স্মার্ট হতে হলে

কিশোর বয়সটাই নতুন কিছু খুঁজে দেখার। অজানাকে জানার। বিভিন্ন নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনটাকে এগিয়ে নেওয়ার। এই বয়সে যে যত বেশি সামাজিক দক্ষতা অর্জনের অভ্যাস করবে, তত বেশি স্মার্ট হয়ে উঠবে সে। স্মার্ট মানে কিন্তু জামা-কাপড়, ক্যারিয়ার আর আর্থিক সাফল্য নয়। সমাজে ইতিবাচক অবদান রেখে সুস্থ দেহে, সুন্দর মন নিয়ে জীবনকে রাঙিয়ে তোলাটাই স্মার্টনেস। কিশোর–তরুণেরা অনেক সময় নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে গিয়ে এমন কিছু আচরণ করে ফেলে, যা তাদের জন্য তো বটেই, এমনকি আশপাশের মানুষ, সমাজ—সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পেছনে রয়েছে তাদের ‘কগনিটিভ এরর’ অর্থাৎ কিছু ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠা। অবশ্য এই ভুল ধারণাগুলো তাদের মধ্যে তৈরি করেন বড়রাই। বড়দের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি কিশোর-কিশোরীদের বুঝতে হবে কোনটা তাদের জন্য ভালো আর কোনটা মন্দ। সামাজিকভাবে দক্ষ হতে গেলে কয়েকটি বিশেষ বিষয়ের দিকে বেশি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বন্ধু নির্বাচন, ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে দূরে থাকা, অ্যাডভেঞ্চার, রোমান্টিকতা, স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে নিয়ে তাদের ভাবতেই হবে।
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

১. বন্ধু বা সঙ্গী নির্বাচন

কে তোমার বন্ধু হবে, তুমি কার সঙ্গে মিশবে আর কে তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হবে, সেটা কিন্তু ভেবেচিন্তে ঠিক করা দরকার। সবাই তোমার সহপাঠী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তোমার বন্ধু, তাদের মধ্যে আবার কয়েকজন তোমার প্রিয় বন্ধু। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ না করে, খারাপ ছাত্র, ভালো ছাত্র চিন্তা না করে, বরং চিন্তা করবে যে কে তোমার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাকেই তুমি বন্ধু করবে। যারা তোমার আশপাশে রয়েছে, তাদের কারও ওপর তুমি নির্ভর করতে পারো, কে তোমাকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে না, বিপদে তোমার পাশ ছেড়ে কে চলে যাবে না, তোমাকে সাহায্য করবে, সে–ই তো তোমার বন্ধু। মা–বাবারা অতিসাধারণীকরণ করে বলেন, ‘কেবল ভালো ছাত্র–ছাত্রীকে (যারা ক্লাসে ফার্স্ট–সেকেন্ড হয়) বন্ধু করবে।’ আসলে তা নয়, তুমি দুর্বল ছাত্র যারা (যারা পড়ালেখায় ততটা ভালো নয়), তাদেরও বন্ধু করবে। দেখা যাবে তোমার প্রভাবে তারাও ভালো ফল করছে। মানুষ হিসেবে এটাই তোমার সফলতা, এটাই তোমার স্মার্টনেস! আর যারা তোমাকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়, তোমাকে বিপজ্জনক আচরণ আর অভ্যাসে উৎসাহিত করে, তাদের দ্বারা মোটেই প্রভাবিত হবে না, বরং তাদের বুঝিয়ে সেই আচরণগুলো দূর করতে সাহায্য করতে পারো।

২. ‘না’ বলতে জানতে হবে

বন্ধু–সহপাঠীদের মধ্যে যারা তোমাকে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করতে উসকানি দেয়, যারা তোমাকে সিগারেট খেতে বলে, তোমার হাতে মাদক তুলে দেয়, তারা তোমার যত কাছের বন্ধুই হোক, তাদের ‘না’ বলা জানতে হবে। ‘না’ এমন একটি শব্দ, যা তোমাকে অসংখ্য বিপদ থেকে দূরে রাখবে। তোমার কাজ হচ্ছে সাহস করে ‘না’ বলতে পারা।

