‘কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে সারা গা। কবে গোসল করিয়ে দেবে আমায়?’
‘এই তো গত সপ্তাহে করালাম। আবার কেন চাইছ?’
‘তোমার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে ছুটতে গিয়েই তো এমন অবস্থা আমার। আমার দুরন্ত গতির জন্য আমার একটু যত্ন তুমি নিতেই পারো।’
মুহিনের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা লাল সাইকেলটা প্রতিদিন এভাবেই একটু যত্নের আবেদন জানায় ওর কাছে। মুহিন কিছু সময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সাইকেলটার দিকে। রোজ সকালে নিয়ম করে সাইকেল চালাতে বের হয় মুহিন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন শহর থেকে দূরদূরান্তে ছুটে যায় সাইকেলটিকে নিয়ে। তবে প্রিয় এই সাইকেলটির ঠিকমতো যত্ন নেয় না মুহিন। তাই নিয়েই রোজ এভাবে অভিমানের আলাপ হয় ওদের।
যারা সাইকেল চালাও আমরা জানি যে তাদের জন্য সাইকেল প্রিয় বন্ধু। প্রিয় বন্ধুর যত্নআত্তির ব্যাপারে একটু সচেতন তো হওয়াই উচিত। তাহলে এসো, জেনে নেওয়া যাক তোমাদের প্রিয় বন্ধু সাইকেলের যত্নআত্তির খুঁটিনাটি।
ফ্রেমের জন্য বাড়তি যত্ন
সাইকেলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ফ্রেম। সাইকেল কতটা মজবুত হবে, তা নির্ভর করে সাইকেলের ফ্রেমের ওপর। ওজন আর গতির একটা বড় কারণ হলো সাইকেলের ফ্রেম। তাই ফ্রেমে যেন দাগ (স্ক্র্যাচ) না পড়ে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সুতি কাপড় দিয়ে সাইকেলের ফ্রেম পরিষ্কার করবে। আর সাইকেল ধোয়ার সময়ও হালকা সাবান পানি আর সুতি কাপড় দিয়ে ফ্রেম মুছে ফেলতে হবে। সাসপেনশনে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে সব সময়। সুতি কাপড়টি তোমার সিটের নিচে রেখে দিতে পারো সব সময়। প্রয়োজনে সাইকেলের ফ্রেম কাভারও ব্যবহার করতে পারো তুমি। আর কাদা থেকে ফ্রেম বাঁচাতে ব্যবহার করতে হবে মাডগার্ড।
বাতাস খাওয়াও সময়মতো
সাইকেলের চাকায় হাওয়া দিতে হবে নিয়ম মেনে। না হলে যেমন তোমার গতি কমে যাবে, তেমনি সাইকেলের চাকার রিংয়েরও ক্ষতি হবে। তুমি যদি বালুতে চালাও তাহলে চাকায় কম হাওয়া থাকলেও চলবে। তবে চাকায় হাওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত চাপ মেনে হাওয়া দিতে হবে। বেশি হাওয়া দিলে যেমন সাইকেল লাফাবে, তেমনি কম হাওয়া হলেও চাকার রিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দূরে কোথাও রাইডে গেলে ব্যাগে অতিরিক্ত টিউব নিতে ভুলবে না কিন্তু। এ ছাড়া চাকার স্পোক বাঁকা হলে বা ভেঙে গেলে দ্রুত বদলে ফেলতে হবে।
চেইনের নিয়মকানুন
জোরে সাইকেল চালাতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে বড় ক্ষতি করি সাইকেলের চেইনের। তাই চেইনের জন্য বেশি সচেতন হতে হবে। প্রতিবার সাইকেল ধোয়ার পর চেইনে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করতে হবে। চেইন কভার থাকলে তা যেন চেইনে আটকে না যায়, সে ব্যাপারে লক্ষ রাখতে হবে। গিয়ার বদলানোর সময় চেইন প্যাড স্বাভাবিক গতিতে ঘোরাতে হবে। না হলে চেইনে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় চেইন ছিঁড়ে যেতে পারে।
টাইট দাও সবাইকে
