সূর্য হয়ে ওঠো ইচ্ছেমতো ছোটো

অলংকরণ: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ক্রসওয়াক কমিউনিকেশনস

আমরা যদি না জাগি মা

কেমনে সকাল হবে?

তোমার ছেলে উঠলে গো মা

রাত পোহাবে তবে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঠিকই বলেছেন। আমরা জাগি বলেই ভোর হয়। তোমরা কি রূপকথার সেই গল্পটা শুনেছ? যে গল্পে থাকে এক পাষাণপুরী। ছলনাময় কোনো দৈত্য জাদু দিয়ে একটা রাজ্যের সবকিছুকে পাথরে পরিণত করে রেখেছে। সেখানে মানুষ, হাতি-ঘোড়া, পশুপাখি, গাছপালা—সবকিছু পাথর হয়ে গেছে। কেউ জেগে নেই। সবাই ঘুমিয়ে। পাথরের মতো। গল্পের নায়ক রাজপুত্র গিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। সেই পাষাণপুরীর কথা কল্পনা করো। সেখানে যদি সূর্য ওঠেও, তবু কিন্তু সকাল হয় না। কারণ, মানুষ জাগেনি।

মানুষ জাগলেই কেবল ভোর হয়।

তোমরা কি কবীর সুমনের গান শোনো? কবীর সুমনের একটা গানের কথা এ রকম:

সূর্য বলল ইশ্‌

আমি উঠলাম ভাগ্যিস

তাই রাত্রির হলো ভোর,

মানুষ বলে ধুৎ,

তোর যুক্তিটা অদ্ভুত

আমরা ছিলাম বলেই দিলাম

সূর্য নামটা তোর।

মানুষই তো সূর্যের ‘সূর্য’ নামটা দিয়েছে। তাই সকাল আনতে হলে মানুষকেই জাগতে হবে। আমাদের জাগতে হবে। তোমাদের জাগতে হবে।

তোমরা বলবে, আমরা তো জেগেই আছি। জেগে না থাকলে এই লেখা পড়ছি কেমন করে!

এই জাগা কেবল দেহের ঘুম থেকে জেগে ওঠা নয়; এই জাগা মানে দেহের জাগা, মনেরও জাগা। আর শুধু জাগলেই হবে না, সূর্যের মতো জাগতে হবে, সূর্যের মতোই আলো ছড়াতে হবে।

এই আলো কিসের আলো! এই আলো জ্ঞানের আলো, ভালোবাসার আলো, সহযোগিতার আলো, দয়া-মায়া-মমতার নরম আলো। এই আলো দূর করবে হিংসা-বিদ্বেষ, এই আলো দূর করবে লোভ-দুর্নীতি-অন্যায়, এই আলো দূর করবে যুদ্ধ, এই আলো দূর করবে অশান্তি, এই আলো পৃথিবীজুড়ে আনবে শান্তি, প্রীতি। মানুষ সবাই ভালো থাকবে, সুখে-শান্তিতে থাকবে।

তা আমরা একেকজন ছোট্ট মানুষ, আমি জাগলেই কি পৃথিবীটা জাগবে! বাংলাদেশ জাগবে!

সূর্য একা। কিন্তু সূর্য তো সমস্ত পৃথিবী আর সৌরজগৎকেই আলো দেয়। আমার ভেতরের সূর্যটাকে আমি জাগিয়ে তুলব। সে-ও পৃথিবীটায় আলো ছড়াবে।

এসবই কবিতার কথা। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু কবিতার তুলনা–উপমাগুলোকে বাস্তবতার চোখ দিয়ে দেখলে মুশকিলেই পড়তে হয়। যেমন কবিতায় আমরা বলি, চাঁদের মতো মুখ। বাস্তবে চাঁদের মতো মুখ তো মানুষের হয় না। কবি আসলে এখানে চাঁদের সৌন্দর্যের কথা, জ্যোৎস্না যে শান্তি দেয়, তার কথাই বোঝাতে চান।

আমরা বলছি, সূর্য হয়ে ওঠো। আমরা বলতে চাইছি, তোমার ভেতরে আলো জ্বালো। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে মোম আছে, সলতে আছে, শুধু শিখাটা জ্বালিয়ে দিলেই হলো। তুমি আলো হয়ে জ্বলতে থাকবে। তা করব কী করে?

