সেরা ১০ রূপকথার বই

বাংলার লোক-রচনা | লালবিহারী দে

লালবিহারী দে’র ফোক-টেলস অব বেঙ্গল প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে। এটি সম্ভবত বাংলা ভাষা থেকে সংগ্রহ করা প্রথম রূপকথার সংকলন। লালবিহারী বলেছেন, আবহমান কাল থেকে বাংলার ঠাকুমা-দিদিমারা তাঁদের নাতি-নাতনিদের যেসব গল্প শুনিয়ে এসেছেন, আমার বইয়ের গল্পগুলো সেগুলোরই সঠিক ও অবিকৃত উদাহরণ।

তিনি যে সময়ে এই রূপকথা সংগ্রহের কাজে নামেন, তখন তাঁর পেশা ছিল শিক্ষকতা, হুগলি কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলার পথেঘাটে, ছেলেবেলায় শোনা রূপকথাগুলো আবার শুনতে ও লিখে রাখতে।

রূপকথার চিরায়ত চরিত্রগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই ডালিমকুমার, রাক্ষস-খোক্কস, ব্রহ্মদৈত্যদের গল্প লিখে রাখেন তিনি। প্রথমে তাঁর এই রূপকথাগুলো প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে, পরে সেসব বাংলায় অনুবাদ হয়। বইটির চমৎকার একটি অনুবাদ করেছেন সাহিত্যিক সাযযাদ কাদির, দিব্য প্রকাশ প্রকাশনীতে বইটি পাওয়া যাবে।

ঠাকুরমার ঝুলি | দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

সাতভাই চম্পা, নীলকমল আর লালকমল, মনিমালা, কাঁকনমালা, সোনার কাঠি, রূপার কাঠি—এসব পরিচিত আর বহুশ্রুত রূপকথারা ঠাঁই পেয়েছে ঠাকুরমার ঝুলিতে, সে ঝুলি বড্ড বেশি মমতায় মাখা, দেশি সবুজ সোঁদা গন্ধে ভরপুর। মিত্র অ্যান্ড ঘোষ পাবলিশার্স থেকে ১৯০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত নীল মলাটে রুপালি হরফে নকশা করা হয়েছিল বইটি। এতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটির ভূমিকা লিখে দেন। রবিঠাকুর তাতে লেখেন, ঠাকুরমার ঝুলিটির মতো এত বড় স্বদেশি জিনিস আমাদের দেশে আর কী আছে?

হয়তো নেই, কারণ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বহু খেটে একদম গল্পবলিয়ে দাদি-নানি-ঠাকুরমা থেকে সংগ্রহ করেছেন এতগুলো গল্প। ঠিক যেন তাঁদের ভাষাতেই গল্পগুলো বলেছেন তিনি।

বইটির গল্পগুলো চার ভাগে ভাগ করা, দুধের সাগর, রূপ-তরাসী, চ্যাং-ব্যাং আর আম-সন্দেশ। এই ঝুলির গল্পগুলো সব অকৃত্রিম, আদি—এসব গল্প থেকেই পরে আধুনিক রূপকথা নির্মাণকারীরা এটা-সেটা নিয়ে নতুন নতুন রূপকথা লিখেছেন।

চিরকালের সেরা | উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী

রূপকথা লিখেছেন অনেকগুলো। ওই যে পান্তাবুড়ির গল্প, যার পান্তাভাত রোজ এক চোর চুরি করে খেয়ে যায়, কিংবা শেয়াল আর কুমিরের গল্প, টুনটুনি ও রাজার গল্প, পিঁপড়ের গল্প—কত কত মজার সব গল্প। তবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রূপকথার গল্পটি বোধ হয় গুপী গাইন বাঘা বাইন। সেটা নিয়ে সত্যজিৎ রায় আস্ত সিনেমাও বানিয়েছেন, যেটা তোমরা অনেকে দেখেছ নিশ্চয়ই। উপেন্দ্রকিশোরের ভাষায় এক স্বভাব রস ছিল, যেটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য ছেলে সুকুমার রায়। সন্দেশ-এর মতো বিখ্যাত পত্রিকা তাঁর হাত দিয়েই বেরোয়। চিরকালের সেরা বইটি উপেন্দ্রকিশোরের সব বিখ্যাত গল্প নিয়ে একটা দারুণ সংকলন, প্রকাশিত হয়েছে চারুলিপি প্রকাশনী থেকে।

