মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল কেন, ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাখ্যা কী

মেট্রোরেলফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানী ঢাকার ফার্মগেটে মেট্রোরেলের ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) থেকে একটির পর একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ছে।

গতকাল রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে এমনই একটি ভারী প্যাড খুলে পড়ে একজন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভয় আর প্রশ্ন—এ প্যাডগুলো খুলে পড়ে যাচ্ছে কেন?

বিয়ারিং প্যাড কী

মেট্রোরেলের ওপরের কংক্রিটের লাইন (যার ওপর ট্রেন চলে) নিচের পিলারের ওপর টিকিয়ে রাখতে হয়। এই দুইয়ের মাঝখানে থাকে একধরনের মোটা রাবারের থালা—বিয়ারিং প্যাড।

এটা পুরো কাঠামোকে সামান্য নড়াচড়া করতে দেয়, যাতে গরম-ঠান্ডা বা ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ফাটল না ধরে।

তুমি একে ভাবতে পারো—ট্রেনের জন্য বিশাল এক শক অ্যাবজরবার।

প্রতিটি বিয়ারিং প্যাডের ওজন প্রায় ৮০ কেজি। তাই এটি যদি আলগা হয়ে নিচে পড়ে, সেটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

আগেও সতর্ক করা হয়েছিল

২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরীক্ষায় দেখা যায়, মেট্রোরেলে ব্যবহারের জন্য আনা কিছু বিয়ারিং প্যাডের মান ঠিক নেই।

এই প্যাডগুলো সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা তখনই এ কথা বলেছিলেন। পরে প্যাড বদল করা হয়েছিল বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা ছিল, মানহীন প্যাড ব্যবহৃত হলে কাঠামোর ঝাঁকুনি বাড়বে, ফাটল ধরতে পারে, এমনকি প্যাড খুলেও যেতে পারে।

এখন কেন পড়ছে

প্রকৌশলীরা বলছেন, যদি ওপরের ভায়াডাক্ট বা কংক্রিটের কাঠামো পুরোপুরি সোজা না থাকে, সামান্য আর্চ (বাঁকা) হয়ে থাকে, তাহলে চাপ সব প্যাডে সমানভাবে পড়ে না। যেখানে চাপ কম পড়ে, সেখানকার প্যাড ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়—শেষে পড়ে যায় নিচে।

কম্পনের ফলে বিয়ারিং প্যাড একটু একটু করে সরে গিয়ে পড়ে যেতে পারে। নির্মাণের সময়ের কোন ত্রুটি থেকেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলারের এই জায়গা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

মানহীন উপকরণে ঝুঁকি

বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, বিয়ারিং প্যাড শুধু ঝাঁকুনি কমায় না, পুরো মেট্রোরেলের কাঠামোকে স্থিতিশীল রাখে। এটার মান খারাপ হলে পিলার বা ফাউন্ডেশনের ক্ষতি হতে পারে। তাহলে পুরো কাঠামোর আয়ু কমে যায়।

জেনে রাখো—

বিয়ারিং প্যাড কী

রাবার ও লোহার স্তর দিয়ে তৈরি একধরনের কুশন, যা পিলার আর ওপরের ভায়াডাক্টের মাঝখানে বসানো হয়। এটি ঝাঁকুনি শোষণ করে, তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় প্রসারণ-সংকোচন সহ্য করে এবং কাঠামোকে টেকসই রাখে।

আর্চ মানে কী

ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় আর্চ মানে বাঁকা হয়ে থাকা কাঠামো। যদি ওপরের কাঠামো পুরোপুরি সোজা না থেকে সামান্য উঁচু বা নিচু হয়ে থাকে, তাহলে সেটি ‘আর্চ’ হয়ে যায়।

আর্চ নিজের ওজন নিজে বহন করতে পারে। আবার বাঁকা অবস্থায় ওজন সমানভাবে বণ্টিত হয় না—ফলে কিছু প্যাডে চাপ না পড়ায়, সেগুলো আলগা হয়ে খুলে যেতে পারে।

সহজভাবে বললে, একটা টেবিলের চার পা যদি সমান না হয়, তাহলে টেবিল কেঁপে ওঠে। তেমনিভাবে মেট্রোরেলের ওপরের কাঠামো যদি সামান্য বাঁকা হয়, তাহলে নিচের প্যাডগুলোও দুলে কোনো এক দিন খুলে পড়ে যেতে পারে।

আর্চ হয়ে যাওয়ার কারণে যদি পিলারের ওপরে চাপ কম পড়ে, তাহলে তা ভবিষ্যতে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

করণীয় কী

আসলে কী ঘটেছে, তা বিশেষজ্ঞ নিরীক্ষা ছাড়া এখনই বলা সম্ভব নয়। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে এখনই সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। বিপদ থেকে মেট্রোরেলকে মুক্ত করতে হবে।