শহরের পিচঢালা ছাইরঙা রাস্তার আশপাশে প্রায়ই জুতা পড়ে থাকে, কখনো খেয়াল করে দেখেছ? বেশির ভাগ সময়ই সেই জোড়ার আরকটি জুতা পাওয়া যায় না, ওই একটাই পড়ে থাকে। পড়ে থাকা এমনই একটা অবহেলিত জুতার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে হাঁটতে শুরু করি আমি, আব্বুর পেছনে পেছনে। কোনো এক অজানা কারণে আরেকটা জুতা খুঁজতে ব্যস্ত আমার চোখজোড়া। এই জুতাগুলোর কোনো একটা হয়তো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া কারও মা, বাবা, বন্ধুর শেষ সময়ের কথা। যখন ওই মানুষের পায়ে জুতা আছে কি না, দেখার চেয়ে তার জীবন বাঁচাতে চাওয়াই প্রধান হয়ে উঠেছিল। হয়তোবা হরতালে বা মিছিলে মারামারি-কাটাকাটিতে কোনো ছাত্র বা নেতা কিংবা সমর্থকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া জুতা সেটা। হয়তো ভূমিকম্প হওয়ায় কিংবা কোথাও আগুন লাগায় তড়িঘড়ি করে পালানোর সময়ে মানুষের পা-ছাড়া হওয়া জুতা সেটা। এত ভয়ানক পরিস্থিতি না-ও হতে পারে। হয়তো নতুন জুতা কিনে পুরোনোটা ফেলে দিয়েছে কেউ। অনেক কিছুই হতে পারে—এমন কিছু, যা এখনো আমার মাথাতেই আসেনি। বাইরে বের হয়ে যেকোনো নগণ্য জিনিস থেকে নানা রকম কাহিনি ভাবতে আমার মজাই লাগে।
আমাকে আশ্চর্য রকমভাবে বোকা বানানোর জন্যই কি না, জানি না। দেখলাম, একটা জীর্ণ ছোট্ট দেহের পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে, যার বাসা খুব সম্ভবত ফুটপাতের ওপর পলিথিনে ঢাকা দুই কোনা ঘরটা, দুটি স্যান্ডেল কুড়িয়ে নিল। একটু আগেই যে স্যান্ডেলটা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেটা। ওটার আরেক পাটি ওর দুই হাতে। আব্বু সামনে এগোচ্ছে।
তবু আমি থামলাম। মেয়েটা কী করে, দেখব। ওর চোখজোড়ায় অস্বাভাবিক উৎফুল্ল ভাব। পুরো মুখটায় হাসি ছড়িয়ে টুকটুকে লাল বানিয়ে ফেলেছে, খুশি ধরে রাখতে পারছে না। জুতাজোড়া দ্রুত হাত থেকে নামিয়ে পায়ে দিল, ওর পিচ্চি দুখানা পায়ে জুতাজোড়া দুই সাইজ বড় হচ্ছে। পা থেকে খুলে আবার হাতে নিয়ে দৌড়ে গেল নীল পলিথিনে মোড়া ঘরটার সামনে।
সেখানে মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক নারী উনুনে থোবড়ানো পাতিলে ভাত রান্না করছিলেন, বাচ্চাটা জুতা দুটি সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আম্মা দেখো! এই জুতা পাইসি, এইটা ঈদে পরুম। আবার পরের ঈদেও পরা যাইব। বড় আছে!’
আমরীন বিনতে মাহবুব
একাদশ শ্রেণি, অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা