মা-বাবা দুজনেই ব্যস্ত। তাই সাব্যস্ত হয় জনি আর রিনি বাবা-মাকে ছাড়াই পোল্যান্ড যাবে। লন্ডন থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট, তিন ঘণ্টা পর সেখান থেকে ওয়ারশ। জীবনে প্রথম ওরা বড়দের বাদ দিয়ে অন্য দেশে যাচ্ছে—এ এক অন্য উত্তেজনা। বিমানেই পরিচয় ঘটল আর্ট ভিলার রবার্ট মারাওস্কির সঙ্গে। রিনির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে ভদ্রলোক হয়ে গেল ওদের মারাওস্কি চাচা। তারপরও বাকিটুকু রয়েছে শাহরিয়ার কবিরের রাজপ্রাসাদ ষড়যন্ত্র বইয়ে।

১৯৮৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়কালের রুমানিয়া। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক কমিউনিটি সরকারের পতন হয়েছে। রুমানিয়া তখনো অবিচল। এরই পটভূমিতে লেখা কিশোরদের জন্য এক অনন্য রাজনৈতিক উপন্যাস কার্পোথিয়ানের কালো গোলাপ। যে উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ঘটনা প্রায় পুরোটাই সত্যি।

শাহরিয়ার কবিরের ছোটগল্প তুলনাহীন। তাঁর ছোটগল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বোধকরি ‘একাত্তরের যীশু’। গল্পটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭৩ সালে, অর্থাৎ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর পরই। পরবর্তী সময়ে ওই গল্প অবলম্বনে সিনেমাও তৈরি হয়। পাকিস্তানি সৈনিকদের বর্বরতা, নির্মমতা এক ঘোর লাগা ভাষায় শাহরিয়ার কবির লিখে রেখেছেন এই গল্পের প্রতি অক্ষরে। এ যেন কালিতে ছাপানো অক্ষর নয়, লাল টকটকে রক্তে লেখা অক্ষর।

আবুদের অ্যাডভেঞ্চার, নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা, পাথরিয়ার খনি রহস্য, অনীকের জন্য ভালোবাসা—শাহরিয়ার কবিরের আরও কটি চিরসবুজ গ্রন্থ। পড়া চাই সব কটি।

আমার বাবা মারা গেছেন তিন মাস হলো মাত্র। শাহরিয়ার কবিরের যে বইগুলো সামনে রেখে লিখছি এই লেখা, সেই বইগুলোর বেশ কটা বাবার সঙ্গে গিয়ে একুশের বইমেলা থেকে কেনা। আমার স্মৃতি দুর্বল। পুরোনো কথা মনে থাকে না মোটেও। তারপরও এই বইগুলোর পুরোনো কাগজের গন্ধে আমি চট করে ফিরে গিয়েছিলাম আজ থেকে দুই দশক, কিংবা তারও আগে। মনে পড়ে, বাবার সঙ্গে যাওয়ার ভারি একটা আকর্ষণ ছিল—শাহরিয়ার কবিরের নতুন বেরোনোর বই কেনা, সন্ধ্যায় ফিরেই বিছানায় উবু হয়ে ওই বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে যাওয়া।

বাবার জন্য মন খারাপ হয়, একই সঙ্গে মন খারাপ হয় এই ভেবে—কেন কে জানে, কিশোরদের জন্য আর লেখেন না শাহরিয়ার কবির। তিনি যেন পণ করেছেন আর লিখবেন না কিশোরদের জন্য!

আফসোস!