এক নম্বর হলো পড়াশোনা করে। আমরা আমাদের পাঠ্যবই ঠিকঠাক পড়ব। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান—যা যা আছে, সব পড়ব। জানার জন্য পড়ব। পাশাপাশি পরীক্ষার ফলও ভালো করার চেষ্টা করব। তারপর? তারপর বাইরের বই পড়ব। যত পারি, বই পড়ব। যে বই আমার ভালো লাগে, সেই বই। গল্পের বই, কবিতার বই। এর বাইরে যে বই পড়ে আমি মজা পাই, তাই পড়তে থাকব।

আর কী করব? সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজকর্মে অংশ নেব। গান করব, নাচ করব, নাটক করব, বিজ্ঞান ক্লাব করব, ফটোগ্রাফি ক্লাব করব, বিতর্ক-বক্তৃতা করব, দেয়ালপত্রিকা বের করব, ছবি আঁকব, বেড়াতে যাব। প্রকৃতি-পরিবেশ ক্লাব করব। মা-বাবাকে কাজে সাহায্য করব। মানুষের পাশে দাঁড়াব। কোনো সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেব।

জগৎটাকে বদলাতে চাইলেই বদলানো যাবে না। কিন্তু সবচেয়ে সহজ হলো নিজেকে বদলানো। জগৎটাকে আলোকিত করতে চাইলেই করা যাবে না, কিন্তু চাইলে নিজেকে প্রতিদিনই একটু একটু আলোকিত করা যাবে!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মানচিত্রের গল্পটা সব সময় বলি। আবারও বলছি। একটা ছেলে তার বাবার বাংলাদেশের মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলেছে। বাবা বললেন, মানচিত্রটা জোড়া লাগাও। ছেলে জোড়া লাগাল। বাবা বললেন, তুমি তো মানচিত্র চেনো না, কী করে পারলে? ছেলে বলল, এই মানচিত্রের উল্টো পিঠে একটা মানুষের মুখ আঁকা ছিল। আমি মানুষটাকে জোড়া লাগিয়েছি, দেশটা আপনা-আপনি জোড়া লেগে গেছে। আমরা যদি আমাদের মানুষগুলোকে গড়ে তুলতে পারি, দেশ গড়ে উঠবে।

রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের একটা গল্প আছে, ‘হাতির বাচ্চা’। ‘এলিফ্যান্ট’স চাইল্ড’।

আগে হাতির নাক এত বড় ছিল না। মানে হাতির শুঁড় ছিল না। ছোট্ট একটা সাধারণ নাক ছিল হাতির।

একটা হাতির বাচ্চার ছিল অনেক কৌতূহল। জানার ইচ্ছা। সে সব সময় প্রশ্ন করত। আশপাশের পশুপাখি মামা-খালাদের সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলত।

একদিন সে প্রশ্ন করল, কুমির কী খায়? সে একে জিজ্ঞেস করে, ওকে জিগ্যেস করে। তারপর সে বের হলো কুমিরের খোঁজে। কুমির কী খায়, তাকে জানতেই হবে। পথে সে দেখা পেল এক অজগরের। তাকেও সে বলল, তুমি কি জানো, কুমির কী খায়? কুমিরের সঙ্গে হাতির বাচ্চার বন্ধুত্বও হয়ে গেল।

হাতির বাচ্চা আরও সামনে এগোল। দেখা পেল এক কুমিরের। তাকে সে জিজ্ঞেস করল, কুমির, তুমি কী খাও?

কুমির বলল, কাছে এসো। তোমাকে বলছি। মনে মনে বলল, আজ হাতির বাচ্চা দিয়েই ভালো ভোজ হবে।

হাতির বাচ্চা কাছে যেতেই কুমির তার নাকটা টেনে ধরল।

হাতির বাচ্চা পালানোর চেষ্টা করছে। আর নাকটা বড় হচ্ছে। সে বলছে, ছেড়ে দাও, আমার নাক ছেড়ে দাও।

এই সময় অজগরটা এগিয়ে এল। সে পেঁচিয়ে ধরল কুমিরকে। কুমির হাতির বাচ্চার নাক ছেড়ে দিল বটে, ততক্ষণে তার নাক বড় হয়ে গেছে।

প্রথমে হাতির বাচ্চা মন খারাপ করল। একটু পরে বুঝল, নাক দিয়ে অনেক কাজ করা যায়। নাক দিয়ে সে পানি-কাদা ওপরে তুলতে পারে, উঁচু গাছের পাতা ছিঁড়তে পারে, কলাগাছ ভাঙতে পারে।

শুঁড় ভালো জিনিস।

সেই থেকে হাতিদের নাক বড়।

তাহলে আমরা কী বুঝলাম? কৌতূহল খারাপ জিনিস নয়। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে। জানতে হবে। বেরিয়ে পড়তে হবে। ছুটতে হবে।