৩. ‘মাদক’ নয় কখনোই

কখনো বন্ধুরা বলবে, ‘একটু টেস্ট করে দ্যাখো।’ কখনো হাতের কাছে পেয়ে মনে হবে, দেখি না কেমন লাগে। কিন্তু না, নিজেকে স্মার্ট রাখতে হলে মাদক গ্রহণ কখনোই নয়। মনে রাখবে, যে মাদক নেয়, সে হচ্ছে সবচেয়ে আনস্মার্ট। ‘জীবনে সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা ভালো’—এই ভুল কথায় মোটেই কান দেবে না। সিগারেটও কিন্তু একধরনের মাদক। ‘আমি কোনো মাদক গ্রহণ করি না’—এই কথা বলার মতো স্মার্ট প্রত্যেক কিশোরকে হওয়া দরকার।

৪. রাগ করে নিজের ক্ষতি

কারও ওপর বা নিজের ওপর রাগ করে নিজের ক্ষতি করার মতো বোকামি আর কিছু হয় না। অনেকে বন্ধু, বান্ধবী, প্রিয়জন বা মা-বাবার ওপর রাগ করে নিজের হাত–পা কাটে, মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খায়! এটিও চরম আনস্মার্টনেস। এ ধরনের আচরণ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কখনো মনে এ ধরনের চিন্তা এলে বাসার বড় কেউ—মা–বাবা, ভাই, বোন, শিক্ষক বা বন্ধুদের কাছে সাহায্য নিতে পারো।

৫. ইন্টারনেট আসক্তি থেকে দূরে

এ বয়সে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গেম, অ্যানিমেশন ইত্যাদির প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু এই আসক্তিকেও এখন একটি রোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই ইন্টারনেট বা মুঠোফোনের পরিমিত ব্যবহার করতে হবে। যদি মনে হয় এগুলো বেশি বেশি ব্যবহারের কারণে তোমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, ঘুম-খাদ্যগ্রহণ অনিয়মিত হচ্ছে, সামাজিকতা কমে যাচ্ছে বা আচরণে আগ্রাসী ভাব দেখা দিচ্ছে, তখন কিন্তু মনে করতে হবে যে তুমি এগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছ। তাই অবশ্যই ইন্টারনেটের যৌক্তিক আর পরিমিত ব্যবহার শুরু করো।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

৬. নারীর প্রতি সম্মানবোধ

স্মার্টনেস আর সামাজিক দক্ষতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে নারীর প্রতি সম্মানবোধ। পরিচিত বা অপরিচিত, বন্ধু বা আত্মীয়—যেকোনো বয়সের যেকোনো নারীর প্রতি কোনো ধরনের কটূক্তি বা আক্রমণাত্মক বক্তব্য কখনোই নয়। কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বা সিনেমা টিভিতে দেখে কখনোই এ ধরনের আচরণ করবে না, বরং এ ধরনের আচরণ কেউ করলে সাধ্যমতো সেটার প্রতিবাদ করতে হবে। পরিবারে যাঁরা নারী সদস্য রয়েছেন, তাঁদের প্রতিও সম্মানবোধ দেখাতে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। মায়ের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে কথা বলবে।

৭. ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব

বন্ধু কেবলই বন্ধু। তাই ছেলেমেয়ে বন্ধুত্ব করতে কোনো বাধা নেই। বন্ধুত্বের জন্য যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে ‘ফ্রেন্ডশিপ জোন’ নির্ধারণ করা। এই জোন নির্ধারণ করবে, কারা বন্ধু হবে, কেন বন্ধু হবে। বন্ধু, নারী বা পুরুষ নয়, সে কেবলই বন্ধু।

৮. ভালো লাগা-ভালোবাসা

কৈশোরে কারও প্রতি ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা জন্ম নিতেই পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে টিনএজ বা ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের এই সময়টাতে শরীর ও মনের নানা পরিবর্তন ঘটে। ফলে বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের মনের মধ্যে ঘটে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; একজন আরেকজনের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করে। এই টান যে সব সময় প্রেমে পরিণত হয়, তা নয়, অনেক সময় দেখা যায় উচ্ছ্বাসের কারণে অন্তরঙ্গতা বাড়ছে কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতা নেই; ফলে তা সত্যিকারের প্রেমে পরিণত হতে পারে না। নিছক ভালো লাগা, ক্রাশ খাওয়া বা মোহ তৈরি হয়। এ সময় মনে আবেগের ঝড়কে সংযত রাখতে হবে। পরিণত বয়সে না পৌঁছানো পর্যন্ত এই ভালো লাগা বা ভালোবাসা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

