আজ আমাদের ছুটি

বৈশাখের অসময়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে শহরে। ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ আজ। প্রায় আড়াই বছর ধরে যার জন্য এত প্রস্তুতি—সেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ। স্কুলজীবনেরও ইতি। উঁচু–নিচু রাস্তা ধরে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলে রিকশা, বৃষ্টির বেয়াড়া ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় হাতের ব্যবহারিকের খাতা।

অসময়ের ধারাপাত দেখতে দেখতে অনেক পুরোনো আরেকটা বৃষ্টির দিনের খেরো খাতার ছবি ভেসে ওঠে মনে।

তখন মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুল থেকে বেরিয়ে সেদিনও দেখি, ঠিক এ রকমই বর্ষণের ধারা। তবে মাসটা বোধ হয় আষাঢ়ই ছিল। কেউ তখনো নিতে আসেনি আমাকে। বাকি বাচ্চাকাচ্চার দল যার যার বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ির পথ ধরেছে। কেন জানি না, একা একা বৃষ্টিতে বেরিয়ে পড়লাম আমি। ভিজতে ভিজতে অর্ধেক পথ আসার পর আম্মুর দেখা পেলাম। তারপর আম্মুর সে কি বকা!

সময়ের দুরন্ত ঘোড়া কী দ্রুতই না চলে। এ যেন গতকাল সবুজ–সাদা ইউনিফর্মটা গায়ে চড়ালাম…আর আজ তার মেয়াদ ফুরাল। ইস্তিরি করে ন্যাপথলিনসহ সযত্নে তাকে তুলে রাখা হবে আলমারির কোনো অন্ধকার কোণে। সময়ের আবর্তে বন্ধুও জুটেছে। এখন বৃষ্টি নামলে ছাতার সঙ্গে সঙ্গীও পাওয়া যায়। আর কিছুদিন পর কলেজে উঠলে… কে জানে হয়তো ছাতার নিচে সঙ্গীর মুখ বদলে যাবে। তারপর একদিন আবার শূন্য হয়ে যাবে সে পাশটা। যেখান থেকে স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল, সেখানে গিয়ে শেষ হবে।

স্কুলের পাট চুকিয়ে অনেকেই কলেজের জন্য থিতু হবে অন্য কোথাও। অন্য কোনো শহরে। রয়ে যাবে তাদের স্মৃতিগুলো। রয়ে যাবে স্কুলের করিডরে রোদের খেলা, ক্লাসরুমের জানালার কাচে গড়াতে থাকা বৃষ্টি, আর ভেন্টিলেটরে থাকা চড়ুইগুলোর সঙ্গে জড়ানো মায়া। এই পড়ে থাকা সবটুকু মায়া নিয়ে একদিন চলে যাব এই শহর ছেড়ে।

রিকশা চলে এসেছে আমার দীর্ঘ সাত বছরের সঙ্গী স্কুলের কাছে। দৃষ্টি ফেরাই সেদিকে। স্কুলড্রেস পরা কয়েকটা বাচ্চা মেয়ে ভিড় করেছে গেটের কাছে। কিছুদিন আগে ওই জায়গায় আমরাও দাঁড়াতাম। ব্যাকুলভাবে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতাম ‘ছুটি কখন?’ হিয়া ছিল ক্লাস ক্যাপ্টেন। ওকে দিয়ে দরখাস্ত লিখিয়ে এক দরখাস্ত দিয়ে পাঁচজন বেরিয়ে যেতাম। এমন কত স্মৃতি।

আজ আমাদের ছুটি। আমাদের চিরদিনের ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে স্কুল থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো উপন্যাসে রবি ঠাকুরের অসমাপ্ত একটা কবিতা ছিল—

‘হেথা হতে যাও, হে পুরাতন।

হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।’

রিকশার বৃষ্টিভেজা লুকিং গ্লাসে তাকালাম...স্কুলটা দেখা যাচ্ছে। মনে হলো, গড়িয়ে পড়তে থাকা জলকণারা আমায় ফিসফিস করে বলছে,

‘হেথা হতে যাও, হে পুরাতন

হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।’

লেখক: এসএসসি পরীক্ষার্থী ২০২৫, ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ভোলা

আরও পড়ুন