প্রতিটি শব্দে আলাদা অনুভূতি
দিনের একটা বড় সময় আমরা একা থাকি। মাঝেমধ্যে কলেজ-কোচিং শেষে বাড়িতে ফিরে ‘মা, মা’ বলে ডাকি; কিন্তু ডাক শুনে উত্তর দেওয়ার কেউ থাকে না। আমাদের বাবা–মায়েরা অনেক ব্যস্ত নিজেদের কাজে। ছোট থেকেই এভাবে একা থেকেই অভ্যস্ত আমি। এ জন্য এগুলো নিয়ে নতুন করে মন খারাপ করতে ভালো লাগে না আর। কিন্তু আজ অনেক লিখতে ইচ্ছা করছে।
কয়েক দিন ধরে জ্বর, প্রতিবারের মতো নয় একদমই, অনেক দিন লেগে যাচ্ছে সারতে। এর মধ্যেও কলেজ-কোচিং সবখানেই আমার নিয়মিত উপস্থিতি। এবার কাউকে জানাইনি অসুস্থতার কথা। প্রথমে বিরক্ত লাগলেও, এখন মনে হচ্ছে অসুখটা মন্দ নয়! সবকিছু থেকে যে আস্তে আস্তে কত দূরে সরে যাচ্ছি, অসুখটা না হলে বুঝতেই পারতাম না।
নিস্তব্ধ ঘরেও যে এত রকম শব্দ আছে, তা–ও জানতে পারতাম না। অ্যাকুয়ারিয়ামে রঙিন সব মাছের চলাফেরা করা, বিকেলে ঘরের কোণে আবছা রোদ এসে পড়া, বারান্দায় থাকা ছোট্ট শিউলিগাছটার নিয়মিত দু–একটা শিউলি ফুল ঝরে পড়া, কিংবা জানালার গ্রিলে চড়ুই পাখিগুলোর চুপি চুপি সাবধানে আনাগোনা।
প্রতিটির আলাদা শব্দ আর অনুভূতি আছে!
কিছুদিন আগে শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে কলেজ থেকে কড়া রোদের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই ওদের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘বাড়ি গিয়েই দেখব, আম্মু ঠান্ডা লেবুর শরবত বানায় রাখছে আমার জন্য।’ ওর কথা শুনে কেউ বলল, ‘পরীক্ষার মধ্যে রাত জেগে পড়ার সময় আম্মু আমার সঙ্গে জেগে থাকে।’ কেউ বলল, ‘এখন বাড়িতে ফিরেই কিছুক্ষণ পরেই ম্যাথ কোচিংয়ে যেতে হবে, এ জন্য সময়স্বল্পতার কারণে আম্মু খাইয়ে দেয় আমাকে।’
সবাই মূলত মায়ের সঙ্গে কাটানো সুন্দর সময়গুলোর কথা বলছিল। আর আমি শুধু শুনছিলাম। দেখছিলাম ওদের চোখেমুখে ভেসে ওঠা উচ্ছ্বাস। আমার কাছে ওদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার মতো এমন কোনো স্মৃতি ছিল না।
আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই! হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। তবে কলেজে একটা বড় বন্ধুবৃত্ত ছিল আমার। এখন আর নেই, বড় হয়ে গেছি যে!
যত দিন যাচ্ছে, আরও কেমন যেন একা হয়ে যাচ্ছি।
ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম, এখন ছবি আঁকাও ছেড়ে দিয়েছি। চারপাশের মানুষের আর শহরের প্রতিদিনের এত শব্দ, এগুলোও আমার প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনের ভালো লাগার একটা অংশ ছিল। কিন্তু এখন নিশ্চুপ অন্ধকার ঘরটাই সবচেয়ে শান্তির মনে হয়।
তাহলে, বড় হলে কি আমাদের জীবনের সব রং ধীরে ধীরে ধূসর হতে থাকে?
এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছি অনেক দিন হলো!
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি বাঙলা কলেজ, মিরপুর, ঢাকা