রেগে রেগেই পাঁচ বছর

 ফিনল্যান্ডের হাড় কাঁপানো শীতের রাত। মার্চের শুরুতে সেদিনও পেঁজাতুলোর মতো আকাশ থেকে তুষার নামছিল। নিজের ছোট্ট উষ্ণ ঘরে একা ৩০ বছর বয়সী ভিডিও গেম ডিজাইনার জাক্কো লিসালো। বসে আছেন নিজের গেম কনসোলের সামনে। একেবারে নটনড়নচড়ন অবস্থা। গেম খেলারও মুড নেই। তার মাথায় তখন একরাশ চিন্তা বরফের মতোই জট পাকিয়ে।

নতুন একটি ভিডিও গেমের আইডিয়া বের করতে হবে শিগগিরই। তাও আবার অ্যাপলের বিখ্যাত আইফোনের জন্য। কিন্তু কোনো আইডিয়াই জুতসই বলে মনে হচ্ছে না। হতাশা আর অস্থিরতায় নিজের চুল ছিঁড়তেই বাকি রেখেছেন তিনি।

অনেক খেটেখুটে এর আগে কয়েকটি নতুন গেমের আইডিয়া তৈরি করেছিলেন তিনি। কদিন আগে সেগুলো রোভিও কোম্পানিকে দেখিয়েছেন। তাঁর সহকর্মী ডেভেলপাররাও জমা দিয়েছিলেন আরও কয়েকটি। কিন্তু সব কটাই বাতিল করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। গেমগুলোর বেশির ভাগই জটিল বলে রায় দিয়েছেন তিনি। কোনো কোনোটি নাকি আবার বেশি সরল, নয়তো বিরক্তিকর। তাই আগের আইডিয়া মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এখন নতুন কিছু ভাবতে হচ্ছে। এমন কিছু বানাতে হবে, যা খেলে সবাই মজা পাবে। খেলাটাও হতে হবে সহজ, থাকতে হবে কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু... কী সেটা...

আলোর ঝলকের মতো হঠাৎ লিসালোর মাথায় নতুন এক ভাবনা খেলে গেল। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলল তাঁর শরীরে। ঝটপট কম্পিউটারে ফটোশপ চালু করলেন তিনি। কী মনে করে যেন গোলগাল একঝাঁক পাখির স্কেচ আঁকতে লাগলেন। পাখিগুলোর মুখে একটু পাগলাটে অভিব্যক্তি। দেখলেই মনে হয়, কোনো কারণে ভীষণ রেগে আছে। প্রায় গোলাকৃতির পাখিগুলোর ঠোঁট হলুদ, ভুরুজোড়াও মোটা আর কোঁচকানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাখিগুলোর পা নেই! এমন পাখি হয় নাকি! কিন্তু তিনি আঁকা থামালেন না।

এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। আবারও বাতিল হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও অফিসে বসসহ অন্যদের সামনে দুরু দুরু বুকে নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করলেন লিসালো। তবে সেই মুহূর্তে গেমটির বিস্তারিত কোনো কিছু বলতে পারলেন না লিসালো। তবে তার পরও ভুরু কোঁচকানো রাগী চেহারার পাখিগুলো পছন্দ হয়ে গেল ঘরে উপস্থিত সবারই। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো এ অদ্ভুত পাখি নিয়েই নতুন এক গেমের ডিজাইন করবেন তাঁরা। রাগী পাখিই হবে গেমটির নায়ক। নায়ক তো পাওয়া গেল কিন্তু ভিলেন? রাগী পাখি তার রাগ ঝাড়বে কার ওপর? কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আবারও চিন্তায় ডুবে গেলেন জাক্কো লিসালো আর তাঁর সহকর্মীরা।

 রিভিয়ো এন্টারটেইনমেন্টে যখন এসব কাণ্ড ঘটছে ঠিক তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে সোয়াইন ফ্লুর দাপট। সে বছর মানে ২০০৯ সালে শয়ে শয়ে মানুষ মরছে শূকর থেকে আসা এক ভয়ংকর ভাইরাসের আক্রমণে। নাম তার  H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। ব্যস! এবার একেবারে হাতেনাতে শত্রু এসে হাজির। এর কয়েক দিন পর, শূকরকেই শত্রু হিসেবে ঠিক করে গেম ডিজাইন করা শুরু হলো। কোম্পানির একদল গেম ডেভেলপার টানা কয়েক মাস খেটেখুটে দাঁড় করাল গেমটি। সে বছর ডিসেম্বরে আইফোনের জন্য ছাড়া হলো। অদ্ভুত ওই রাগী পাখির নামেই গেমটির নাম দেওয়া হলো অ্যাংরি বার্ড।

 অনেকে হয়তো আগেই ধরে ফেলেছ, এতক্ষণ অ্যাংরি বার্ডের কথাই বলছিলাম। গেমের গল্প সাজানো হলো এভাবে: একবার পাখিদের ডিম চুরি করে নিয়ে যায় পাজি শূকরছানার দল। ডিম হারিয়ে ভীষণ রেগে যায় পাখিরা। ডিম উদ্ধার করতে শূকরছানাদের আক্রমণ করে রাগী পাখির দল। গেমটিতে লাল পাখি হচ্ছে প্রধান চরিত্র। এ ছাড়া আছে নীল পাখি, হলুদ পাখি, কালো পাখি, ইগল, বিগ ব্রাদার, কমলা পাখি, সবুজ পাখি। একেক পাখির রয়েছে একেক ক্ষমতা। গুলতিতে পাজি শূকরছানা লক্ষ্য করে ছুড়তে হয়, তা তো সবাই জানোই। পাখিরা রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে শূকরছানাদের আক্রমণ করে, ওদের আস্তানা ধ্বংস করে। এভাবেই আসে পয়েন্ট, বোনাস আর স্টার। একটি ধাপ সফলভাবে শেষ হলে পরের ধাপ খেলা যায়।

শুরুতে ফিনল্যান্ডের আইফোন ব্যবহারকারীরা খেলতে শুরু করল গেমটি। কদিনের মধ্যে দেশটিতে এক নম্বর গেমের মর্যাদা পেল অ্যাংরি বার্ড। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল গেমটি। তারপরের কাহিনি তো ইতিহাস। আইফোনে ব্যাপক সফলতার পর অ্যান্ড্রয়েড, সিম্বিয়ান, উইন্ডোজ ফোন, ম্যাক, পিসি, প্লেস্টেশন, ফেসবুকের জন্য ছাড়া হতে লাগল গেমটি। সবখানেই জনপ্রিয়তার চূড়া স্পর্শ করল অ্যাংরি বার্ড। রিভিয়োর হিসেবে, এখন পর্যন্ত দুই বিলিয়ন মানে বার গেমটি ডাউনলোড হয়েছে। গেম ডাউনলোডের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ। আরেক হিসেবে, প্রতিদিন বিশ্বের অন্তত ৩০ মিলিয়ন মানুষ ৩০ কোটি মিনিট অ্যাংরি বার্ড খেলে কাটায়। সবগুলো সময় একসঙ্গে জোড়া লাগালে তার পরিমাণ প্রায় ৫৭০ বছর। ভাবা যায়!

 প্রথমে অ্যাংরি বার্ডের একটি সংস্করণ থাকলেও এখন প্রায় প্রতি মাসেই আসছে নিত্যনতুন লেভেল, আপডেট আর সংস্করণ। তাই গেমটির প্রতি এখনো বিরক্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি গেমারদের মধ্যে। এখন পর্যন্ত সাতটি স্পেশাল এডিশন প্রকাশিত হয়েছে অ্যাংরি বার্ডের। সেগুলো হচ্ছে: অ্যাংরি বার্ডস সিজন, রিও, স্পেস, স্টার ওয়ারস, ফ্রেন্ডস, স্টার ওয়ারস টু এবং অ্যাংরি বার্ডস গো। এ ছাড়া প্রতি এডিশনেই রয়েছে নিত্যনতুন পর্ব ও আপডেট। তাই শুরু থেকেই সবার মন জয় করেছে অ্যাংরি বার্ডস। ২০১১ সালে ব্রিটেনের বেস্ট গেম অ্যাপ এবং অ্যাপ অব দ্য ইয়ারও জিতেছে গেমটি। বিখ্যাত ওয়েবি পুরস্কারের পক্ষ থেকেও অ্যাংরি বার্ড পেয়েছে বেস্ট গেম ফর হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইসেস। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধ হয় বিশ্বব্যাপী এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।

 শুধু আমজনতাই নয়, গেমটির ভক্ততালিকায় আছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি। চলতি মাসে পাঁচ বছর পূর্ণ করল ভুরু কোঁচকানো রাগী পাখির দল। তাই আপাতত ভুরু কুঁচকে না থেকে এ বেলায় একটু হেসে উঠে বলে নিতে পারো: শুভ জন্মদিন! অ্যাংরি বার্ডস! জয়তু! অ্যাংরি বার্ডস!