৯. কতটুকু ঝুঁকি নেবে

বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের মজাই আলাদা। একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, আনন্দ করা খুবই দারুণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সামান্য কারণে ঝুঁকি নেওয়ার জন্য তুমি মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করোনি। তোমার সামনে অনেক কাজ, নিজেকে তৈরি করার কাজ, পরিবারের জন্য কিছু করার কাজ, আর দেশের জন্য কিছু করার কাজ। ছোটখাটো কারণে ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে বিপন্ন করাটা মোটেই সাহসিকতা বা স্মার্টনেস নয়। বড় কিছুর জন্য, দেশের জন্য, মানুষের মুক্তি বা মঙ্গলের জন্য যদি ঝুঁকি নিতে হয় তবে, সেটাতে পিছপা হবে না। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে বাজি রেখে ভাটার সময় সাগরে নামার ঝুঁকি, জোরে বাইক বা গাড়ি চালিয়ে ঝুঁকি নেওয়াটা প্রমাণ করে তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান হয়ে ওঠোনি। এ ধরনের মামুলি কারণে কখনোই ঝুঁকি নেবে না। এগুলো সাহস বা অ্যাডভেঞ্চার নয়, এগুলো বোকামি।

১০. আইন ও নিয়ম মানতেই হবে

অনেক কিশোর-কিশোরী মনে করে, নিয়ম ভাঙার মধ্যেই আমার সাহস আর স্মার্টনেস। বিষয়টি পুরো উল্টো! নিয়ম মেনে যে চলতে পারে, সে–ই কিন্তু সামাজিকভাবে দক্ষ। নিজের জীবনে শৃঙ্খলা মানতে হবে। বিনা কারণে দেরি করে ঘরে ফেরা যাবে না। আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে রাতে জেগে থাকা আর দিনে ঘুমানো, এটি অনেক বড় অনিয়ম, এতে আমাদের মস্তিষ্কের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ এলোমেলো হয়ে যায়, তখন চিন্তা আর আচরণও এলোমেলো হয়ে পড়ে। এ জন্য রাতে অবশ্যই ঘুমাতে হবে আর দিনে কখনোই দুপুর অব্দি ঘুমানো যাবে না। নিজের জীবনে নিয়ম পালনের পাশাপাশি সমাজের, দেশের প্রচলিত আইনগুলো মেনে চলতে হবে। কখনোই কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে না। অপরকে হুমকি দেওয়া, গ্যাং তৈরি করা ইত্যাদি তোমার জীবনকে বিপন্ন করতে পারে। রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি না চালানো, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করা, লিফটের সামনে লাইনে দাঁড়ানোর মতো নিয়মগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। মনে রাখবে, ‘তুমি না বদলালে বদলাবে না কিছুই’।

১১. তুমি কি যথেষ্ট বড়

‘আমি তো অনেক বড়, আমার সিদ্ধান্ত আমিই নেব,’ বিষয়টি কিন্তু এতটা সরল নয়। মানুষের জীবনে বিকাশের কতগুলো পর্যায় আছে। মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে আমাদের ‘বড়’ হয়ে ওঠা শুরু হয়। এই ‘বড়’ হয়ে ওঠাটা মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত চলতে থাকে! মানুষের শারীরিক বিকাশ, কগনিটিভ (ধারণার) বিকাশ, আবেগের বিকাশ আর নৈতিকতার বিকাশের ধাপগুলো একেক বয়সে একেক রকম। এই সব ধরনের বিকাশ যদি সুষমভাবে চলে, তবে ২১ বছর বয়স হলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সক্ষমতা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সবার, সব বিকাশ সব সময় সুষম হয় না। তাই গুনে গুনে ১৮ বা ২১–এ নয়, যে সময় মানুষ তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নিজের ভালো–মন্দ বুঝতে পারে, সেটাই তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স। একুশের পরও তাই সতর্কতার সঙ্গে, প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, নিজের সক্ষমতা আর দুর্বলতাকে বিবেচনা করে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই চর্চা করতে হবে।

যেকোনো কাজ করার আগে, যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করতে হবে। পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্বের কথা চিন্তা করতে হবে। দেশের জন্য তুমি যে একটি অমূল্য সম্পদ, তা ভুলে গেলে চলবে না। তোমার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য আর দেশের জন্য তোমাকে এমনভাবে চলতে হবে, ভাবতে হবে যেন তুমি কোনো ঝুঁকির মুখে না পড়ো। নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। নিজেকে ভালো না বাসলে আরেকজনকে বা দেশকে ভালোবাসা যায় না।