ইচ্ছা হয়ে ছুটতে থাকো।

কিশোর আলো পত্রিকাটা কিশোরদের জন্য। আমরা এই পত্রিকা করেছি আমাদের শিশু-কিশোরদের দিগন্তকে বড় করার জন্য। তাদের হৃদয়টাকে খুলে দেওয়ার জন্য। আমরা চাই তারা প্রচুর গল্প-কবিতা পড়ুক। তাদের মনটা সুন্দর হোক। আর চাই তাদের মনের জানার ইচ্ছা, করার ইচ্ছা, গড়ার ইচ্ছাটাকে উসকে দিতে। আবার এসবই আমরা করতে চাই আনন্দের মধ্য দিয়ে। শৈশব ও কৈশোর আনন্দময় হোক।

কিআর ১০ বছর পূর্ণ হলো। এ-ও এক আবেগের ব্যাপার। ১০ বছর আগে ১৭ বছরের যে কিশোর কিআ হাতে নিয়েছিল বা কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে এসেছিল, আজ তার বয়স ২৭। সে হয়তো এখন কর্মজীবনে ঢুকে গেছে। যার বয়স তখন ১৯ ছিল, আজ সে ২৯। হয়তো তার বিয়েই হয়ে গেছে।

মা-বাবার জীবনের একটা নিয়ম হলো, সন্তানেরা বড় হয়ে যায়। আর মা-বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে তারা আপন জগৎ তৈরি করে। তাদের ছায়ায় আবার তাদের সন্তানেরা বড় হতে থাকে।

কিশোর আলোয় আমরা এই নিয়মকেই দেখি। শিশু-কিশোরেরা বড় হয়ে যায়। তারা আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়। আমরা সেটাই চাই। তারা ছুটতে থাকুক। দুনিয়াটা অনেক বড়। আমরা বলি, আমার পৃথিবী অনেক বড়। মানে তোমার পৃথিবী অনেক বড়।

কিন্তু নতুন শিশু-কিশোরেরা আসে। কিশোর আলো পড়ে। কিআ বুক ক্লাব করে। কিআর স্বেচ্ছাসেবক হয়। আমাদের ঘর আবার ভরে যায়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের এই কথাটাও মনে পড়ছে—মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তুমি যত বড় স্বপ্ন দেখবে, তুমি তত বড় হতে পারবে। এ জন্য নিজের ইচ্ছাগুলোকে চাপা দিয়ে রেখো না। ইচ্ছার মতো ছুটতে থাকো।

লিও তলস্তয়ের ‘তিনটি প্রশ্ন’ গল্পটা আবার মনে করি।

রাজা তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চান।

১. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী?

২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে?

৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?

এ তিন প্রশ্নের উত্তর জানতে রাজা চললেন বনে। সেখানে একজন জ্ঞানী মানুষ থাকেন। তিনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবেন। রাজা ছদ্মবেশে একা চলেছেন বনে।

জঙ্গলে গিয়ে রাজা দেখা পেলেন জ্ঞানী মানুষটির। রাজা বললেন, আমি তিনটি প্রশ্নের জবাব চাই। জ্ঞানী ব্যক্তি তখন কাঠ কাটছিলেন। তিনি বললেন, আগে বসো। আমার সঙ্গে কাঠ কাটো।

রাজা কাঠ কাটায় ওই ব্যক্তিকে সাহায্য করতে লাগলেন। হঠাৎ হইচই। ব্যাপার কী! রাজা একা আসতে চাইলেও তাঁর সৈন্যরা পেছনে পেছনে চুপি চুপি চলে এসেছে। তারা একটা মানুষকে ছুরিসমতে ধরে ফেলেছে। জানা গেল, ছুরিওয়ালা মানুষটা রাজার শত্রু। রাজাকে খুন করার জন্য তাঁকে অনুসরণ করে চলে এসেছে। সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলেছে।

জ্ঞানী মানুষটা বলতে শুরু করলেন, এবার আমি তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেব।

রাজা, তুমি যদি আমার জন্য কাঠ না কেটে তখনই চলে যেতে, তোমার শত্রু তোমাকে খুন করত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো সে-ই, যে তোমার সামনে আছে। মানে তোমার জন্য তখন ছিলাম আমি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী? এখন। এই মুহূর্ত।

আর সবচেয়ে জরুরি কাজ কী? তোমার সামনের মানুষটার উপকার করা। তুমি আমার উপকার করেছিলে বলেই এখনো বেঁচে আছ। না হলে তোমার শত্রু তোমাকে খুন করে ফলত এতক্ষণে।

এসো, আমরা মানুষের উপকার করি। কোন মানুষের? যে আমাদের সামনে আছে। সঙ্গে আছে। তা করব কখন। এখনই।