তোমাদের জন্য রূপকথা | হুমায়ূন আহমেদ

আমাদের বরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ খুব বেশি রূপকথা লিখে রেখে যাননি, কিন্তু যে কয়টা লিখেছেন সেসব যেন সোনায় মোড়া, হীরে আর চুনিতে গাঁথা। তাঁর রূপকথাগুলো একদমই অন্য রকম, সেখানে রাজারাজড়াদের তলোয়ারবাজি নেই, রাক্ষস-খোক্কস, সাপের মাথার মণি, সাত রাজার ধন, দুয়োরানির নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি ভয় আর লোভের উপাদানগুলো নেই বললেই চলে। তাঁর গল্পের কানি ডাইনিকেও পাঠকেরা না ভালোবেসে পারে না, একটা ছোট্ট মেয়ের অসুখ কীভাবে সারে কিংবা বোকা এক দৈত্যকে নিয়ে কেমন ঝামেলা হয়, এক চালাক শেয়াল এসে কীভাবে বনের রাজা সেজে বসে সেসব নিয়ে গল্প।

তাঁর এমন কয়েকটা অসাধারণ রূপকথার গল্প নিয়ে প্রতীক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তোমাদের জন্য রূপকথা। এখনো যারা পড়োনি, তোমাদের ভাগ্যটা খুবই ভালো—পড়ার জন্য দারুণ একটা বই রয়ে গেছে তার মানে।

অপরূপ রূপকথা | বুদ্ধদেব বসু

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের রূপকথা কে না পড়েছে। ডেনিশ সেই গল্পের জাদুকরের মনমাতানো গল্পগুলো ১২৫টিরও বেশি ভাষায় তর্জমা হয়েছে, কত কত নাটক, সিনেমা বানানো হয়েছে। হাল আমলে অ্যানিমেশন ফিল্মও তৈরি হচ্ছে সেসব গল্পের আদলে। আমরা বাংলাভাষীরা ভীষণ সৌভাগ্যবান যে এ গল্পগুলো বাংলায় তর্জমা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কবি ও ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসু। তিনি বলেছেন, গল্পগুলো তিনি প্রায় আক্ষরিক অনুবাদই করেছেন—কেটেছেঁটে দেশি বানানোর চেষ্টা করেননি। কিন্তু তাঁর মোহনীয় ভাষাশৈলীতে অ্যান্ডারসেনের রূপকথাগুলো যেন আরও স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। তিনি এ অনুবাদকর্মের নাম দেন অপরূপ রূপকথা, প্রথম প্রকাশ পায় কলকাতা থেকে ১৯৩৬ সালে, বইটি বাংলাদেশে পুনর্মুদ্রণ হয় ১৯৯৩ সালে, অবসর প্রকাশনী থেকে।

মালাকাইটের ঝাঁপি | পাভেল বাঝোভ

রূপকথাদের জন্য প্রচলিত কথাটি হলো, সারা দুনিয়ার যত দেশের আর রাজ্যের রূপকথা আছে, সেগুলোতে খুব মিল রয়েছে। তাই ইউরোপের অনেক লোককথার সঙ্গে আমাদের ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মিল পাওয়া যায়। গ্রিম ভাইদের একটি গল্পের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায় কবি জসীমউদ্দীনের বাংলাদেশের কোনো গ্রাম থেকে সংগৃহীত এক লোককথার। আবার কিছু রূপকথা উৎপত্তিস্থলের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত, তাকে বাকিদের সঙ্গে মেলানোর জো নেই। তেমনি স্বতন্ত্র এক রূপকথার সংগ্রহ মালাকাইটের ঝাঁপি, রাশিয়ার আজোভ পাহাড়ের পাদদেশে উরাল গিরিশিরার ঢালুতে এসব রূপকথার জন্ম। সোনা, তামা, লোহা আর মালাকাইট রত্নের খনিতে ভরপুর জায়গাটা। সেসব খনিতে ভূমিদাসেরা উদয়-অস্তাচল শ্রম দেয়, কারিগরেরা পাথর কেটে বের করে আশ্চর্য নকশা। সামন্ত প্রভুরা সুযোগ পেলেই নির্দয় অত্যাচার করে শ্রমিকদের। এসবই যেন কল্পনায় নানা রূপ ধরে তাদের মুখে মুখে প্রচলিত গল্পগুলোতে উঠে এসেছে। সেসব উপকথা আর রূপকথা তাই রত্ন আর নানা পাথরে সাজানো। সেসব পেয়েও কিছু মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মহৎ নায়কদের গল্পে খচিত, আশ্চর্য নকশায় দক্ষ কারিগর আর ভূমিদাসদের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে তৈরি।

এই অসাধারণ আর স্বতন্ত্র রূপকথাগুলোর রুশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ননী ভৌমিক। প্রকাশিত হয়েছিল রামধনু প্রকাশনী থেকে।

