তীব্র শব্দে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলাম। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখে অন্ধকার দেখছি। কিন্তু কানে বাজছে কলেজ কাঁপানো শব্দ। মিসাইল বিস্ফোরণেও মনে হয় এত শব্দ হয় না। হতভম্বের মতো বসে রইলাম কিছুক্ষণ। ব্যাপার কী? স্বপ্ন দেখছি না তো? তখনই চোখের সামনে তীব্র আলো এসে পড়ল। দেখি, মোবাইলের আলো। মোবাইলে অ্যালার্ম বাজছে। শব্দ এখান থেকেই হচ্ছে। কিছু কাজ আছে, যা মানুষ নিজেই করে এবং একসময় নিজেই সে কাজের ওপর বিরক্ত হয়। অ্যালার্ম দেওয়া সে রকম কাজের মধ্যে একটি। প্রতিবারই ঘুমানোর আগে মোবাইলে অ্যালার্ম দিই এবং ঘুম ভাঙার পর প্রতিবারই বিরক্তিভরে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিই। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। অ্যালার্ম বন্ধ করার পরও কান ভোঁ ভোঁ করছে। মারাত্মক রিংটোন সেট করেছি। অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে হার্টবিট লাফিয়ে ওঠে। প্রতিদিন এখন লাফানো হার্টবিট নিয়ে দিন শুরু করতে হয়। কোনো উপায় নেই। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ছয়টা বাজে। সাতটায় স্কুল শুরু হবে। এই কাকডাকা ভোরে কাক পর্যন্ত ঘুম থেকে ওঠে না, কিন্তু স্কুল ঠিকই শুরু হয়। কিছুক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার কিছু শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শর্তই হলো যা-ই হোক না কেন, কচ্ছপের মতো বিছানায় কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। অ্যালার্ম বাজবে অ্যালার্মের মতো। আর সেই অ্যালার্ম শুনেও না শোনার ভান করে বিছানায় চিতপটাং হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। তাই অ্যালার্মকে স্যালুট জানিয়ে আমি বিছানায় পাশ ফিরলাম। নিয়মে কিছুটা গন্ডগোল হয়েছে। তবে সেটা মাফ করে দেওয়া যায়। মানুষমাত্রই ভুল।
আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম মনে হয় আইনস্টাইনের সময়ের সূত্র মেনে চলে না। টাইম ডাইলেশনের পরিবর্তে সময় এগিয়ে-পিছিয়ে যায়। কখনো মনে হয় এক ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে, আবার কখনো মনে হয়, কই? মাত্র তো ১০ মিনিট পার হয়েছে। ঘুমাচ্ছি, হঠাৎ ঘুমের মধ্যে খটকা লাগল। আচ্ছা, আমার তো আজ স্কুল। আমি ঘুমাচ্ছি কেন? আসলে সমস্যাটা হলো স্কুলের। গ্রীষ্মের ছুটির কারণে স্কুল বন্ধ করে দিল। এই সুযোগে আর যা-ই হোক না কেন, আমার ঘুমটা ঠিকই বেড়ে গেল।একেবারে যাকে বলে বিছানায় শিকড় গজিয়ে উঠল আমার। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একেবারে দুপুরের খাবার খেতাম। তো স্কুলের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠলাম এবং বিছানা থেকে একটা ঝাঁপ দিলাম। ল্যান্ডিং ঠিক জায়গায় হলো না। সোজা পা গিয়ে পড়ল কয়েল রাখার পাত্রে। পায়ের অবস্থা আর না বলাই ভালো। কোনো রকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রেডি হতে শুরু করলাম। আমি আগেও লক্ষ করেছি যে একমাত্র তাড়াহুড়ার সময় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় না। যেমন এক জায়গায় যেতে হবে। খুব তাড়া। বের হওয়ার সময় হঠাৎ বাথরুমের চাপ লাগল। কিন্তু অবাক করা বিষয়, বাথরুম আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। (এ থেকে উপদেশ: কোথাও যাওয়ার অনেক আগে থেকেই বাথরুম করে নিন। না হলে পরে বাথরুমের চাপ নিয়েই বের হতে হবে)। রেডি হওয়া শেষ করেছি। রেডি হওয়াতে আমিই মনে হয় বিশ্ব রেকর্ড করেছি। কিন্তু আফসোস! কেউ এটা জানতে পারল না। রেডি শেষে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হব, এমন সময় মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
আমি মায়ের চেয়ে দ্বিগুণ অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন? স্কুলে যাচ্ছি।’
মা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যেন আমি মাকে বলেছি আমি মঙ্গল গ্রহে ঘুরতে যাচ্ছি।
‘ঘড়ি দেখেছিস?’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘তোর স্কুল শুরু হয়েছে কম করে হলেও দুই ঘণ্টা আগে। আর তুই এখন যাস মানে?’
আমি ঘড়ি দেখলাম এবং সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘড়ি তৈরি করা ঠিক হয়নি। মানবজাতির সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে ঘড়ি আবিষ্কার করে। ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা! আরেকবার ঘুমাব নাকি? ঘুমটা এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। পুরোপুরি মীমাংসা করার জন্য তাই আমি আবার বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। না, এবারের ল্যান্ডিংটা ঠিক জায়গায় হয়েছে। তবে একটু বেশি ওপর থেকেই মনে হয় পড়েছি। কারণ, সেটা জানানোর জন্য বিছানার এক পাশ থেকে ‘ফট’ করে শব্দ হলো। নিশ্চয়ই কোথাও ভেঙে গিয়েছে। দেখতে সাহস পাচ্ছি না। আজকে আমার খবর হয়ে যাবে। পত্রিকায় হেডলাইন ওঠার মতো খবর হবে। আমি আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম?
লেখক: শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণি, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর