সত্যজিতের ছোটগল্প ও অনুবাদ

বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন বেশ দেরি করেই। তবে লেখার ভঙ্গিটা যেন তাঁর সিনেমার মতো গম্ভীর মেজাজের নয়, বরং চমক আর রোমাঞ্চে মোড়া। ঠিক মেলানো যায় না যে পথের পাঁচালী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারুলতা ইত্যাদির পরিচালকই গল্পের ইতি টানছেন শেষ প্যারার টুইস্ট বা পাঞ্চ লাইন দিয়ে। ফেলুদা, শঙ্কু বা তারিনীখুড়োর মতো জনপ্রিয় সিরিজগুলোর পাশাপাশি তাঁর স্বতন্ত্র ছোটগল্পগুলোর জন্যও বাঙালি পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে আছেন তিনি। তেমনি রহস্য-রোমাঞ্চ পাঠকেরাও একেবারে তাঁদের মণিকোঠায় রেখেছেন সত্যজিৎ রায়কে।

সত্যজিৎ পেশাদার ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়, তাই চিত্রকলায় তাঁর আগ্রহ, শ্রম, অবদান—সবই বেশ গভীর। সে প্রভাব পড়েছে তাঁর একদম প্রথম দিকে লেখা ছোটগল্পে। চল্লিশের দশকের শুরুতে ইংরেজিতে লেখা তাঁর দুটি ছোটগল্প abstraction এবং shades of grey দুটিই পেইন্টিং নিয়ে। তবে ওই যে শেষ প্যারার চমক, এ দুটি গল্পেও ছিল সেটা। এরপর বহুদিন তিনি স্বতন্ত্র ছোটগল্প লেখেননি। ২০ বছর পরে ১৯৬২-তে লিখলেন প্রথম বাংলা গল্প বঙ্কুবাবুর বন্ধু। এক ভিনগ্রহবাসী নিয়ে গল্পটা; এটাই হয়তো তাঁর দ্য এলিয়েন নামক চিত্রনাট্য লেখার প্রেরণা। চিত্রনাট্যটি নিয়ে সত্যজিৎ হলিউডেও গিয়েছিলেন, সিনেমাটা বানানোর পরিকল্পনাও ছিল কলাম্বিয়া পিকচার্সের। নানা কারণে সেটা অবশ্য পরে হয়নি, তবে সত্যজিৎ সে সময়কার ভিনগ্রহবাসীর যে অমায়িক চিত্র এঁকেছেন, সেটা বেশ অনন্য ছিল।

তাঁর ছোটগল্পগুলো প্রায় সবই কিশোর উপযোগী। এর একটা কারণ হতে পারে তিনি মূলত শিশু-কিশোর পত্রিকা সন্দেশ-এর জন্যই এগুলো লিখতে শুরু করেন। বিষয়বৈচিত্র্যে গল্পগুলো রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক ইত্যাদি ধরনের, সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল কাহিনির টুইস্ট কিংবা থ্রিল, সাদামাটা ভাষা, অ্যাডভেঞ্চারমুখিতা, মনে রাখার মতো সমাপ্তি ইত্যাদি। সন্দেশ পত্রিকা ছাড়াও তাঁর গল্পগুলো বারোটি করে সংকলন হিসেবে বেরিয়েছে নানা সময়ে। সংকলনের নামই থাকত এমন যে এক ডজনই গল্প আছে তা নিশ্চিত করে বুঝে ফেলত পাঠক, এক ডজন গপপো, আরো এক ডজন, আরো বারো, একের পিঠের দুই, এবারো বারো, জবর বারো, বাছাই বারো, বা! ১২ ইত্যাদি।

সত্যজিতের ছোটগল্প বাঙালি পাঠকদের জন্য বিস্ময়-রসের খোরাক হয়ে থাকবে সব সময়—সে কথা হলফ করে বলা যায়, আটপৌরে জীবনের নানা ব্যস্ততায় অতিষ্ঠ পাঠক পালানোর পথটি সহজেই খুঁজে পাবে তাঁর ডজন ডজন গল্পে। উৎকণ্ঠা, চমক আর মন-ধাঁধানো প্লটের সঙ্গে সরল-মনোমুগ্ধকর ভাষাশৈলীতে মোড়া তাঁর এসব ছোটগল্প তাই অতিক্রম করেছে বয়সের রেখা, ছেলে-বুড়ো—সবার জন্যই মণিমুক্তো ছড়িয়ে রেখে গেছেন সত্যজিৎ রায়।

সত্যজিৎ লেখালেখির ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েল দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন সেটা হয়তো অনুমান করা চলে। কেননা শার্লক হোমস আর ফেলুদা, বিজ্ঞানী চ্যালেঞ্জার আর প্রফেসর শঙ্কু, এমনকি বেশ কিছু ছোটগল্পও তাঁদের দুজনার একই বৈশিষ্ট্যময়। কোনান ডয়েল যে আসলেই সত্যজিতের প্রিয় লেখক ছিলেন, সেটার প্রমাণ মেলে তাঁর করা অনুবাদ গল্পগুলোর দিকে তাকালে। ডয়েলের দ্য টেরর অব ব্লু জন গ্যাপ, দ্য ব্রাজিলিয়ান ক্যাট-এর অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তিনি, যথাক্রমে ব্লু জন গহ্বরের বিভীষিকা এবং ব্রেজিলের কালো বাঘ শিরোনামে। এ ছাড়া সন্দেশ-এর জন্য তিনি অনুবাদ করেন রে ব্রাডবেরির মারস ইজ হেভেন (মঙ্গলই স্বর্গ), আর্থার সি ক্লার্কের দ্য নাইন বিলিয়ন নেমস অব গড (ঈশ্বরের নয় লাখ কোটি নাম)। এ ছাড়া মোল্লা নাসিরুদ্দিনের অনেক কৌতুক চমৎকার রসাল আর মেদহীন অনুবাদ তিনি করেন সন্দেশ-এর জন্য।

তবে যে অনুবাদকর্মটির জন্য তাঁকে অনুবাদে অদ্বিতীয় ধরতেই হবে সেটি হলো তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। বাংলায় অর্থ-অপ্রধান সাহিত্য বা ননসেন্স ধারাকে জনপ্রিয় করেছেন সুকুমার রায়। আর তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ পশ্চিমের অসাধারণ কিছু ননসেন্সকে অনুবাদ করে বড় অবদান রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে। নানা সময়ে সত্যজিৎ তাঁর পিতার কিছু ছড়াকে যেমন ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন, তেমনি ননসেন্স সাহিত্যের দিকপাল এডওয়ার্ড লিয়ার বা লুইস ক্যারলের বেশ কিছু কাজ বাংলায় পাল্টেছেন এই বইটিতে—পাল্টেছেন বলাই ভালো, কারণ এসবের অনুবাদ আসলে হয় না, মূলভাবটা নিয়ে নিজের মতো করে লিখেছেন সত্যজিৎ—সেটা বইয়ের শুরুতে তিনি উল্লেখও করেছেন। এডওয়ার্ড লিয়র তাঁর জীবদ্দশায় লিখেছেন অসংখ্য লিমেরিক, মানে পাঁচ বাক্যের ছড়া, সঙ্গে এঁকেছেন ছবি। সত্যজিৎ সেই ছবিগুলো রেখে আনকোরা বাংলায় রূপান্তর করেছেন সেসবের অনেক। লিয়রের jumblies অবলম্বনে পাপাঙুল, কিংবা ডং উইথ লুমিনাস নোজ-এর যে বিস্ময়কর অনুবাদ তিনি করেছেন, সেগুলো মৌলিক বলাই যৌক্তিক। লুইস ক্যারলের বিখ্যাত জবরওয়াকিসহ বেশ কয়েকটা ছড়ার অনুবাদও করেছেন একইভাবে। এসব পড়লে মনে হয় সত্যজিৎ চাইলেই তাঁর পিতার মতো ছড়ার জগেকও মাতিয়ে রাখতে পারতেন। সুকুমারের আবোল-তাবোল-এর যে বিদায়ী করুণ বাক্যদ্বয়—

‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর’
ঠিক তার আগের লাইনই ছিল
‘আদিমকালের চাদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’

সেই আবোল-তাবোল-এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্যই হয়তো সত্যজিৎ বইয়ের নামটাও সেখান থেকেই নিয়েছেন। তো আর দেরি কেন? ডুব দাও সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প আর অনুবাদের জগতে। যারা আগেই ডুব দিয়েছ, তাদেরও মানা নেই। এ এমনই জগৎ, বারবার ডুব দিলেও কমে না ভালো লাগা।