পুরোনো কিছু স্মৃতি

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করার আগের রাতে হঠাৎ আমার ডায়েরিটা শেলফের ফাঁকে খুঁজে পেলাম। গত দুই বছরের নানা সুখ–দুঃখের অংশ আমার এই ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। ভার্সিটির ব্যস্ততার ভেতর হৃদয়ের গভীরে রাখা স্মৃতিগুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল। ডায়েরিটা পেয়ে মনটা উসখুস করে উঠল। মহামারির সময় যখন হল বন্ধ করে দেওয়া হলো, সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রামে মায়ের কাছে যাব। শৈশবের ছোটাছুটি আর গ্রামের আকাশে-বাতাসে নিজের ছোট্ট ‘আমি’টাকে খুঁজব। গ্রামের মাটিতে পা রাখতেই চারপাশের সজীব সুরভিত বাতাস আমার ফুসফুসকে ভরিয়ে তুলল। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল। হয়তো তার চোখ ছাপিয়ে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। কিন্তু মা অত্যন্ত গোপনে তা লুকিয়ে ফেলল। এত দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে মায়ের অন্দরমহলে বয়ে চলা জোয়ার-ভাটাকে অনুভব করার সুপ্ত চেষ্টা করছিলাম আমি। মায়ের সান্নিধ্য আমার হৃদয়টাকেও দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছিল। মা ওই দিন পরম যত্নের সঙ্গে আমাকে খাবার খাইয়ে দিয়েছিল। হলের খাবারে যে স্বাদ কখনোই পাব না। আমার জীবনের এসব সূক্ষ্মতর আনন্দময় অনুভূতি হৃদয়ের গহিনে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। আজ অনেক দিন পর সেগুলো মুক্তি পেয়ে পাখির মতো উড়াল দিয়েছে।

সেদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল। আমি সচরাচর এত ভোরে ঘুম থেকে উঠি না। আজ চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি। বিছানা থেকে উঠে কোনোরকমে চোখমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। গ্রামাঞ্চল হলেও এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি বা উঠলেও রাস্তায় কেউ বের হয়নি। অর্থাৎ, কোনো মানুষের দেখা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। শৈশবেই আমি বাবাকে হারিয়েছি। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এখানেই আমার মৃত বাবাকে পোড়ানো হয়েছিল ! এখানে এলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়, বুকটা হাহাকারে ভরে ওঠে! এখনো মনে আছে, বাবাকে যখন শ্মশানে তোলা হলো, মা তখনো ঘোর কাটাতে পারেনি। শেষকৃত্যের যাত্রার সময় মায়ের চোখে চোখ পড়তেই মা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিল। আমার তো তখন সবে সাত বছর, সেভাবে সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আমার জীবনে সেটাই সবচেয়ে করুণ মুহূর্ত! আমি আর কখনো এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই না। হঠাৎ কল্পনা ভাঙতে খেয়াল হলো, আমার চোখ ভিজে গেছে। এই সবকিছুর মধ্যেই বারবার মনে উঁকি দিত, কবে সব আগের মতো হবে! কবে নিজের প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে পা দিতে পারব?

এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে প্রায় দুই বছর পর। তবে আগের মতো নয়, নতুন করে। আবার শুরু হয় ব্যস্ততার পালা। ভার্সিটি খুলে যাওয়ায় আমাকে আবার ঢাকায় চলে আসতে হয়। মায়ের কাছ থেকে বিদায়বেলায় আমিও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। যথাসময়ে বাস ছেড়ে দেয়। বাসে বসে থাকা আমি সহসা আমার বুকের মধ্যে কষ্ট অনুভব করি। এভাবেই হৃদয়ের গহিনে জমে থাকা অনবদ্য কিছু পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে গেলাম ডায়েরির পাতায় পাতায়।