ক্ষীরের পুতুল | অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনী ঠাকুরের হাতটি যেন সোনায় গড়া। কারণ এত সুন্দর ছবি তিনি এঁকেছেন। আর তারই সঙ্গে লিখেছেন দারুণ সব রূপকথা। তারই একটি ক্ষীরের পুতুল, অবনী ঠাকুর এর মূল গল্পটা নিয়েছেন কবিগুরুর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রূপকথার খাতা থেকে। তার সঙ্গে তিনি বেশ কিছু লোককথার উপাদানকে গুঁজেছেন। গল্পটা চিরায়ত রাজা আর তার দুই রানি নিয়ে—একজন ভালো, অন্যজন মন্দ। একজনের সুখের অভাব নেই, অন্যজন ভীষণ বঞ্চিত। একসময় আগমন হয় এক মুখপোড়া বাঁদরের, সে বাঁদরের ভূমিকাতেই সুখ বণ্টন হয়ে উপযুক্তজনের কাছে—এমনই এক সাধারণ গল্প হলেও ভাষার গুণে, বর্ণনার মাধুর্যে লেখাটা হয়ে ওঠে জ্বলজ্বলে রত্নের মতো।

গ্রিমভাইদের সমগ্র রচনাবলি | কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

জার্মানির জ্যাকব আর উইলগেম গ্রিম ভাইদের রূপকথাও বিশ্বজোড়া পরিচিত। তাঁরাই তো সিন্ডারেলা, রুপানজেল, ঘুমকুমারী, তুষার-কন্যার মতো অসাধারণ সব গল্পকে জনপ্রিয় করেছেন। এ দুই ভাইয়ের ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। তাই বহুকাল আগের, বহু যুগ ধরে শ্রুত নানা লোককথাকে এ যুগের মোড়কে সহজবোধ্য করে তুলে এনেছিলেন তাঁরা। সেগুলো পরে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ হতে হতে আমরা বাংলাতেও পেলাম। আর এই দারুণ কাজটি করেছেন কবি ও সাহিত্যিক কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। আমাদের জন্য রুশি কয়েকটা বইও তিনি তর্জমা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা থেকে বই আকারে এই অনুবাদগুলো বেরোয়।

অনেক চাঁদ | সম্পাদনা: জামিল বিন সিদ্দিক

২০১৬ সালে প্রকাশিত দারুণ এক রূপকথার সংকলন অনেক চাঁদ। দারুণ ১২টি রূপকথা দুই মলাটে জায়গা করে নিয়েছে বইটিতে। একেকটির স্বাদ একেক রকম। প্রায় সবগুলোই খুব মিষ্টি, কোনোটা পড়ে ভারি ফুর্তি হবে, কোনোটায় মনটা হু হু করে উঠবে আর মুখ টিপে হাসতে হবে মাঝেমধ্যেই, ঠিক যেন হাতে চাঁদ পাওয়াই। গল্পগুলো নানা ভাষার আর অনূদিত হয়েছে সেরা কজন বাঙালি অনুবাদকের হাত দিয়ে। প্রিয় গল্পকার শিবরাম চক্রবর্তীর একটি দুর্লভ অনুবাদও জায়গা করে নিয়েছে সংকলনে। এ ছাড়া অনুবাদকেরা হচ্ছেন কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রেখা চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন শর্মা, জাহীদ রেজা নূর, মুনীর রানা, শিবব্রত বর্মন, সুমন কায়সার এবং জামিল বিন সিদ্দিক। বইটি প্রকাশ করেছে ইকরিমিকরি প্রকাশনী, সম্পাদনা করেছেন জামিল বিন সিদ্দিক।

রুশদেশের উপকথা

রুশি রূপকথা জগৎসেরা, শুধু রাজা-রানি নয়, চাষি, সৈনিক আর একদম সাধারণ মানুষ নিয়ে ভারি চমৎকার সব গল্প আছে সেসব রূপকথায়। এমনই একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশনী থেকে, গল্পগুলো বাংলায় তর্জমা করেছিলেন সুপ্রিয়া ঘোষ। সোভিয়েত ইউনিয়ন যত দিন বজায় ছিল, তত দিন বইগুলো মস্কো থেকে ছাপা হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাত শিশুকিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য। গল্পগুলো সহজেই মন কেড়ে নেয় আর বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যেও অনন্য তারা। ছোট্ট একটা গোল রুটি কীভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, এক সৈনিক কীভাবে কুড়োল থেকে জাউ রেঁধে খেল, যমরাজকে এক বীর কী করে ফাঁকি দিল—এমন নানা পদের, নানা কাহিনি—কোনোটায় দুষ্টের দমন হয়, কোনোটা পড়ার পরে পেট ফেটে হাসি পায়, কোনোটা স্বপ্নে বিভোর করে আমাদের। বইয়ের সাদা-কালো ছবিগুলোও ভারি নজরকাড়া। যারা পড়োনি, সুপ্রিয়া ঘোষের অনুবাদে বইটি জোগাড় করে নাও। দারুণ একটা সময় যাবে তোমার—সেটা হলফ করে বলতে পারি।