মা আমার সফলতার ছায়াসঙ্গী

এআই আর্ট

ভর্তি পরীক্ষার দিনগুলোতে আমি ছিলাম এক দিগন্তহীন সমুদ্রে ভেসে থাকা বিবর্ণ পালতোলা নৌকা—কোনো লক্ষ্য নেই, নেই কোনো দিশার আলো। বুকের গভীরে জমে উঠেছিল অনন্ত শূন্যতা। সেই অন্ধকার কুয়ার কিনারায় ছিল একটি আলো—আমার মা। মা কখনো অভিযোগের ভাষা জানতেন না। তাঁর ভালোবাসা ছিল এক নীরব দীপ্তি—আগুনের মতো জ্বলেন না, তবু তাঁর উত্তাপে গলে যায় মন। কান্নার মতো শব্দহীন এই ভালোবাসায় ছিল শান্তির সব সুর। আমার এই চরম হতাশার মুহূর্তে মা বলেছিলেন, ‘শেষ মানেই সব সময় সমাপ্তি নয়, কখনো কখনো এটা নতুন গল্পের শুরুও হতে পারে।’

তখন বুঝেছিলাম, ব্যর্থতা মানে থেমে যাওয়া নয়, ব্যর্থতাই জীবনের নতুন বাঁক। মায়ের কোল তখন ছিল এক আশ্রয়দ্বীপ—নিঃশব্দে জ্বলে থাকা শান্তির বাতিঘর। রাতে যখন আমি জ্বরে কাঁপতাম আর কাঁদতাম, মা তখন ঠান্ডা জলে ভেজা তোয়ালে বেঁধে দিতেন কপালে। শুধু শীতলতা নয়, তাতে ছিল অদ্ভুত এক সাহস, যেটা আমাকে বইয়ের পাতার দিকে ফিরিয়ে আনত। ভয়, ক্লান্তি কিংবা ব্যর্থতার অতলে যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম, তখনো মা ছিলেন কিনারায় দাঁড়িয়ে—নিঃশব্দে আলো ধরে রাখা এক দীপশিখার মতো।

মা স্বপ্নের রেখা টেনে দিতেন আমার ক্লান্ত চোখে। নিজের আরাম বিসর্জন দিয়ে, নিজের অসুস্থ শরীরটাকে উপেক্ষা করে বসে থেকেছেন আমার শিয়রে। মায়ের এই নিঃশব্দ ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে দামি পাঠ্যবই, যেখানে লেখা ছিল, ‘সফলতা হঠাৎ করে আসে না। তাকে জাগাতে হয় চোখের জল, ক্লান্তি, নিঃশব্দ লড়াই দিয়ে। সফল হওয়ার আসল সাহস তো তুই দেখাস তখনই, যখন ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়াস আর স্বপ্নগুলোকে আবার নিজের হাতেই গড়ে নিস। মনে রাখবি, হার মেনে না নেওয়া মনটি একদিন সবচেয়ে বড় জয় আনবে।’

ঠিক তা–ই হলো। সেই ক্লান্ত শরীর, অসহায় মন আর অস্পষ্ট ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মায়ের সাহচর্যে আমি লিখেছিলাম ভর্তি পরীক্ষার খাতা। সেই খাতা যখন ‘ভর্তি নিশ্চিত’ বলে ফিরিয়ে দিল, তখন আমি অশ্রুভেজা চোখে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, ‘তুমি না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না, মা।’ মা তখন মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘আমি তো ছিলাম শুধু ছায়া হয়ে পাশে। তুই যে পথ বেছে নিয়েছিস, সেটা তোর একান্ত সংগ্রাম আর তুই আলোর দিকটা চিনে নিয়েছিস নিজের সাহসে।’

আমার যাত্রা এখনো চলমান, অনেক দূর যেতে হবে। তবু জানি, এই পথ আমি পার হব মায়ের ছায়া মেখে। সঙ্গে থাকবে সততার দীপশিখা, ভালবাসার নদী আর সহমর্মিতার উষ্ণ হৃদয়। তাঁর আলোতেই আমি গড়ব এক মানবিক, সৎ ভবিষ্যৎ।

তানজিনা জান্নাত

অনার্স প্রথম বর্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

আরও পড়ুন