প্রতিদিন সাইকেল চালানো শুরু করার আগেই দেখে নেবে সবকিছু টাইটভাবে লাগানো আছে কি না। দুই চাকার দুই পাশের নাট সঠিক মাত্রায় টাইট করে নেবে। হ্যান্ডেলবার টাইট হয়ে কতটা শক্তভাবে লাগানো আছে, সেটাও কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অনেকে রেঞ্জ ব্যবহার করে সাইকেলের নাট অনেক বেশি টাইট করে লাগায়। তবে এমনটা করা চলবে না। বেশি শক্ত করে নাট লাগালে প্যাঁচ কেটে গিয়ে বরং তোমার সাইকেলের ওই অংশটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই নির্ধারিত মাত্রা অনুসরণ করে সাইকেলের সব নাট টাইট করে লাগাতে হবে
ব্রেক নিয়ে বাড়াবাড়ি
অনেক জোরে সাইকেল চালিয়ে হঠাৎ ব্রেক চেপে ধরলে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হবে তোমার সাইকেলের ব্রেকিং সিস্টেম। তাই সাইকেল জোরে না চালিয়ে বরং থামার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ব্রেক ধরে থামলেই চলবে। সাধারণ ডিস্ক ব্রেক বা প্যাড ব্রেকের ক্ষেত্রে এগুলো চাকার নির্ধারিত অংশে বাধা দিয়ে সাইকেল থামায়। তাই জোরে চালানো অবস্থায় ব্রেক করলে ওই অংশগুলোর ক্ষতি হয়। আর হাইড্রোলিক ব্রেক চটজলদি সাইকেলকে থামিয়ে দেয়। তাই হাইড্রোলিক ব্রেক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চাই বাড়তি সচেতনতা। আর প্রতিবার সাইকেল চালানোর আগেই দেখে নেবে যে ব্রেক কেব্ল ঠিকমতো কাজ করছে কি না। প্রয়োজনে তিন–চার মাস পরপর ব্রেক কেব্ল বদলে নিতে পারো। সাইকেলের প্যাডেল ভেঙে গেলেও তা বদলে নিতে হবে দ্রুত।
কেউ যেন হাত না দেয়
তোমার প্রিয় সাইকেলের নিরাপত্তাও কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাইকেল যেন চুরি না হয়, সে ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। কিছু নিরাপত্তা অ্যালার্ম পাওয়া যায়। অনাহূত কেউ সাইকেল ধরলেই অ্যালার্মগুলো বেজে ওঠে। এ ধরনের অ্যালার্মগুলোও ব্যবহার করতে পারো। এ ছাড়া স্টেইনলেস স্টিলের শিকল পাওয়া যায় সাইকেলের দোকানগুলোয়। মোবাজ তালাসহ এ ধরনের শিকল দিয়েও বেঁধে রাখতে পারো তোমার সাইকেল। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবে, শিকল ব্যবহার করে যার সঙ্গে সাইকেল আটকে রাখছ, সেটা যেন মজবুত হয়। প্রয়োজনে শিকলের কভার ব্যবহার করতে হবে যেন ফ্রেমে দাগ না পরে।
দেখেশুনে রাখতে হবে
সাইকেলের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আওয়াজ অনুসরণ করা। সাইকেল চালানোর সময় সাইকেলের কোনো অংশ থেকে আওয়াজ হলে সেই অংশে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কাছের মেকানিকসের দোকানে নিয়ে যাবে তোমার প্রিয় সাইকেলকে। নিজে বা আশপাশের সাইক্লিস্ট বন্ধুদের কথা না শুনে অভিজ্ঞ মেকানিকসের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেবে। কারণ তিনি তোমাদের চেয়ে সাইকেলের বিষয়ে বেশি অভিজ্ঞ। কোনো স্থানে সাইকেল রাখার ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখবে যেন অন্যের সাইকেলের সঙ্গে তোমার সাইকেল লেগে না থাকে। না হলে দুজনের সাইকেলেই স্ক্র্যাচ পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এ ক্ষেত্রে সাইকেলের সঙ্গে লাগিয়ে নিতে পারো আলাদা সাইকেলস্ট্যান্ড। তাহলে এখন আর কিসের অপেক্ষা? সবকিছু দেখে নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে পড়ো তোমার প্রিয় সাইকেল সঙ্গে নিয়ে। প্রকৃতির অ্যাডভেঞ্চার আর শহরের অলিগলি তো তুমি আর তোমার সাইকেল গেয়ে বেড়াবে ‘ক্রিং ক্রিং’।